"জন্ম থেকেই তো এই কাজ করছি, সারাটা জীবন মজুরি করেই কেটে গেল," কুয়াশায় ঢাকা অগস্টের এক সকালে বাড়ি থেকে মাঠের দিকে যেতে যেতে বললেন রত্নাভ্যা এস. হরিজন। দিনমজুরির কাজে রোজই ওই খামারটিতে কাজ করতে যান তিনি। কঙ্কালসার দেহ, ঈষৎ কুঁজো, অল্পবয়স থেকেই খুঁড়িয়ে হাটেন, তবে তা টের পাওয়ার জো নেই সাততাড়াতাড়ি পা চালান বলে।
কাজের জন্য আলাদা একপ্রস্থ কাপড় এনেছিলেন, খামারে পৌঁছতে না পৌঁছতেই বার করে ফেললেন সেটা। প্রথমেই একটা রং-চটা নীল জামায় ঢেকে ফেললেন শাড়িখানা, তারপর হলদেটে একখানা ছাপা-নাইটি আচ্ছা করে বেঁধে ফেললেন কোমরে, যাতে পরাগের ছোপ না লেগে যায় আর। এর উপর ছেঁড়াখোঁড়া নীল শিফনের একটা ছোট্ট বোঁচকা বেঁধে নিলেন, ঢ্যাঁড়শ গাছের গান্ডু হুভু (পুরুষ ফুল) ভরে রাখেন তিনি এই পুঁটুলিতে। বিবর্ণ একটা সাদা তোয়ালে মাথায় ফেট্টির মতো করে বেঁধে কাজ শুরু করলেন রত্নাভ্যা (৪৫), বাঁহাতে ধরা ছিল কয়েক গোছা সুতো।
দক্ষ হাতে একটি ফুলের পাপড়িগুলো মেলে ধরলেন তিনি, যাতে পুংকেশরের পরাগরেণু আলতো করে গর্ভকেশরে মাখিয়ে দেওয়া যায়। পরাগমিলনের চিহ্নস্বরূপ ডাঁটিতে একটি সুতো বেঁধে দিলেন তারপর। সারি সারি ঢ্যাঁড়শ গাছ, উবু হয়ে ঝুঁকে এক এক করে প্রত্যেকটা ফুলে পরাগদান করে ফেললেন অদ্ভুত এক ছন্দে। এই যে হাতে করে পরাগমিলন ঘটানো – মেয়েবেলা থেকেই এ পেশায় সিদ্ধহস্ত তিনি।
মাদিগা সম্প্রদায়ের মানুষ রত্নাভ্যা, এটি কর্ণাটকের একটি দলিত জাতি বিশেষ। হাভেরি জেলার রানিবেন্নুর তালুকে রয়েছে কোনানাতালি গ্রাম, সেখানকার মাদিগারা কেরিতে (মাদিগা পাড়া) থাকেন তিনি।
ভোর ৪টে বাজতে না বাজতেই শুরু হয়ে যায় তাঁর দিন। গেরস্থালির সব কাজ সামলে, পরিবারের হাতে চা-জলখাবার তুলে দিয়ে, দুপুরের রান্নাবান্না সব শেষ করে, নাকেমুখে কোনওমতে চাট্টি গুঁজে ৯টা বাজার আগেই দৌড় লাগান খেতের পানে।
তিন একরের এই জমিটার প্রায় আর্ধেক জুড়ে রয়েছে দুশোটার মতন ঢ্যাঁড়শ গাছ, দিনের প্রথমার্ধ কেটে যায় পরাগমিলন করতে করতে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার জন্য মোটে আধ-ঘণ্টার ছুটি মেলে, তারপর আবার লেগে পড়েন কাজে। পরদিন যে ফুলগুলিতে পরাগদান করবেন, সযত্নে এক এক করে তাদের পাপড়িগুলি মেলে দেন তিনি। এসবের জন্য দৈনিক ২০০ টাকা খেতমজুরি বেঁধে দিয়েছেন জমির মালিক।
হাতে করে পরাগদানের কায়দা অল্পবয়েসেই শিখে নিয়েছিলেন তিনি। রত্নাভ্যা বলছিলেন, "আমাদের কোনও জমিজমা নেই নিজেদের, তাই পরের জমিতেই খেটে মরি, ইস্কুলের মুখ দেখিনি কখনো। কচি বয়েস থেকেই কাজে নেমে পড়েছি। দেখতেই তো পারছেন, কতটা গরিব আমরা, এছাড়া আর উপায়ই বা কী আছে বলুন? ছোটবেলায় আগাছা উপড়াতাম আর টমেটোর ফুল ক্রস করাতাম।" এই যে তিনি হাতে করে পরাগমিলন করেন, ক্রস বা ক্রসিং বলতে সেই কাজটিকেই বোঝাচ্ছিলেন তিনি।
রানিবেন্নুর তালুকের তিরুমালাদেবারাকোপ্পা গ্রামে একটি ভূমিহীন কৃষক-পরিবারে জন্ম হয় তাঁর। একে তো হাভেরির মজদুরদের মধ্যে ৪২.৬ শতাংশ খেতমজুর, তার উপর এখানকার গ্রামীণ অঞ্চলের শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই (২০১১ আলের জনগণনা অনুযায়ী) মহিলা। সুতরাং রত্নাভ্যা যে এমন অল্পবয়স থেকেই মাঠঘাটে ঘাম ঝরাচ্ছেন, এটা ব্যতিক্রম নয় মোটেও।
আট ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়ো। বাকি সাতজনের মধ্যে ভাইয়ের চেয়ে বোনের সংখ্যাই ছিল বেশি। কোনানাতালির সান্নাচৌডাপ্পা এম. হরিজনের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। সান্নাচৌডাপ্পাও পেশায় খেতমজুর। "বাপ ছিল মদ্যপ-মাতাল লোক, তাই কচি বয়েসেই বিয়ে দিয়ে দেয় আমার, মাসিক শুরু হওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই। তবে তখন আমার বয়স ঠিক কত ছিল, সেটা বলতে পারব না," জানালেন তিনি।
তিরুমালাদেবারাকোপ্পায় থাকাকালীন পরাগমিলনের কাজ করে রত্নাভ্যা দৈনিক ৭০ টাকা করে পেতেন, বছর ১৫ আগে কোনানাতালিতে আসার পর সেটা বেড়ে ১০০ টাকায় এসে দাঁড়ায়। তাঁর কথায়: "বছর গেলে ওরা [জমির মালিকেরা] বেতন দশটাকা করে বাড়ায়, এখন তাই ২০০ টাকা পাই।"
কোনানাতালিতে হাইব্রিড প্রজাতির ঢ্যাঁড়শ, টমেটো, ঝিঙে আর শশার চাষ হয়, তাই হাতে করে পরাগমিলন করার কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। এই কাজ সাধারণত বর্ষা এবং শীতকালেই করা হয়ে থাকে। এই গ্রামটিতে সব মিলিয়ে ৫৬৮ একর শালিজমি আছে (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী)। এখানে উৎপাদিত দ্রব্যের মধ্যে বিভিন্ন সবজির বীজ তথা কাপাস তুলো উল্লেখযোগ্য। একদিকে যেমন ভারতবর্ষে সবজির বীজ উৎপাদনে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে কর্ণাটক আর মহারাষ্ট্র, তেমনই এতে বেসরকারি পুঁজির একটি বিশাল হাতও রয়েছে।
পরাগমিলন মানেই ফুলের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে কারবার, কাজটা যতটা কষ্টের, ঠিক ততটাই ক্ষিপ্র হতে হয়। শ্যেনদৃষ্টি, চটপটে হাত, অপরিসীম ধৈর্য এবং অপার মনঃসংযোগ, এগুলো ছাড়া এই কাজ অসম্ভব। সাধারণত এই কাজে পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের চাহিদাই বেশি – এমনকি চাষের মরসুমে অটোরিক্সা ভাড়া করে কাছেপিঠের গ্রাম থেকে মহিলা মজুরদের নিয়ে আসা হয় কোনানাতালিতে।
বছরের যেদিনই যান না কেন, দেখবেন যে পরমেশাপ্পা পাক্কিরাপ্পা জাদরের জমিতে কাজ করছেন রত্নাভ্যা। আর যাবেনই বা কোথায়, মালিকের কাছে ১.৫ লাখ টাকা ধার রয়েছে যে তাঁর। পরমেশাপ্পা অম্বিগা জাতির মানুষ (অন্যান্য অনগ্রসর জাতির তালিকাভুক্ত)। তবে রত্নাভ্যা জানালেন যে এই টাকাটা তিনি মজুরি থেকে অগ্রিম বাবদ নিয়েছেন, তাছাড়া কর্জ বাবদ সুদ দিতে হয় না তাঁকে।
"হাতে আলাদা করে একটা টাকাও পাই না। (কতদিন কাজ করলাম, সেটা) খাতায় লিখে রাখে মালিক। ধার করা টাকা থেকে এই মজুরির অংশটা কাটা যায়," বলছিলেন তিনি, "এভাবেই খেতমজুরি করে শোধ করি, আর দরকার পড়লে খানিকটা করে আবারও ধার নিই। এই দেওয়া আর নেওয়ার চক্করেই ঘুরপাক খাচ্ছি সারাটা জীবন।"
বর্ষাকাল, অর্থাৎ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝে ঢ্যাঁড়শ আর শশাগাছে পরাগমিলন ঘটাতে হয়। এই সময়টা রত্নাভ্যার পক্ষে সবচেয়ে কষ্টকর। শশাগাছে ফুল এলে একটানা ছয় ঘণ্টা কাজ করতে হয়, মাঝে এক মিনিটের জন্যও ছুটি মেলে না। আর ঢ্যাঁড়শের কুঁড়ি তো কাঁটায় ভরা, ফালাফালা হয়ে যায় আঙুলগুলো।
অগস্টে যখন দেখা করেছিলাম তাঁর সঙ্গে, ছেলের একখানা নখ কেটে নিজের বুড়োআঙুলে সেঁটে নিয়েছিলেন রত্নাভ্যা – ঢ্যাঁড়শ ফুলের উপরের খোসাটা ছাড়াতে গেলে এমনটা না করে উপায় নেই। ছেলে লোকেশ (১৮) অসুস্থ, তাই পরমেশাপ্পার খামার থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে অন্য এক জায়গায় কাজ করতে এসেছিলেন তিনি। কলেজে ভর্তি হবে ছেলে, তাই ৩,০০০ টাকা ধার নিয়েছে মা, সেটা মেটাতেই এই খামারটিতে কাজ শুরু করেছিলেন লোকেশ।
জনা ছয় প্রাণী মিলে সুখদুঃখের সংসার, টাকাপয়সার পুরো দ্বায়িত্বটাই রত্নাভ্যার একার ঘাড়ে। বর, শাশুড়ি, কলেজ-পড়ুয়া তিন সন্তান আর নিজের খাইখরচা ছাড়াও রয়েছে সান্নাচৌডাপ্পার চিকিৎসার গুরুভার, মানুষটা যে বড্ডো অসুস্থ।
স্বামীর চিকিৎসা বাবদ মালিকের থেকে কেবল অগস্টেই ২২ হাজার টাকা চেয়েচিন্তে নিয়েছিলেন তিনি। জন্ডিসের কারণে রক্তে প্লেটলেটের মাত্রা হুহু করে পড়ে যায় তাঁর, রক্ত দিতেও হয়েছিল খানিকটা। আর এসবের জন্য তাঁদের হাতের কাছে একটাই জায়গা রয়েছে, গ্রাম থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে মাঙ্গালোরের সরকারি হাসপাতাল।
তবে প্রয়োজন পড়লেই জমির মালিক টাকাপয়সা দেন বটে। "খাবারদাবার, হাসপাতালের খরচা, মাসকাবারির হাজারো জিনিসপত্র, এসবের জন্যই হাত পাতি। আমাদের দুঃখকষ্ট খানিকটা হলেও বোঝেন মালিক, তাই তো অতগুলো করে টাকা ধার দেন। ওখানেই যাই শুধু [কাজের জন্য], অন্য কোত্থাও আর না," বললেন রত্নাভ্যা, "পুরো টাকাটা এখনও অবধি মেটাতে পারিনি। একলা হাতে কী করেই বা অতটা সামলাই বলুন তো?"
আর্থিক অসহায়তার এই যে অনন্ত মরণফাঁদ, এর চাপে মালিক ডাক পাঠানো মাত্র কাজে যেতে বাধ্য হন তিনি। মজুরি নিয়ে দরাদরিও করতে পারেন না ঠিক এই কারণেই। আশেপাশের গ্রামের মহিলারা যেখানে কোনানাতালিতে দিনে আট ঘণ্টা কাজ করে ২৫০ টাকা পান, সেখানে ২০০ টাকাতেই আটকে আছেন রত্নাভ্যা, দিনে যত ঘণ্টাই কাজ করুন না তিনি, তাতে কিস্যুটি এসে যায় না।
"সে যখনই ডাক আসুক না কেন, কাজে আমাকে যেতে হবেই। একেক দিন সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা অবধি খাটতে হয়। 'ক্রসিংয়ের' কাজ যখন থাকে না, তখন আগাছা-টাগাছা উপড়ে মোটে শ'দেড়েক টাকা জোটে," বুঝিয়ে বললেন তিনি, "ধারটার করি তো, তাই মুখ বুজে থাকতে হয়। হাঁক পাড়লেই চলে যাই, বেতন বাড়ানোর কথাও বলতে পারি না।"
তবে শুধু যে ধারদেনার জন্যই রত্নাভ্যার শ্রম স্বল্পমূল্যে বিকিয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু একেবারেই নয়। বিভিন্ন পালা-পার্বণের সময় তাঁকে স্থানীয় একটি লিঙ্গায়ত পরিবারের কাছে বিনেপয়সায় খাটতে যেতে হয়। যুগ যুগান্ত ধরে চলে আসা এই বর্ণবাদী প্রথাটির নাম ওক্কালু পদ্ধতি (এটি ' বিত্তি চাকরি ' , অর্থাৎ 'বিনেপয়সায় মজুরি' নামেও কুখ্যাত)। খাতায়-কলমে এটি আজ বেআইনি হলেও কোনানাতালি অঞ্চলে বেশ রমরমিয়েই চলে। এখানকার লিঙ্গায়ত সম্প্রদায়ের মানুষেরা সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ, আর এই প্রথাটির মাধ্যমে একেকটি মাদিগা পরিবারকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে নির্দিষ্ট লিঙ্গায়ত পরিবারগুলির সঙ্গে, মাদিগা মানুষগুলো লিঙ্গায়তদের বাড়িতে বকলমে ক্রীতদাসের মতো বেগার খাটতে বাধ্য হন।
"ধরুন বিয়েশাদি বা অন্য কিছু পরব-টরব চলছে, কিংবা বাড়িতে কেউ একটা মারা গেছে, তখন আমাদের গিয়ে ঘরদুয়ার সব ঝাড়পোঁছ করতে হয়। একটা গোটা দিন কেটে যায়, একলা হাতে টানতে হয় সবকিছু। বিয়ে লাগলে তো হয়েই গেল, টানা আট দিনের খাটুনি," জানালেন রত্নাভ্যা, "তবে ব্যাটারা কিন্তু বাড়ির ভিতর ঢুকতে দেয় না কক্ষনো, বাইরে বসিয়ে রেখে খানিক চা-মুড়ি খেতে দেয়। একখানা রেকাবিও দেয় না আমাদের। ওসব নিজেরাই বয়ে নিয়ে যাই বাড়ি থেকে। মাঝেসাঝে ভেড়ার ছানা বা বাছুর দেয় বটে, তবে মরে গেলেও পয়সা দিতে চায় না। ধরুন গরুছাগল কিছু একটা অক্কা পেলো ওদের, তখন সেটার লাশটাও সেই আমাদেরকেই গিয়ে ফেলে আসতে হয়।"
বছর চারেক আগে সেই লিঙ্গায়ত পরিবারটির এক সদস্যের বিয়ে হয়েছিল, তখন বর্ণাশ্রমের নিয়ম অনুযায়ী রত্নাভ্যা বাধ্য হয়েছিলেন নতুন একজোড়া চপ্পল কিনে, সেটাকে পুজো করে, তারপর বরকে প্রদান করতে। এমনতর খাটাখাটনির পরিবর্তে দুটো পয়সা চাওয়ার চেষ্টা বারংবার বিফল হওয়াতে আজ থেকে বছর দুই আগে তিনি ঠিক করেন যে আর কক্ষনো সেখানে যাবেন না। জানালেন যে এই সিদ্ধান্তটার কারণে সেই লিঙ্গায়ত পরিবারটি বিশাল খেপে আছে তাঁর উপর।
সরকার থেকে আধা একর জমির পাট্টা পেয়েছিলেন সান্নাচৌডাপ্পা। পরমেশাপ্পার থেকে খানিকটা টাকা ধার করে সেখানে ঢ্যাঁড়শ আর ভুট্টার চাষ শুরু করেছিলেন রত্নাভ্যা। তবে জুলাইয়ে শুরু হয় অতিবর্ষণ, ফলত কোনানাতালির মাডাগা-মাসুর হ্রদের পাড় ঘেঁসে যে জমিগুলি মাদিগা পরিবারদেরকে প্রদান করেছিল সরকার, সেগুলি সব ভেসে গেছে। "হরিজনদের [মাদিগাদের] জমিতে ঢ্যাঁড়শ লাগানো হয়েছিল এ'বছর, জলের তোড়ে সব তছনছ হয়ে গেছে," দুঃখ করছিলেন রত্নাভ্যা।
তাঁর জ্বালাযন্ত্রণা লাঘব করতে প্রশাসন কিন্তু কুটোটাও নাড়েনি। চাষিদের জন্য হাজার একটা সরকারি যোজনা থাকলেও রত্নাভ্যা যেহেতু ভূমিহীন কৃষক, তাই তিনি সেগুলোর আওতায় পড়েন না। বানভাসি ফসলের জন্য সরকার থেকে না পেয়েছেন কোনও ক্ষতিপূরণ, না পেয়েছেন প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য সরকারি খাতে বরাদ্দ করা মাসিক ১,০০০ টাকা, অথচ প্রতিবন্ধকতা বিষয়ক শংসাপত্র আছে বই কি তাঁর।
সারাটা জীবন অমানবিক পরিশ্রম করা সত্ত্বেও আবহমান কালের অনটন তাঁকে বাধ্য করেছে ক্ষুদ্রঋণদায়ক সংস্থাগুলির দরজায় কড়া নাড়তে, ফলত দেনার ভারে উত্তরোত্তর আরোই যেন তলিয়ে গেছেন রত্নাভ্যা। পরমেশাপ্পার থেকে নেওয়া ধারটা তো আছেই, এছাড়াও ২-৩ শতাংশ সুদের হারে ২ লাখ টাকার কাছাকাছি দেনা তাঁর।
ছেলেমেয়ের কলেজের মাইনে, স্বামীর চিকিৎসা এবং ঘরে একখানা নতুন কামরা বানাতে হবে বলে গত দু'বছরে নিদেনপক্ষে ১০টা আলাদা আলাদা জায়গা থেকে টাকা ধার করেছেন তিনি। ঘরখরচার জন্য তিনি বাধ্য হন পয়সাওয়ালা লিঙ্গায়ত পরিবারগুলির কাছে হাত পাততে। "[চারিদিক থেকে] এত টাকা ধার করেছি যে মাস ২,৬৫০ টাকা সুদ গুনতে হয়েছিল গতবছর," বলছিলেন রত্নাভ্যা, "পেট চালানোর জন্য প্রতিমাসেই হাত পাততে হচ্ছে, কিন্তু কোভিড-১৯ অতিমারির ওই লকডাউনটা শুরু হওয়ার পর থেকে সুদের টাকাটুকুও আর মেটাতে পারছি না।"
তবে পাহাড়প্রমাণ ঋণ উপেক্ষা করে রত্নাভ্যা সংকল্প করেছেন যে মরে গেলেও তিনি ছেলেমেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হতে দেবেন না। মেয়ে সুমাকে যাতে কখনও ' বিত্তি চাকরির ' ওই জঘন্য ফাঁদে না পড়তে হয়, সেটাও সুনিশ্চিত করে তুলেছেন তিনি। "না আছে কোমরের জোর, না আছে পায়ের। তাই তো এমন আটকা পড়েছি গেরোয়। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েদের এটা [দাসত্ব] থেকে বাঁচাতে হতই, নয়ত ওদের ইস্কুল-কলেজ যাওয়া সব চুকে যেত। তাই একটা মুহূর্তের জন্যও মজুরি থামাইনি।" শতসহস্র বাধা-বিপত্তি তুচ্ছ করে রত্নাভ্যা প্রতিজ্ঞা করলেন: "ওরা যতদূর পড়তে চায় ততদূরই পড়াব আমি।"
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)