“আব্বু আমার ছিল দিনমজুর, তবে মাছধরা ছিল তার ধ্যানজ্ঞান । কোনওমতে এক কিলো চালের টাকা এনে ধরে দিল, তাতেই হয়ে গেল… তারপর আর তার দেখা নেই! আম্মিকেই সব সামাল দিতে হত,” বেলডাঙ্গার উত্তরপাড়ায় নিজের বাড়ির ছাদে বসে কোহিনূর বেগম তাঁর জীবনের দাস্তান শোনাচ্ছিলেন।

“আর ভাবুন দেখি, ওই এক কিলো চাল দিয়ে আম্মিকে নিজের চার-চারটে বাচ্চা, দাদি, আব্বু, ফুফু আর নিজের পেট ভরাতে হত,” খানিক দম নিয়েই আবার বললেন, “এতসবের পরেও আবার আব্বু মাছের ছারার জন্য ভাত চাইত। লোকটাকে নিয়ে আমাদের জ্বালার শেষ ছিল না!”

মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙ্গার জানকীনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিল কর্মী হিসেবে বহাল আছেন কোহিনূর আপা। মধ্য পঞ্চাশের এই মানুষটি বিড়ি বাঁধাইয়ের কাজে নিযুক্ত মহিলা শ্রমিকদের অধিকার দাবি নিয়ে সদা মুখর। সময় পেলে বিড়িও বাঁধেন। মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও প্রান্তিকতম অবস্থানে থাকা মহিলারা বিড়ি বাঁধাইয়ের মতো কঠোর শারীরিক শ্রমের কাজটি করে থাকেন। খুব অল্প বয়স থেকেই তামাকের অবিরাম সান্নিধ্যের জেরে তাঁদের স্বাস্থ্যের অপূরণীয় ক্ষতি হতে থাকে। বিস্তারিত জানতে পড়ুন : ঔদাসীন্যের ধোঁয়াশায় মহিলা বিড়ি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য

২০২১ সালের ডিসেম্বরের এক সকালে বিড়ি শ্রমিকদের ঘিরে এক প্রচার কর্মসূচী চলাকালীন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কর্মব্যস্ত কোহিনূর আপার প্রথমবার সাক্ষাৎ হয়। পরের মোলাকাতের সময় অবশ্য কোহিনূর ছিলেন বেশ ফুরফুরে মেজাজে। নিজের ছোটোবেলার কথা বলেছিলেন। আর শুনিয়েছিলেন নিজের তৈরি করা গান – যে গানে বিড়ি শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রম আর শোষণের ছবি ফুটে ওঠে।

কোহিনূর আপা বলছিলেন, যদিও তিনি তখন খুবই ছোটো, কিন্তু চরম আর্থিক অনটনের জেরে বাড়িতে যে অবাঞ্ছিত পরিবেশ সৃষ্টি হত, তা সহ্য করতে পারতেন না তিনি। “আমার তখন মাত্র নয় বছর বয়স, একদিন সকালে উঠে দেখি বাড়িতে যথারীতি অশান্তির আবহাওয়া। মাটির চুলায় কয়লা, কাঠ আর ঘুঁটে সাজাতে সাজাতে মা হাপুস নয়নে কাঁদছে। ঘরে যে একটা দানাপানি নেই, রান্না করবে কেমনে?”

বাঁদিকে: নিজের মায়ের সঙ্গে কোহিনূর বেগম। মায়ের জীবন সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়ে কোহিনূর সমাজে নিজের স্থান তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ডানদিকে: মুর্শিদাবাদের বহরমপুর শহরে একটি মিছিলের অগ্রভাগে কোহিনূর। ছবিগুলি নাসিমা খাতুনের সৌজন্যে প্রাপ্ত

নয় বছরের বালিকার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। “একছুটে হাজির হলাম কয়লার ডিপোয়। মালিকের স্ত্রীকে বললাম, ‘কাকিমা, আমাকে এক মণ করে কয়লা দেবে রোজ?’” সগর্বে সেই স্মৃতি রোমন্থন করেন কোহিনূর আপা। “অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে সেই কাকিমাকে রাজি করানো গেল। ডিপো থেকে রিকশায় এক মণ করে কয়লা আমাদের বাড়ি নিয়ে আসতে শুরু করলাম। তখন রিকশা ভাড়া ছিল কুড়ি পয়সা।”

জীবনের চাকা এই ছন্দেই গড়িয়ে চলল কিছুদিন। ১৪ বছর বয়স অবধি কোহিনূর আপা উত্তরপাড়া-সহ আশপাশের এলাকায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাঁট কয়লা বিক্রি করতে থাকেন। নিজের কচি কাঁধে কুড়ি কেজি অবধি কয়লা নিয়ে ফেরি করতেন সেইসময়। “আয় বলতে তেমন কিছু হত না, কিন্তু যা হোক করে খানিক আহারের বন্দোবস্ত হচ্ছিল আমাদের।”

নিত্য অনটনের সংসারে অল্প হলেও সাহায্য করতে পেরে কোহিনূর স্বস্তি ও খুশি পেয়েছিলেন বটে, তবে নিজের জীবন যে এই চক্করে হারিয়ে যাচ্ছিল তা তিনি বেশ উপলব্ধি করতে পারছিলেন। “পথে পথে কয়লা মাথায় হাঁটার সময় দেখতাম কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মেয়েরা ইস্কুলে যাচ্ছে, বড়ো মেয়েরা কলেজে আর আপিসে যাচ্ছে। আমার নিজের জন্য খুব কষ্ট হত,” ঘন হয়ে আসে গলার স্বর কোহিনূর আপার, তড়িঘড়ি গিলে ফেলেন চোখের জল আর বলে ওঠেন, “আমারও যে ব্যাগ কাঁধে করে কোথাও যাওয়ার ছিল…”

এইসময়েই তাঁর এক তুতো দাদার মাধ্যমে তিনি পৌরসভার অধীনে স্থানীয় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাজকর্ম সম্বন্ধে জানতে পারেন। “বাড়ি বাড়ি কয়লা বেচার সময় আমার সঙ্গে কতই না মেয়েদের আলাপ পরিচয় হত। তাদের জ্বালা-যন্ত্রণা ভালো করে বুঝতাম। পৌরসভা যেন আমাকে তদারকির কাজে বহাল করে এই মর্মে আমি দরবার করতে লাগলাম।”

বাধ সাধল একটা ব্যাপার, যেটা নজরে আনলেন তাঁর ওই দাদা। কোহিনূর যে লেখাপাড়া জানেন না, ইস্কুলে যাননি কখনও, তাহলে তাঁর পক্ষে তো স্বনির্ভর গোষ্ঠীর হিসাবের খাতাপত্তর দেখা সম্বব হবে না আদৌ।

“আমার কাছে এসব কোনও ব্যপারই ছিল না। আমি দিব্যি ভালো হিসেব করি, গোনাগুনতি করতেও কোনও অসুবিধা নেই। কয়লা বেচতে বেচতে এইসবে আমি সড়গড়,” নিজের স্বভাবসিদ্ধ স্বাচ্ছন্দ্যে বলে উঠলেন আপা। কোনও ভুলভ্রান্তি হবে না কথা দিয়ে ওদের নিশ্চিন্ত থাকতে বললেন। শুধু একটা ব্যাপারে সাহায্য চেয়েছিলেন তিনি তাঁর দাদার কাছ থেকে। দাদা যেন ডায়রিতে লেখালিখিটুকু করে দেন, “বাদবাকি সব আমার দায়িত্ব।”

Kohinoor aapa interacting with beedi workers in her home.
PHOTO • Smita Khator
With beedi workers on the terrace of her home in Uttarpara village
PHOTO • Smita Khator

বাঁদিকে: উত্তরপাড়ার বাড়ির ছাদে বসে বিড়ি শ্রমিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন কোহিনূর আপা। ডানদিকে: এবার সবাই মিলে ছবি তোলার পালা

আর বলাই বাহুল্য, নিজের দায়িত্ব তিনি দক্ষতার সঙ্গেই পালন করলেন। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে কাজকর্ম করতে গিয়ে কোহিনূর এই মহিলাদের আরও ভালোভাবে জানা-বোঝার সুযোগ পেলেন। এঁদের অধিকাংশই ছিলেন বিড়ি শ্রমিক। তিনি সঞ্চয়, আমানত, পুঁজি, ঋণ এবং পরিশোধ ইত্যাদি জটিল বিষয়গুলির সঙ্গে সম্যকভাবে অবহিত হলেন।

কোহিনূর আপার নিজের জীবনে টাকাপয়সার অনটন না ঘুচুক, তাঁর মতে এই কাজ “বিরাট বড়ো এক শিক্ষা” কারণ “আমার মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হচ্ছিল। সারাক্ষণ সবার সঙ্গে আমি তর্ক করতাম, কোথাও ভুল কিছু দেখতে চুপ থাকতে পারতাম না। এইসময়ে শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মীদের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ তৈরি হচ্ছিল।”

এতে অবশ্য আত্মীয়স্বজনদের রাতের ঘুম নষ্ট হতে বসেছিল। “তাই আমার বিয়ে দিয়ে দিল।” ১৬ বছর বয়সে কোহিনূর আপার বিয়ে হল জামালউদ্দীন শেখের সঙ্গে। এক এক করে তাঁদের জীবনে এল তিন সন্তান।

সবচেয়ে বড়ো কথা এটাই যে, বিয়ে হল বলে কোহিনূর আপার জীবনে কোনও কিছুই থেমে গেল না, নিজের পছন্দের সব কাজই তিনি করে যেতে থাকলেন। “আমি আমার চারপাশের সবকিছুকে খুব খুঁটিয়ে দেখতাম। মাটিতে থেকে মানুষের মধ্যে কাজ করা সংগঠনগুলিকে আমার খুব ভালো লাগত। বিশেষ করে যেগুলি আমার মতো মেয়েদের অধিকার নিয়ে লড়াই করে, তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বাড়তেই থাকল।” জামালউদ্দীন সাহেব লোহালক্কড়, প্লাস্টিক ইত্যাদি বর্জ্য সংগ্রাহকের পেশায় বহাল আছেন, আর কোহিনূর আপা ইস্কুলের মধ্যাহ্নভোজন কর্মী হিসেবে কাজের পাশাপাশি মুর্শিদাবাদ জেলা বিড়ি মজদুর এবং প্যাকার্স ইউনিয়নের অধীনে অন্যতম অধিকার কর্মী হিসেবে বিড়ি শ্রমিকদের দাবিদাওয়া এবং অধিকারের লড়াইয়ে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন।

“এই তো রবিবার সকালগুলোতেই যা একটু সময় পাই নিজের জন্য,” রোদে রাখা নারকেল তেলের শিশি থেকে খানিকটা তেল হাতের তালুতে ঢেলে চুলে মাখতে মাখতে বলছিলেন কোহিনূর আপা। ঘনকালো চুলে আয়েশ করে তেল ঘষে এবার রয়েসয়ে চিরুনি চালানোর পালা।

এসব মিটলে এবার ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে, সামনে মেঝেয় রাখা একটা খুদে আয়নায় নিজের মুখখানি দেখে ঝলমলে হেসে বললেন, “আজ আমার গান গাইতে মন করছে। একটা বিড়ি বাঁধাইয়ের গান শোনাই…”

ভিডিও দেখুন: কোহিনূর আপা গাইছেন শ্রমের ঘাম ঝরানিয়া গান

বাংলা

একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই

শ্রমিকরা দল গুছিয়ে
শ্রমিকরা দল গুছিয়ে
মিনশির কাছে বিড়ির পাতা আনতে যাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই

পাতাটা আনার পরে
পাতাটা আনার পরে
কাটার পর্বে যাই রে যাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই

বিড়িটা কাটার পরে
পাতাটা কাটার পরে
বাঁধার পর্বে যাই রে যাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই
ওকি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই

বিড়িটা বাঁধার পরে
বিড়িটা বাঁধার পরে
গাড্ডির পর্বে যাই রে যাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই

গাড্ডিটা করার পরে
গাড্ডিটা করার পরে
ঝুড়ি সাজাই রে সাজাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই

ঝুড়িটা সাজার পরে
ঝুড়িটা সাজার পরে
মিনশির কাছে দিতে যাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই

মিনশির কাছে লিয়ে যেয়ে
মিনশির কাছে লিয়ে যেয়ে
গুনতি লাগাই রে লাগাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই

বিড়িটা গোনার পরে
বিড়িটা গোনার পরে
ডাইরি সারাই রে সারাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই
একি ভাই রে ভাই
আমরা বিড়ির গান গাই

ডাইরিটা সারার পরে
ডাইরিটা সারার পরে
দুশো চুয়ান্ন টাকা মজুরি চাই
একি ভাই রে ভাই
দুশো চুয়ান্ন টাকা চাই
একি ভাই রে ভাই
দুশো চুয়ান্ন টাকা চাই
একি মিনশি ভাই
দুশো চুয়ান্ন টাকা চাই।


গানের রচয়িতা: কোহিনূর বেগম

Smita Khator

స్మితా ఖటోర్ పీపుల్స్ ఆర్కైవ్ ఆఫ్ రూరల్ ఇండియా (PARI) భారతీయ భాషల కార్యక్రమం, PARIBhasha ప్రధాన అనువాదాల సంపాదకులు. అనువాదం, భాష, ఆర్కైవ్‌లు ఆమె పనిచేసే రంగాలు. స్త్రీల, కార్మికుల సమస్యలపై ఆమె రచనలు చేస్తారు.

Other stories by Smita Khator
Editor : Vishaka George

విశాఖ జార్జ్ PARIలో సీనియర్ సంపాదకురాలు.ఆమె జీవనోపాధుల, పర్యావరణ సమస్యలపై నివేదిస్తారు. PARI సోషల్ మీడియా కార్యకలాపాలకు నాయకత్వం వహిస్తారు. PARI కథనాలను తరగతి గదుల్లోకి, పాఠ్యాంశాల్లోకి తీసుకురావడానికి, విద్యార్థులు తమ చుట్టూ ఉన్న సమస్యలను డాక్యుమెంట్ చేసేలా చూసేందుకు ఎడ్యుకేషన్ టీమ్‌లో పనిచేస్తున్నారు.

Other stories by Vishaka George
Video Editor : Shreya Katyayini

శ్రేయా కాత్యాయిని పీపుల్స్ ఆర్కైవ్ ఆఫ్ రూరల్ ఇండియాలో సీనియర్ వీడియో ఎడిటర్, చిత్ర నిర్మాత కూడా. ఆమె PARI కోసం బొమ్మలు కూడా గీస్తుంటారు.

Other stories by Shreya Katyayini