“লাই দে ভে জুত্তি ম্যানু
মুক্তসারি কডাই ওয়ালি,
প্যারন ভিচ্ মেরে চান্না,
যাচুগি পায়ি বহালি”

“দুপাটি জুত্তি সখা এনে দে আমায়
যাতে মুক্তসারের আছে নকশিয়া কাজ,
দুপায়ে পরব তাহা, শোন্ সখা শোন্,
লাগবে দারুণ যেন রূপকথা কোনও।”

খসখসে সুতোটা শক্ত করে চেপে ধরলেন হংস রাজ, তারপর একখান ছুঁচলো ইস্পাতের ছুঁচ দিয়ে চিমোড় এক পরত চামড়া ফুঁড়ে দিলেন এই অভিজ্ঞ মুচিটি। ছুঁচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রায় ৪০০ বার এফোঁড়-ওফোঁড় করল সুতোটা — হাতে করে একজোড়া পঞ্জাবি জুত্তি (ঢাকা জুতো) বানাতে গেলে ঠিক এতগুলোই সেলাই লাগে। চারধারের নিস্তব্ধতা বারবার ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছিল তাঁর দীর্ঘশ্বাস ও ‘হুম্’ শব্দে।

পঞ্জাবের শ্রী মুক্তসার সাহিব জেলার এই রূপানা গাঁয়ে প্রথাগত কায়দায় জুত্তি বানাতে পারেন, এমন ওস্তাদ কারিগর কেবল হংস রাজই আছেন।

“পঞ্জাবি জুত্তি কেমনভাবে বানানো হয়, কারাই বা বানায়, অধিকাংশ লোকই এসব জানে না। উপরন্তু চলতি একখান ভুল ধারণা আছে যে এগুলো মেশিনে তৈরি। অথচ শুরুর তোড়জোড় থেকে সেলাই অবধি পুরোটাই হাতে হয়,” প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে জুত্তি বানিয়ে আসা হংস রাজ (৬৩) জানালেন, সঙ্গে নির্লিপ্ত স্বরে জুড়ে দিলেন, “মুক্তসার, মালৌট, গিদ্দেরবাহা বা পাতিয়ালা, সে যেখানেই যান না কেন, আমার মতন এমন নিখুঁত ভাবে জুত্তি কেউই বানাতে পারে না।”

হররোজ সকাল ৭টা বাজলেই নিজের ভাড়ায় নেওয়া কর্মশালার দোরগোড়ায় একটা সুতির কাঁথার উপর বসে পড়েন তিনি। চার দেওয়ালের খানিকটা জুড়ে সাজানো আছে সারি সারি হস্তনির্মিত পঞ্জাবি জুত্তি — মেয়েমরদ উভয়েরই জুতো রয়েছে। একেক জোড়ার দাম ৪০০ থেকে ১,৬০০ টাকা, মাস গেলে এ জীবিকা তাঁকে হাজার দশেক টাকা এনে দেয় বলে জানালেন হংস রাজ।

Left: Hans Raj’s rented workshop where he hand stitches and crafts leather juttis.
PHOTO • Naveen Macro
Right: Inside the workshop, parts of the walls are covered with juttis he has made.
PHOTO • Naveen Macro

বাঁদিকে: হংস রাজের ভাড়ায় নেওয়া কর্মশালা, এখানেই তিনি হাতে করে চামড়ার জুত্তি সেলাই করেন। ডানদিকে: কর্মশালার অন্দরে, দেওয়ালের কিছু অংশ তাঁর হস্তনির্মিত জুত্তি দিয়ে ঢাকা

Hansraj has been practicing this craft for nearly half a century. He rolls the extra thread between his teeth before piercing the tough leather with the needle.
PHOTO • Naveen Macro
Hansraj has been practicing this craft for nearly half a century. He rolls the extra thread between his teeth before piercing the tough leather with the needle
PHOTO • Naveen Macro

প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে এ কারিগরি জগতে বিচরণ হংস রাজের। ভোমর (জুতো-সেলাইয়ের বড়ো আকারের ছুঁচ) দিয়ে মজবুত চামড়ার পরত ফোঁড়ার আগে বাড়তি সুতোটুকু দাঁত দিয়ে পাকিয়ে নিচ্ছেন তিনি

জরাজীর্ণ দেওয়ালে হেলান দিয়ে পরবর্তী ১২টা ঘণ্টা চলবে জুত্তি বানানো। শ্রান্ত পিঠখানি দেওয়ালের যেখানে ঠেস দেন, সেখানকার পলেস্তারা ছেড়ে খাবলা খাবলা ইট বেরিয়ে পড়েছে। “গোটা শরীর জুড়ে ব্যথা, বিশেষ করে পা-দুটোয়,” হাঁটু মালিশ করতে করতে জানালেন হংস রাজ। গরমকালে “ঘেমেনেয়ে পিঠে দানে জে [ফোস্কা] পড়ে যায়, বড্ড দর্দ হয়।”

বছর পনেরো বয়সে এ কারিগরি শেখেন তিনি, হাতেখড়ি ও তালিম, দুটোই তাঁর বাবা দিয়েছিলেন। “আমার ঝোঁক ছিল বাইরে ঘুরে-বেড়ানোর দিকে। মাঝে মাঝে শিখতে বসতাম, সবদিন বসতাম না।” তবে বড়ো হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে রুজিরুটির চাপ, তখন তালিম নেওয়ার সময়টাও বাড়াতে বাধ্য হন হংস রাজ।

হিন্দিমিশ্রিত পঞ্জাবিতে জানালেন, “এ কাজে বারিকির [নিখুঁত] প্রয়োজন।” চশমা ছাড়া বহুবছর কাজ করার পর, “আজকাল কেমন যেন গড়বড় ঠেকছে চোখে। অনেকক্ষণ ধরে কাজ করলে চোখের উপর চাপ পড়ে। সবকিছু জোড়ায়-জোড়ায় দেখি।”

আর পাঁচটা কর্মদিনে, কাজের ফাঁকে তিনি চায়ে চুমুক দিতে দিতে রেডিও চালিয়ে খবর, গান আর ক্রিকেটের ধারাভাষ্য শোনেন। ওঁর সবচাইতে পছন্দের অবশ্য “ফরমাইশি প্রোগ্রাম,” অর্থাৎ অনুরোধের আসর, যেখানে শ্রোতাদের অনুরোধ মোতাবেক সাবেক দিনের হিন্দি আর পঞ্জাবি গান বাজানো হয়। তবে হংস রাজ নিজে কিন্তু আজ অবধি কখনও রেডিও স্টেশনে কোনও গানের অনুরোধ নিয়ে ফোন করেননি, “সংখ্যা-টংখ্যা বুঝি না তো আসলে, ডায়ালও করতে পারি না।”

'I always start by stitching the upper portion of the jutti from the tip of the sole. The person who manages to do this right is a craftsman, others are not',  he says
PHOTO • Naveen Macro
'I always start by stitching the upper portion of the jutti from the tip of the sole. The person who manages to do this right is a craftsman, others are not',  he says.
PHOTO • Naveen Macro

‘আমি সবসময় সোলের আগা থেকে সেলাই করা শুরু করি। এ কাজ যে সঠিক ভাবে করতে সক্ষম, সে-ই মিস্ত্রি [কারিগর], বাকিরা নয়,’ হংস রাজ জানালেন

জিন্দেগিতে কখনও স্কুলের চৌকাঠ ডিঙোননি ঠিকই, তবে নিজের এই গাঁ ছেড়ে বাইরের নতুন নতুন জায়গায় যেতে তাঁর বড্ড ভালো লাগে। বিশেষ করে সঙ্গে তাঁর দোস্ত থাকলে তো আর কথাই নেই! এই বন্ধুবর পড়শি গ্রামের এক সাধুসন্ত। “ফি বছর একবার করে ঘুরতে বেরোই। ওর নিজের মোটরগাড়ি আছে, হামেশাই ঘুরতে বেরোলে আমায় ডেকে নেয়। সঙ্গে আরও এক-দু’জন থাকে, হরিয়ানার বিভিন্ন জায়গা ও রাজস্থানের আলোয়ার আর বিকানেরে গেছি।”

*****

অনেকক্ষণ হল ঘড়ির কাঁটা বিকেল চারটে পেরিয়েছে, মাঝ-নভেম্বরের সূর্যটা যে ডুবতেই চাইছে না, উষ্ণ আলোর ছটায় স্নান করেছে রূপানা গ্রাম। হংস রাজের এক বাঁধাধরা খদ্দের একজোড়া জুত্তি কিনতে এসেছেন, সঙ্গে তাঁর এক বন্ধু। “কালকের মধ্যে ওঁর জন্যও দুপাটি জুত্তি বানিয়ে দিতে পারবেন?” ক্রেতা হংস রাজকে অনুরোধ করলেন। তাঁর দোস্ত বহুদূর থেকে এসেছেন — হরিয়ানার তোহানা, এখান থেকে পাক্কা ১৭৫ কিলোমিটার।

মুচকি হেসে হংস রাজ জবাব দিলেন, “ইয়ার, কালকের মধ্যে তো না-মুমকিন।” তবে খদ্দের মহাশয় হাল ছাড়তে নারাজ, “মুক্তসার তো পঞ্জাবি জুত্তির জন্য বিখ্যাত,” এবার আমাদের দিকে ঘুরে বলতে লাগলেন, “ওই শহরে হাজার হাজার জুত্তির দোকান আছে। কিন্তু আমাদের এই রূপানা গাঁয়ে কেবল ইনিই হাতে করে জুত্তি বানান। আমরা সব্বাই ওঁর কাজের সঙ্গে পরিচিত।”

দিওয়ালি পর্যন্ত অসংখ্য জুত্তি দিয়ে ঠাসা থাকে এই দোকানটি, সেটাও জানালেন ক্রেতাটি। তার একমাস পর, নভেম্বরে মোটে ১৪ জোড়া পড়ে আছে। কিন্তু হংস রাজের জুত্তির এত কদর কেন শুনি? খদ্দের মশাই দেওয়ালে টাঙানো পাদুকার দিকে আঙুল তুলে বলে উঠলেন, “ওঁর বানানো জুতোগুলোর মাঝখানটা চ্যাপ্টা হয়। তফাতটা আসলে [কারিগরের] হাতে।”

‘There are thousands of jutti shops in the city. But here in Rupana, it is only he who crafts them by hand,’ says one of Hans Raj’s customers
PHOTO • Naveen Macro
‘There are thousands of jutti shops in the city. But here in Rupana, it is only he who crafts them by hand,’ says one of Hans Raj’s customers.
PHOTO • Naveen Macro

হংস রাজের এক ক্রেতার কথায়: ‘শহরে হাজার হাজার জুত্তির দোকান আছে। কিন্তু আমাদের এই রূপানা গাঁয়ে কেবল ইনিই হাতে করে জুত্তি বানান’

তবে পুরো কাজ হংস রাজ একা একা করেন না। খানকতক জুত্তি সন্ত রামকে দিয়ে সেলাই করিয়ে নেন। এই ওস্তাদ মুচিটি থাকেন তাঁর ছেলেবেলার গাঁ খুনান খুর্দে, রূপানা থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে। দীপাবলি বা ধানচাষের সময়, চাহিদা যখন তুঙ্গে ওঠে, কাজের খানিক চাপ সন্ত রামের ঘাড়ে চাপান হংস রাজ — একেক জোড়া জুত্তি সেলাই করার মজুরি ৮০ টাকা।

এই ওস্তাদ পাদুকা-শিল্পী আমাদের কারিগর ও মজদুরের মধ্যে ফারাক বাৎলেছিলেন: “আমি সবসময় সোলের আগা থেকে জুত্তির পান্না [উপরের ভাগ] সেলাই করা শুরু করি। জুত্তি বানানোয় এটাই সবচেয়ে কঠিন ধাপ। এ কাজ যে সঠিক ভাবে করতে সক্ষম, সে-ই মিস্ত্রি [কারিগর], বাকিরা নয়।”

এ দক্ষতা শিখতে কিন্তু তাঁকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। “গোড়ার দিকে সুতো দিয়ে ঠিকমতন জুতো সিলতে পারতাম না,” স্মৃতিচারণ করছিলেন তিনি, “কিন্তু তখন প্রতিজ্ঞা করি যে শিখবই, মোটে দু’মাসে ওটা রপ্ত করে নিয়েছিলাম। বাদবাকি এলেম আমি ধীরে ধীরে শিখেছি, প্রথমে বাবাকে জিগিয়ে জিগিয়ে, তারপর মানুষটাকে দেখে দেখে।”

শিক্ষানবিশির পর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর, ধীরে ধীরে নিজেও মাথা খাটিয়ে অনেক নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছেন হংস রাজ। যেমন জুত্তির দুই প্রান্তেই ছোটো ছোটো চামড়ার ফালি সেলাই করা, যাতে জোড়গুলো এক্কেবারে গায়ে গায়ে মিশে যায়। “এই ছোট্ট ছোট্ট ফালিগুলো দেওয়ায় জুত্তিগুলো আরও মজবুত হয়। চট করে ছিঁড়তে-ফাটতে চায় না।”

The craft of jutti- making requires precision. ‘Initially, I was not good at stitching shoes with thread,’ he recalls. But once he put his mind to it, he learnt it in two months.
PHOTO • Naveen Macro
The craft of jutti- making requires precision. ‘Initially, I was not good at stitching shoes with thread,’ he recalls. But once he put his mind to it, he learnt it in two months
PHOTO • Naveen Macro

জুত্তি বানাতে গেলে নিখুঁত না হয়ে উপায় নেই। ‘গোড়ার দিকে আমি সুতো দিয়ে জুতো সেলাই ঠিকমতন পারতাম না,’ স্মৃতিচারণ করছিলেন হংস রাজ। তবে শেখার জেদ একবার চাপতেই মোটে দু’মাসে শিখে যান

*****

স্ত্রী ভীরপাল কৌর, এক মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে হংস রাজের সংসার। বছর আঠারো আগে খুনান খুর্দ ছেড়ে রূপানায় এসেছিলেন। ছেলেমেয়েরা আজ বিয়েথা করে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে যে যার মতো ঘর করছে। বড়োছেলের বয়স ৩৬, খুনান খুর্দ ছেড়ে আসার পর থেকে এখানকার একটি কাগজ-কলে কাজ করছেন।

“খুনান খুর্দে মূলত [দলিত] পরিবারের সবাই মিলেই জুত্তি বানাত, নিজে নিজের বাড়িতে বসেই কাজ করত সবাই। আস্তে আস্তে বখত পাল্টালো, নতুন প্রজন্ম আর এই কারিগরি শিখল না। আর যাঁরা জানতেন, তাঁরা একে একে চোখ বুজেছে,” হংস রাজ জানালেন।

আজ তাঁর ফেলে আসা গাঁয়ে মোটে তিনজন স্বহস্তে পঞ্জাবি জুত্তি বানান, প্রত্যেকেই তাঁর বেরাদরির মানুষ — রামদাসী চামার (এ রাজ্যের তফসিলি জাতির তালিকাভুক্ত)। এদিকে রূপানায় এ কারিগরির গড় আগলে একা হংস রাজ পড়ে আছেন।

“খুনান খুর্দে ছেলেমেয়ে তিনটের কোনও ভবিষ্যৎ ছিল না, তাই ঘটিবাটি সব বেচে এখানে এসে জমি কিনলাম,” কণ্ঠভরা দৃঢ়তা ও উমিদ নিয়ে বললেন ভীরপাল কৌর। এ মহল্লায় বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বাস, সেই সুবাদে ঝরঝরে হিন্দিতে কথা বলেন ভীরপাল জী। এই পাড়ায় মূলত উত্তরপ্রদেশ ও বিহার থেকে আগত দেশান্তরি শ্রমিকের বাস, সিংহভাগই উপরোক্ত কাগজ-কলে কাজ করেন। কারখানার আশপাশেই যে যার মতো কামরা ভাড়া নিয়ে থাকেন তাঁরা।

Veerpal Kaur, Hans Raj’s wife, learnt to embroider juttis from her mother-in-law. She prefers to sit alone while she works, without any distractions
PHOTO • Naveen Macro
Veerpal Kaur, Hans Raj’s wife, learnt to embroider juttis from her mother-in-law. She prefers to sit alone while she works, without any distractions.
PHOTO • Naveen Macro

হংস রাজের স্ত্রী ভীরপাল কৌর তাঁর শাশুড়ির কাছে জুত্তির উপর কশিদার কাজ শিখেছেন। মনঃসংযোগ যাতে না ভাঙতে পারে, তাই একা-একা বসে কাজ করতে ভালোবাসেন তিনি

It takes her about an hour to embroider one pair. She uses sharp needles that can pierce her fingers if she is not careful, Veerpal says
PHOTO • Naveen Macro
It takes her about an hour to embroider one pair. She uses sharp needles that can pierce her fingers if she is not careful, Veerpal says
PHOTO • Naveen Macro

ঘণ্টাখানেকের ভিতর দুপাটি জুতোয় সুতোর কাজ করতে সক্ষম ভীরপাল কৌর। তাঁর কাজের ছুঁচগুলো ভীষণ তীক্ষ্ণ, একচুল এদিক-ওদিক হলেই আঙুলে ফুটে যাবে বলে জানালেন তিনি

তবে এটা কিন্তু হংস রাজের পরিবারের পয়লা পরিযান নয়। “আমার বাবা নারনৌল [হরিয়ানা] থেকে পঞ্জাবে এসে জুত্তি বানানো আরম্ভ করেন,” হংস রাজ বললেন।

২০১৭ সালে, শ্রী মুক্তসার সাহিব জেলার গুরু নানক মহিলা কলেজ একটি গবেষণা করে দেখে যে ১৯৫০-এর দশকে রাজস্থানের হাজার হাজার জুত্তি কারিগর-পরিবার নিজ নিজ গাঁয়ের পাট তুলে পঞ্জাবে এসেছিল। নারনৌল, অর্থাৎ হংস রাজের পৈত্রিক বাসস্থানটিও হরিয়ানা ও রাজস্থানের সীমান্তে অবস্থিত।

*****

“এ কাজ যখন শুরু করি, একজোড়া জুতো মোটে তিরিশ টাকায় মিলত। আর আজ আগাগোড়া নকশি জুত্তির দাম আড়াই হাজারেরও বেশি,” বলছেন হংস রাজ।

কর্মশালার মেঝেময় ছোটোবড়ো নানান আকারের চামড়ার ফালি, তার মধ্যে থেকে দু’ধরনের চামড়া আলাদা করে দেখালেন তিনি: গরুর চামড়া আর মোষের চামড়া। একদা এই কাঁচামালই ছিল তাঁর শিল্পের শিরদাঁড়া, সযত্নে তাতে হাত বোলাতে বোলাতে হংস রাজ বোঝালেন, “মোষের চামড়া দিয়ে সোল বানাই, আর জুতোর উপরিভাগে গরুর চামড়া কাজে লাগে।”

ট্যানড্ [কষের সাহায্য পাকানো] গোচর্ম তুলে জিজ্ঞেস করলেন, এসবে হাত দিতে আমাদের কোনও আপত্তি আছে কিনা। আমাদের সম্মতিসূচক ইঙ্গিত পেতেই দু’ধরনের ট্যানড্ ও তাদের ফারাক বুঝিয়ে দিলেন। মোষের চামড়ার একেকটা পরত একসঙ্গে জোড়া ৮০ খানা কাগজের মতো মোটা। তুলনামূলক ভাবে গরুর চামড়া অনেকটাই পাতলা, মেরেকেটে দশ পাতা কাগজের মতো হবে। উপরন্তু মোষচর্ম মসৃণ হলেও অপেক্ষাকৃত অনমনীয়, সে তুলনায় গোচর্ম ঈষৎ খসখসে হলেও বেশ নমনীয়, খুব সহজেই দোমড়ানো যায়।

Hans Raj opens a stack of thick leather pieces that he uses to make the soles of the jutti . ‘Buffalo hide is used for the sole, and the cowhide is for the upper half of the shoes,’ he explains.
PHOTO • Naveen Macro

বান্ডিল খুলে কয়েকটি মোটাসোটা চামড়ার টুকরো বার করলেন হংস রাজ, এগুলো দিয়ে জুত্তির সোল তৈরি হয়। ‘মোষের চামড়া দিয়ে সোল বানাই, আর জুতোর উপরিভাগে গরুর চামড়া লাগে,’ বুঝিয়ে বললেন তিনি

Left: He soaks the tanned buffalo hide before it can be used.
PHOTO • Naveen Macro
Right: The upper portion of a jutti made from cow hide
PHOTO • Naveen Macro

বাঁদিকে: ইস্তেমাল করার আগে কষানো মোষচর্ম ভিজিয়ে রাখেন তিনি। ডানদিকে: জুত্তির উপরের ভাগটা গোচর্ম দিয়ে নির্মিত হয়

ক্রমশ বাড়তে থাকা চামড়ার দাম — তাঁর ক্ষেত্রে যা কিনা অত্যাবশকীয় কাঁচামাল — এবং “বুট-চপ্পল”-এর দিকে ক্রমেই ঝুঁকতে থাকা সমাজ, এর ফলে যেচে এ পেশায় জগতে পা রাখা মানুষের সংখ্যা দিনকে-দিন কমে যাচ্ছে।

নিজের যাবতীয় যন্ত্রপাতি-সরঞ্জাম সযত্নে সাবধানে নাড়াচাড়া করেন হংস রাজ। চামড়া কেটে-চেঁছে জুতোর আকার দিতে ইস্তেমাল হওয়া রাম্বি (বাটালি), চামড়া পিটিয়ে পিটিয়ে শক্ত করার কাজে ব্যবহৃত মোরগা (লগুড় বা কাঠের মুগুর)। এই মোরগাটি তাঁর বাবার থেকে পাওয়া। এছাড়াও বাবা তাঁকে একখান হরিণের শিং দিয়ে গেছেন, যেটা দিয়ে জুত্তির শুঁড়-তোলা আগার অংশটায় আকার দেন তিনি — খালিহাতে এ কাজটা করা খুব কঠিন।

ট্যানড্ চামড়া কিনতে গ্রাম থেকে ১৭০ কিলোমিটার দূর জলন্ধরের জুতোর হাটে পাড়ি দেন এই ওস্তাদ মুচি। প্রথমে একটা বাসে চেপে মোগায় পৌঁছন, সেখান থেকে আরেকটা বাসে জলন্ধরের মান্ডিতে (পাইকারি বাজার)। একদিকের ভাড়াতেই প্রায় ২০০ টাকা খসে যায়।

শেষবার গিয়েছিলেন দিওয়ালির আগে, ২০ হাজার টাকা দিয়ে ১৫০ কিলো ট্যানড্ চামড়া কিনে এনেছিলেন। তাঁকে সওয়াল করলাম, এতটা চামড়া বয়ে আনতে কখনও কোনও অসুবিধা হয়নি? জবাব এল, “ভয়টা কাঁচা (ট্যান না করা) চামড়া বওয়ায়, ট্যানড্ চামড়ায় নয়।”

Hans Raj takes great care of all his tools, two of which he has inherited from his father
PHOTO • Naveen Macro
Hans Raj takes great care of all his tools, two of which he has inherited from his father
PHOTO • Naveen Macro

নিজের যাবতীয় যন্ত্রপাতি-সরঞ্জাম সযত্নে সাবধানে নাড়াচাড়া করেন হংস রাজ, এগুলোর মধ্যে দুটি তিনি বাবার থেকে বিরাসতে পেয়েছেন

The wooden morga [hammer] he uses to beat the leather with is one of his inheritances
PHOTO • Naveen Macro
The wooden morga [hammer] he uses to beat the leather with is one of his inheritances
PHOTO • Naveen Macro

উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই মোরগা-টি [লগুড় বা কাঠের মুগুর] চামড়া পিটানোর কাজে লাগে

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রয়োজনীয় গুণমানযুক্ত চামড়া কিনবেন বলেই অতদূরের মাণ্ডিতে যান হংস রাজ, কাছের শহর মুক্তসার পর্যন্ত সেটা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব বেনিয়াদের, তারপর চামড়াগুলো সেখান থেকে তিনি সংগ্রহ করে নেন। “অত্ত ওজনদার মালপত্তর একা-একা বাসে করে নিয়ে আসা তো এমনিতেই মুমকিন নয়,” জানালেন তিনি।

যুগ পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে জুত্তির কাঁচামালও বদলেছে। বয়সে তাঁর চেয়ে ছোটো মালৌটের গুরু রবিদাস কলোনির মুচিদ্বয় রাজ কুমার ও মহিন্দর কুমার জানাচ্ছেন যে আজকাল বেশিরভাগ কারিগরই রেক্সিন ও মাইক্রো সেল্যুলার শীটের মতো কৃত্রিম চামড়া ব্যবহার করে। এঁদের দুজনেরই বয়স বছর চল্লিশেক হবে, দুজনেই দলিত জাটভ জাতির মানুষ।

মহিন্দরের কথায়: “যেখানে মাইক্রো শীটের দাম ১৩০ টাকা কেজি, সেখানে গরুর চামড়া ১৬০ থেকে ২০০ টাকার ভিতর ঘোরাফেরা করে।” তাঁরা দুজনেই জানালেন যে এ তল্লাটে চামড়া আজ নিতান্তই একটি দুর্লভ বস্তু হয়ে উঠেছে। “আগে আগে কলোনির মধ্যে একগাদা ট্যানারি ছিল, কাঁচা চামড়ার দুর্গন্ধে টেকা যেত না। কিন্তু বস্তিটা বহরে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্যানারিগুলো সব একে একে বন্ধ হয়ে গেল,” রাজ কুমার বললেন।

উঠতি ছেলেপুলেরা এ পেশায় যোগ দিতে একবিন্দুও উৎসাহী নয়, জানালেন তাঁরা, এবং এর পিছনে কম উপার্জন ছাড়াও অন্যান্য কারণ রয়েছে। “দুর্গন্ধটা জামাকাপড়ে লেগে থাকে, পিছু ছাড়ে না,” মহিন্দর বললেন, “মাঝেসাঝে তো ইয়ার-দোস্তরাও হ্যান্ডশেক করতে চায় না।”

Young shoemakers like Raj Kumar (left) say that artificial leather is now more commonly used for making juttis . In Guru Ravidas Colony in Malout where he lives and works, tanneries have shut
PHOTO • Naveen Macro
Young shoemakers like Raj Kumar (left) say that artificial leather is now more commonly used for making juttis . In Guru Ravidas Colony in Malout where he lives and works, tanneries have shut
PHOTO • Naveen Macro

রাজ কুমারের (বাঁদিকে) মতো তুলনায় কম বয়সি মুচিরা জানাচ্ছেন যে আজকাল সাধারণত কৃত্রিম চামড়া দিয়েই জুত্তি বানানো হয়। মালৌটের যে গুরু রবিদাস কলোনির তিনি বাসিন্দা, সেখানকার প্রতিটা ট্যানারিই বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেছে

একই কথা শোনা গেল হংস রাজের কাছে: “খোদ আমারই বাড়িতে বাচ্চারা জুত্তি বানাতে চায় না। এ কারিগরি বোঝা তো দূর অস্ত, আমার ছেলেরা দোকানের ছায়াটাও মাড়ায়নি। কোথা থেকে শিখবে বলুন তো? আমারাই শেষ প্রজন্ম যারা জুত্তি বানাতে জানে। আমি নিজেও আর মেরেকেটে বছর পাঁচেক বানাতে পারব, আমার পরে আর কে-ই বা পড়ে থাকবে?”

ভীরপাল কৌর রাতের খাবারের জন্য কুটনো কুটতে কুটতে বলে উঠলেন, “শুধু জুত্তি বানিয়ে দালান তোলা সম্ভব নয়। বছর দুয়েক হতে চললো আমাদের পাকাবাড়িটা তৈরি হয়েছে, বড়োছেলে কাগজ-কলে কাজ করার সুবাদে কর্মীদের জন্য বরাদ্দ ঋণ নিতে পেরেছিল, নইলে চাপ ছিল।”

“আমি তো ওকে এটাও বলেছিলাম যে কশিদা শেখ, কিন্তু শিখলই না,” স্ত্রীর সঙ্গে খুনসুটি করছিলেন হংস রাজ। ৩৮ বছরের দাম্পত্য তাঁদের। “আমার একফোঁটাও ভাল্লাগতো না,” সপাটে জবাব দিলেন ভীরপাল জী। শাশুড়ির থেকে যেটুকু কশিদা শিখেছেন, তা দিয়ে ঘরে বসে মোটে একঘণ্টায় দুপাটি জুতোয় জরির সুতো বুনতে সক্ষম তিনি।

বড়ো ছেলের তিন সদস্যের পরিবারের সঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকেন স্বামী-স্ত্রী। ঘর বলতে দু’খানা কামরা, একটা হেঁশেল, একটি বৈঠকখানা, ঘরের বাইরে শৌচালয়। কামরায় কামরায় সাজানো রয়েছে ড. বি.আর. আম্বেদকর ও সন্ত রবিদাসের তসবির, এমনকি হলঘরেও। হংস রাজের কর্মশালার দেওয়ালেও শোভা পাচ্ছে রবিদাসের একখান ছবি।

Hans Raj’s juttis have travelled across India with their customers. These are back in vogue after a gap of about 15 years. Now, ‘every day feels like Diwali for me,’ a joyous Hans Raj says.
PHOTO • Naveen Macro

খদ্দেরের হাতে হাতে সারা ভারতে ঘুরেছে হংস রাজের জুত্তি। মাঝে ১৫ বছর এ পাদুকার কোনও কদর ছিল না, আজ আবার তার চাহিদা বেড়েছে। উৎফুল্ল মনে হংস রাজ বলে উঠলেন, ‘হররোজই আমার জন্য দিওয়ালি মনে হয়’

“গত ১০-১৫ বছরে মানুষ আবার করে জুত্তি পরা শুরু করেছে,” হংস রাজ জানালেন, “তার আগে তো অনেকে মুচিদের খোঁজখবর নেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিল।”

তখন মূলত খেতমজুরি করে পেট চালাতেন তিনি, আর কালেভদ্রে খদ্দের-টদ্দের এলে দুয়েকদিনের মধ্যে জুত্তি বানিয়ে দিতেন।

“যতদিন যাচ্ছে, তত বেশি করে কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা এধরনের জুত্তি পরতে চাইছে,” ভীরপাল জী বললেন।

ক্রেতাদের দৌলতে আজ লুধিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাত ও উত্তরপ্রদেশের মতো বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে গেছে পঞ্জাবি জুত্তি। হংস রাজের মনে আছে, শেষবার যখন বড়ো কাজের বরাত পেয়েছিলেন। জনৈক কাগজ-কলের মজুর তাঁর উত্তরপ্রদেশ-নিবাসী আত্মীয়দের জন্য হংস রাজের থেকে আট জোড়া জুত্তি কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন।

যেহেতু এ গাঁয়ে তাঁর কারিগরির চাহিদা অটল, হংস রাজ অত্যন্ত উৎফুল্ল মনে বলে উঠলেন, “আমার তো হররোজই দিওয়ালি মনে হয়।”

নভেম্বর ২০২৩, এই প্রতিবেদনটির লেখার সপ্তাহখানেক পর আংশিক পক্ষাঘাতের শিকার হন হংস রাজ। তিনি এখন সুস্থ হয়ে উঠছেন।

প্রতিবেদনটি মৃণালিনী মুখার্জী ফাউন্ডেশন (এমএমএফ) প্রদত্ত একটি ফেলোশিপের সহায়তায় লিখিত।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Sanskriti Talwar

சன்ஸ்கிருதி தல்வார் புது டில்லியை சேர்ந்த சுயாதீனப் பத்திரிகையாளரும் PARI MMF-ன் 2023ம் ஆண்டு மானியப் பணியாளரும் ஆவார்.

Other stories by Sanskriti Talwar
Naveen Macro

நவீன் மேக்ரோ தில்லியை சேர்ந்த சுயாதீன புகைப்பட பத்திரிகையாளரும் ஆவணப்பட இயக்குநரும் PARI MMF-ன் 2023ம் ஆண்டு மானியப் பணியாளரும் ஆவார்.

Other stories by Naveen Macro
Editor : Sarbajaya Bhattacharya

சர்பாஜயா பட்டாச்சார்யா பாரியின் மூத்த உதவி ஆசிரியர் ஆவார். அனுபவம் வாய்ந்த வங்க மொழிபெயர்ப்பாளர். கொல்கத்தாவை சேர்ந்த அவர், அந்த நகரத்தின் வரலாற்றிலும் பயண இலக்கியத்திலும் ஆர்வம் கொண்டவர்.

Other stories by Sarbajaya Bhattacharya
Translator : Joshua Bodhinetra

ஜோஷுவா போதிநெத்ரா, பாரியின் இந்திய மொழிகளுக்கான திட்டமான பாரிபாஷாவின் உள்ளடக்க மேலாளராக இருக்கிறார். கொல்கத்தாவின் ஜாதவ்பூர் பல்கலைக்கழகத்தில் ஒப்பீட்டு இலக்கியத்தில் ஆய்வுப்படிப்பு படித்திருக்கும் அவர், பன்மொழி கவிஞரும், மொழிபெயர்ப்பாளரும், கலை விமர்சகரும், ச்மூக செயற்பாட்டாளரும் ஆவார்.

Other stories by Joshua Bodhinetra