"এক মিনট ভি লেট নহি হো সকতে ওয়রনা হমারি ক্লাস লগ জায়েগি" [এক মিনিটও দেরি করতে পারব না, নয়ত আমার বারোটা বেজে যাবে], লখনউ ক্যান্টনমেন্ট বিধানসভা কেন্দ্রের মহানগর পাবলিক ইন্টার-কলেজের পথে হন্তদন্ত পায়ে হাঁটা লাগিয়ে বলে উঠলেন রীতা বাজপাই। এই বুথেই নির্বাচনী দ্বায়িত্ব সামলাতে হবে তাঁকে – অবশ্য তাঁর নিজের ভোট এই কেন্দ্রে নয়।
বাড়ি থেকে এই কলেজের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। ভোর ৫.৩০ বাজে, তড়িঘড়ি হেঁটে চলা এই মানুষটার ঘাড়ে পেল্লায় সাইজের এক ব্যাগ, তাতে রয়েছে ডিজিটাল থার্মোমিটার, বোতলভরা স্যানিটাইজার, বেশ কয়েক জোড়া ডিস্পোসেবল্ দস্তানা এবং সুরক্ষা মুখোশ – কেন্দ্রে পৌঁছে বিতরণ করতে হবে এগুলো। ইউপির বিধানসভা নির্বাচনের চতুর্থ পর্যায়ে নয়খানি রাজ্য জুড়ে ৫৯টি কেন্দ্রের মধ্যে নাম রয়েছে লখনউয়ের, সুতরাং তিনি যে আজ সারাটাদিন নাকানিচোবানি খেতে চলেছেন, সেটা দিব্যি ঠাহর হচ্ছিল।
হ্যাঁ, ইউপির ভোটগ্রহণ শেষ, ফলাফলও বেরিয়ে গেছে, তবে বিশাল সংখ্যক মহিলা আজ এক অন্য পরীক্ষার ফলাফলের পথ চেয়ে আছেন – এ পরীক্ষা যে কতটা দুশ্চিন্তার সেটা হাড়ে হাড়ে জানেন তাঁরা, যমে-মানুষে টানাটানি হওয়াটাও আশ্চর্যের নয়। ভারতের সবচাইতে জনবহুল রাজ্যের বিধানসভা ভোট সামলাতে গিয়ে যে ঝুঁকিটা তাঁরা নিয়েছেন, সেটা যে কতটা মারাত্মক তা বোঝা যাবে ওই পরীক্ষায়।
লিখিত কোনও সরকারি আদেশ ছাড়াই ১৬৩,৪০৭ জন আশাকর্মী (অ্যাক্রেডিটেড সোশ্যাল হেল্থ অ্যাক্টিভিস্ট) বাধ্য হয়েছিলেন নির্বাচনী বুথে কাজ করতে। তবে আসল প্যাঁচটা কোথায় ছিল জানেন? বুথে বুথে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করার দ্বায়িত্ব যাঁদের ঘাড়ে, নিজেদের সুরক্ষিত রাখার কোনও সাজ-সরঞ্জামই জোটেনি তাঁদের। কোন রাজ্যে জানেন? যেখানে ২০২১ সালের এপ্রিল-মে মাসে প্রায় ২,০০০ জন ইস্কুল শিক্ষকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল কোভিড-১৯। সে বছর এপ্রিলে যখন অতিমারির কবলে ছারখার হয়ে যাচ্ছে গোটা দেশ, তখন ইচ্ছার বিরুদ্ধেই একরকম বাধ্য হয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দায়-দায়িত্ব তাঁদের সামলাতে হয়েছিল।
ক্ষতিপূরণের জন্য লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হয় মৃত শিক্ষকদের শোকাহত পরিবারগুলি, সে যুদ্ধে জয়ী হন অনেকেই, ভালোবাসার মানুষ খুইয়ে হাতে আসে ৩০ লাখ টাকা। তারই বোধহয় মাশুল গুনছেন আশাকর্মীরা। হাতে নেই কোনও লিখিত আদেশ, ফলত অনুরূপ যুদ্ধে নামা অসম্ভবের সামিল, উপরন্তু এভাবে তাঁদের ভোট দেওয়া থেকেও বিরত রাখা যাবে।
কোন পরীক্ষার ফলাফল এঁদের তাড়া করে ফিরছে জানেন? কোভিড-১৯। নির্বাচনের প্রথম পর্যায়গুলিতে সহকর্মীদের কতটা ক্ষতি করল কোভিড, সে ব্যাপারে ধন্দ আজও কাটেনি তাঁদের।
*****
কাকে কোন নির্বাচনী বুথে যেতে হবে, সেখানকার দায়-দায়িত্বের রকমসকমটাই বা কেমন, এসব কথা লখনউয়ের এক হাজার তিনশোরও অধিক আশাকর্মী মৌখিক রূপে জানতে পেরেছিলেন নিজের নিজের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র (পিএইচসি) থেকে। অথচ এ হেন নির্বাচনী কাজে তাঁদের বহাল করেছে খোদ রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর।
"চন্দন নগর পিএইচসি থেকে ডাক পড়ে আমাদের, গিয়ে শুনি মুখে মুখে হুকুম দিচ্ছে ভোটের দিন স্যানিটাইজ করার। জীবানুনাশক স্প্রে ছিটাতে হবে, [ভোটারদের] তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হবে, আর মুখোশ বিতরণ করতে হবে," জানালেন রীতা।
১০ই ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ই মার্চ ২০২২ – এই সময়কালের মধ্যে চলে বিধানসভা নির্বাচন, ওই সময় গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে উপরোক্ত দায়িত্বগুলি চাপিয়ে দেওয়া হয় আশাকর্মীদের উপর।
লখনউয়ের সর্বাঙ্গীন বিকাশ ইন্টার কলেজ নির্বাচনী বুথে পাঠানো হয়েছিল পূজা সাহুকে (৩৬), তাঁর থেকে জানতে পারলাম: "[পোলিং] স্টেশনগুলোয় আশাকর্মীদের নাম লেখা একটা করে কাগজ ছিল বটে, তবে কোথাও কোনও সইয়ের নামগন্ধ দেখিনি।"
সোজা ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন শান্তি দেবী (৪১): "আপনিই বলুন তো, ভোটকেন্দ্রে যদি হুড়োচাপা হয় কিংবা আমাদের সঙ্গে কেউ উল্টোপাল্টা কিছু করে, তার দায় কে নেবে?" ২৭শে ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী কাজে চিত্রকূট শহরে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। "লিখিত কাগজ ছাড়া এটা কীভাবে প্রমাণ করব যে আমাদের কাজে পাঠানো হয়েছিল? প্রতিবাদ করার মতো সাহস নেই আশাকর্মীদের। বেশি কিছু বলতে গেলে আমিই বিপদে পড়ে যাব, যুগটাই এমন। আরে বাবা, আমাকে যে একা একাই যাতায়াত করতে হয়।"
তবে চিত্রকূটে গিয়ে অন্যান্য কর্মীদের হাজিরার খাতায় সই করতে দেখে শান্তি দেবী মুখ না খুলে থাকতে পারেননি। প্রিসাইডিং আধিকারিককে জিজ্ঞেস করে বসলেন আশাকর্মীদেরকেও সই করতে হবে কিনা। "সবাই হাসাহাসি করল আমাদের উপর," জানালেন তিনি, "বলল যে আমাদের তো আর নির্বাচন কমিশন থেকে বহাল করেনি, ফলত আমরা যে এসেছি সেটার প্রমাণস্বরূপ সইসাবুদের কোনও প্রশ্নই উঠছে না।" চিত্রকূট জেলায় শান্তির মতো প্রায় ৮০০ জন আশাকর্মী এই একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন।
চিত্রকূটে পৌঁছে ডিউটির চিঠি চাইতে গিয়ে পিএইচপি কর্মীর কাছে রীতিমত ধমক খেয়েছিলেন আশাকর্মী কলাবন্তী (৩৯)। "সরকারি প্রাথমিক ইস্কুলের শিক্ষক আমার বর, হপ্তাখানেক আগে ওর হাতে ডিউটির চিঠি দেখেছিলাম," বলে উঠলেন তিনি, "আমি ভাবলাম যে আমাকেও তো একই কাজে পাঠানো হচ্ছে, তাই চিঠি তো আমারও পাওয়ার কথা। কিন্তু পিএইচসি থেকে স্যানিটাইজ করার সামগ্রী হাতে পাওয়ার পর যখন লিখিত আদেশের কথা বললাম, প্রভারি লখন গর্গ [প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রধান] আর বিসিপিএম [ব্লক কৌম নির্বাহী পরিচালক] রোহিত বলল যে সে গুড়ে বালি, কোনও চিঠি-ফিঠি পাবে না আশাকর্মীরা, মুখে মুখে যে হুকুমটা দেওয়া হচ্ছে, সেটাই নাকি যথেষ্ট।"
নির্বাচনের দিন টানা ১২ ঘণ্টা ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পড়ে থাকতে হবে কলাবন্তীকে। তবে সেখানেই শেষ নয়, আরও কাজ আছে। তিনি যে পিএইচসির সঙ্গে যুক্ত, সেখানকার এএনএম ফোন করেন তাঁকে। "বাড়ি ফেরার পর এএনএম ফোন করে চূড়ান্ত শর্ত দিল একটা। বলল যে তার পরদিন রাতের মধ্যে গোটা এক গ্রামের সমীক্ষা শেষ করে রিপোর্ট জমা দিতে হবে।"
নির্বাচনী কেন্দ্রে বেকার খেটে মরেছেন কলাবন্তী, না জুটেছে এ কাজের স্বীকৃতি, না পেয়েছেন মাইনে। কেন্দ্রে নিযুক্ত অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে সমান তালে কাজ করেছেন আশাকর্মীরা, অথচ একটি পয়সাও পাননি তাঁরা। ইউপির আশা সংগঠনের সভাপতি বীণা গুপ্ত জানালেন: "তাদের বারবার বলা সত্ত্বেও কোনও চিঠিপত্র দেয়নি আমাদের। আসলে চিঠি দিলে পারিশ্রমিকটাও দিতে হত যে। নির্বাচনী কাজে বাকি সমস্ত কর্মীরা খানিক খানিক টাকা পেয়েছিলেন, পেল না শুধু আশা আর অঙ্গনওয়াড়ির মহিলারা। নিজের টাকায় যাতায়াত করে মরল সবাই, এককথায় বলতে গেলে ওরা সুযোগ নিয়েছে আমাদের।"
তবে এমনটা যে প্রথমবার হল, তা কিন্তু মোটেই নয়।
*****
নামমাত্র মজুরিতে খেটে মরা আশাকর্মীরা ২০০৫ থেকে জনস্বাস্থ্য পরিষেবার প্রথম সারিতে লড়ছেন , ওঁদের ছাড়া জাতীয় স্বাস্থ্য অভিযান কল্পনাই করা যায় না। অথচ সরকারের তরফ থেকে জুটেছে শুধুই অবহেলা, ঔদাসীন্য, এমনকি ঘোর অবিচারও।
করোনাভাইরাস জনিত অতিমারিতে গোটা দেশ ছারখার হয়ে যাচ্ছে তখন, সেই সময় বাড়ি-বাড়ি ঘুরে পরীক্ষা করা, পরিযায়ী শ্রমিকদের চোখে চোখে রাখা, অতিমারির বিধিনিষেধ পালন করা হচ্ছে কিনা সেটার খেয়াল রাখা, রোগীদের হাতের মুঠোয় কোভিড-১৯ অতিমারির চিকিৎসা তথা টিকা এনে দেওয়া এবং তথ্য সংগ্রহ করে পিএইচসিতে জমা দেওয়ার মতো অতিরিক্ত অথচ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি সামলেছিলেন আশাকর্মীরাই। ছেঁড়া-ফাটা সুরক্ষা সরঞ্জাম এবং দেরি করে পাওয়া বেতন সয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাম ঝরিয়েছেন এই মানুষগুলি। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দৈনিক ৮-১৪ ঘ ণ্টা বাইরে বাইরে কাজ করা, প্রতিদিন গড় হিসেবে ২৫-৫০টি বাড়ির চৌকাঠ মাড়ানো, এমনকি সপ্তাহান্তেও – এসব কথা না হয় না-ই বা তুললাম।
"গতবছরের [২০২০] তুলনায় কাজের চাপ অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু কাজ বেশি করলে বেতনটাও তো বেশি হওয়া উচিত, তাই না?" সাফ জিজ্ঞেস করলেন চিত্রকূটের আশাকর্মী রত্না (৩২)। মাস গেলে সাম্মানিক দক্ষিণা স্বরূপ মোট ২,২০০ টাকা হাতে পান ইউপির আশাকর্মীরা। এছাড়াও তাঁদের কাজকর্মের নিরিখে বিভিন্ন স্বাস্থ্য যোজনার আওতায় উৎসাহ ভাতা জোটে খানিকটা করে। মেরেকেটে ওই ৫,৩০০ টাকার মতো হয় সব মিলিয়ে।
মার্চ ২০২০ সালের শেষের দিকে কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রস্তুতিকরণ ও আপৎকালীন প্রতিক্রিয়া প্যাকেজের আওতায় 'কোভিড ভাতা' হিসেবে প্রতিমাসে আশাকর্মীদের ১,০০০ টাকা করে দেওয়া শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রথমে বলা হয়েছিল যে অতিমারি-সংক্রান্ত কাজের জন্য এই টাকাটা ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেওয়া হবে, পরে অবশ্য উক্ত আপৎকালীন প্রতিক্রিয়া প্যাকেজটির সঙ্গে কোভিড ভাতা প্রদানের মেয়াদটিও মার্চ ২০২১ অবধি বাড়ানো হয়।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার উন্নয়ন মন্ত্রকের নির্দেশ অনুযায়ী রাজ্যগুলিকে গত আর্থিক বছরের খরচ না-হওয়া তহবিল থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর অবধি কোভিড ভাতার টাকাটা ব্যয় করার কথা বলা হয়। অথচ দ্বিতীয় দফা (১লা জুলাই ২০২১ থেকে ৩১শে মার্চ ২০২২) কোভিড ইর্মাজেন্সি প্যাকেজ জারি করার সময় আশাকর্মী সহ সামনের সারির যোদ্ধাদের দেয় উৎসাহ ভাতার কথা বেমালুম ভুলে যায় আমাদের সরকার বাহাদুর।
আশাকর্মীদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ও ভাতা বিষয়ে এপ্রিল ২০২০ সালে ১৬টি রাজ্য জুড়ে একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় যে ১১টি রাজ্যে উক্ত কোভিড উৎসাহ ভাতা টাকা দেওয়া হচ্ছে না। ৫২ জন আশাকর্মী তথা আশা সংগঠনের নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া সেই রিপোর্টিতে বলা হয়েছে: "লকডাউনের জন্য টিকাকরণের মতো নিত্যনৈমিত্তিক যে কাজগুলো মুলতুবি ছিল, একটা রাজ্যেও সে বাবদ প্রাপ্য পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে না।"
২০২১ সালের জুন মাসের পর থেকে 'কোভিড ভাতার' টিকিটিও দেখতে পাননি রত্না, অথচ যাবতীয় অতিরিক্ত কাজের সবটাই করেছেন তিনি। "গতবছর [২০২১] এপ্রিল আর মে মাসে ২,০০০ টাকা পেয়েছি মোটে। মাস গেলে হাজার টাকা পাওয়ার কথা, এবার তাহলে নিজেই অঙ্ক কষে দেখুন মোট কতটা টাকা পাওনা বকেয়া আছে আমার," বললেন তিনি। ২০২১ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর অবধি ন্যূনতম ৪,০০০ টাকা বাকি আছে তাঁর। অথচ এএনএমকে দিয়ে পারিশ্রমিকের প্রত্যেকটি রশিদ সই করিয়েছেন তিনি – যেটা কিনা তাঁর বরাদ্দ কাজের মধ্যেই পড়ে।
"এএনএমকে দিয়ে মজুরির রশিদগুলো সই করানো যে কতটা ঝকমারির কাজ তা বললে বিশ্বাস করবেন না, বরাদ্দ কাজগুলো যে সবই করে ফেলেছি এটা তিনি মানতেই চান না," বলেছিলেন রত্না, "কোনও জরুরি কাজকম্ম বা শরীর-টরির খারাপ হলে একটা দিনও যদি ছুটি নিই, ওমনি 'তুমি তো এ মাসে কাজই করোনি ঠিকঠাক' বলে সে মাসের ১,০০০ টাকার উৎসাহ ভাতাটা কেটে নেবে ঘ্যাচাং করে, অথচ মাসের বাকি ২৯টা দিন সামনের সারিতে খেটে মরেছে আশাকর্মী।"
যে দেশে শ্রমের বাজারে মজুরি চুরির রমরমা, সে দেশে গ্রামীণ তথা শহুরে অঞ্চলে স্বীকৃতির জন্য দিনান্ত লড়ছেন ১০ লাখেরও বেশি আশাকর্মী। সিটিজেন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিসের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে: "ন্যূনতম মজুরি আইনের আওতায় তাঁরা [আশাকর্মীরা] পড়েন না, তাই আর পাঁচজন সরকারি কর্মচারীর মতো মাতৃত্বকালীন-সুবিধা তথা অন্যান্য যোজনার ফল থেকে তাঁরা বঞ্চিত থেকে যান।"
তামাশাটা কোথায় জানেন? কোভিড-১৯ চলাকালীন কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের মাঝখানে অতিমারি নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার শৃঙ্খলায় সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল যাঁদের, সেই আশাকর্মীরাই সবচাইতে বেশি কষ্ট পেয়েছেন চিকিৎসা তথা ডাক্তারবদ্যির অভাবে। অতিমারির বাজারে ইউপিতে কাজ করতে গিয়ে অকালে প্রাণ গেছে অসংখ্য আশাকর্মীর।
"গত [২০২১] এপ্রিলে বাড়ি থেকে ফোন এল, জানতে পারলাম যে মা অসুস্থ," ২০২১ সালের মে মাসে তাঁর মা শান্তি দেবী মারা যাওয়ার দিন কয়েক আগের কথা মনে করছিলেন বছর ২৩-এর সুরজ গঙ্গোয়ার, "শুনেই দিল্লি থেকে দৌড়ে গেলাম বারেলি। ততক্ষণে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।" পেশায় ইঞ্জিনিয়ার সুরজ কাজ করেন দিল্লির একটি বেসরকারি সংস্থায়, তিন সদস্যের পরিবারটি আজ তাঁর একার রোজগারেই চলছে।
"মা যে কোভিড পজিটিভ, সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি তখন। ২৯শে এপ্রিল আরটি-পিসিআর করে জানা গেল সেটা। পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাওয়া মাত্র হাসপাতাল থেকে বলে দেয় যে মাকে ওরা আর রাখবে না। বাধ্য হলাম বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে। ১৪ই মে যায় যায় অবস্থা মায়ের, অনেক চেষ্টা করেছিলাম অন্য কোনও হাসপাতালে নিয়ে যেতে, কিন্তু শেষরক্ষা হল না আর, পথেই মারা গেল মানুষটা," জানালেন তিনি। দেশের-দশের জন্য প্রাণপাত করে করোনা বাধিয়েও যে কর্মীরা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুবিধা ভোগ করতে না পেরে বেঘোরে মারা গেছেন, সেই তালিকায় জ্বলজ্বল আছে শান্তি দেবীর নাম।
২৩শে জুলাই, ২০২১ তারিখে লোকসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ভারতী প্রবীণ পাওয়ার জানান যে এপ্রিল ২০২১ অবধি মোট ১০৯ জন আশাকর্মী মারা গেছেন কোভিডে – ওদিকে সরকারি খতিয়ানে উত্তরপ্রদেশের মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য। কোভিড-১৯ অতিমারির ফলে বাস্তবে যে কতজন আশাকর্মীর প্রাণ গেছে সে ব্যাপারে ভরসাযোগ্য কোনও তথ্য নেই সরকারের কাছে। প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনার খাতে কোভিডে মারা যাওয়া সামনের সারির কর্মীদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ৩০শে মার্চ ২০২০ থেকে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছিল বটে, তবে হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার বাদে এই প্রকল্পের টাকা কেউই পায়নি।
"একটা দিনের জন্যও কাজ ফাঁকি দিত না মা, আশাকর্মী হিসেবে নিজের দায়-দায়িত্ব কাঁটায় কাঁটায় পালন করত," জোরগলায় বলেছিলেন সুরজ, "অতিমারি চলাকালীন এক পায়ে খাড়া হয়ে থাকত। মানুষটা এরকম বেঘোরে মারা গেল, অথচ স্বাস্থ্য দফতর পাত্তাই দিতে চাইছে না। মুখের উপর বলে দিচ্ছে যে ক্ষতিপূরণ দেবে না।"
বারেলির নবাবগঞ্জে যে সামাজিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি রয়েছে, সেখানকার প্রধান চিকিৎসা আধিকারিক (সিএমও) সহ অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে বৃথাই দেখা করার চেষ্টা করেছেন সুরজ ও তাঁর বাবা। মায়ের আরটি-পিসিআর রিপোর্ট এবং মৃত্যুর শংসাপত্র দেখাতে দেখাতে তিনি বলে উঠলেন: "সিএমও বললেন যে ক্ষতিপূরণ পেতে হলে হাসপাতাল থেকে দেওয়া এমন একটা ডেথ সার্টিফিকেট লাগবে যেখানে মৃত্যুর কারণ হিসেবে কোভিড-১৯এর কথা উল্লেখ করা রয়েছে। এমন সার্টিফিকেট কোথা থেকে পাই বলুন তো? মাকে তো কেউ ভর্তিই করল না। টাকাটা যাদের সত্যিকারের দরকার তারাই যদি না পায়, তাহলে এমন একটা ভুয়ো যোজনা ধুয়ে কি জল খাব?"
*****
গতবছরের সেই বীভৎস স্মৃতিগুলো এখনও ঝাপসা হয়নি, অথচ এরই মধ্যে বিধানসভা নির্বাচনের দোহাই দিয়ে ১৬০,০০০ জন আশাকর্মীর গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে বিনে পয়সার কাজের পরোয়ানা, সঙ্গে ১৬ আনা ঝক্কি আর প্রাণের ঝুঁকি। এটাকে তুখোড় একটা রাজনৈতিক চাল বই আর কিছু ভাবতে নারাজ সংগঠনের সভাপতি বীণা গুপ্ত: "আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন তো সোজা কথা বলব যে এটা পাতি একটা নোংরা চাল। না মেনেছে আশাকর্মীদের একটাও দাবি-দাওয়া, না দিয়েছে আমাদের নায্য পারিশ্রমিক। এইসব কারণে পাছে আমরা ওদের বিরুদ্ধে ভোট দিই, এই ভয়েই এমন একটা কাজে জোর করে পাঠাল যে টানা ১২ ঘণ্টা আটকে গেলাম, ভোট দিতে তো পারলামই না, উপরন্তু একটা পয়সাও পারিশ্রমিক মিলল না।"
অথচ রীতার ভোট দেওয়ার ইচ্ছে ছিল পুরোদমে। পারিকে জানিয়েছিলেন: "বিকেল চারটে নাগাদ নিজের কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার তাল করছি। তবে ওটুকু সময় আমার হয়ে অন্য কোনও আশাকর্মীকে হাজিরা দিতে হবে, নয়তো যেতে পারব না। আমার কেন্দ্রটা এখান থেকে পাক্কা চার কিলোমিটার দূরে।" এই যে খানিকক্ষণের জন্য কাজ সামাল দিতে লোক খুঁজছেন, আর পাঁচজন আশাকর্মীর মতো এই দ্বায়িত্বটা তাঁর নিজের উপরেই বর্তায়, স্বাস্থ্য দফতর কুটোটিও নাড়তে রাজি নয়।
সাত-সকালে নির্বাচনী বুথে গিয়ে হাজিরা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা, না জলখাবার না মধ্যাহ্নভোজ, কিচ্ছুটির ব্যবস্থা ছিল না তাঁদের জন্য। "স্বচক্ষে দেখলাম বাদবাকি সব্বার জন্য মোড়কে ভরা খাবার এলো, ওনারা সেসব তারিয়ে তারিয়ে খেলেনও আমার সামনে। আর আমার জন্য পেটে কিল মেরে পড়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই ছিল না," পারিকে জানিয়েছিলেন লখনউয়ের আলমবাগ মহল্লার এক আশাকর্মী, পূজা।
৩টে বাজতে না বাজতেই প্যাকেট ভরা মধ্যাহ্নভোজ চলে এসেছিল অন্যান্য কর্মীদের জন্য, ওদিকে আশাকর্মীদের জন্য না ছিল এক দানা খাবার, না ছিল বাড়ি গিয়ে খাবার সময়। "এই তো, নিজেই দেখুন না কেমন করে আমরা চাট্টি খেতে যাব বলে ছুটির জন্য জোরাজুরি করছিলাম। খানিক বিরতি তো দিতেই পারত চাইলে, টুক করে বাড়ি গিয়ে নাকে-মুখে দুটো দানা গুঁজেই চলে আসতাম আবার। ঘরদোর খুব একটা দূরেও তো নয়। নিয়ম মাফিক বাড়ির কাছেই কাজ পড়ে আশাকর্মীদের," আলমবাগের আশাকর্মীদের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মেসেজগুলি দেখাতে দেখাতে বলছিলেন পূজা।
পেশায় সাধারণ আয়া-ধাত্রী (জিএনএম) অন্নু চৌধুরীও বহাল ছিলেন পূজার কেন্দ্রে। পুলিশ সহ অন্যান্য সরকারি কর্মচারীরা দিব্যি খেতে পারছে অথচ তাঁদের ভুখা পেটে রাখা হচ্ছে, এটা দেখে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল তাঁর। "আমাদের সঙ্গে এরকম জুলুম করার কোনও মানে হয়?" ঝাঁঝিয়ে উঠেছিলেন তিনি, "আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করছিল যেন আমরা ফ্যালনা! সবাই তো একই কাজে বহাল রয়েছি, তাহলে সুযোগ সুবিধাগুলো সব্বার জন্য এক নয় কেন?"
নির্বাচনের দায়িত্ব ছাড়াও আরও একটি কাজ চাপিয়ে দেওয়া হয় চিত্রকূটের আশাকর্মীদের ঘাড়ে: আবর্জনা পরিষ্কার করা। এই জেলার বহু আশাকর্মীর মতো শিবানী কুশওয়াহারও ডাক পড়ে পিএইচসি-তে, সেখানে যেতেই স্যানিটাইজিং সরঞ্জাম সমেত ময়লা ফেলার একটি ব্যাগ ধরিয়ে দেওয়া হয়। "খানকতক পিপিই পোশাকও দিয়েছিল," জানালেন তিনি, "ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে এসে কোনও ভোটারের কোভিড ধরা পড়লে এগুলো তাদের দেওয়ার কথা। উপরন্তু সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা অবধি নির্বাচনী বুথে ঠায় বসে থাকতে বলা হল আমাদের। ভোট-ফোট শেষ হলে সেই ব্যাগটায় ব্যবহৃত আর অব্যবহৃত সবকটা পিপিই কিট ভরে খুটাহা উপকেন্দ্রে পৌঁছে দিতে হবে।" অর্থাৎ পিপিই-ভরা বস্তা কাঁধে তুলে প্রধান সড়ক থেকে নেমে এক কিলোমিটার পথ ঠেঙিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা।
রাগে কুশওয়াহার গলাটা কেঁপে উঠছিল ক্ষণে ক্ষণে। "হ্যাঁ, স্যানিটাইজেশন হোক বা সাফসাফাই, হাসিমুখে সবই করব আমরা। কিন্তু যথাযথ একখান চিঠি তো অন্তত দিতে পারত, বাকি সমস্ত কর্মীরা তো পেয়েছে। ভোটের কাজ সামলে সরকারি কর্মচারীরা তো দিব্যি পারিশ্রমিক পাচ্ছে, আমরাই বা পাব না কেন? মাগনার চাকর নাকি আমরা?"
ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশান থেকে প্রাপ্ত একটি স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা অনুদানের সাহায্যে জিজ্ঞাসা মিশ্র জনস্বাস্থ্য এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে লেখালিখি করেন। এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুর ওপর ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন কোনওরকম সম্পাদকীয় হস্তক্ষেপ করেনি।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)