২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের এক বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা। লালতি দেবী পাসওয়ান এবং শোভা ভারতী উত্তরপ্রদেশের সোনভদ্র জেলার রবার্টসগঞ্জ শহরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয়ের বাইরে একটা প্লাস্টিকের বেঞ্চে অপেক্ষা করছেন। দুজনের মধ্যে অস্থিরতার লেশমাত্র নেই। এসব তাঁরা ঢের দেখেছেন, সয়েছেন।
লালতি দেবী ও তাঁর স্বামী শ্যামলালের বিরুদ্ধে কুড়িটিরও বেশি ফৌজদারি মামলা ঝুলছে। তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে এসেছেন যে গ্রামের কিছু লোক ডাইনি অপবাদ দিয়ে তাঁর নামে গুজব ছড়িয়ে তাঁর অবস্থা আরও কঠিন করে তুলছে – মানুষের কাছে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা এবং তাঁর সংগঠনের কাজকর্মকে দুর্বল করে দেওয়ার চক্রান্ত এগুলি। “জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাটা দরকার। আমাদের কথা তাঁকে শুনতে হবে এবং আমাদের সঙ্গে দেখা করতে হবে যাতে আমরা আইন ব্যবহার করে বদল আনতে পারি,” বলছেন লালতি, যাঁর বয়স এখন ৬০-এর কোঠায়।
“আমি ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় আছি,” শোভা বলেন, তার বয়স ৫০ পেরিয়েছে। “আমি ক্ষতিপূরণের জন্য আমার আবেদন দাখিল করতে এসেছি। স্থানীয় সরকারকে এই ক্ষতিপূরণ প্রদান করতেই হবে [ধর্ষিতা মহিলাদের], কিন্তু ডিএম এখনও পর্যন্ত আমার ফাইলটিকে ছাড়েননি।” শোভা ও তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধেও অবৈধভাবে গাছ কাটাসহ আরও নানান অপরাধে বনবিভাগ মামলা দায়ের করেছে। অথচ তাঁরা জানাচ্ছেন এইসব ঘটনার সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগই ছিল না।
দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত দুই মহিলাই এক ঘণ্টা হল ডিএম প্রমোদ উপাধ্যায়ের অফিসে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে আছেন। তাঁদের সঙ্গে আছেন অখিল ভারত বন শ্রমজীবী ইউনিয়নের (অল ইন্ডিয়া ইউনিয়ন অব ফরেস্ট ওয়ার্কিং পিপল - এআইইউএফডব্লিউপি) সাধারণ সম্পাদক রোমা মালিক এবং রবার্টসগঞ্জের ইউনিয়ন অফিসের অন্যান্য কর্মীরা। বিগত ১৮ বছর ধরে মালিক সোনভদ্র জেলায় কাজ করছেন। তিনি জানালেন, “পুলিশি নৃশংসতার বেশ কয়েকটি ঘটনার ব্যাপারে আমরা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।”
এআইইউএফডব্লিউপি (প্রাথমিকভাবে ১৯৯৬ সালে গঠিত অরণ্যজীবী ও বন শ্রমিকদের জাতীয় সংঘ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৩ সালে। উত্তরাখণ্ড, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং মধ্যপ্রদেশসহ ১৫টি রাজ্যে এই সংগঠনের মোট সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৫০,০০০। এই ইউনিয়নের কাজকর্ম উত্তরপ্রদেশের প্রায় ১৮টি জেলায় বিস্তৃত, রাজ্যে মোট ১০,০০০ সদস্য আছেন। সংগঠনের মোট নেতৃত্বের প্রায় ৬০ শতাংশই মহিলা এবং তাঁদের প্রধান দাবি গ্রামসভার (গ্রাম পরিষদ, গ্রামস্তরের প্রশাসনিক একক) কর্তৃত্বের স্বীকৃতির মাধ্যমে বনবাসী সম্প্রদায়গুলিকে স্বশাসনের অধিকার প্রদান করে বন অধিকার আইনের (এফআরএ) যথাযথ বাস্তবায়ন।
ইউনিয়নের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে লালতি এবং শোভাও বিগত কয়েক বছর ধরে বন অধিকার আইনের অধীনে জমির অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করে চলেছেন। এইজন্য, তাঁদের একাধিকবার হাজতে যেতে হয়েছে। বনবাসী ও বননির্ভর সম্প্রদায়গুলি স্মরণাতীত কাল থেকে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবিচার এবং বৈষম্য ভোগ করে আসছে তারই মোকাবিলা করার লক্ষ্যে ২০০৬ সালে বন অধিকার আইন (এফআরএ) প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই আইনের অন্যান্য পদক্ষেপগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য জমির ‘জবরদখল’কে অপরাধের তকমা থেকে মুক্ত করা, অরণ্যবাসী এবং অরণ্যনির্ভর সম্প্রদায়গুলির জ্বালানি কাঠ, ফুল, ফল ইত্যাদি সংগ্রহের পরম্পরাগত জীবিকার স্বীকৃতি প্রদান।
ইউনিয়নের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে লালতি এবং শোভাও বিগত কয়েক বছর ধরে বন অধিকার আইনের অধীনে জমির অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করে চলেছেন। এইজন্য, তাঁদের একাধিকবার হাজতে যেতে হয়েছে। অরণ্যবাসী এবং অরণ্যনির্ভর সম্প্রদায়গুলি স্মরণাতীত কাল থেকে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবিচার এবং বৈষম্য ভোগ করে আসছে তারই মোকাবিলা করার লক্ষ্যে ২০০৬ সালে বন অধিকার আইন (এফআরএ) প্রণয়ন করা হয়েছিল
কিছুটা সময় কাটলে পর, ডিএম-এর অফিসের বাইরে অপেক্ষারত মহিলাদের ভেতরে যাওয়ার ডাক এল। ভেতরে যাওয়ামাত্র উপাধ্যায় জিজ্ঞেস করেন, “আপনারা ওখানে বেআইনিভাবে বাস করছেন?” তিনি কেবলমাত্র রোমা মালিককেই সম্বোধন করেন, কোনও আশ্বাসও তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায় না এবং মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তাঁদের বিদায় করেন। রোমার কথায়, “সোনভদ্র জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ডিএম-এর। কোথাও কোনও অত্যাচারের ঘটনা ঘটে থাকলে আপনাকে তার মোকাবিলা করতে হবে বই-কি... এমনকি বন অধিকার আইন থাকলেও, এটির বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের মোটেই কোনও আগ্রহ নেই।”
উত্তরপ্রদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা সোনভদ্র তার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং চুনাপাথরের খনির জন্য সুপরিচিত। একই সঙ্গে এটি রাজ্যের সবচেয়ে দূষিত এলাকাগুলির মধ্যে একটি, জানাচ্ছে দিল্লির সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের ২০১২ সালের উত্তরপ্রদেশের সোনভদ্র জেলায় পারদ দূষণ এবং স্বাস্থ্যের উপর তার প্রভাব শীর্ষক একটি রিপোর্ট। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে কিছু কিছু জলাধারে পারদ যে মাত্রায় রয়েছে তাতে সেই জল মানুষের প্রয়োজনে বা কৃষিকাজে ব্যবহার – দুটির কোনওটির জন্যই উপযুক্ত নয়, তবে সেটা অবশ্য আরেক গল্প।
লালতির কাহিনি
বন অধিকারকেই কেন্দ্র করে ২০০৪ সালে লালতি দেবী রবার্টসগঞ্জে একটি বৈঠকে যোগদান করার পরেই ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হলেন। তাঁর গ্রাম রামগড়ে জমির মালিকরা লালতিদের জমির দখল নিতে চাইলে পরিবারের সদস্যরা বিরোধিতা করেন, তাই পরবর্তীকালে যখন এক ভাইপোর কাছে এই ইউনিয়নের কথা জানতে পারলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়ে তাঁদের মনে আগ্রহ জন্মালো। তিন বছর পরে লালতি এবং শ্যামলাল হররা-বিরৌলা গ্রামে জমি পুনর্দখলের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন – ১৫০টি দলিত এবং আদিবাসী পরিবার ১৩৫ একর অরণ্য জমির দখল নিয়ে তাকে কৃষিজমিতে রূপান্তরিত করল।
“আমাদের দাদু-দিদারা অবাধে জঙ্গলে বিচরণ করতেন, যখন ইচ্ছা সেখানে যেতে পারতেন, অথচ আমাদের ক্ষেত্রে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হল,” শ্যামলাল বলছিলেন। জমি পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনাতে লেগেছে দুই বছর - জমির মানচিত্র খুঁটিয়ে দেখা, মানুষকে সংগঠিত করা, জমি পরিষ্কার, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি কাজে।
লালতি সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন: “আমরা প্রতিদিন ভোর পাঁচটা বাজতে না বাজতেই ঘুম থেকে উঠে পড়তাম যাতে, কারারক্ষক গণনা করতে পারেন। এরপর ঝাড়পোঁছ করে, স্নান সেরে রুটি আর ডাল বা সবজি খাওয়ার পালা, স্নান খাওয়ার পর্ব চুকলেই আবার আমাদের কুঠুরিতে বন্ধ করে দিত।” একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন, “আমার বাচ্চাদের কথা খুব মনে হত। কান্নাকাটি করতাম। শুধুমাত্র রবিবারে জেলে তাদের সঙ্গে দেখা করা যেত। নিজেদের শক্ত রাখতে হচ্ছিল – এতবড়ো এক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই যে!” লালতি ও শ্যামলালের পাঁচ সন্তান এখন বড়ো হয়েছে; তারা চাষবাস এবং দিনমজুরি করে।
২০১০ সালে ভূমি সংস্কারের দাবিতে আয়োজিত একটি সমাবেশ থেকে ফেরার পথে লালতি দেবী এবং শ্যামলালকে ওবরা শহরের (তাঁদের গ্রাম থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে) পুলিশ আটকাল। “পুলিশ আমাদের চিনত। আমাদের থানায় যেতে জোরজরবরদস্তি করলে আমরা বিরোধিতা করলাম। তারপর আমাদের হাত পিছন করে বেঁধে দিল। আমার চুল ধরে টানল, আমাদের ভীষণ পেটালো – সে এক ভয়ানক ব্যাপার,” তিনি বলছেন।
“আমাদের গ্রেফতার করে পুলিশের গাড়িতে করে মির্জাপুর জেলে নিয়ে গেল। আমার এত আঘাত লেগেছিল যে হাজতে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। নিজে নিজে খাওয়া বা স্নান করার জন্য নড়াচড়া করার ক্ষমতাটুকুও ছিল না। জেলের সব দিন একইরকম - একই খাবার, একই ব্যবহার, কিন্তু এইবার যেন আমার আর লড়ার মতো মনের জোরই ছিল না। আমি সে যাত্রা বেঁচে গেছিলাম কারণ অন্য এক মহিলা রোগীজ্ঞানে আমার দেখাশোনা, সেবাযত্ন করেছিল।”
লালতি ও শ্যামলাল হররা-বিরৌলা গ্রামে জমি পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন – শ্যামলালের কথায়, ‘আমাদের দাদু-দিদারা অবাধে জঙ্গলে বিচরণ করতেন, যখন ইচ্ছা সেখানে যেতে পারতেন, অথচ আমাদের ক্ষেত্রে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হল’
প্রতিবারই রবার্টসগঞ্জের আদালতের হস্তক্ষেপে লালতি মুক্তি পেয়েছেন এবং ইউনিয়নের আইনজীবী বিনোদ পাঠকের সাহায্যে তাঁর বিরুদ্ধে চলা মামলাগুলি নিয়ে এখনও লালতি লড়ে যাচ্ছেন। দাঙ্গায় মদত দেওয়া, জমিতে অনধিকার প্রবেশ ইত্যাদি অপরাধ দেখিয়ে মামলাগুলি দায়ের করা হয়েছে। “উকিলের সঙ্গে কথা বলা, আদালতে হাজিরা দেওয়া, মিটিংয়ে যাওয়া, ডিএম-এর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা ইত্যাদির পেছনে আমাদের অনেকটা সময় ব্যয় হয়। আমাদের বিরুদ্ধে কত মিথ্যা মামলা রয়েছে, কখনও কখনও মনে হয় এইসব মামলা সংক্রান্ত কাগজ দলিল দস্তাবেজ গোছানো ছাড়া আমাদের জীবনে যেন আর কোনও কাজই নেই! আমাদের সব টাকা এবং শক্তি এইসবের পেছনেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। রোজকার জীবন স্বাভাবিকভাবে কাটানোর, অর্থ উপার্জনের অথবা নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকার কোনও সময়ই নেই,” তিনি বলেন। ছেলেদের কাছ থেকে লালতি ও শ্যামলাল কিছুটা আর্থিক সাহায্য পান, এছাড়া ইউনিয়নের কাজকর্মের জন্য লালতি সামান্য কিছু টাকা উপার্জন করেন।
কোনও কিছুই অবশ্য তাঁকে দমাতে পারে না। “কখনও কখনও ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমার সত্যিই জানতে ইচ্ছে করে কবে আমরা একটু শান্তিতে থাকতে পারব, এত কষ্ট আমরা করছি আমাদের সন্তানদের জন্য। জেলে যেতে আমরা মোটেই ডরাই না। নিয়ে যাও না আমাদের! জমি নেওয়ার চাইতে বরং আমাদের নিয়ে যাওয়া ঢের ভালো।”
শোভার কাহিনি
মহিলারা ভূমি অধিকার আন্দোলনে প্রায়শই অগ্রণী ভূমিকা নিলেও তাঁদের স্বীকৃতি জোটে না। দ্য হিন্দু সেন্টার ফর পলিটিক্স অ্যান্ড পাবলিক পলিসির ২০১৬ সালের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে বিভিন্ন অনগ্রসর, সামাজিকভাবে দুর্বল সম্প্রদায়গুলি থেকে আসা লালতি এবং শোভার মতো মহিলারা যাঁরা আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন তাঁদের সর্বদাই রাষ্ট্রীয় হিংসা এবং হাজতবাসের ঝুঁকির মধ্যেই কাজ করতে হয়।
শোভা এবং তাঁর স্বামী রাম গরিব ভারতী রবার্টসগঞ্জ তালুকের চোপান ব্লকের বাদি গ্রামে বিগত কুড়ি বছর ধরে তাঁদের চার বিঘা জমির (প্রায় এক একর) জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন । বাসে চেপে লালতির গ্রাম থেকে চোপানে পৌঁছাতে ঘন্টা দুয়েক লাগে। চোপান চুনাপাথর, শ্বেতপাথর এবং আকরিক লৌহের মতো প্রাকৃতিক খনিজে সমৃদ্ধ।
বাদি এবং সংলগ্ন অঞ্চলে পাথর ভাঙার কাজ করতে করতে এক বছর আগে তাঁরা ধীরে ধীরে এক চিলতে জমি পরিষ্কার করতে শুরু করেন। যুগযুগান্ত ধরে জমির মালিকানা ভোগ করে আসা সম্প্রদায়গুলি এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে গেলেন না কেন – এই প্রশ্নের উত্তরে শোভা বলেন, “কিন্তু যেতাম কোথায়? সর্বত্রই এক হাল।”
২০০৬ সালে, জমির মালিকানা ভোগকারী সম্প্রদায়ের জনৈক ব্যক্তি শোভাকে তাঁর দোকানে আসতে বলেন। সেখানে পৌঁছলে শোভার উপর মারধোর, অত্যাচার এবং যৌন নির্যাতন চালান। “এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো” নির্যাতনের কথা মনে করতে করতে শান্ত স্বরে শোভা বলেন। “আমার স্বামী লোকটিকে মেরে ফেলত, কিন্তু আমি ন্যায়বিচার চেয়েছিলাম। আমার জরায়ুতে অস্ত্রোপচার হয়।”
এই ঘটনার অব্যবহিত পরেই শোভা দুই কিলোমিটার দূরে চোপান থানায় যান। কিন্তু পুলিশ মামলা নথিভুক্ত করেনি। পুলিশের কাছে মামলা দায়ের করতে প্রায় দুই বছর সময় লেগেছে। “আমি কত জায়গায় চরকির মতো ঘুরেছি, এলাহাবাদ, নানান মন্ত্রণালয়, দিল্লি কোথায় না গেছি! অবশেষে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল আইনজীবী বিনোদ পাঠকের, তিনি আমার মামলাটি নিলেন এবং তাঁর মাধ্যমেই আমার সঙ্গে রোমাদির পরিচয় হল।”
পাঠক বলছেন, “আমাদের আশা শিগগির আদালতে মামলা বিচারের জন্য যাবে। কখনও কখনও মামলার জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র দাখিল করতে বিলম্ব হলে বিচারকের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে অভিযুক্ত কারাগারে ছিল [জামিন মঞ্জুর হওয়ার আগে প্রায় ২০ দিন]। আমরা তাকে বরাবরের জন্য হাজতে পাঠাতে চাই।”
২০১০ সালে শোভা ইউনিয়নে যোগদান করেন এবং অপরাপর ভূমিহীন মহিলাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রেশন কার্ড, পুলিশের অত্যাচার ইত্যাদি বিষয়ে কথাবার্তা বলতে থাকেন। তাঁরা নিয়মিত মিটিং করতেন, একসঙ্গে মিলে জমির মানচিত্র এবং আদালতের নথিপত্র দেখা ইত্যাদি কাজ করতেন। কিছুদিন পর তাঁরা ১৫০ বিঘা কৃষিজমিসহ (প্রায় ৩৮ একর) মোট ৫০০ বিঘা (১২৪ একর) যার মধ্যে বাদির অদূরে কিছুটা জঙ্গলও আছে, সেই জমিটিকে চিহ্নিত করলেন। এই স্থানটির নাম তাঁরা দিলেন দুর্গা টোলা। “আমরা মা দুর্গার পুজো করি বলে এই নাম। যাতে সব মহিলা তাদের মধ্যে দুর্গার শক্তিকে অনুভব করতে পারে!” শোভা বলেন।
“নিজেদের সংগঠিত করতে আমাদের দুই বছর সময় লেগেছিল, কিন্তু মেয়েরা সবাই একজোট হয়েছিল। আমরা একসঙ্গে থাকতাম। জঙ্গল পরিষ্কার করেছি, গাছ কিনেছি, সেগুলো রোপণ করেছি এবং ধীরে ধীরে নিজেদের ঘর তুলেছি। এখন আমরা সেখানে চাষবাস করি।”
রোমা জানালেন, “দুর্গা টোলা ও হররা-বিরৌলা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমরা বন ও ভূমি সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে বিগত ২০ বছর ধরে সোনভদ্র জেলায় কাজ করছি, সম্প্রদায়গুলিকে ঐক্যবদ্ধ, সংগঠিত করার চেষ্টা করেছি। মানুষ জমি পুনরুদ্ধার করতে থাকেন এবং এইভাবেই আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠল, বড়ো চেহারা নিল। জমিতে কাজ করে মানুষের পেট ভরে খাওয়া জুটছিল না। আমরা এখনও বন বিভাগ এবং পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছি।
৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সালে দুর্গা টোলার সাফল্যের পর শোভার বাড়িতে হামলা চালানো হয়। সকালে ১১টা নাগাদ কয়েক ডজন লোক তাঁর বাড়ির দরজা ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে, অবশেষে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হল। ভিতরে তখন ছিলেন শোভা, তাঁর তিন কন্যা এবং আরও ১৮ জন মহিলা। তাঁরা যখন বাইরে ছুটে বেরিয়ে এলেন, তখন ইতিমধ্যেই সেখানে হাজির পুলিশ সমস্ত মহিলাকে গ্রেফতার করে ১১০ কিলোমিটার দূরে মির্জাপুরের জেলা সংশোধনাগারে নিয়ে যায় বাসে করে। “আমাদের জানানো পর্যন্ত হয়নি যে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে,” শোভা বললেন।
মির্জাপুর জেলে ৩০ জন মহিলাকে রাখার মতো একটা মাত্র ব্যারাক আছে, কিন্তু শোভা যখন সেখানে পৌঁছলেন, তখন সেখানে প্রায় ১০০ জন মহিলাকে রাখা হয়েছিল। ২০১৭ সালের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া রিপোর্ট জাস্টিস আন্ডার ট্রায়াল বলছে সমগ্র উত্তরপ্রদেশ জুড়ে ৬২টি সংশোধনাগারে বিচারাধীন কয়েদির সংখ্যা প্রায় ৬৩,০০০ – অর্থাৎ বসবাসকারীদের শতকরা হার ১৬৮ শতাংশ। অধিকাংশই আদালতে শুনানির এমনকি প্রাথমিক শুনানির অপেক্ষাতেও আছেন।
শোভা জানাচ্ছেন, “আমাদের ফোন কেড়ে নেওয়া হল। আমাদের টাকাও [যেটুকু আমাদের সঙ্গে ছিল] নিয়ে নিল। শৌচালয়ের পাশে ঘুমাতে হত। ঠান্ডা ছিল অথচ কম্বল একেবারে ছেঁড়া। আমাদের থালাগুলো গোবর দিয়ে তৈরি। দুদিন সহ্য করলাম, তারপর আমরা প্রতিবাদ শুরু করি। ঘুমোনোর ভদ্রস্থ ব্যবস্থা, কম্বল, ভালো খাবার ইত্যাদির দাবি পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত পরবর্তী দুদিন আমরা অনশন চালিয়ে গেলাম।”
জেল থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে সোনভদ্রের ডিএম কার্যালয়ে ইউনিয়নের তরফ থেকে প্রতিবাদের পর ২০১৫ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি তাঁরা মুক্তি পেলেন।
শোভার কথায়, “আমাদের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। আমরা আমাদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে জেলে গিয়েছিলাম। আমরা চুরি করিনি, কোনও অন্যায় করিনি, তাই জেলে যাওয়া নিয়ে আমার মনে কোনও গ্লানি নেই।”
তাঁদের সংগ্রাম জারি আছে। ২০১৮ সালের ২৩শে মার্চ, শোভা এবং লালতিসহ সোনভদ্রের ২০টি গ্রামের প্রায় ২৫০০ মানুষ কমিউনিটি রিসোর্স রাইটস বা সর্বজনীন গণসম্পদের অধিকার (বন অধিকার আইনের অধীনে) আদায়ের দাবিতে ডিএম-এর কার্যালয়ে মিছিল করে হাজির হলেন। তাঁরা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন গ্রামসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত; পরম্পরাগতভাবে বন, নদী এবং পাহাড় ব্যবহারকারী অধিবাসীদের নিজেদের তৈরি মানচিত্র, বনবিভাগের ‘কর্ম পরিকল্পনা’ অনুসারে নির্দেশিত অধিকারগুলির একটি তালিকা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় দস্তাবেজ। আজও তাঁরা সরকারের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় আছেন।
এই প্রতিবেদনটি ন্যাশানাল ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডস প্রোগ্রামের অংশ হিসাবে রচিত হয়েছিল ; লেখক ২০১৭ সালে এই ফেলোশিপ লাভ করেন।
বাংলা অনুবাদ : স্মিতা খাটোর