ভোর ৪টের সময়েও তাঁকে মগ্গামের (তাঁত) সামনে বসে কাজ করতে দেখা যাবে। পাশেই অন্য একটি তাঁতে কাজ করছে দুই সন্তান। “সবই যে নির্ভর করে বিজলি কখন আসবে, সেই সময়টার উপর,” মৃদু হেসে কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন তিনি। “এই শাড়িগুলো সময়ের মধ্যে শেষ করার জন্য আমাদের যে কত লম্বা সময় কাজ করতে হয়। দেখছেনই তো এখানে কেমন আঁধার হয়ে যায়।”
“এখানে” মানে, আট ফিট চওড়া নয় ফিট লম্বা একটি ঘর যেখানে দুটি তাঁত সহ কৃষ্ণাম্মা থাকেন দুটি সন্তানকে নিয়ে। ঘরের বেশিরভাগটা দখল করে আছে যে তাঁত দুটি, তা বসিয়ে দিয়ে গেছেন এক ব্যবসায়ী, কাঁচামালও তিনিই দিয়ে গেছেন আর সময়মতো এসে তৈরি জিনিসগুলো নিয়েও যাবেন। এমন সুন্দর করে বোনা শাড়ি কৃষ্ণাম্মা বা তাঁর মেয়ে অমিতা হয়তো কোনওদিনই গায়ে তুলতে পারবেন না। শাড়ি পিছু ৬০০ টাকা করে পাবেন। ছেলে পুলান্না কাজে যোগ দেওয়ায় ওঁরা এখন “মাসে দুটো শাড়ি শেষ করতে পারেন। এখন আমরা এটুকুই কাজ পাচ্ছি।” তাঁদের কাজের সময় আগে থেকে ঠিক করে রাখা সম্ভব হয় না বিদ্যুৎ সরবরাহ ঘিরে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার কারণে। অনন্তপুর জেলার সুব্রায়ানাপল্লি গ্রামের এটাই দাস্তান।
“অগত্যা, যখনই বিদ্যুৎ আসে, তখনই আমরা কাজে লেগে যাই, সময় যা-ই হোক না কেন,” কৃষ্ণাম্মা বুঝিয়ে বললেন। দুই সন্তানকে অন্য তাঁতটিতে কাজে সাহায্য করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিজের কাজও চলতে থাকে। আর এসবই তিনি করেন রোজকার ধোয়া, মাজা, রান্না-বান্নার কাজ ইত্যাদি গৃহস্থালির সব দায়িত্ব সেরে। মাঝেসাঝে তিনি অন্য কাজও পান বটে, কিন্তু তাতেও দিনে ২৫ টাকার বেশি রোজগার তাঁর হয় না। “খানিক তাঁত বোনার কাজ আমি শিখেছিলাম ছোটোবেলায়,” তিনি বললেন। বাচ্চাদের কাজের চাপ কমাতে তাদের আর নিজের দুইখান তাঁতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করে ইতিমধ্যেই তাঁর পা ফুলে গেছে। বাচ্চারা দুজনেই স্কুল-ছুট। ১৪ বছর বয়সী পুলান্নার স্কুল ছিল ৪ কিমি দূরে। ১৫ বছর বয়সী অমিতার স্কুলের জন্য মন কাঁদলেও মায়ের মুখের দিকে চেয়ে কিছুতেই সেকথা স্বীকার করে না।
কৃষক আত্মহত্যার কারণে সারা দেশে বিগত ১৪ বছরে যে এক লক্ষাধিক মহিলা স্বামীহারা হয়েছেন, কৃষ্ণাম্মা তাঁদেরই একজন। কৃষক আত্মহত্যার ধাক্কা সবচেয়ে বেশি নাড়িয়ে দিয়ে গেছে অনন্তপুরকে। নিজের সাড়ে তিন একর জমিতে ৬০,০০০ টাকা খরচ করে চারটি নলকূপ বসিয়ে যখন একটিও কাজ করল না, তখন তাঁর স্বামী, শ্রীনিবাসুলু ২০০৫ সালে গলায় দড়ি দেন। কৃষ্ণাম্মা বললেন, “মহাজনেরা আমার কাছে এসে টাকা ফেরত চেয়েছে। আমি দিতে পারিনি। টাকা কোথায়?” সরকারের থেকে কিছুই পাননি বোধহয়। “না, আমি তাঁর মৃত্যুর পর কোনও ক্ষতিপূরণ পাইনি,” তিনি বললেন। কৃষিকাজের উপর কৃষ্ণাম্মার আর একফোঁটাও আস্থা নেই। “আমরা এতকিছু হারিয়েছি, কত সময় নষ্ট করেছি।” পিছন ফিরে তাকানোর বা হাহুতাশ করার সময় অবশ্য তাঁর এখন নেই — তিনি এখন মরিয়া হয়ে কাজ করছেন। পরিবারের পেট ভরানোর জন্য তিনি যে কোনও মূল্যই চোকাবেন।
ছিন্না মুস্তুরু গ্রামে পার্বতী মাল্লাপ্পা নিজের সেলাই-স্কুল চালু করার কাজে হাত দিয়েছেন। এই অসাধারণ মহিলা ২০০৩ সালে নিজের স্বামীকে বুঝিয়ে আত্মহত্যার পথ থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। তিনি বুঝিয়ে বলেন যে সারা গ্রামই যখন ঋণ আর হতাশায় জর্জরিত, তখন মহাজনের চাপের কাছে মাথা নত করার কোনও মানে হয় না। দুগ্গালা মালাপ্পা অবশ্য শেষমেশ আত্মহত্যার পথই বেছে নেন। পার্বতী সিদ্ধান্ত নেন যে, কর্ণাটকে নিজের মায়ের গ্রাম বেল্লারিতে ফিরে যাবেন না। নিজের মেয়েদের শিক্ষার কথা ভেবে তিনি এখানেই থেকে যান। তাঁর তিন মেয়ে, বিন্দু, ভিদি ও দিব্যার বয়স এখন যথাক্রমে, চার, সাত ও নয় বছর। দশম শ্রেণি অতিক্রম করা পার্বতী তাঁর নিজের গ্রামের সর্বাধিক শিক্ষিত মহিলাদের একজন।
নিজেদের ১২ একর জমি অতি সামান্য অর্থের বিনিময় ইজারা দিয়ে তিনি সেলাই শিখতে শুরু করেন। তিনি বলছিলেন, “ছোটোবেলায় আমি কিছু কিছু সেলাই করতাম বটে। আমার মনে হল এই কাজটা আমি ঠিক পারব।” সত্যি সত্যিই পেরেছেন। প্রায় ক্রীতদাসের মতো কাজ করতে হয়েছে, তাছাড়া মাল্লাপ্পার নেওয়া ঋণ পরিশোধের বোঝাও ছিল। সেটাও তিনি করেছেন, ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়া টাকা আর পোষ্য জীব ও অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে। এই পুরো সময়টা তিন শিশুকন্যাকে নিয়ে তিনি একা দাঁতে দাঁত চেপে থেকেছেন। বড়ো মেয়ে দুটি এখন স্কুলে ভালোমতোই পড়াশুনা করছে। এক মেয়ে এরই মধ্যে বিজ্ঞানের একটা পরীক্ষায় ৫০-এ ৪৯ পেয়েছে। ওরা ‘যত দূর চাইবে তত দূর’ অবধি লেখাপড়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই পার্বতীর লক্ষ্য।
সেলাইয়ের কাজটা কেন শুরু করলেন? নিজের গ্রামের পরিস্থিতি দেখে তিনি এই কাজ করবেন বলে স্থির করেন। “আমাদের এখানে ৮০০টির মতো পরিবার আছে। প্রায় প্রত্যেকেরই মেয়ে আছে। অতএব, একদিকে যেমন সেলাইয়ের কাজ যা পাই তা করে রোজগার খুব সামান্য হলেও, অন্যদিকে সেলাই শেখাবার যথেষ্ট সুযোগ এখানে আছে। যদি এখানকার দশ শতাংশ পরিবারও নিজেদের মেয়েদের সেলাই শেখাতে চায়, তাতে আমি যত সংখ্যক ছাত্রী পাব, তা একা সামলাতেই পারব না।” তাই খানিক সাহায্য নিয়ে আরও দুটি মেশিন কিনে তিনি তাঁর ‘স্কুল’ খুলবেন বলে প্রস্তুত হয়েছেন। “মেয়েগুলো যতক্ষণ স্কুলে থাকে, আমি অনেক বেশি কাজ করতে পারি। ওরা ফিরে এলেই হুলুস্থুল শুরু হয়ে যায়,” তাঁর নালিশ।
“আশ্চর্য সাহস তাঁর,” অনন্তপুর গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থার পরিবেশ বিভাগের অধিকর্তা, মাল্লা রেড্ডি বললেন। তিনি যে সংস্থাটির সঙ্গে যুক্ত, মেয়েদের শিক্ষায় সেটি সহযোগিতা করে। “তিনটে বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে একা হাতে সব অসুবিধার মোকাবিলা করা সহজ কাজ নয় মোটেই। অথচ, তিনি তা করে দেখিয়েছেন। নিজের কর্তব্য সম্বন্ধে তিনি খুব সজাগ। মেয়েদের মধ্যেই নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পান। ওরাই তাঁর প্রেরণা।”
এই জেলাতেই আছেন আরও অনেকে কৃষ্ণাম্মা আর পার্বতী, তাঁরা হয়তো পরিস্থিতির মোকাবিলা ততটা শক্ত হাতে করে উঠতে পারেননি। অনেকে জমি-জিরেত বেচে দিয়েও দেনা শোধ করতে পারেননি। অনেকে অসহায় চোখে নিজের সন্তানদের স্কুলছুট হতে দেখেছেন। অনেকে নামমাত্র মজুরিতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়েছেন, কারণ তাঁরা জাতীয় গ্রামীণ কর্ম সুনিশ্চয়তা প্রকল্পের মাধ্যমে কোনও কাজ পাননি। দেশের অন্যান্য প্রান্তে, কৃষি-সংকটের কারণে আত্মহত্যার করাল গ্রাসে পড়া পরিবারগুলির মতোই এই পরিবারগুলিও ক্রমবর্ধমান ক্ষুধা ও যাতনার শিকার। অনেক পরিবার একই সংকটের কারণে প্রথমবারের পর দ্বিতীয়বার আত্মহত্যাও দেখতে বাধ্য হয়েছেন। দেশব্যাপী এক লক্ষাধিক পরিবার এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে যাতে পরবর্তী প্রজন্ম একটু স্বস্তিতে বাঁচতে পারে। যে কথাটা পার্বতী বলেছিলেন, “এখন সবই সন্তানগুলোর মুখ চেয়ে। আমাদের সময় তো পার হয়ে গেছে…”
এই প্রতিবেদনের একটি সংস্করণ সর্বপ্রথম ২০০৭ সালের ২৬শে জুন দ্য হিন্দু সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
অনুবাদ: চিলকা