মে মাসের শেষের দিকে নিখিরাপ্পা গাদিয়াপ্পা রামনগর শহরের রেশমগুটি বা কোকুন মান্ডিতে এসেছিলেন কোকুন বেচতে সুদূর হাভেরি তালুক থেকে। অনেক আশা নিয়েই তিনি সারা রাতের ধকল সয়ে এসে পৌঁছেছিলেন এই বাজারে। একটানা ১১ ঘণ্টা টেম্পো চলছে, ৩৭০ কিলোমিটারের লম্বা পথ — রাস্তার ধারের খাবারের দোকান লকডাউনের জন্য বন্ধ — ভয় জমছে তাঁর মনেও। এখন যদি এই রেশমগুটির ঠিকঠাক দর না মেলে?
হাভেরি জেলায় নিজের গ্রাম হান্ডিগানুরে ফিরতে ফিরতে গাদিয়াপ্পার মন থেকে আশা উধাও হয়ে ভয়টাই সত্যি হয়ে দাঁড়াল। নিখিরাপ্পা ২৫০ কিলোগ্রাম বাইভোল্টিন কোকুন বা দ্বিচক্রী রেশমগুটি, অর্থাৎ তাঁর ফসলের পুরোটাই মাত্র ৬৭,৫০০ টাকা বা ২৭০ টাকা প্রতি কিলো দরে বেচে এসেছেন।
মার্চের প্রথমদিকে বিয়ের মরসুম জনিত বাড়তি চাহিদার ফলে, বাইভোল্টিন বা দ্বিচক্রী কোকুনের দাম ওঠে কিলো প্রতি ৫৫০ টাকা, আর সংকর বা ক্রসব্রিড কোকুন বিক্রি হয় কিলো প্রতি প্রায় ৪৮০ টাকায়। অন্যান্য সময়ে, যখন বাজারে সিল্ক কোকুনের স্বাভাবিক চাহিদা থাকে, বাইভোল্টিন কোকুনের গড়পড়তা মূল্য হয় ৪৫০-৫০০ টাকা প্রতি কিলো, আর ক্রসব্রিড কোকুনের দাম পড়ে প্রায় ৩৮০-৪২০ টাকা প্রতি কিলো। (দ্বিচক্রী বা বাইভোল্টিন হল সাদা উৎকৃষ্ট মানের রেশমের গুটি; সংকর প্রজাতিটি হলদেটে হয় এবং অনমনীয় নিম্নমানের কোকুন ও বাইভোল্টিন কোকুনের সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হয়।)
“রেশমগুটি বানাবো বলে আমার পারিবারিক জমিতে আমিই তুঁত চাষ প্রথম [২০১৪ সালে] শুরু করি। এখন, জলের দরে কোকুন বিক্রি করতে আমরা বাধ্য হচ্ছি। আমি জানি না কোথা থেকে আমার বাকি ধারদেনা মেটাব,” বলছেন ৪২ বছর বয়সি গাদিয়াপ্পা।
২০১৪ পর্যন্ত, গাদিয়াপ্পা কর্ণাটকের হাভেরি জেলায় কৃষি শ্রমিকের কাজ করেছেন ১৫০-১৭০ টাকা দৈনিক মজুরিতে। তিন একর পারিবারিক জমিতে, গাদিয়াপ্পার দশজনের পরিবার প্রধানত জোয়ার আর চিনাবাদাম চাষ করত — নিজেদের খোরাকি এবং বাজারে বিক্রির জন্য। ২০১৬ সালে, একটু বেশি রোজগার হতে পারে ভেবে গাদিয়াপ্পা আরও ৫ একর জমি ইজারা নিয়েছিলেন; খানিকটা জমিতে জোয়ার আর চিনাবাদাম লাগালেন, আর বাকি জমিতে তুঁতচাষ করলেন।
গাদিয়াপ্পা ও অন্যান্য চাষিরা ৩৫-৪৫ দিনে একবার, অর্থাৎ বছরে প্রায় দশ বার রেশমগুটি বিক্রি করেন। চৌকি অর্থাৎ ছোটো রেশমকীটগুলির গুটি বা কোকুন সৃষ্টি করতে লাগে প্রায় ২৩ দিন। এইবারের জন্য, গাদিয়াপ্পা মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই গুটিপোকাগুলির দেখাশোনা শুরু করে দিয়েছিলেন। প্রত্যেকদিন প্রায় দশ ঘণ্টা করে গাদিয়াপ্পা কাটাতেন কোকুনগুলির পরিচর্যায়, দেখতেন যাতে গুমোট ও আর্দ্র আবহাওয়ায় কোকুনগুলির কোনও সংক্রমণ বা বিকার না ঘটে। এইভাবেই চলছিল, তারপর মে মাসের শেষে রামনগর মার্কেটে যাওয়ার পালা এল — আর ক্ষতির হিসাব কষা শুরু হল।
“প্রায় ৪৮,০০০ টাকা খরচ করেছি শ্রম, চৌকি, সার, রক্ষণাবেক্ষণ আর যাতায়াত নিয়ে, তারপরে ২০,০০০ টাকাও লাভ করতে পারিনি,” দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন গাদিয়াপ্পা জানান। কপালের ভাঁজে সিঁদুরের আবছা দাগ তাঁর উদ্বেগকে যেন আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।
কোভিড-১৯ লকডাউনে রেশম শিল্প প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ফলস্বরুপ গাদিয়াপ্পার মতো বহু চাষিকেই চরম সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে। এইসব চাষিরা মূলত রামনগরের সরকারি রেশমগুটি মান্ডিতেই আসেন — রামনগরের মান্ডিটি এই জাতীয় বাজারের মধ্যে এশিয়ার বৃহত্তম । এই বাজারের সহপরিচালক, মুন্সি বাসাইয়া বললেন, প্রত্যেক দিন গড়ে ৩৫-৪০ মেট্রিক টন কোকুন এখানে বিক্রি হয়। ২০১৮-১৯ সালে ভারতবর্ষ ৩৫,২৬১ মেট্রিক টন সিল্ক উৎপাদন করে, যার মধ্যে কর্ণাটক থেকেই এসেছে ৩২ শতাংশ। (চিনের পর, ভারতবর্ষ এখন বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় রেশম উৎপাদনকারী দেশ।)
১১ লক্ষ জনসংখ্যা বিশিষ্ট রামনগর
শহরের এই বিস্তৃত বাজারে অনেকগুলি পেল্লায় আকারের হলঘর আছে, যেখানে বড়ো বড়ো ধাতব ট্রে
জুড়ে রাখা থাকে কর্ণাটকের নানান প্রান্তের চাষিদের আনা কোকুন। এখানে বাজার ২৪ ঘণ্টাই
খোলা থাকে। পরদিনের নিলাম প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার জন্য চাষিদের অনেকেই আগের দিন মাঝরাত্রে
এসে পৌঁছন।
ব্যবসার সময়ে শত শত সিল্ক রিলার বা কাটুনি (এঁদের বেশিরভাগই কর্ণাটকের), কোকুনগুলি ভালো করে পরিদর্শন করেন এবং নিলামে অংশগ্রহণ করেন ই-অকশন ব্যবস্থার মাধ্যমে। এই রিলাররাই প্রধান ক্রেতা — এঁরা চরকা বা স্বয়ংক্রিয় রিলিং মেশিন বা কাটাই যন্ত্রের সাহায্যে কোকুন থেকে কাঁচা রেশম তৈরি করেন, তারপর সেই সিল্ক বিক্রি করা হয় তাঁতিদের কাছে।
দিনের ই-নিলাম প্রক্রিয়া শেষ হলে, চাষিরা ক্যাশ কাউন্টার থেকে লেনদেনের বিল সংগ্রহ করেন। বিগত মার্চ থেকেই রামনগর বাজারে সিল্ক কোকুনের দাম অবাধে পড়ছে। কোনও কোনও দিন ভাগ্য সহায় হলে চাষিদের সামান্য কিছু মুনাফা হয়, নয়তো কেবলই লোকসানের পালা।
দোদ্দাবল্লাপুর তালুকের চন্দ্রশেখর সিদ্দালিঙ্গাইয়া তাঁর লেনদেনের রসিদের দিকে অবিশ্বাস ভরা চোখে চেয়ে থাকেন — ১৬৬ কিলোগ্রাম কোকুন বিক্রি করেছেন ৩২০ টাকা কিলো প্রতি দরে। তাঁর কথায়, “আমি ১,৩০,০০০ টাকা খরচ করেছি এর চাষে। আমার ভাই উচ্চমানের ডিম এনেছিল যাতে আমরা ভালো গুটি পাই।” অর্থাৎ চন্দ্রশেখর ও তাঁর ভাইয়ের আরও বেশিই খরচ হয়েছে কোকুন উৎপাদনের জন্য; এঁরা চার একর জমিতে কোকুন চাষ করেন। “কোনও খদ্দেরই নেই, আমরা বাধ্য হয়েছি খুব কম দামে গুটি বিক্রি করতে। আমাদের মতো চাষিদের জন্য এটা বিশাল ক্ষতি,” সিদ্দালিঙ্গাইয়া বললেন।
“আমরা আগের রাত্তিরে এখানে এসে পৌঁছেছি। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও হয়নি, এমনকি সিল্ক মার্কেটের সামনের চায়ের দোকানগুলোও বন্ধ পড়ে আছে,” বলছেন এই ৫০ বছর বয়সি কৃষক, চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ তাঁর। তবু, তিনি ৯০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে রামনগরে এসেছেন তাঁর কোকুন বিক্রি করতে। কারণটা তিনি জানালেন, “আমার গ্রামে বা হাটে, ওরা [রেশম রিলাররা] প্রতি কিলোতে মাত্র ২০০ টাকা দেয়। আমাদের মতো চাষিদের আর কতদিন এরকম করে চলবে?”
সিদ্দালিঙ্গাইয়া কাউন্টারের দিকে হাঁটতে থাকেন, বাজারের শ্রমিকেরা তাঁর কোকুনগুলি থরে থরে প্লাস্টিকের ক্রেটে তুলছেন। নিজের আলগা মুঠোয় খানকতক কোকুন তুলে বললেন, “আমাদের আবাদ করা গুটি খুবই ভালো, দেখুন! এটা বেস্ট কোয়ালিটির মাল। আমি এই জিনিসই ডিসেম্বরে ৬০০ টাকা প্রতি কিলো দরে বেচেছি।” সিদ্দালিঙ্গাইয়ার ছয়জনের পরিবার পুরোপুরি এই কোকুন চাষ থেকে আসা আয়ের উপর নির্ভরশীল। “আমার স্ত্রী আর ভাই আমার সঙ্গেই মাঠে কাজ করে। তাছাড়া আমরা আরও পাঁচজন মজুর লাগিয়েছি। সমস্ত পরিশ্রমই জলে যাচ্ছে,” তাঁর আক্ষেপ।
সিল্ক কোকুনের মূল্য হ্রাস পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণটি হল চাহিদা-সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত। অতিমারির জন্য বহু বিয়ে স্থগিত হয়েছে, নানান অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে, এবং জামা কাপড়ের দোকান আর বিপণিগুলি বন্ধ হওয়ায় সিল্কের চাহিদাও অনেক পড়ে গেছে। তার ফলে রেশম কাটুনিদের আর রামনগরে আসার তাগিদ থাকছে না বলে জানালেন বাজারের কর্মকর্তাসহ অন্যান্য লোকজন।
অন্তত কাটুনি এবং তাঁতিদের রেশম মজুদ করার উপায় আছে, চাষিরা সেটাও করতে পারেন না — কোকুন পচনশীল সুতরাং অপেক্ষা করা যায় না, বিক্রি করতেই হয়।
রেশম তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় গৃহপালিত রেশম মথের মিলন দিয়ে। এরপর তারা যে ডিমগুলি পাড়ে, সেইগুলিকে ফোটানোর জন্য রেশমকীটের প্রতিপালন কক্ষে বা সিল্কওয়ার্ম রিয়ারিং ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ডিম ফুটে হয় শূককীট — আট দিন বয়স হলে সেগুলি চাষিদের কাছে বিক্রি করা হয় কোকুন সৃষ্টি করার জন্য। চাষিরা হয় চৌকি কেন্দ্রে যান, নয়তো এজেন্টের মাধ্যমে কেনেন। একটি ২৩ দিন ব্যাপী কোকুন উৎপাদন চক্রের জন্য তাঁরা ৭৫,০০০-৯০,০০০ শূককীট কেনেন, এতে খরচ পড়ে প্রায় ১,৮০০-৫০০০ টাকা। দাম নির্ভর করে প্রজাতির উপর। (প্রতি দ্বিচক্রী রেশমকীট বা বাইভোল্টিন সিল্কওয়ার্ম বাবদ চাষিরা সরকারের কাছ থেকে ১০০০ টাকা ভর্তুকি পান।)
রেশমকীটের দেখাশোনা হয় বিশেষভাবে নির্মিত প্রতিপালন কক্ষ বা রিয়ারিং হাউসে; সেখানে তাদের প্রত্যেক এক ঘণ্টা অন্তর তুঁত পাতা খাওয়াতে হয়, সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে হয় (২৪-৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং ঝরনা (স্প্রিংক্লার) ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রক (হিউমিডিফাইয়ার) দ্বারা আপেক্ষিক আর্দ্রতা বজায় রাখতে হয়। পোকাগুলিকে বাঁশের ট্রেতে খবরের কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখা হয় যাতে ২০-২৩ দিনের জন্য তারা রোগমুক্ত থাকে। এই পর্যায়ে শূককীটগুলি যে কোকুন তৈরি করে, সেগুলি বাজারে কাটুনিদের কাছে বিক্রি করা হয়। রিলাররা সেই কোকুন থেকে রেশম তৈরি করেন এবং তারপরে সেগুলি তাঁতি বা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। চাষিরা কাটুনিদের কাছে ভালো কোকুন বিক্রি করার জন্য উপযুক্ত প্রতিপালন কক্ষ নির্মাণ করেন, এই প্রক্রিয়ায় তাঁদের প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় (অনেকেই টাকা ধার করেন) ঝরনা, আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রক, বাঁশের ট্রে ও অন্য সরঞ্জাম কেনাকাটার জন্য।
লকডাউনে, চৌকি পালন কেন্দ্রগুলি ২৫ মার্চ থেকে এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। বহু কেন্দ্র উৎপাদন কমিয়ে দেয়, এবং তাদের কাছে থাকা শূককীট ও ডিমগুলিকে তারা ফেলে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু যেহেতু রেশমকীট পালন সময়নির্ভর, তাই উৎপাদন আবার শুরু হয় এবং চাষিরা আগের মতোই লকডাউনেও প্রতিপালন কেন্দ্র থেকে রেশমপোকা কিনতে থাকেন।
রামনগরের মান্ডি স্বাধীনতার পর, এই প্রথমবার, ২৫ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল
পর্যন্ত, টানা এক সপ্তাহর জন্য বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় মার্কেট চালু হওয়ার পর, বাইভোল্টিন
সিল্কের দাম কমে গড়ে ৩৩০ টাকা প্রতি কিলোগ্রাম হয় আর সংকর প্রজাতির সিল্ক কোকুনের দাম
দাঁড়ায় ৩১০ টাকা প্রতি কিলো। এর আগে, রামনগরের এই রেশম মান্ডি বছরে সাধারণত প্রজাতন্ত্র
দিবস ও স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে কেবল দুদিন বন্ধ থাকত।
দেশ জুড়ে লকডাউনের বিধিনিষেধগুলি যখন ক্রমশ শিথিল হচ্ছিল, তখন রেশম চাষিরাও আশা করেছিলেন যে সিল্ক কোকুনের দামের হার বৃদ্ধি হবে। কিন্ত রেশমের মূল্য আরও হ্রাস পেল; মে মাসের শেষ সপ্তাহে দ্বিচক্রী কোকুনের গড় মূল্য ২৫০ টাকা থেকে কমে দাঁড়াল আর সংকর প্রজাতির কোকুনের দাম হল ২০০ টাকা প্রতি কিলো।
“কর্ণাটকের রেশম কাটুনিরা সাধারণত সারাদেশের তাঁতি ও ব্যবসায়ীদের রেশম বিক্রি করলেও তাঁদের প্রধান ক্রেতারা তামিলনাডু এবং অন্ধ্রপ্রদেশ থেকেই আসেন,” উপ-পরিচালক মুন্সি বাসাইয়া জানালেন। “লকডাউন শুরু হওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। এই সময় কাটুনিদের কাছে যে বাড়তি সিল্ক মজুত ছিল, তার জেরে তাঁদের তখন আর কোকুনের কোনও চাহিদাও ছিল না।”
রামনগর সেরিকালচার ডিপার্টমেন্টের সহকারী পরিচালক মহেন্দ্র কুমার জি.এম. বিস্তারে জানালেন, “কোভিড-১৯ অতিমারির আগে, সিল্ক মান্ডির নিলামে প্রতেক দিন ৮৫০-৯০০ জন কাটুনি অংশগ্রহণ করতেন। ২ এপ্রিল যখন মার্কেট পুনরায় চালু হল, তখনও ৪৫০-৫০০ কাটুনি এসেছেন। মে মাসের শেষদিকে, শুধু ২৫০-৩০০ জন আসতেন রেশমগুটি কিনতে। অথচ, রেশম চাষিদের সংখ্যা সেই তুলনায় কিন্তু খুব একটা বদলায়নি, শুধু এপ্রিল মাসের প্রথম দিকেই যা একটু কমেছিল।”
তিনি আরও জানালেন, “রেশমের মূল্য হ্রাস পাওয়ার পেছনে চাহিদা-সরবরাহের চক্রটি ছাড়াও অন্যান্য সমস্যা আছে। কোকুন কেনার জন্য রেশম কাটুনিদের হাতে প্রয়োজনীয় পুঁজি খুব একটা নেই। বাজারে যে কোকুন আসছে তার মান খারাপ; হয়তো তার মধ্যে মোটে পাঁচ শতাংশ কোকুন ভালো। আর্দ্রতা কোকুনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বর্ষায় [কর্ণাটকে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, ফলে তাপমাত্রাও কমেছে] উৎপাদনের মান পড়ে যায়, তাই এখন খুব কম কাটুনি মান্ডিতে আসছে।”
সেরিকালচার বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন যে চাষিরা কবে রেশমগুটির ভালো দাম পাবেন তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
এই অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন নির্বাহ করতে এবং বিভিন্ন খরচ বজায় রাখতে গভীর সংকটে পড়েছেন রামনগরের চান্নাপট্টানা তালুকের অঙ্কূশনাহল্লি গ্রামের বোরালিঙ্গাইয়া বোরেগৌড়া ও রামকৃষ্ণ বোরেগৌড়ার মতো রেশম চাষিরা। বোরেগৌড়া ভ্রাতৃদ্বয় তাঁদের চার একর জমি জুড়ে তুঁত গাছ উপড়ে ফেলছেন। তাঁরা পণ করেছেন যে রেশমগুটির মূল্য স্থিথিশীল না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা মোটেই কোকুন উৎপাদন করবেন না।
“এতবছর ধরে তো আমরা মানিয়ে নিয়েই চলছি। কোকুন তৈরি করব বলে কখনও আমরা কলা বা টমেটো বিক্রি করেছি। আবার কখনও আমরা কোকুন বেচেছি অন্য কিছু চাষ করব বলে। এখন আর বাজারে কিছুই বিক্রি করতে পারছি না। টমেটো আর কলাও মাঠে পচে যাচ্ছে। এমনকি কেউ নারকেলও কিনতে আসছে না আমাদের কাছে। আমি সারাটা জীবন কষ্ট করেছি, কিন্তু একটা আশা ছিল যা আমাদের এগোতে রসদ জুগিয়েছে। এখন আর কিছুই বাকি নেই, কিচ্ছু বিক্রি করার নেই,” আক্ষেপ ৬০ বছর বয়সি রামকৃষ্ণ বোরেগৌড়া।
দুই ভাই বোরালিঙ্গাইয়া ও রামকৃষ্ণ ২০ একর জমির যৌথ-মালিক। চাষাবাদের খরচের জন্য তাঁরা বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে মোট ১৯ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনটি ব্যাংক থেকে। এই ধার তাঁরা শোধ করতে পারেননি। তিন বছর আগে তাঁরা দুটি রেশমকীট প্রতিপালন ইউনিট বানিয়েছিলেন ৮ লাখ টাকা দিয়ে; রাজ্য সরকার থেকে তাঁরা ১ লাখ টাকা ভর্তুকি বাবদ পেয়েছিলেন। এখন, কেবল একটি প্রতিপালন ইউনিটেই রেশমকীট রাখা হয়। “এইবারের মতো কোকুন তৈরি হয়ে গেলেই আমরা সব কাজ বন্ধ করে দেব। আদৌ কোনও লাভ আছে এত খেটে, স্প্রিংক্লার লাগিয়ে? বিদ্যুৎ, মজুর এসবের খরচা বয়ে? যদি না বাজার থেকে তার জন্য কোনও লাভ আদায় করতে পারি? আমাদের আর কোকুন তৈরির কাজ করার মতো সামর্থ্য নেই,” রামকৃষ্ণ জানান।
তাদের তুঁত খেত এখনও অর্ধেক ভরা। “আমরা বাকি পাতাগুলো আমাদের গরুবাছুরদের খাইয়ে দেব। তারপর মাঠ পরিষ্কার করে, আমরা নারকেল গাছ লাগাব। হয়তো নারকেল বেচে কিছু টাকা আসবে,” ৭০ বছর বয়সি বোরালিঙ্গাইয়া ফোকলা দাঁতে হাসেন। তাঁদের পরিবার বিপিএল কার্ডের দৌলতে রেশনটুকু জোগাড় করছে, সঙ্গে তাঁদের চাষ করা খানিক রাগি আর সবজি — এই দিয়েই সংসার চলছে।
রেশম চাষ বন্ধ করে সব চাষিদের পক্ষে অবশ্য রেশম শিল্প থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা সম্ভব হয় না। অনেকেই বাধ্য হয়ে এই ব্যবসায় আছেন কারণ তাঁরা অন্য এমন কিছু চাষ করেন না যা তাঁদের সাময়িকভাবেও জীবন গুজরানে সহায় হতে পারে।
“দাম কমেছে বলে আমি তো আর কাজ থামিয়ে রাখতে পারি না, একদিনের জন্যও না। আমি কাজ না করলে আমার পরিবার খাবে কোথা থেকে?” হাভেরির গাদিয়াপ্পার প্রশ্ন। পরের খেপের কোকুন উৎপাদনের জন্য তাকে আরও টাকা ধার করতে হবে। ইতিপূর্বে নেওয়া দুটি অপরিশোধিত দেনা মাথায় ঝুলছে — ২০১৯ সালে একটি সমবায় ব্যাংক থেকে ১২ শতাংশ হারে ৩.৫ লক্ষ টাকা এবং চার বছর আগে, বিজয়া ব্যাংক থেকে ৭ শতাংশ হারে একটি ১.৫ লক্ষ টাকার শস্য ঋণ। তিনি এখনও দুটি ঋণের আসল অংকটাই চুকিয়ে উঠতে পারেননি।
“এখন আর একটা লোন ছাড়া আমি চলতি খরচ চালাতে পারব না। অথচ টাকা দিতে কেউ রাজি হচ্ছে না,” গাদিয়াপ্পা বললেন। “আমি যদি ১০,০০০ টাকাও [প্রতি কোকুন উৎপাদন চক্রে] রোজগার করতে পারি, তাহলে অন্তত একপেটা খেয়েও বাঁচতে পারব। অন্যথায় আমার পরিবার না খেয়ে মরবে। জানি বড্ড কঠিন সবকিছু, তবুও একটা পথ আমায় বের করতেই হবে। এই করোনা মিটে গেলে সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে।”
কভার চিত্র: মাণ্ডিয়া জেলার মাদুর তালুকের মারাসিঙ্গানাহাল্লি গ্রামের কোকুন চাষি এম.এস. রুদ্র কুমারের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
অনুবাদ: মেধাশ্রী মহান্তী