পড়ুয়া ঔচিত মহাত্রের একরকম অভ্যাসই হয়ে গেছিল ক্লাস-ঘরে একা একা লেখাপড়া করার। অবশ্য বিদ্যালয়ের সর্বশেষ ছাত্র হিসাবে এখানে পড়ে থাকাটা তার কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা বটে।
অতিমারির কারণে ১৮ মাস বিদ্যালয় বন্ধ থাকায়, বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গতবছর ৪ঠা অক্টোবর ১১টা নাগাদ ঔচিত যখন বিদ্যালয়ে পা রাখল তখন এই কাণ্ডটিই ঘটল। বিদ্যালয়ের তিনটি ক্লাস-ঘর একেবারে ফাঁকা পড়েছিল। সবেধন নীলমণি ছাত্রটির অপেক্ষায় শিক্ষক মশাই পাশে মহাত্মা গান্ধীর একটি ছবি চেয়ারে সাজিয়ে বসেছিলেন।
২০১৫ সালে ছয় বছর বয়সে প্রথম শ্রেণিতে দাখিল হওয়ার সময় থেকেই নিজের শ্রেণিতে ঔচিতের কোনও সহপাঠী ছিল না। তার কথায়, “আমি একাই ছিলাম।” সে ছিল এই ইস্কুলে ভর্তি হওয়া শেষ ছাত্র, তখন অবশ্য সেখানে আরও জনা ২৫ ছাত্র পড়ত। মোরাবন্দর, রাজবন্দর, ও শ্বেতবন্দর - ঘারাপুরী গ্রামের তিনটি পাড়া থেকে থেকে তারা আসত। এই এলাকাগুলিতে মোট ১,১০০ মানুষের বাস। মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলার ঘারাপুরী গ্রাম এলিফ্যান্টার গুহা প্রাচীন ভাস্কর্যের কারণে একটি অতি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। দক্ষিণ মুম্বইয়ের গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া থেকে নৌকা করে এখানে পৌঁছাতে ঘণ্টা খানেক সময় লাগে।
এক দশকেরও বেশি আগে ঔচিতের জেলা পরিষদ ইস্কুলে প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ৫৫-৬০ জন ছাত্র ছিল। তিনবছর ধরে ছাত্র সংখ্যা কমতে কমতে ২০১৯ সালে ১৩ জনে এসে ঠেকে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ জনে। ২০২০-২১ শিক্ষা বর্ষে যখন তিনজন সপ্তম শ্রেণির পাঠ শেষ করল আর দুজন পড়াশোনাই দিল ছেড়ে তখন বাকি রইল মোটে আর দুইজন — ষষ্ঠ শ্রেণির ঔচিত আর সপ্তম শ্রেণির গৌরী মহাত্রে। “এখানে পড়াশুনা ভালো করে হত না বলে সবাই ছেড়ে দিত,” গৌরী জানাল।
এই ভাঙনের কারণ অনেক — দূরত্ব ও বিদ্যালয়টির অবস্থানগত সমস্যার কারণে শিক্ষকের অভাব, দ্বীপের দুর্বল পরিকাঠামো, ওইখানকার মানুষের কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ ও দারিদ্র, বাচ্চাদের ইংরাজি মাধ্যমে পড়ার ঝোঁক আর ঘারাপুরীর মারাঠি মাধ্যম থেকে পাস করার পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের অসুবিধা।
যখন পুরোদমে জেলা পরিষদ বিদ্যালয়টি চলত, তখনও সেখানে জল-সংযোগ তথা বিদ্যুৎ অমিল ছিল। ২০০০ সাল থেকে ঘারাপুরী জেনারেটর চালিত বিদ্যুৎ পেতে শুরু করে সন্ধে ৭টা থে রাত ১০টা অবধি, আর ২০১৮ থেকে চালু হয় সর্বক্ষণের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করে বললেন। (২০১৯ থেকে জলের লাইনেও উন্নতি দখা দেয়)।
দীর্ঘদিন বিদ্যালয়টি টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়েছিল। একটি কম্পিউটার ও একটি ল্যাপটপ লাগানো হয় ২০১৪-১৫ সালে (দুটিতেই চার্জ দেওয়া হত সন্ধে বেলা বিদ্যুৎ চালু হলে)। এখন একটি শ্রেণিকক্ষে অব্যবহৃত অবস্থায় সেই দুটি পড়ে আছে। “কিছুদিন আমরা নিজেদের ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইউটিউবর মাধ্যমে বাচ্চাদের ছড়া আর অঙ্ক শেখাতে এইদুটি ব্যবহার করেছিলাম,” সেই শ্রেণিকক্ষ যেখানে ঔচিতই একমাত্র ছাত্র, সেই ঘরেই বসে জানালেন শিক্ষক, রান্যা কুয়র।
মাত্র তিনজন শিক্ষককে দিয়ে প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণি অবধি ইস্কুল চালাতে অনেক সময়ে সব শ্রেণির ছাত্রকে একটা ঘরেই ঢুকিয়ে দেওয়া হত, ফলে কিছু পড়ুয়া ক্লাস-ঘরের বাইরে বা শ্রেণিকক্ষের বাইরে ছোটো উঠোনে বসে ক্লাস করত।
বহু বছর ধরে লাগাতার দ্বীপটিতে যাতায়াত করে কাজ করতে রাজি হয়েছেন খুব কম সংখ্যক শিক্ষকই। উরান তালুকের অন্যান্য গ্রাম থেকে প্রতিদিন নৌকা করে আধা ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে ঘারাপুরীতে আসতে হয় তাঁদের — এছাড়া সেখানে পৌঁছাবার আর কোনও পথ নেই। বর্ষার সময়ে, (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) ভারি বর্ষণ আর ভরা জোয়ারের কারণে ক্লাস হয়ে পড়ে আরও অনিয়মিত। ঘারাপুরীতে রেশন দোকান, ব্যাঙ্ক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো পরিষেবা না থাকায় শিক্ষকরা এখানে থাকতে চান না এবং সুযোগ পেলেই বদলি হয়ে যান।
“প্রায় কোনও শিক্ষকই এখানে কয়েক মাসের বেশি টেকেননি,” জানাচ্ছে ১৪ বছরের গৌরী। “প্রত্যেকের পড়াবার ধরন আলাদা, ফলে তাঁদের সেই নিজস্ব ছন্দের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমাদের বেশ সময় লাগত।”
৫২ বছর বয়সী রান্যা অবশ্য ৫০০ টাকা ভাড়া দিয়ে ওই গ্রামেই সস্ত্রীক (সুরেখা) থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন—এমন সবাই করেন না। “এতদিন থাকার পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। আমাকে বলা হয়েছিল এই পদে বছর খানেক থাকতে হবে,” জানালেন, মহারাষ্ট্রের ধুলে জেলার মানুষ রান্যা, তিনি এখানে পড়াচ্ছেন ২০১৬ সাল থেকে। ২০১৯ সালের দীপাবলির সময় তাঁর স্ট্রোক হলে তার থেকে পক্ষাঘাত হয় এবং চিকিৎসার জন্য তাঁকে চলে যেতে হয়। ২০২০ সালে অগস্ট মাসে ফিরে এসে তিনি দেখেন বিদ্যালয়ে কেবল ঔচিত ও গৌরীই পড়ে আছে। ওই মাসেই জেলা পরিষদ অপর এক আংশিক সময়ের শিক্ষক নিয়োগ করে কারণ তখন রান্যা ছাড়া তখন বিদ্যালয়ে আর কোনও শিক্ষক ছিলেন না।
৩রা সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে রায়গড় জেলা পরিষদের শিক্ষা বিভাগ ঘারাপুরী গ্রামের সরপঞ্চকে বিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দেয় (কারণ তখন ঔচিত ছাড়া সেখানে আর কোনও ছাত্র ছিল না) এবং বলে যে যদি কোনও ছাত্র ওই বিদ্যালয়ে থেকে থাকে তাহলে তাকে নিকটবর্তী বিদ্যালয়গুলির কোনও একটাতে (উরান অঞ্চলে) পাঠিয়ে দিতে।
বলিরাম বিদ্যালয়টি চালু রাখতে বদ্ধপরিকর। “একজন ছাত্র থাকলেও আমি স্কুল বন্ধ করে দিতে পারি না। আমাদের বিষয়টা আলাদা...যেখানে আমাদের গ্রামটি অবস্থিত আর এখানে কাছাকাছি আর কোনও স্কুলই নেই,” তিনি বললেন। শিশুদের অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার আইন , ২০০৯ সালে বলা হয়েছে যে পঞ্চম শ্রেণি অবধি ছাত্রদের বাসস্থানের এক কিলোমিটারের মধ্যে, অষ্টম শ্রেণি অবধি ছাত্রদের বাসস্থানের তিন কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যালয় থাকা আবশ্যক।
“এখানকার বাবা-মায়েরা নিজেদের ঘর ছেড়েছেন বাচ্চাদের [উরান এলাকার] অন্য বিদ্যালয়ে পড়াবার জন্য।” বলিরাম আরও বললেন, “এই স্কুলের মানোন্নয়নের চেষ্টা করলে নিশ্চয় অভিভাবকরা বাচ্চাদের ছাড়িয়ে নেবেন না।”
এই দ্বীপের ছাত্ররা বহুদিন ধরেই লেখাপড়ার জন্য উরান তালুকের অন্যান্য গ্রামে অথবা নভি মুম্বই অঞ্চলে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ সেখানে আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করে আবার কখনোবা গোটা পরিবার সেখানে গিয়ে ঘর ভাড়া করে থাকে। মুম্বইও কাছেই, কিন্তু ঘরাপুরী গ্রামের মানুষদের পক্ষে সেখানকার সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করা বড়োই বেশি খরচ সাপেক্ষ। এই পরিবারগুলির বেশিরভাগই (ওবিসি হিসেবে চিহ্নিত) অগ্রি কোলি সম্প্রদায়ভুক্ত —এঁদের মধ্যে অনেকেই ছোটো ছোটো গুমটিতে টুপি, রোদ-চশমা, স্মারক ও অন্যান্য ছোটখাটো জিনিস পর্যটকদের কাছে বিক্রি করেন, অথবা এলিফ্যান্টা গুহার কাছে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত কোনও কাজ করেন।
“অন্য জায়গায় পড়তে যাওয়া খরচ মানে তো আর কেবল স্কুলের বেতন না, তার সঙ্গে আছে ঘর ভাড়া নেওয়ার জন্য অগ্রিম টাকা জমা দেওয়া, আছে ঘর ভাড়া সহ অন্যান্য খরচপাতি। তাছাড়া মা-বাবাকে নতুন কাজের সন্ধানও করতে হয় আবার,” বললেন, ঔচিতের মা বিনতী মহাত্রে। “আমরা অন্য জায়গায় যেতে পারব না, আয়ের কী ব্যবস্থা হবে? চেষ্টা করব ঔচিতকে কোনও হস্টেলে রেখে পড়ানোর। এখানকার হাইস্কুলটা বন্ধ হয়ে গেছে, আর তার সঙ্গে লকডাউনের কারণে আমাদের আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে (বহু মাস যাবৎ)।
জাহাজ ঘাটা থেকে যে ১২০টি সিঁড়ি বেয়ে এলিফ্যান্টা গুহায় যেতে হয় তার কাছেই, বিনতী ও তাঁর ৪২ বছরের স্বামী, নীতিন একটি অস্থায়ী গুমটি দোকান চালান। ২০২০ সালের মার্চ মাসে লকডাউন শুরু হওয়ার আগে মাস গেলে তাঁদের টেনেটুনে ৬,০০০-৭,০০০ টাকা আয় করতেন। পর্যটক কমে যাওয়ার পর থেকে এই পরিমাণ অর্থ তাঁরা কেবল কোনও মাসে আয় করতে পারেন। ২০১৯ সালে গুহাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার জন্য, মাসিক ১,২০০ টাকা বেতনে নীতিনকে নিয়োগ করেন এক ঠিকাদার (যিনি পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের হয়ে কাজ করেন—এলিফ্যান্টা গুহার তত্ত্বাবধায়ক পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ) । সেই বছরই ওঁদের বড়ো ছেলে ১৮ বছরের আদিত্য, গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয় থেকে দশম শ্রেণির পাঠ শেষ করে। নীতিনের মাইনের জোরে সে পেরেছিল উরানে গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে। (নীতিনের মতে মাইনে সংক্রান্ত গোলমালের কারণে তিনি ২০২২ সালে ওই কাজটি হারান)।
ঘারাপুরীতে যে মারাঠি মাধ্যম কেইএস মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে আদিত্য পাস করেছে সেটি কোঙ্কণ এডুকেশন সোসাইটি নামের একটি সেবামূলক সংস্থা ১৯৯৫ সালে স্থাপন করে। গ্রামের এক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, ৪০ বছর বয়সী, সুবর্ণা কোলি বিদ্যালয়টি স্থাপিত হওয়ার পর নিজের সেদিনের আনন্দ উত্তেজনার কথা স্মরণ করে বললেন, “সপ্তম শ্রেণির পাঠ শেষ করার পর (১৯৯২) আর পড়াশুনা চালাবার মতো স্কুল তখন পাইনি। আমাদের বাবা-মায়েরা তখন মনে করতেন যে এর পর হয় আমাদের বিয়ে করে নিতে হবে অথবা কোনও দোকানে কাজ করতে হবে।” সুবর্ণার মা একটা খাবারের স্টলে রান্না করতেন আর বাবা চাষাবাদ করার কাজের সঙ্গেই গ্রামের সরপঞ্চকে কাজে সাহায্য করতেন। নার্স হওয়ার ইচ্ছা ছিল সুবর্ণার, কিন্তু সে ইচ্ছা পূরণ না হলেও, তিনি মৃদু হেসে জানালেন, “আমি অন্তত, দশম শ্রেণির পাঠ পুরো (১৯৯৮) করতে পেরেছিলাম,” আর তাও আবার সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে।
একসময়ে এই অবৈতনিক কেইএস বিদ্যালয়ে চারজন শিক্ষক, ৩০ জন পড়ুয়ার দায়িত্বে ছিলেন। তাঁদেরই একজন নবনীত কাম্বলে। ঘারাপুরীতে শিক্ষকতার মোট ১২ বছরের মধ্যে ৬ বছর তিনি এই গ্রামে থেকেই পড়িয়েছেন। বিয়ের পর তিনি উরান থেকে নৌকায় যাতায়াত করতেন। “জেলা পরিষদ স্কুলে ঠিকমতো পড়াশুনা না হওয়ার কারণে যেসব ছাত্ররা অষ্টম শ্রেণিতে এসে যোগ দিত তাদের লেখাপড়া বুঝতে রীতিমতো বেগ পেতে হত আর অনেকের তেমন উৎসাহও থাকত না,” তিনি বললেন।
ক্রমে সেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সংখ্যা কমতে শুরু করল। বিদ্যালয়টির অর্থাভাব দেখা দিল এবং প্রতিবছর সেখানে একটি করে ক্লাস বন্ধ হয়ে যেতে লাগল — ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে যথাক্রমে বন্ধ হয়ে গেল অষ্টম, নবম আর দশম শ্রেণি।
হাইস্কুল বন্ধ করে দেওয়া এবং কোনোমতে টিকে থাকা জেলা পরিষদ স্কুলগুলি পরিবর্তনের যে দিকনির্দেশ করছে তা আদতে শিক্ষা পরিস্থিতির বার্ষিক সুরতহাল (গ্রামীণ) (অক্টোবর ২০২০) রিপোর্টে করা সুপারিশটির সম্পূর্ণ বিপরীত: দুর্বল তথা সুযোগসুবিধা-বঞ্চিত পরিসর থেকে উঠে আসা সরকারি স্কুলে পাঠরত পড়ুয়াদের লকডাউন পরবর্তী সময়ে আরও অধিক সহায়তার প্রয়োজন।
সুবর্ণা ও তাঁর এক সহকর্মী ঘারাপুরী গ্রামে নবজাতক থেকে ছয় বছর বয়সী জনা ৪০ বাচ্চার জন্য অঙ্গনওয়াড়ি বিদ্যালয় চালান বটে, তবে ৬-১৪ বছরের ২১টি বাচ্চার কেউই আর জেলা পরিষদ বিদ্যালয়ে দাখিল হয়নি (এই পরিসংখ্যান একত্রে তৈরি কররেছেন সুবর্ণা, রান্যা ও সুরেখা কুয়র)। জেলা পরিষদ বিদ্যালয়টির ক্রমাবানতি দেখে এবং সেটিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় ঘরাপুরীর অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের উরানের অন্যান্য বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে শুরু করেন।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সপ্তম শ্রেণির পাঠ শেষ করেই পড়ুয়াদের ঘারাপুরী ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হত। এরকমই এক ছাত্র ছিল ১৬ বছরের কল্পেশ মহাত্রে, নভা গ্রামের একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও সে মাঝপথেই পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। তার কথায়, “আর পেরে উঠলাম না।” পরবর্তীকালে সে এলিফ্যান্টা গুহা দর্শনে আগ্রহী পর্যটকদের চেয়ারে বসিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তুলে দেওয়ার পেশায় নিযুক্ত কুর্সিওয়ালার কাজ শুরু করে। চারজনের একটি দল প্রতিদিন এমন ৩-৪ দফা যাতায়াত করে পর্যটকদের নিয়ে। প্রতি দফায় ৩০০-৫০০ টাকা আয় হয়।
ঘারাপুরীর কিছু কিছু শিক্ষার্থী অবশ্য খানিক বেশি লেখাপড়া করতেও সক্ষম হয়েছে। গৌরী মহাত্রের দিদি ভাবিকা মহাত্রে, ২০১৬ সালে গ্রামের বিদ্যালয় থেকে দশম শ্রেণির পাঠ শেষ করে পানভেল থেকে স্নাতক হয়েছেন। কিন্তু ২০২০ সালে মা-বাবার মৃত্যুর পর সে গ্রামে ফিরে এসে ওদের ছোটো দোকানটির দায়িত্ব নিয়ে সেখানে কিছু জলখাবার আর গয়না বিক্রি করতে শুরু করে। গৌরী এখন পানভেলে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে।
“মা-বাবা আমাদের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার উপর জোর দিতেন। মা নিজে অষ্টম শ্রেণি অবধি পড়েছিলেন, কিন্তু তাঁর ইচ্ছে ছিল আরও পড়ার। সেটা আর সম্ভব হয়নি। বাবা চেয়েছিলেন নৌবাহিনীতে যোগ দিতে, কিন্তু তাঁর বাবার মৃত্যুর পর তাঁকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়,” ২০ বছর বয়সী ভাবিকা বলছিল। “বাবা আমাদের নিজেই হিন্দি আর অঙ্ক শেখাতেন, আর সবকিছু শিখতে উৎসাহ দিতেন। আমাদের বাবা ছিলেন এক স্বশিক্ষিত চিত্রশিল্পী আর গ্রামের বিয়ের অনুষ্ঠানে ডিজের ভূমিকাতেও তাঁকে দেখা যেত। আমাকে বাবা টাইপিং স্কুলেও ভর্তি করে দিয়েছিলেন। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসি, আর তারপর আইএএসের জন্য আবেদন করি বা উকিল হই - এইসব চাইতেন বাবা...”
ঘারাপুরীতে শিক্ষার পথে এতশত অন্তরয়ের কারণেই ভাবিকার মতো কয়েকজন মাত্র পড়ুয়াই উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পেরেছে। পরিবার পিছু শিক্ষাগ্রহণের প্রবণতা
https://ruralindiaonline.org/en/library/resource/key-indicators-of-household-social-consumption-on-education-in-india-nss-75th-round-july-2017-june-2018/
(৭৫ দফার এনএসএস সমীক্ষা ২০১৭-১৮) লক্ষ্য করলে দেখা যাবে গ্রামীণ ভারতে ১৫ বছর ও তার বেশি বয়সী কিশোরদের মধ্যে মাত্র ৫.৭ শতাংশ স্নাতক স্তর অবধি পড়াশুনা করেছে। মহারাষ্ট্রে পরিসংখ্যান খানিক ভালো হলেও মাত্র ১২.৫ শতাংশের বেশি সেখানে স্নাতক বা তার ঊর্ধ্বে পড়াশুনা করে। সমীক্ষা বলছে শিক্ষার্থীরা বিবিধ কারণে লেখাপড়া ছেড়ে দেয়। এর মধ্যে শিক্ষায় অনাগ্রহ, পড়াশুনার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা, পঠনপাঠনে ব্যবহৃত ভাষার মাধ্যম, বিদ্যালয়ের দূরত্ব, দারিদ্র, ও গৃহস্থালি অথবা অর্থকরি কজে যুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা প্রধান।
ঘারাপুরীর ২৩ বছর বয়সী সোনাল মহাত্রে ২০১৬ সালে উরানে আত্মীয়দের বাড়িতে থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ শেষ করেন। পরিবারের আয় ছিল বড্ডো কম, তাঁর মায়ের চিপস বিক্রির একটা স্টল ছিল এবং বাবা উরানে একটা নৌকায় কাজ করে মাস গেলে ৫০০০ টাকা পেতেন। এই পরিস্থিতিতে সোনাল ঘারাপুরী ফিরতে বাধ্য হয়।
বিনয় কোলিও, ২০১৯ সালে উরানের একটি বিদ্যালয়ে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে পড়া ছেড়ে দেয়; বাণিজ্য বিভাগে লেখাপড়া করার সময়ে কিছু বিষয় মারাঠি ভাষায় পড়ানো হলেও হিসাব শাস্ত্র পড়ানো হত ইংরাজিতে। তার কথায়, “যা লেখা আছে তা বুঝতে অনেক সময় লেগে যেত।” চুক্তি কর্মী হিসেবে মাসিক ৯,০০০ টাকা বেতনে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে এলিফ্যান্টা গুহায় টিকিট সংগ্রহের কাজ নেয়।
ঘারাপুরীর কিছু ছাত্র দ্বাদশ শ্রেণির পর দুইএক বছর বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করে বিদ্যুৎ মিস্ত্রি, কল মিস্ত্রি, ঝালাই মিস্ত্রি বা টার্নার হতে চায়। বাসুদেব চাসকর নামে আহমেদনগর কেন্দ্রিক এক শিক্ষা-কর্মী ও শিক্ষক বললেন, “এইসব কাজ করে তো কেবল মজুর হওয়া যায়। যারা উচ্চশিক্ষার পথ ধরতে পারে না সাধারণত তারা প্রান্তিক পরিবার থেকে আসা সন্তান।”
ঘারাপুরীতে তো প্রাথমিক শিক্ষার রাস্তাই এখন বন্ধ হয়ে গেল।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মহারাষ্ট্র সরকার ঘোষণা করে যে ৫০০ জেলা পরিষদ বিদ্যালয়কে পরিকাঠামো, পঠনপাঠন সহ অন্যান্য দিক থেকে আদর্শ হিসাবে গড়ে তোলা হবে। আদর্শ বিদ্যালয়ের তকমা লাভ করতে গেলে “বিদ্যালয়টিকে কোনও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত হতে হবে এবং সেখানে ভালো সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকতে হবে।”
ঘারাপুরীর বিদ্যালয়টির অবশ্য এই যোগ্যতা ছিল না। ঔচিতের সপ্তম শ্রেণির পাঠ শেষ হলে তারপর আর এই জেলা পরিষদ ইস্কুলে আর কোনও ছাত্র না থাকবে না। ফলে এপ্রিলেই এই ইস্কুলের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাবে।
অনুবাদ: চিলকা