বস্তির সরু গলিপথ ধরে, পাহাড়ের উপরে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা লাগিয়েছেন ভানু। মুখে বাঁধা আছে রুমাল আর হাতে কয়েকটি পলিথিন ব্যাগের ভিতর সহায়তা বাবদ পাওয়া আধকিলো চাল ও ডাল। উল্টোদিক থেকে কয়েকজনকে এদিকে আসতে দেখে, ভানু ঝট করে গলির কোণে একটি বাড়ির পিছনে লুকিয়ে পড়েন। পাহাড় থেকে নামতে থাকা মানুষগুলোর হাত-বোঝাই বস্তা ও ঝোলা। ফের হাঁটতে শুরু করার আগে আড়াল থেকে ভানুর চোখ পরিচিত মুখগুলিকে খানিক নিরীক্ষণ করে নেয়।
রাস্তায় একটি উদোম, সরু নালার উপর লাফ দিলেন ভানু। আশপাশের ১০×১০ বর্গ ফিটের কামরাগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি বন্ধ। তাদের অস্থায়ী দরজাগুলির ওপারে অস্বস্তিকর এক নৈঃশব্দ্য ছড়িয়ে রয়েছে যেন। কেউ কথা বলছে না, ঝগড়া করছে না, হাসছে না, মোবাইলে চিৎকার করে কারও সঙ্গে গল্প করছে না, গাঁক গাঁক আওয়াজ করে টিভি দেখছে না। নেই রান্নাবান্নার কোনও ম ম গন্ধও। উনোনগুলিও ঠান্ডা।
ভানুর ঘর পাহাড়ের অনেক উঁচুতে। ঘরে, তার বউ সরিতা উননের পাশে বসে শূন্য দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ছ’মাসের গর্ভবতী সরিতার হাত দুটি তার পেটের উপর। নয় বছরের রাহুল নিজের ছোট্ট খেলনা গাড়িটাকে সিমেন্টের মেঝেতে গোলগোল ঘুরিয়ে খেলছে আর অনবরত মায়ের কাছে খাবারের বায়না করছে।
“আম্মা, আমার খিদে পেয়েছে! সকাল থেকে কিছুই তো খাইনি। তুমি তো আমায় দুধ আর ক্রিম বিস্কুটও দাওনি, আম্মাআআ…”
সরিতা অজান্তেই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। “হ্যাঁ, সোনা,” নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, “জানি। আমি দেব তোকে কিছু না কিছু। তোর বাবা এই এল বলে…তোর জন্য অনেক কিছু আনবে। ততক্ষণ বরং বাইরে গিয়ে তুই একটু খেল।”
“আমার সঙ্গে খেলার মতো কেউ নেই যে,” রাহুল উত্তর দেয়। “আম্মা, ভিকি আর বান্টি কোথায় গেছে?”
“মনে হয় ওদের গ্রামে, গতবারের মতো। ফিরে আসবে ঠিক।”
“না আম্মা, স্কুলের বছরের মাঝে নয়। আমার তো মনে হয় না ওরা ফিরে আসবে। আমরা ইঞ্জিনিয়ার হতাম। স্কুল শেষ হলে, তিনজনে মিলে গ্যারেজ খুলে গাড়ি ঠিক করতাম। কিন্তু ওরা তো আর কোনওদিন স্কুলেই আসবে না!”
“তুই আর তোর গাড়ি! তুই একটা গ্যারেজ খুলবি…অনেক বড়ো! খুব বড়ো মানুষ কিনা তুই!” সরিতা ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে উনুনের পিছনের তিনটে তাক তন্ন তন্ন করে খোঁজেন। একটা তাকে কয়েকটা ফাঁকা বাসন, একটা কড়াই, একটা খুন্তি, চামচ, চারটে থালা, কিছু বাটি এবং ছোটো প্লেট – তাঁর রান্নাঘরের সরঞ্জাম বলতে সাকুল্যে এই। অন্য আরও দুটি তাকে নুন, চাল, ডাল, আটা, গম, মশলাপাতি, রান্নার তেল রাখার প্লাস্টিকের কৌটোগুলি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। রাহুলকে কিছু একটা দেবেন এমন ভাব করে যাবতীয় কৌটো এক এক করে খুলে কিছু খোঁজার ভান করতে থাকেন। একটির মধ্যে ক্রিম বিস্কিটের ফাঁকা একখানা মোড়ক পড়ে রয়েছে। হাতের মুঠোয় সেটিকে মুড়ে, রাহুলের দিকে ফিরতেই, সরিতা দরজার কাছে ভানুকে দেখতে পেলেন। মুখ থেকে রুমালটা খুলতে না খুলতেই, একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্ত দেহে উঠোনে বসে পড়েন তিনি। বাবাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে রাহুল ব্যাগগুলি নিয়ে আসতে দৌড় লাগায়।
“তুমি বাড়ি ফিরেছ?! রাহুল, বাবাকে জল দে, শিগগির।”
ভানুর মাথায় তখন ঠিকাদারের কথাগুলো হাজারবার পাক খেতে থাকে।
বাবা, জল…বাবা, এই নাও জল। একটাও বিস্কুট পাওনি না বাবা? পেয়েছ?” রাহুল পিতার কাঁধ ধরে ঝাঁকায়।
ভানু রাহুলের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে নিঃশব্দে জলটা খেয়ে নেন।
“ঠিকাদার একটা টাকাও দেয়নি আর বলেছে এক মাসের আগে নাকি কাজ শুরু হবে না।” সরিতার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন তিনি।
সরিতা হাতটি আবার নিজের বর্ধিত পেটের উপর বোলায় - ভিতরে বেড়ে ওঠা বাচ্চাটিকে সান্ত্বনা দিতে, নাকি নিজে খানিক সান্ত্বনা পেতে, ঠিক বোঝা যায় না।
“সরকার তো সব বন্ধ করে রেখেছে, রোগ ছড়াচ্ছে যে। ফের কবে কাজ শুরু হবে সরকার ছাড়া কেউ জানে না,” ভানু বলে চলেন।
“আজ দেড় মাস হল হাতে কোনও টাকাপয়সা নেই। চাল, ডাল - কিছুই আর বাকি নেই। আর কতদিন লোকের দয়ায় কাটবে?”
“তোমাদের এখানে নিয়ে আসা আমার উচিত হয়নি,” গলার স্বরে অপরাধবোধ চেপে রাখতে পারেন না ভানু। “তোমার এই অবস্থা…খাবার জোগাড় করে উঠতে পারছি না। এরকম আর ক’মাস চললে কি হবে?”
চিন্তায় ভানু হাত কচলান। এই নিয়ে দেড় মাস হল তাঁর পরিবার দিনে কেবল একটি বেলা খেয়ে কাটাচ্ছে - সামান্য ভাত ও ডাল, সেটিও লোকাল সংগঠনগুলির বদান্যতায়। এইসব শুরু হওয়ার আগে, তাঁরা শাক-সবজি, দুধ এবং মাঝে মধ্যে সামর্থ্য হলে, ফল, আপেল, কমলালেবু, আঙুরের মতো ফল মাঝেসাঝে কিনে খেতে পারতেন।
করোনা ভাইরাসের প্রকোপে সরকার যখন আচমকা সারা দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করে, তখন থেকে সমস্ত কাজকর্ম-কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। গত আট বছরে প্রথমবার ভানু এতদিন ধরে টানা কর্মহীন। আগে ইমারতিক্ষেত্রে মাসে ২৫ দিন কাজ করে, দৈনিক ৪০০ টাকা করে মজুরি পেতেন। তাতে তাঁর নিজের পরিবারের খরচ বাদেও খানিকটা উত্তরপ্রদেশে, নিজের গ্রামে বয়স্ক বাবা-মা কে পাঠানোর মতোও থাকত কিছু টেনেটুনে।
এই তরুণ স্বামী-স্ত্রীর কথাবার্তার সময়, ভানুর দুই বন্ধু - সূর্য আর অভয় তাঁদের দোরে এসে হাজির হলেন। আগে প্রতিদিন সকালে তাঁরা কাছাকাছি শ্রমিক নাকায় দাঁড়িয়ে সাধারণত কোনও না কোনও নির্মাণস্থলে কাজ পেয়ে যেতেন। সে সব অবশ্য লকডাউনের আগের কথা। এখন তাঁরা সবাই বেকার, কর্মহীন। সূর্য ভানুর হাতে চারটে কলা ধরিয়ে দেন।
অভয় সরিতাকে তাড়া দিয়ে বলেন, “কি করছ বৌদি? আগে কয়েকটা কলা খাও…কাল থেকে তো কিছুই খাওনি তুমি।”
সূর্য ভানুকে জিজ্ঞেস করেন, “ঠিকাদার তোর মজুরিটা দিল? কি বলল?”
“কি আর বলবে? কতদিন ধরে তো আমার ফোনই ধরছিল না। ওর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। এক ঘণ্টা পর দেখি সে কোথা থেকে এসে হাজির হল। দেখলাম হাতে খবরের কাগজে মোড়া একটা মদের বোতল। আমার থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকছিল ব্যাটা। আমি গত মাসের মজুরি চাইলাম…দু’সপ্তাহ কাজ করেছিলাম, সেই বাবদ। বলল ওর কাছে নাকি এখন টাকা নেই। এই একটা ৫০০ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলল ‘নিজের ব্যবস্থা করে নাও’।”
সূর্য বলে উঠলেন, “ওহ, মদ? বাহ্! খুব জরুরি জিনিস, ভাই।”
সরিতা অতিথিদের দিকে দু’গ্লাস জল বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “গাড়িঘোড়ার ব্যাপারে কিছু জানতে পারলেন, দাদা?”
“না বৌদি, কিচ্ছু না,” বললেন অভয়। “যেখানেই যাও, দেখবে মানুষজন হয় লাইনে দাঁড়িয়ে, নয় রাস্তায় বসে। আমরা চারটে রেল স্টেশন আর তিনটে বাস স্টপ অবধি হেঁটে হেঁটে গেলাম। কোনও ট্রেন বা বাসের দেখা পেলাম না কোত্থাও।”
“কিন্তু আমরা যে ফর্ম জমা দিলাম, টেস্ট করালাম…তার কিছু হল?”
“মোবাইলে চেক করলাম। দেখাচ্ছে ক্যানসেল্ড। জিজ্ঞেস করার জন্য যখন স্টেশনে গেলাম, পুলিশে তাড়া করে ভাগিয়ে দিল আমাদের,” সূর্য জবাব দিলেন।
“নিচের কামরার গীতাবৌদি আর ওর পরিবার গতকাল কারও নিজের গাড়িতে করে গ্রামে ফেরত গেল। শুনলাম সেই লোকটা নাকি এক একজনের জন্য ৩-৪০০০ করে নিয়েছে,” সরিতা জানালেন তাঁদের।
“ব্যাঙ্কে কেবল ১০,০০০ এর মতো পড়ে রয়েছে আর এখন হাতে এই ৫০০…” ভানু বলে ওঠেন, “শুনলাম অনেকে নাকি হেঁটে হেঁটেও বাড়ি যাচ্ছে…”
সূর্য উত্তেজিত হয়ে ভানুর সোজাসুজি একটি বন্ধ কামরার চৌকাঠের ওপরেই বসে পড়েন। “আমি তো কিছু বুঝতেই পারছি না। বাড়িওয়ালা বারবার ফোন করে দু’মাসের ভাড়া চাইছে…কেমন করে দেব?” অভয় দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। সরিতা ভানুর পিছনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। অভয় বলে ওঠেন, “সব জায়গায় এই এক অবস্থা, সবারই এক গল্প…আমাদের শ্রমিকদের…দু’মাস ধরে ঘরে একটা পয়সা পাঠাতে পারিনি। এমনকি বাবার ওষুধের টাকাটাও না…।” অভয়ের বাবার ফুসফুসের রোগ। ওঁর ছোটো বোন দশ ক্লাসের ছাত্রী। খানিকক্ষণ চিন্তার জগতে হারিয়ে গেলেন যেন। সম্বিৎ ফিরলে, বাচ্চাটির সঙ্গে গল্প করতে শুরু করেন, “এই রাহুল, কি করছিস রে তুই?”
“আমি অডি চালাচ্ছি, কাকু।”
সূর্য খানিক মজা করেই জিজ্ঞেস করে, “অডি…তোর অডি কি আমাদের প্রদেশ নিয়ে যাবে…?”
“হ্যাঁ, কেন পারবে না! আমার গাড়ি সবখানে সবাইকে নিয়ে যেতে পারে। জুমসসরুমসসরুমসসরুমসসরুমসসসস…” মুখে জুম জুম আওয়াজ করতে করতে, বাবাকে পাশ কাটিয়ে রাহুল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে সরু গলির মধ্যে খেলনা গাড়িটা জোরে চালাতে লাগল। সরিতা, ভানু, সূর্য আর অভয় শিশুটিকে মনের আনন্দে খেলতে দেখতে থাকেন।
সূর্য বেশ জোর দিয়ে বলে উঠলেন, “চল বৌদি, আমরা সবাই মিলে ঘরে ফিরে যাই।”
তারপর প্রায় সারাটা রাত ধরে তাঁরা বাসন আর কাপড় গোছগাছ করেন। পরদিন কাকভোরে, সূর্য ওঠার আগেই হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে পড়েন সেই পথের পানে যা হয়তো তাঁদের শহরে পৌঁছে দেবে।
*****
পরিবার শহর থেকে আন্দাজ ৫০ কিলোমিটার দূরে, হাইওয়ের ধারে, ঘাসে ঢাকা একটি খোলা মাঠের মধ্যে ঘুম ভাঙে পিথ্যা আর তাঁর পরিবারের। ভোর চারটে। ঘাসের উপর পেতে রাখা হাতে সেলাই করা কম্বলগুলো ভাঁজ করে তাঁরা ফের হাঁটতে শুরু করেন। গতকাল বুদ্রুজ গ্রামের ইটভাটা থেকে হাঁটা শুরু করেন তাঁরা। গারদেপাড়ায় তাঁদের ঘরখানা এখনও আন্দাজ ১৫০ কিলোমিটার দূরে… ইটভাটায় তাঁরা কাজের সন্ধানে এসেছিলেন।
পিথ্যার মাথায় একটি ওজনদার বস্তার ভিতর জোয়ার আর চাল এবং হাতের ঝোলাটিতে কিছু বাসন-কোসন। খানিক পিছনেই তাঁর স্ত্রী জুলা মাথায় করে একটি বিশাল বড়ো কম্বল-বোঝাই কাপড়ের ঝোলা বইছেন। মায়ের বুকের কাছে কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা আট মাসের ছোট্ট সুরক্ষিত নন্দু এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। বাচ্চাটির ধুলোমাখা মুখটায় চোখের জলের শুকনো দাগ স্পষ্ট। তেরো বছরের কল্পনা মাথায় করে একটি কাপড়ের ঝোলা বইছে এবং ছয় বছরের গীতা তার দিদির ফ্রকের কোনা ধরে মায়ের পিছন পিছন হাঁটছে।
পিছনে না তাকিয়েই জুলা তাদের বলেন, “এই মেয়েরা, সাবধানে হাঁটিস।”
পিথ্যা সামনে থেকে বলে ওঠেন, “ওদেরকে আমাদের মাঝে হাঁটতে বল। পিছনে না। তাহলে নজর রাখতে পারব।”
কল্পনা আর গীতা পিথ্যা এবং জুলার মাঝে হাঁটা শুরু করে। কয়েক ঘণ্টা পরেই, সূর্য মাথার উপর উঠতেই, গরম বাড়তে থাকে প্রবলভাবে। ক্ষয়ে যাওয়া চটিগুলো থেকে বেরিয়ে আসা ওদের গোড়ালি আর আঙুলগুলো তপ্ত মাটির স্পর্শে জ্বলেপুড়ে ওঠে। জুলার বুক ধড়ফড় করে ওঠে, শ্বাসকষ্ট হতে থাকে।
“হুম…হুম…শোনো। কিছুক্ষণ দাঁড়াই। আর হাঁটতে পারছি না। খুব তেষ্টাও পেয়েছে।”
“সামনে একটা গ্রাম পড়বে। সেখানেই দাঁড়াই,” পিথ্যা বলে ওঠেন।
সম্মুখে একটা পিপল গাছ দেখতে পান তাঁরা। গাছের ডালে ঝোলানো বোর্ডের নির্দেশ বলছে বাঁদিকের কাঁচা রাস্তাটি গেছে আদর্শওয়াড়ি গ্রামের দিকে। পিথ্যা নিজের বোঝাগুলি গাছের বেদিতে নামিয়ে রাখেন। জুলা কল্পনার সঙ্গে হাঁপাতে হাঁপাতে নিজেদের জিনিসপত্র নামাতে থাকেন। গাছের ছায়ায় খানিক স্বস্তি পান তাঁরা। নন্দুকে বুকের কাছে বেঁধে রাখার কাপড়টি খুলে ফেলেন জুলা। তারপর ওকে কোলে শুইয়ে, শাড়ির প্রান্ত দিয়ে ঢেকে দুধ খাওয়াতে শুরু করেন।
তপ্ত শরীরটা খানিক ঠান্ডা হলে, পিথ্যা ঝোলাগুলির মধ্যে একটা থেকে তিনটে প্লাস্টিকের বোতল বের করে আনেন। “তোমরা এখানেই দাঁড়াও। আমি জল নিয়ে আসছি।”
কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে খানিক এগোলে, কাঁটা ঝোপের একটি ব্যারিকেড নজরে পড়ে পিথ্যার। ব্যারিকেডের উপরে বসানো বোর্ডে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা: গ্রামকে করোনাভাইরাসের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য, বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
“নিষিদ্ধ? করোনা…” পিথ্যা ধীরে ধীরে লেখাটা পড়েন। তারপর জোরে হাঁক পেড়ে অদৃশ্য কাউকে লক্ষ্য করে ডেকে ওঠেন।
“কেউ আছেন? ভাই…বোন…কেউ আছেন? আমাদের একটু জল চাই। কেউ আছেন এখানে?”
অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকির পরেও কোনও সাড়া না পেয়ে পিথ্যা চূড়ান্ত হতাশ হয়ে পড়েন। স্বামীকে ফেরত আসতে দেখে জুলার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
“কই, জল কোথায়?”
“রাস্তাটা বন্ধ। গ্রামের লোকদেরও ডাকার চেষ্টা করলাম। কেউ এল না। এখানেও নাকি রোগ ছড়িয়েছে। দেখি সামনে কি পাই। কিছু একটা খুঁজে নেব।”
জুলা আশাবাদী। “সামনে কোনও ফাঁকা জমি পেলে, চুলা জ্বালাব।”
গীতা কাতর গলায় বলে ওঠে, “বাবা, আমার খুব খিদে পেয়েছে।”
বাবা ওকে সান্ত্বনা দিতে বলেন, “গীতু, আয়, আমার পিঠে বোস। আমাদের বল তো উপর থেকে কি দেখতে পাস।”
গীতা বাবার মাথাটি ধরে কাঁধে চেপে বসে। পিথ্যার এক হাতে চাল আর ময়দার বস্তা এবং আরেকটিতে ভর্তি বাসনপত্র। এভাবে দু-তিন কিলোমিটার হাঁটার পর, রাস্তার ধারে একটি টিনের কুঁড়েঘর চোখে পড়ে। জুলা কাউকে একটা দেখতে পান।
“শোনো! ওখানে কেউ একজন মাটিতে পড়ে গেছে।”
পিথ্যা খুব সন্তর্পণে দেখে বলে ওঠেন, “মনে হয় ঘুমোচ্ছে।”
“কে অমন করে মাটিতে শুয়ে থাকে? একবার দেখ। আমার মনে হয় জ্ঞান নেই।”
কুঁড়েঘরটির একটু কাছে গিয়ে পিথ্যা হাতের বস্তাগুলো মাটিতে রেখে, গীতাকে কাঁধ থেকে নামান। সত্যিই একজন বৃদ্ধা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রয়েছেন ওইখানে।
“জুলা, এদিকে এস দেখি।”
জুলা তৎক্ষণাৎ কুঁড়েঘরটির দিকে দৌড়ে যান, পিছনে কল্পনা। সবাই মিলে বৃদ্ধার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করেন। জুলা কল্পনাকে ঘরের ভিতর থেকে জল আনতে পাঠান।
“ও বুড়ি মা,” বৃদ্ধার মুখে জলের ঝাপটা দিতে দিতে ডেকে ওঠেন পিথ্যা।
তারপর ওঁকে তুলে একটি খাটিয়ায় শুইয়ে দিয়ে নন্দুকে কোলে নিয়ে ঘাসের উপর বসেন পিথ্যা।
আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে জুলা কয়েকটি পাথর আর শুকনো ডালপালা জোগাড় করে, ঘরের বাইরে রান্নার আগুন জ্বালিয়ে ফেলেন। ঠিক তক্ষুনি, বৃদ্ধা নড়েচড়ে জেগে ওঠেন।
পিথ্যা বলেন, “উঠে পড়েছ, বুড়ি মা? তোমার পেটে যে খুব আওয়াজ হচ্ছে। জলটল বা খাবার কিছুই খাওনি, নাকি?”
“আমি বুড়ি নই! আমার নাম লক্ষ্মীবাই। আর তোমরা না বলে অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়লে কেমনভাবে? লজ্জা শরম নেই, নাকি?”
কল্পনা তাঁর হাতের মধ্যে একটি ভাখরি আর তিলের চাটনি দিয়ে হেসে বলে, “এটা নাও ঠাকুমা, খাও।”
গরম গরম ভাখরি পেয়ে বৃদ্ধা রাগ ভুলে যান। একটা খাওয়া শেষ হলে জুলা আরেকটা ভাখরি দেন তাঁকে। লক্ষ্মীবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসেন।
“তোমরা এবার কোনদিকে যাবে?”
“আমরা ইটভাটার দিকে গেছিলাম। তবে অর্ধেক রাস্তা গিয়ে ফিরে আসতে হল।”
“হুম…শুনছি কোনও রোগ ছড়িয়েছে ওখানে। গ্রামের লোকেরা আমায় ঢুকতে দেয় না ভিতরে। এখন ভিক্ষে করেই বেঁচে আছি। চারদিন পর এই একটা ভাখরি দাঁতে কাটতে পারলাম।” কেটে খেতেই কথাবার্তা চলতে থাকে। লক্ষ্মীবাইকে বিদায় জানানোর আগে জুলা একটা কাপড়ে পাঁচখানা ভাকরি মুড়ে নিলেন। পিথ্যা জলের বোতলগুলো ভরে রওনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হন।
লক্ষ্মীবাই খাটিয়ায় বসেই তাঁদের দিকে হাত নেড়ে বলে ওঠেন, “সাবধানে যাস তোরা বাছা,” আর তারপর অনেকক্ষণ ওদের যাওয়া দেখতে থাকেন। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে, টিনের ঘরটিতে ঢুকে মাটির কলসি থেকে জল গড়িয়ে খেতে খেতে হঠাৎ কলসির পাশে একটি প্লাস্টিক ব্যাগে মোড়া জোয়ার আর তিলের চাটনি চোখে পড়ে তাঁর। বৃদ্ধা সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে ঘরের বাইরে এসে দেখেন ওঁরা ততক্ষণে চলে গেছেন।
প্রায় দশ কিলোমিটার হাঁটার পর রাস্তায় কিছু থেতলে যাওয়া বেগুন আর টমেটো নজরে পড়ে ওঁদের। কোনও চাষি হয়তো ফেলে দিয়ে থাকবেন। “এগুলো এখনই পচে যেতে শুরু করেছে। কীভাবে শহরে পাঠাব এসব? কতটাই বা খেতে পারব আমরা? ফেলেই দাও,” পিথ্যা যেন সেই চাষির কথাগুলো শুনতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে, গত বছর অসময়ের বৃষ্টিতে ফসল কাটার মরসুমে ক্ষতিগ্রস্ত ধান জমিগুলোর কথা মনে পড়ে যায় তাঁর।
“জুলে, দেখ কেমন একজন চাষাকে নিজের জীবন দিয়েই ক্ষতিপূরণ করতে হয়,” পিথ্যা বলে ওঠেন, “সে বৃষ্টিই হোক বা কোনও রোগ।”
ঘরে পৌঁছানোর আশায়, তাঁরা চলতে থাকেন নিরন্তর, খানিক দিকশূন্য হয়েই। হঠাৎ, সামনে একটা জটলা দেখা যায়। কতিপয় খাকি উর্দিধারী পুলিশ হলদে রঙের প্লাস্টিকের ব্যারিকেডগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে, কাঠের ব্যাটন দিয়ে মানুষজনকে পিছনে ঠেলছে। কেউ কেউ অনুরোধ করছেন এবং প্রায় সকলেই রাস্তায় বসে পড়েছেন - মহিলা, বাচ্চা, পুরুষ, প্রত্যেকে। বাচ্চাদের নিয়ে পিথ্যা আর জুলা ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে যান।
*****
“ও সাহেব, আমাদের যেতে দিন। সকাল থেকে হাঁটছি। কিচ্ছুটি খাওয়া হয়নি,” এক পুলিশের কাছে মিনতি করেন সূর্য।
“তো? আমি হাঁটতে বলেছিলাম? উপর মহল থেকে অর্ডার এসেছে। কেউ বর্ডার পেরোতে পারবে না। এই পিছনে যাও। দয়া করে পিছনে যাও, ভাই।”
“আমরা যাব কোথায় সাহেব? এই দেখুন, আপনার লোকেরা আমার পায়ে মেরেছে। কোনো স্প্রে থাকলে দিন না। বড়ো ব্যথা করে যে!”
“আমাদের লোকেরা? দূর হ এখান থেকে। ভাগ।” পুলিশটি হাতের লাঠিটা উচুঁ করে। নিজের মাথাটা কোনওরকমে চাপা দিয়ে, পিছিয়ে আসেন সূর্য। ওদিকে, ভানু, সরিতা আর ছোট্ট রাহুল গাছের নিচে বসে, অভয় গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে।
“বলেছিলাম ওদিকে না যেতে,” অভয় সূর্যকে ধমক দেয়। “তুই তো আমার কোনও কথাই শুনিস না! আবার মার খেতে চাস নাকি?”
“ভাই, আমরা এখানে দেড় ঘণ্টা ধরে বসে রয়েছি। আমি মার খাই, লাথি খাই, কিন্তু ঘরে যেতে চাই।”
“ঘর! এই ক’বছরে আমরা কতগুলো বড়োলোকের ঘর আর কতগুলো বিল্ডিং বানিয়েছি? আজ সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে সেগুলো কি আমাদের চোখে পড়েনি?”
“একজনও কেউ জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ধন্যবাদটুকুও জানায়নি আমাদের,” বাঁকা হাসি হেসে বলে ওঠেন সূর্য।
“ওরা নিশ্চয়ই ওদের জানলা দিয়ে রাস্তায় মানুষের লম্বা লাইন দেখতে পেয়েছে। অবশ্যই দেখেছে!” ইতিমধ্যে, ভানুকে মাঝপথে থামিয়ে পিথ্যা এগিয়ে এসে জানতে চান, “ভাই, এখানে পুলিশ কেন রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে?”
সূর্য হিন্দিতে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি মারাঠি জানো না?”
পিথ্যা নিজের ভাষাতেই বলে চলেন, “ভাই, আমরা আমাদের গ্রামে ফিরতে চাই। ইটভাটায় কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তায় কোনও গাড়িঘোড়া নেই, তাই হাঁটছি।”
সূর্য এবং তাঁর সঙ্গীসাথীরা পিথ্যার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকেন। অভয় এগিয়ে এসে তাঁকে বোঝাতে উদ্যত হন, “আমি তোমার কথার মধ্যে কেবল ‘রাস্তা’ শব্দটা ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারিনি। রাস্তা তো এখন বন্ধ।”
“আমার বাবা যা বলছে আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি তোমাদের,” স্কুলে শেখা হিন্দির জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কল্পনা বলে ওঠে। “আমাদের গ্রামে ফিরতে হবে আর বাবা জানতে চাইছে এখানে এত পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন।”
সূর্য হেসে বলে ওঠে, “বাহ্! আমরা তো তোমার বাবার বলা মারাঠি কিছুই বুঝিনি। শহরের লোকেদের মুখের মারাঠি থেকে এ অনেক আলাদা।”
কল্পনা জবাব দেয়, “রাজ্যের প্রতিটা জেলা-গ্রাম-শহরে মারাঠি বলার ধরন আলাদা।”
ভানু, যিনি কিনা হাতে গোনা ক’টি মারাঠি শব্দের সঙ্গে পরিচিত, পিথ্যাকে বসতে ইশারা করে সূর্যর দিকে ফিরে বলে ওঠেন, “তুই কি এখন ভাষা শিখতে বসবি নাকি?” তারপর কল্পনার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন, “তোমার তো খুব বুদ্ধি!”
ভাষার চৌহদ্দি পেরিয়ে সবাই অনেকক্ষণ পরস্পরের সঙ্গে গল্পগাছা করে সময় কাটান। হঠাৎ, ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা শোরগোল শোনা গেল।
“আর কতক্ষণ এখানে বসে থাকব?” একজন বলে ওঠেন। “চল সবাই কাঁচা রাস্তা ধরে রেললাইনের দিকে এগিয়ে যাই। এরা যখন আমাদের হাঁটতেই বাধ্য করেছে, তখন নিশ্চয় কোনও ট্রেনও চালাবে না। চল সবাই, চল।”
সকলেই ধুলোভরা রাস্তার দিকে হাঁটা লাগান। তাঁদের পিছু নেয় ওই দুটি পরিবারও। অন্ধকার নামা অবধি সবাই হাঁটতে থাকেন নিরন্তর। পিথ্যা আর বাকি সকলে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেন। এবার রেললাইন ধরে হাঁটা লাগানোর পালা। আহত পা’টা নিয়ে সূর্য ধুঁকতে ধুঁকতে পিছনে পড়ে যায়। কল্পনা আর গীতা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে।
ভানু পিথ্যাকে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে বলেন। “আমরা একটু দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। চলো, ওরা না আসা অবধি এখানটায় বসি।”
সরিতা ভানুকে খানিক জিরিয়ে নিতে বলেন। “এখন তো রাতও হয়ে গেছে আর এদিকে রাহুল খিদে আর ঘুমে কাহিল।”
জুলা ভাখরির ঝোলাটা খুলতে শুরু করেন। বাকি সকলে রেললাইনে গা এলিয়ে পা টানটান করে বসে বলে ওঠেন, “চল একটু খেয়ে নেওয়া যাক।”
অভয় বলেন, “বাচ্চাগুলো আর সূর্যর জন্য একটু দাঁড়িয়ে যাই। তারপর না হয় সবাই মিলে খাওয়া যাবে।”
অপেক্ষা করতে করতে ঘুমে ওদের দু’চোখের পাতা লেগে আসে। পিথ্যা মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুম কাটানোর চেষ্টা করেন বটে, তবে শেষমেষ লাইনের উপরেই ঘুমিয়ে পড়েন। বাকিরাও ততক্ষণে হয় ঝিমোচ্ছেন, নয়তো ইতিমধ্যেই অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
ট্রেনের তীব্র হর্ন হয়তো তাঁদের কারও বিধ্বস্ত কানগুলি ভেদ করে উঠতে পারে না। এমনকি দূরন্ত বেগে ধেয়ে আসা ট্রেনের ইঞ্জিনের চড়া আলোও তাঁদের নিদ্রায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে না; পারে না ঘুমন্ত মানুষগুলোর ঘরে ফেরার স্বপ্ন ভেঙে দিতে।
অলংকরণ শিল্পী:
বেঙ্গালুরুর সৃষ্টি ইন্সটিটিউট অফ আর্ট, ডিজাইন অ্যান্ড টেকনোলজির স্নাতক অন্তরা রামন একজন অঙ্কনশিল্পী এবং ওয়েবসাইট ডিজাইনার। সামাজিক প্রকরণ ও পৌরাণিকীতে উৎসাহী অন্তরা বিশ্বাস করেন যে শিল্প ও দৃশ্যকল্পের দুনিয়া আদতে মিথোজীবী।
অনুবাদ: অধ্যেতা মিশ্র