আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো পদ্মাবাই গাজারে নিজের জমি হারিয়ে বসবেন। “এই জমিটা না থাকলে, ভগবান জানেন আমরা কিভাবে বেঁচে থাকতাম,” জানান তিনি।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় স্বামী পান্ধারীনাথকে (৪০) হারিয়ে গত আট বছর ধরে পদ্মাবাই দিনরাত পরিশ্রম করে নিজের পরিবারকে আর্থিক অনটনের মধ্যে থেকে বের করে খানিক স্থিতিশীল করেছেন। পান্ধারীনাথ রেখে গেছেন দুই ছেলে, দুই মেয়ে, তাঁর মা এবং একটি ৬.৫ একর চাষজমি।
“আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম আর একলাও ছিলাম,” ঔরঙ্গাবাদের বাইজাপুর তালুকার অন্তর্গত হাদাস পিম্পালগাঁও গ্রামে নিজের পরিবারের দু-কামরার বাড়িতে বসে জানান তিনি। “আমার বাচ্চারা তখন ছোটো। আমায় এমন সব দায়িত্ব নিতে হয় যার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। রান্নাঘর সামলাতে সামলাতে খেতেরও দেখাশোনা করতে শুরু করি। এমনকি এখনও, খেতে আমি ঠিক ততটাই কাজ করি।”
তবে এখন ৪০ বছরের গাজারেকে হয়তো বাধ্য হয়েই তাঁর জমি ছেড়ে দিতে হবে। রাজ্য সরকার এখন তা সমৃদ্ধি মহামার্গের জন্য নিজের কব্জায় আনতে উদ্যত। মহারাষ্ট্র সমৃদ্ধি মহামার্গের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এই সড়ক নাকি রাজ্যের ১০টি জেলার ২৬টি তালুকের অন্তর্গত ৩৯২টি গ্রামকে ‘জুড়তে’ সক্ষম হবে। এর মধ্যে ৬৩টি গ্রাম মারাঠওয়াড়ার কৃষিক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত, প্রধানত ঔরঙ্গাবাদ এবং জালনা জেলার অংশ।
এই ‘সমৃদ্ধি’ মহামার্গ নির্মাণের জন্য সরকারের চাই ৯৯০০ হেক্টর (প্রায় ২৪,২৫০ একর), জানাচ্ছে মহামার্গের ওয়েবসাইট। এরই মধ্যে অন্তর্ভুক্ত পদ্মাবাইয়ের ৬ একরের খেত, যেখানে তিনি তুলো, বাজরা এবং মুগ চাষ করে থাকেন। যদি জমি দিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়, এই পরিবারটির কাছে পড়ে থাকবে কেবল আধ একর। যতবার এই যোজনার কথা শোনেন, পদ্মাবাই শিউড়ে ওঠেন। “যদি আমার জমি ছিনিয়ে নেয়, আমি আত্মহত্যা করব,” জানান তিনি। “এই জমি আমার কাছে নিজের বাচ্চার মতো।”
এই বছরের মার্চে, মহারাষ্ট্র রাজ্য সড়ক বিকাশ নিগম লিমিটেডের তরফ থেকে পদ্মাবাইয়ের জমির মূল্যায়ন করা হয় - প্রতি একর পিছু ১৩ লক্ষ টাকা অথবা ৬ একরের ৭৮ লক্ষ। শুনে আকর্ষণীয় মনে হলেও, তাঁর কাছে টাকাটা গৌণ। “আমার দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি (এখন ২৫ এবং ২২), ছেলেদের লেখাপড়া শিখিয়েছি, শাশুড়ির দেখাশোনা করেছি, বাড়িটা ফের একবার তৈরি করেছি - সমস্তটাই এই জমিতে কাজ করে,” সরোষে বলেন তিনি। “এটাই আমাদের পরিবারকে একজোট করে রেখেছে। জমিটাই যদি চলে যায়, আমার ভরসা করার মতো আর কি থাকবে? আমাদের খেতটাই আমাদের পরিচয়।”
পদ্মাবাইয়ের ছোটো ছেলের বয়স ১৮, বর্তমানে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছে এবং বড়ো ছেলের বয়স ২০। দুজনেই এই পারিবারিক জমিতে কাজ করে। “আমরা সবাই জানি আজকের দিনে একটা চাকরি পাওয়া কত কঠিন,” বলেন পদ্মাবাই। “চাকরি না পেলে ওদেরকে দিনমজুরি অথবা শহরে চৌকিদারির কাজ করতে হবে। নিজেদের জমি থাকলে নির্ভর করার মতো একটা জায়গা থাকে।”
প্রায় ১২৫০ জনসংখ্যা বিশিষ্ট হাদাস পিম্পালগাঁও গ্রামে গাজারেদের জমিটি মুম্বই-নাগপুর মহাসড়কের থেকে বেশি দূরে অবস্থিত নয়। তবে, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফাডনাভিস এই নতুন মহাসড়কের প্রচার করছেন এমন এক প্রকল্প হিসেবে যা নাকি রাজ্যের ভাগ্য বদলে ফেলবে। ১২০ মিটার প্রস্থে এবং ৭০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই আট লেনের এক্সপ্রেসওয়ে, মুখ্যমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী, জাহাজবন্দর, বিমানবন্দর এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রগুলিতে দ্রুত কৃষিজাত দ্রব্য পৌঁছে দিয়ে অর্থনীতিতে উন্নতি আনবে। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ৪৬,০০০ কোটি হতে চলেছে।
তবে কেন মারাঠওয়াড়ার চাষিরা ভালো দামে নিজেদের জমি বিক্রি করতে নারাজ, যখন এই অঞ্চলে চাষাবাদ উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে উঠছে?
এই ৯৯০০ হেক্টর জমির মধ্যে ১০০০ হেক্টর আগে থেকেই রাজ্য সরকারের আয়ত্তাধীন, যার মধ্যে বন বিভাগের জমিও অন্তর্ভুক্ত আছে বলে সংবাদদাতাকে জানালেন এমএসআরডিসি’র যুগ্ম অধিকর্তা কে. ভি কুরুন্ডকার। বাকিটা অধিগ্রহণ করতে হবে। “আমরা কেবল ২৭০০ হেক্টরের সম্মতি পেয়েছি এবং ৯৮৩ হেক্টর অধিগ্রহণ করেছি,” কুরুন্ডকার জানান। “জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া এখনও চলছে। যেসব গ্রামে প্রতিরোধ হচ্ছে, আমরা সেখানে চাষিদের সঙ্গে কথা বলে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি।”
তবে কেন মারাঠওয়াড়ার চাষিরা ভালো দামে নিজেদের জমি বিক্রি করতে নারাজ, তাও এমন এক সময়ে যখন প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ব্যবস্থার (ফর্মাল ক্রেডিট সিস্টেম) অভাব, খামখেয়ালি জলবায়ু এবং খাদ্যশস্য থেকে পড়তি উপার্জনের কারণে এই অঞ্চলে চাষাবাদ উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে উঠছে? পরিস্থিতি এতটাই সঙ্কটজনক যে এই কারণে শত শত চাষিকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়েছে এবং আরও হাজার হাজার চাষিকে দেনায় তলিয়ে যেতে হয়েছে।
এর একটি কারণ পদ্মাবাই উল্লেখ করলেন, জমির মূল্য অর্থের নিরিখে পরিমাপ করা যায় না। আরেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা। দেনায় জর্জরিত এমন বহু চাষি হয়তো তাঁদের জমি বিক্রি করতে সম্মত হতেন, তবে সরকারের তরফ থেকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি যে আদৌ পূর্ণ হবে, এমন ভরসা তাঁরা কেউই করেন না।
কাকাসাহেব নিঘোটে, আরেকজন হাদাস পিম্পলগাঁও নিবাসী বলেন, “যে কোনও সরকারের ট্র্যাক রেকর্ড দেখুন। তাতে কি ভরসা জাগে? ওরা চাষিদের পরোয়াই করে না। দেশে এরকম অগুন্তি উদাহরণ পাবেন যেখানে চাষি এবং আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহণের আগে প্রচুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। অথচ শেষপর্যন্ত ওরাই অত্যাচারিত হয়।”
৪০ বছরের নিঘোটে তাঁর ১২ একর হারাতে চলেছেন এই মহাসড়কের দৌলতে। উনি আমাদের ৩ মার্চে এমএসআরডিসি-র তরফ থেকে গ্রামে পাঠানো নির্দেশিকাটি দেখালেন। তাঁর কথায়, “সরকার বলছে চাষিদের সম্মতি ছাড়া ওরা কিছুই করবে না। তবে নোটিসে বলা আছে যদি আপনি অথবা আপনাদের কোনও প্রতিনিধি উক্ত দিনে উপস্থিত না থাকেন, তবে ধরে নেওয়া হবে যে আপনার আর জমির যৌথ গণনার কোনও প্রয়োজন নেই। আমাদের তো নিজেদের অভিযোগগুলো লেখার জন্য একটি সাধারণ ফর্ম পেতেও লড়াই করতে হয়েছে [কালেক্টরের অফিসে]।”
হাদাস পিম্পলগাঁও থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটারের দূরত্বে, পুরোনো মুম্বই-নাগপুর মহাসড়কের সমান্তরালে অবস্থিত ঔরঙ্গাবাদ-নাসিক মহাসড়ক লাগোয়া মালিওয়াড়া গ্রামের অন্তর্গত গঙ্গাপুর তালুকের চাষিরাও এখন বিপদে। প্রায় ৪৪০০ জনসংখ্যা বিশিষ্ট এই গ্রামের অধিকাংশ চাষিই পেয়ারা, সবেদা এবং আঞ্জির জাতীয় ফল চাষ করে থাকেন।
এঁদের চাষজমিগুলি একেবারে ঔরঙ্গাবাদ এবং গঙ্গাপুরের বর্ডার লাগোয়া। মালিওয়াড়ার ভিতর দিয়ে যাওয়া একটি ১০ ফিট চওড়া ধুলোময় রাস্তা দুটি তালুককে আলাদা করছে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে যখন এমএসআরডিসি জমিগুলির মূল্যায়ন করে, তখন ঔরঙ্গাবাদ শহরের কাছাকাছি অবস্থিত গ্রামগুলি বেশি মূল্যবান বলে নির্ধারিত হয়। শহর থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটারের দূরত্বে অবস্থিত মালিওয়াড়া, অথচ, ঔরঙ্গাবাদ তালুকের অন্তর্গত না হওয়ায় চাষিরা জানান, তাঁদের প্রতি একর পিছু ১২ লক্ষ টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অথচ মাত্র ১০ ফিট দূরে যাদের জমি, সেই চাষিদের একর পিছু ৫৬ লক্ষ টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
মালিওয়াড়ার ৩৪ বছরের বালাসাহেব হেকড়ে, যাঁর ৪.৫ একরের বাগান খোয়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে, জানালেন, “এই [মূল্যায়নের] কোনও মানে নেই। আমি জাফরান, পেয়ারা আর আম চাষ করি। আমার বার্ষিক লাভই ওদের প্রস্তাবিত দামের কাছকাছি (১২ লক্ষ টাকা)। যত দামেরই প্রস্তাব দেওয়া হোক না কেন, তা দিয়ে কতদিনই বা চলবে?”
হেকড়ে জানাচ্ছেন মারাঠওয়াড়ার বহু অঞ্চলের চাষিরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ে রইলেও, মালিওয়াড়ার মতো গ্রামাঞ্চলে ফলের বাগানের মালিকদের আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল। কাছেই কেসাপুরী বাঁধ, জমিও এখানে উর্বর। “জমি উর্বর হলে আর টাকা ভালো পেলে কেউ কেন তার জমি বিক্রি করবে?” জিজ্ঞেস করেন তিনি। “এর জন্য প্রথমে অনেকটা বিনিয়োগ প্রয়োজন। আমার বাবা ১৫ বছর ব্যয় করেছেন এই বাগানটি তৈরি করতে। যদি ওরা আমাদের আরেকটা জমি দিয়েও ক্ষতিপূরণ করে, সেখানে এরকম একটা বাগান তৈরি করতে আরও ১৫ বছর লেগে যাবে। আর সেই নতুন জমি উর্বর হবে কিনা তা জানবই বা কেমন করে?”
“চাষিরা তাঁদের উর্বর জমি বিক্রি করতে চান না,” একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন রাজু দেসলে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী) কৃষক অধিকার কর্মী এবং এই প্রকল্পের বিরোধী সমৃদ্ধি মহামার্গ শেতকরি সংঘর্ষ সমিতির এক সদস্য। তাছাড়াও, চুক্তির এই তারতম্য চাষিদের মধ্যে আরও অসন্তোষ সৃষ্টি করছে। দেসলে জানাচ্ছেন, “কমপক্ষে ১০,০০০ চাষি স্থানচ্যুত হবেন [সারা রাজ্য জুড়ে]। এক-প্রকল্প-এক-মূল্য হিসেবে ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত ছিল। অথচ কিছু কিছু চাষি অনেক সুবিধে পাচ্ছেন আর বাকিরা পাচ্ছেন ন্যূনতম।”
তবে, এমএসআরডিসি-র কুরুন্ডকার অবশ্য জমির মূল্যায়নকে সঠিক বলেই দাবি করেন। তিনি মনে করেন সব জমির এক মূল্য নির্ধারণ করলে তা সেইসব চাষিদের প্রতি অন্যায় হবে যাঁদের জমি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে বয়েছে। তাঁর কথায়, “এই অসমতা তখনই দূর হয় যখন চাষিরা তাঁদের জমির মূল্যের চার গুণ বেশি দর পাবেন। যেসব চাষিরা তাঁদের জমি আমাদের কাছে বিক্রি করেছেন, তাঁরা সন্তুষ্ট। আমরা তাঁদের বাজার মূল্যের চার গুণ বেশি টাকা দিয়েছি এবং তাঁরা অন্য জমি কিনেও নিয়েছেন। এখন তাঁদের কাছে জমি এবং ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স দুটোই রয়েছে।”
তবে থেকে মালিওয়াড়া ‘গাঁওবন্দি’ নামক এক প্রস্তাব পাশ করেছে যা এক অর্থে এমএসআরডিসি’র কর্মকর্তাদের গ্রামে প্রবেশ ঘিরে নিষেধাজ্ঞা। মারাঠওয়াড়ার এমন বহু গ্রামের মধ্যে এখানেও এই বছর বাড়ির সামনে কালো লণ্ঠন বসিয়ে ‘কালো দীপাবলি’ পালন করা হয়েছে। দেসলে জানান, নাসিক জেলার ১৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত জমি বিক্রির বিরোধিতা করে একটি প্রস্তাব পাশ করেছে।
এতএব, হেকড়ের সাফ কথা, এই অবাঞ্ছিত নতুন হাইওয়েটি না বানিয়ে “রাস্তার খানাখন্দ মেরামতের পিছনে সরকার নজর দিলে পারে।”
অনুবাদ: অধ্যেতা মিশ্র