পঞ্জাবে তাঁর পিন্ডের (গ্রাম) সেই ট্রাভেল এজেন্টকে ঘিরে সিং সাহেবের দুঃস্বপ্ন আজও কাটতে চাইছে না।

সেই এজেন্ট বাবাজির পয়সাকড়ি মেটাতে সিং সাহেব (নাম পরিবর্তিত) তাঁর পারিবারিক এক-একর জমি বেচতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার বিনিময়ে জতিন্দর নামে সেই এজেন্ট “এক নম্বর [আইনি নথি]”-এর কথা দেয়, যার দৌলতে সিং সাহেবের বিনা ঝুটঝামেলায় সার্বিয়া হয়ে পর্তুগালে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু অচিরেই সিং সাহেব টের পেলেন জতিন্দর তাঁকে ঠকিয়েছে, আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে মানব-পাচারের শিকার হয়েছেন তিনি। রাগেদুঃখে হতভম্ব মানুষটি মুখ ফুটে একথা দেশগাঁয়ে তাঁর ফেলে আসা পরিবারকে জানাতেও পারেননি।

সেযাত্রায় তিনি ও তাঁর সহ-পরিয়ায়ীরা কেবল বৃষ্টির জমা পানি ও পাউরুটি খেয়ে ইউরোপের ঘন বনজঙ্গল ঠেঙিয়ে, নর্দমা সাঁতরে, পাহাড়পর্বত ডিঙোতে বাধ্য হয়েছিলেন — তারপর থেকে পাউরুটিতে অরুচি ধরে গেছে সিং সাহেবের।

“মেরে ফাদার সাব হার্ট পেশেন্ট আ। ইন্না টেনশন ওহ্ লেহ্ নি সাকতে। নালে, ঘর মেঁ জা নহি সকদা কে ম্যাঁ সারা কুছ দাউ তে লাকে আয়া সি [আমার বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত। উনি এত মানসিক টানাপোড়েন সহ্য করতে পারবেন না। আর আমিও ঘরে ফিরতে পারিনি, কারণ সবকিছুর বাজি রেখেই তো এখানে এসেছিলাম],” ঝরঝরে পঞ্জাবি ভাষায় জানালেন ২৫ বছরের সিং সাহেব, পর্তুগালে যে দু’কামরার বাড়িটায় বসে বলছিলেন সেটা আরও পাঁচজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ভাড়ায় নেওয়া।

বিগত বেশ কিছু বছর ধরেই ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো দক্ষিণ এশীয় দেশসমূহের মজুরদের পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠেছে পর্তুগাল।

Singh sold his family’s one-acre of farm land to buy 'legal papers' that would ensure his safe passage to Portugal via Serbia
PHOTO • Karan Dhiman

‘আইনি নথি’ কিনতে তাঁর পারিবারিক এক-একরের খামারটি বেচতে বাধ্য হয়েছিলেন সিং সাহেব, যাতে বিনা ঝুটঝামেলায় সার্বিয়া হয়ে পর্তুগালে গিয়ে উঠতে পারেন

এককালে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার বড়ো ইচ্ছে ছিল তাঁর, কিন্তু বারকতক বিফল হওয়ার পর লক্ষ্য পাল্টে দেশান্তরের পথ বেছে নেন তিনি। গন্তব্য হিসেবে বেছে নেন পর্তুগালকে, কারণ সে মুলুকের অভিবাসন নীতিতে বিশেষ কড়াকড়ি নেই। গাঁয়ের বেশ ক’জন মরদ নাকি ইউরোপের সেদেশে যেতে সফল হয়েছেন, মুখে মুখে চাউর হওয়া সেসব গপ্প শুনে অনুপ্রাণিত হন সিং সাহেব। তারপর, একদিন কারও একটা থেকে জতিন্দরের খবর পান, যে কিনা তাঁরই গাঁয়ের বাসিন্দা। সিং সাহেবকে মদত করতে জিতেন্দ্র রাজিও হয়ে যায়।

“জতিন্দর আমায় বলেছিল, ‘আমি ১২ লাখ টাকা (আনুমানিক ১৩,০০০ ইউরো) নিয়ে আপনাকে আইনি পথে পর্তুগালে পাঠাব।’ পুরো টাকাটা দিতে রাজি হয়ে যাই, জায়েজ পথ অনুসরণ করার জন্য জোরাজুরিও করতে থাকি,” সিং সাহেব বললেন।

অথচ টাকাটা দেওয়ার সময় দালাল বাবাজি তাঁকে ব্যাংকের বদলে “অন্য পন্থা” ইস্তেমাল করতে অনুরোধ করে বসে। সিং সাহেব প্রথমটায় বেঁকে বসেন, তখন জতিন্দর তাঁকে জোর করতে থাকে। দেশ ছাড়ার জন্য মুখিয়ে ছিলেন সিং সাহেব, তাই শেষমেশ রাজি হয়ে যান। পয়লা দফায় ৪ লাখ টাকা (৪,৩৮৩ ইউরো) তুলে দেন পঞ্জাবের জলন্ধরের একটি পেট্রোল পাম্পে, তারপর দ্বিতীয় দফায় একটি দোকানে গিয়ে হস্তান্তরিত হয় আরও এক লাখ (১,০৯৫ ইউরো)।

অক্টোবর ২০২১-এ দিল্লি রওনা দেন, কথা ছিল বিমানপথে বেলগ্রেড হয়ে পর্তুগাল পৌঁছবেন। এই প্রথমবার উড়োজাহাজে চাপবেন সিং সাহেব, কিন্তু এয়ারলাইন তাঁকে বিমানে চাপতে দিলে তো! আসলে কোভিড-১৯-এর জন্য ভারত থেকে সার্বিয়ায় প্লেন চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল — এজেন্ট মহাশয় এ তথ্যটা পুরোপুরি চেপে গিয়েছিলেন। ফলত দুবাই হয়ে বেলগ্রেড যাওয়ার জন্য নতুন করে টিকিট কাটতে বাধ্য হন সিং সাহেব।

“বেলগ্রেড বিমানবন্দরে একজন দালাল আমাদের নিতে আসে, সে ব্যাটা তো এসেই সবার পাসপোর্ট হাতিয়ে নেয়, বলেছিল যে সার্বিয়ার পুলিশ নাকি খুব বাজে, ভারতীয়দের পছন্দ করে না। আমরা তো ভয়েই অস্থির হয়ে গেছলাম,” সিং সাহেব জানালেন। সেদিন আর সবার মতো তিনিও তাঁর পাসপোর্টটি দালালের হাতে তুলে দেন।

বেআইনি ভাবে যাত্রা বোঝাতে হামেশাই তিনি “দো নম্বর” শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন, ঠিক যেভাবে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড থেকে গ্রিসের থিভায় পৌঁছেছিলেন। সঙ্গে থাকা ডাংকাররা (মানব-পাচারকারী) তাঁকে আশ্বস্ত করেছিল যে গ্রিস হয়েই তিনি পর্তুগালে গিয়ে উঠবেন।

অথচ থিভায় পা রাখতেই দালাল ব্যাটা বেঁকে বসে, বলে যে কথামতন সিং সাহেবকে সে পর্তুগালে পাচার করতে পারবে না।

“জতিন্দর আমায় জানায়, ‘আপনার থেকে সাত লাখ টাকা পেয়েছি। আমার কাজ খতম। গ্রিস থেকে আপনাকে বার করতে পারব না,” সিং সাহেবের মনে পড়ে, সেদিন এ কথা কানে যেতেই রাগে-দুঃখে কেঁদে ফেলেছিলেন।

Many young men and women are promised safe passage by agents who pass them on to donkers (human smugglers)
PHOTO • Pari Saikia

তরুণ প্রজন্মের অসংখ্য ছেলেমেয়েদের আইনি পথে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডাংকারদের (মানব-পাচারকারী) হাতে তুলে দেয় দালালরা

মার্চ ২০২২, গ্রিসে আসার পর কেটে গেছে দু-দুটো মাস, সার্বিয়ার সেই ডাংকারের থেকে নিজের পাসপোর্ট ফেরত পাওয়ার চেষ্টায় লেগে পড়েন সিং সাহেব। যে পেঁয়াজ খামারে তখন কাজ করছিলেন, সেখানকার সহকর্মীরা তাঁকে সে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেন — কারণ সেখানে সিং সাহেবের কোনও ভবিষ্যৎ তো নেই-ই, উপরন্তু ধরা পড়লে সিধে ভারতে চালান করে দেবে।

অগত্যা আবারও চোরাপাচারের পথে পা বাড়ালেন পঞ্জাবের এই যুবকটি। “[মনে মনে] গ্রিস ছাড়বার প্রস্তুতি নিলাম। ভেবেছিলাম, এই শেষবারের মতন জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছি।”

খুঁজেপেতে গ্রিস দেশে আরেকজন নতুন দালাল জোগাড় করেন, যে কিনা ৮০০ ইউরোর বিনিময়ে তাঁকে সার্বিয়া পাঠানোর কথা দেয়। তিনমাস পেঁয়াজ খেতে ঘাম ঝরিয়ে তবেই এই টাকাটা জমাতে পেরেছিলেন তিনি।

এবার অবশ্য পথে নামার আগে সিং সাহেব নিজে নিজে খানিক খোঁজখবর নিয়েছিলেন, গ্রিস থেকে সার্বিয়া ফেরত যাবার রাস্তাটা নিজেই ঠিক করেন, পরিকল্পনা ছিল সেখান থেকে হাঙ্গেরি ও অস্ট্রিয়া হয়ে পর্তুগাল পৌঁছবেন। কানে আসে, গ্রিস থেকে সার্বিয়া যাওয়ার রাস্তাটা বেজায় কঠিন, “কোনক্রমে ধরা যদি পড়েন, তাহলে জাঙিয়া পরিয়ে সোজা তুরস্ক পাঠিয়ে দেবে,” সিং সাহেব বললেন।

*****

জুন ২০২২-এ ছ’দিন ছ’রাত পায়ে হেঁটে সার্বিয়ায় ফেরত আসেন তিনি। সেদেশের রাজধানী বেলগ্রেডে কয়েকটি উদ্বাস্তু শিবিরের সন্ধান পান — সার্বিয়া-রোমানিয়া বর্ডারে কিকিন্দা ক্যাম্প ও সার্বিয়া-হাঙ্গেরি সীমান্তে সুবোতিকা ক্যাম্প। সিং সাহেব জানাচ্ছেন যে এই মুহাজির শিবিরগুলি চোরাপাচারকারীদের আখড়া, দিব্যি রমরমিয়ে চলছে তাদের মানব-পাচারের কারবার।

“ওখানে [কিকিন্দা শিবির] তো প্রতি দুজনের একজনই ডাংকার। ওরা বলবে, ‘আপনাকে ওখানে নিয়ে যাব, তবে এই এতটা টাকা লাগবে,” সঙ্গে এটাও বললেন যে তাঁকে অস্ট্রিয়া যেতে সাহায্য করতে পারে, শেষ অব্দি এমন একজন ডাংকারের সন্ধান পান।

কিকিন্দা শিবিরের সেই (ভারতীয়) চোরাপাচারকারী তাঁকে জলন্ধরে “গ্যারান্টি রাখার” কথা বলে। কিন্তু এই “গ্যারান্টি” বস্তুটি কী? সিং সাহেব বোঝালেন, একজন ফড়ে যখন পরিযায়ী ও ডাংকার দুপক্ষেরই টাকাটা ধরে রাখে, সেটাকেই গ্যারান্টি বলা হয়, উক্ত দেশান্তরি তাঁর গন্তব্যে পৌঁছে গেলে তবেই সেই ফড়ে টাকাটা ছাড়ে।

Singh was willing to share his story as he wants the youth of Punjab to know the dangers of illegal migration
PHOTO • Karan Dhiman

পঞ্জাবের যুবসমাজ জানুক বেআইনি অভিবাসন ঠিক কতটা বিপজ্জনক, তাই স্বেচ্ছায় নিজের দাস্তান জনসমক্ষে তুলে ধরতে চেয়েছেন সিং সাহেব

একজন আত্মীয়ের মাধ্যমে ৩ লাখ টাকা (৩,৩০২ ইউরো) গ্যারান্টি ইন্তেজাম করে ডাংকারের নির্দেশ মাফিক হাঙ্গেরি সীমানার দিকে রওনা দেন সিং সাহেব। আফগানিস্তানের ক’জন চোরাপাচারকারী সেখানে দেখা করে তাঁর সঙ্গে। তারপর, মাঝরাত্তিরে সবাই মিলে দুখানা ১২ হাত উঁচু কাঁটাতার টপকান। সিং সাহেবের সঙ্গে একজন ডাংকারও বর্ডার টপকেছিল, সে তাঁকে চারঘণ্টা বনবাদাড় ঠেলে হাঁটিয়ে মারে। কিন্তু এতকিছুর পরেও সীমান্ত পুলিশের হাতে পাকড়াও হন সিং সাহেব।

“ওরা [হাঙ্গেরির পুলিশ] আমাদের হাঁটু গেড়ে বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালায় যে কোন দেশ থেকে এসেছি। ডাংকারকে পিটিয়ে তুলোধোনা করে দিয়েছিল। তারপর আমাদের [পরিযায়ীর দল] ফের সার্বিয়া চালান করে দিল,” স্মৃতিচারণ করছিলেন তিনি।

চোরাপাচারকারী ব্যক্তিটি তখন সিং সাহেবকে সুবোতিকা ক্যাম্পের কথা জানায়, যেখানে নতুন একজন ডাংকার অপেক্ষা করে রয়েছে। তার পরদিন দুপুর দুটো নাগাদ তিনি ফের এসে হাজির হন হাঙ্গেরির বর্ডারে, যেখানে ২২ জন ইতিমধ্যেই ওপারে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলেন। অথচ সিং সাহেব সমেত মোটে ৭ জন সফল হন সীমানা টপকাতে।

এরপর শুরু হয় ঘন বনজঙ্গল ঠেঙিয়ে ৩ ঘণ্টা পদযাত্রা, ডাংকার বাবাজি সঙ্গেই ছিলেন। “বিকেল ৫টা নাগাদ একটা দৈত্যাকার শুখা পরিখার ধারে এসে হাজির হলাম। ডাংকারের আদেশ মতন ওর মধ্যে শুয়ে পড়ে জঙ্গলের শুকনো পাতা-টাতা দিয়ে নিজেদের ঢেকে ফেললাম আমরা।” কয়েক ঘণ্টা পর আবারও আরম্ভ হল হণ্টন। শেষে একটা ভ্যানগাড়ি এসে তাঁদের অস্ট্রিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নামিয়ে দেয়। ওই সময় তাঁদের বলা হয়, “হাওয়াকল (উইন্ড টার্বাইন) লক্ষ্য করে হেঁটে যান, অস্ট্রিয়া পৌঁছে যাবেন।”

কোথায় আছেন তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না, এদিকে না আছে খাবারদাবার না আছে পানি, বাদবাকি অভিবাসীদের সঙ্গে সারাটা রাত ধরে হেঁটে চললেন সিং সাহেব। পরদিন সকালে একখানা অস্ট্রিয়ান সামরিক শিবির চোখে পড়ল। অস্ট্রিয়ার সেপাইদের দেখতেই চটজলদি আত্মসমর্পণ করতে দৌড়লেন সিং সাহেব, কারণ “এদেশে শরণার্থীদের স্বাগত জানানো হয়, ডাংকাররা এটা হলফ করে বলেছিল,” বললেন তিনি।

“কোভিড-১৯-এর জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেরে ওঁরা আমাদের একখান অস্ট্রিয়ান রিফিউজি ক্যাম্পে নিয়ে গেলেন, সেখানে গিয়ে আমাদের জবানবন্দি নিয়ে আঙুলের ছাপ রেকর্ড করে রাখা হল। তারপর আমাদের হাতে হাতে মুহাজির কার্ড ধরিয়ে দিলেন, যার বৈধতা ছিল ছ’মাস,” যোগ করলেন তিনি।

পঞ্জাবের এই দেশান্তরি শ্রমিক তারপর ছ’মাস ধরে খবরের কাগজ বিলি করে প্রায় ১,০০০ ইউরো জমান। মুহাজির কার্ডের বৈধতা ফুরোতেই শিবির আধিকারিক তাঁকে পাততাড়ি গোটাতে হুকুম দেন।

Once in Portugal, Singh makes sure to call his mother in Punjab and reply to her messages and forwards
PHOTO • Karan Dhiman

পর্তুগালে পা রাখতেই পঞ্জাবে ফেলে আসা মা-কে ফোন করেন সিং সাহেব, আম্মার যাবতীয় মেসেজ ও ফরওয়ার্ডেড বার্তার জবাব দেন

“তারপর সরাসরি স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া (কারণ শেনগান অঞ্চলের বিমান কস্মিনকালে যাচাই করা হয়) যাওয়ার বিমানের টিকিট কাটি, আর সেখান থেকে রেলগাড়ি চেপে বার্সেলোনা — এক বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটাই গিয়ে। আমার কাছে কোনও নথিপত্তর ছিল না, মায় পাসপোর্টটাও নয়, তাই বন্ধুটি আমায় পর্তুগাল যাওয়ার বাসের টিকিট কেটে দেয়।” এযাত্রায় তিনি বুদ্ধি করে পাসপোর্টটা গ্রিসে রেখে এসেছিলেন, অন্য এক দোস্তের হেফাজতে, যাতে ধরা পড়লেও কেউ তাঁকে ভারতে চালান না করতে পারে।

*****

অবশেষে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩এ, বাস ধরে সিং সাহেব তাঁর স্বপ্নের গন্তব্য পর্তুগালে পৌঁছন। সর্বসাকুল্যে ৫০০ দিনের বেশিই লেগেছিল সেখানে যেতে যেতে।

পর্তুগালের ভারতীয় দূতাবাস স্বীকার করছে , দেশান্তরি বহু মজদুরের কাছে “বৈধ আবাসিক নথিপত্র নেই, সরকারি পরিসংখ্যানও অবর্তমান।” সেই সঙ্গে তারা এটাও যোগ করছে যে সাম্প্রতিক কালে পর্তুগাল তার অভিবাসন আইন শিথিল করায় সেদেশে ভারতীয়দের (বিশেষ করে পঞ্জাবি তথা হরিয়ানাবাসী) সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

সিং সাহেবের জবানে: “ইয়াহাঁ ডকুমেন্টস্ বন্ যাতা হ্যায়, আদমি পাক্কা হো যাতা হ্যায়, ফির অপনি ফ্যামিলি বুলা সকতা হ্যায়, অপনি ওয়াইফ বুলা সকতা হ্যায় [এখানে কাগজপত্র সব তৈরি হয়ে যায়, লোকে দিব্যি স্থায়ী বাসিন্দা বনে যায়, তারপর নিজেদের পরিবারকে এখানে ডেকে নেয়, নিজের স্ত্রীকেও ডেকে নেয়]।”

ফরেনার্স অ্যান্ড বর্ডার্স সার্ভিসেসের (এসইএফ) তথ্য মোতাবেক ২০২২ সালে ৩৫ হাজারেরও অধিক ভারতীয়কে স্থায়ী অধিবাসীর তকমা প্রদান করেছিল পর্তুগাল। সেবছর আনুমানিক ২২৯জন ভারতীয় এখানে অ্যাসাইলাম, অর্থাৎ আশ্রয়ের জন্য আবেদন জানায়।

সিং সাহেবের মতো যুবক-যুবতীর চোখে আপন দেশে কোনও ভবিষ্যৎ নেই, তাই দেশান্তরে পাড়ি দিতে তাঁরা মরিয়া। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন দ্বারা প্রকাশিত ভারতের কর্মসংস্থান রিপোর্ট ২০২৪ বলছে, “মোটের উপর উচ্চ বৃদ্ধি সত্ত্বেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে লাভজনক কর্মসংস্থানে সম পরিমাণ বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়নি।”

ভিডিওতে দেখুন: সিং সাহেবের লব্জে তাঁর পরিযানের কথা

খাবার নেই, জল নেই, সারারাত হেঁটে চললেন সিং সাহেব। পরদিন সকালে একখান অস্ট্রিয়ান সামরিক শিবির চোখে পড়ে...তিনি দৌড়ে যান আত্মসমর্পণ করতে, কারণ ‘এদেশ শরণার্থীদের স্বাগত জানায়’

ন্যাচারালাইজেশন বা স্বাভাবিকীকরণের নিরিখে ইউরোপীয় দেশগুলির ভিতর পর্তুগালের সময়সীমা সংক্ষিপ্ততম, এখানকার নাগরিক হতে গেলে মোটে ৫ বছর আইনি বাসিন্দা হয়ে বসবাস করতে হয়। গ্রামীণ ভারতের যাঁরা মূলত কৃষি তথা ইমারতি ক্ষেত্রে কাজ করেন, তাঁরা এই পরিযানের পথে পা বাড়ান। বিশেষ করে পঞ্জাবের পুরুষেরা, অধ্যাপক ভাস্বতী সরকার জানাচ্ছেন। ইনি জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোপীয় গবেষণা কেন্দ্রের জীন মনেই পদে আছেন।

“পাকাপাকি ভাবে শিকড় গেড়ে বসা গোয়ানিজ ও গুজরাতি সম্প্রদায় ছাড়াও বহু পঞ্জাবি এখানকার নির্মাণক্ষেত্র তথা বাগিচা সংক্রান্ত কৃষিক্ষেত্রে নিম্ন-দক্ষতার মজদুরি করেন,” যোগ করলেন তিনি।

পর্তুগালের আবাসিক ছাড়পত্রের আরেক নাম টেম্পোরারি রেসিডেন্সি কার্ড (টিআরসি), এর একটা বড়ো হল কোনও ভিসা ছাড়াই আপনি ১০০টিরও অধিক শেনগান দেশে ঢুকতে পারবেন। তবে হ্যাঁ, চিত্রটা ক্রমেই বদলাচ্ছে, ৩ জুন ২০২৪-এ অনথিভুক্ত পরিযায়ীদের জন্য অভিবাসন আইন আরও কড়া করার নিমিত্তে সেন্টার-রাইট ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের (এডি) লুই মন্টেনেগ্রো একটা ফরমান জারি করেন।

এই নয়া আইনের জেরে কোনও বিদেশী মানুষ পর্তুগালে বসত পাততে চাইলে এখানে আসার আগেই তাকে ওয়ার্ক পারমিটের (কাজের অনুমতি) জন্য দরখাস্ত জানাতে হবে। মনে করা হচ্ছে যে এর নেতিবাচক প্রভাব গিয়ে পড়বে ভারতীয় অভিবাসীদের উপর, বিশেষ করে যাঁরা পঞ্জাব তথা হরিয়ানা ছেড়ে আসতে চাইছেন।

ইউরোপের অন্যান্য মুলুকেও অভিবাসন ঘিরে নিয়মকানুন কঠোরতর হয়ে উঠছিল। তবে অধ্যাপক ভাস্বতী সরকারের মতে এসব দিয়ে অনিয়মিত তথা উচ্চাভিলাষী পরিযায়ীদের আটকানো যাবে না, “তাঁরা যেসব দেশ থেকে আসেন সেখানে তাঁদের কাজের সুযোগ, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা প্রদান করা গেলে তবেই কার্যকরী হবে।”

পর্তুগালের এআইএমএ-তে (এজেন্সি ফর ইন্টিগ্রেশন, মাইগ্রেশন এবং অ্যাসাইলাম) ৪,১০,০০০টি মামলা তামাদি হয়ে পড়ে আছে। পরিযায়ী সমাজের বহুদিনের অনুরোধ রক্ষার্থে অভিবাসীদের নথি এবং ভিসার মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে জুন ২০২৫ অব্দি করা হয়েছে।

‘আইনি রাস্তা মারফত ভারতীয় শ্রমিকদের প্রেরণ তথা গ্রহণ প্রক্রিয়া’ বিধিবদ্ধ করতে ২০২১ সালে ভারত ও পর্তুগাল দুটি দেশ মিলে একটি চুক্তিতে দস্তখত করেছে। ইতালি, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স ও ফিনল্যান্ডের মতো বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে পরিযান ও যাতায়াত চুক্তিতে সই করেছে ভারত সরকার। তবে তৃণমূল স্তরে মানুষ যেখানে এই জাতীয় পরিযানের সিদ্ধান্ত নেন, সেখানে শিক্ষা কিংবা তথ্যের বড্ড অভাব।

এই প্রতিবেদনটির লেখকদ্বয় ভারত ও পর্তুগাল দুই দেশের সরকারের থেকেই বারংবার মন্তব্য চেয়েছে, অথচ কোনও তরফ থেকেই কেউ কিছু জানায়নি।

Young people like Singh are desperate to migrate because they are unable to find jobs in India
PHOTO • Pari Saikia

ভারতবর্ষে কামকাজ পেতে ব্যর্থ হওয়ায় সিং সাহেবের মতন জোয়ান ছেলেমেয়েরা দেশান্তরে পাড়ি দিতে মরিয়া হয়ে উঠছে

*****

সিং সাহেব তাঁর খোয়াবের গন্তব্যে তো পৌঁছলেন, কিন্তু গোড়াতেই যা টের পেলেন তা হল স্বদেশের মতন পর্তুগালেও কর্মসংস্থানে ভাঁটা, উপরন্তু আবাসিক ছাড়পত্র পাওয়ার দুরূহ প্রক্রিয়া তো আছেই। ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা যখন করেছিলেন, তখন এসবের কিছুই জানতেন না।

তিনি পারি’কে জানাচ্ছেন, “পর্তুগালের মাটিতে পা রেখে প্রথমটায় খুব ভাল্লাগছিল। কিন্তু, পরে গিয়ে বুঝতে পারি যে কামকাজের কতখানি অভাব, ওখানে এশীয় মানুষ প্রচুর, তাই কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। কামধান্দা নেই বললেই চলে।”

স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে অভিবাসী-বিরোধী মনোভাবের কথাও উল্লেখ করছেন সিং সাহেব: “এখানকার লোকজন পরিযায়ীদের পছন্দ করে না, অথচ চাষবাস আর ইমারতির যত খাটাখাটনির কাজ আছে, সেখানে আমাদের এত চাহিদা।” সবচাইতে শ্রমসাধ্য কাজগুলো ভারতীয়রা করে থাকেন, অধ্যাপক ভাস্বতী সরকারের লব্জে যেগুলো “থ্রি-ডি কামকাজ — ডার্টি, ডেঞ্জারাস ও ডিমিনিং (নোংরা, বিপজ্জনক ও অবমাননাকর), যা কিনা স্থানীয়রা করতেই চায় না।” দেশান্তরিদের আইনি অবস্থান নড়বড়ে, এই কারণেই তাঁরা আইনানুগ মজুরির অনেকখানি কমে চট্ করে মেহনত করতে রাজি হয়ে যান।

এধরনের কাজের জন্য সিং সাহেবও হন্যে হয়ে ফিরছেন, সেজন্যই বোধহয় আরও কয়েকটা জিনিস তাঁর গোচরে এসেছে। একটা ইস্পাত কারখানার পাঁচটা শাখাতেই যাবতীয় নির্দেশিকা পর্তুগিজের তলায় লেখা আছে পঞ্জাবিতে। “কাজের চুক্তিপত্রেও পঞ্জাবি ভাষায় তর্জমা করা থাকে। অথচ কাজের খোঁজে যদি সরাসরি ওঁদের কাছে যাই মুখের উপর জবাব আসে, ‘কোনও কামকাজ নেই’,” জানালেন সিং সাহেব।

Despite the anti-immigrant sentiment in Portugal, Singh says he is fortunate to have found a kind and helpful landlord here
PHOTO • Karan Dhiman

পর্তুগালে পরিযায়ী-বিরোধী মনোভাব থাকা সত্ত্বেও একজন দয়ালু ও মদতকারী গৃহমালিক পেয়ে সিং সাহেব ধন্য হয়ে গেছেন

অনথিভুক্ত পরিযায়ী হওয়ায় নির্মাণক্ষেত্রে একটা চাকরি পেতে পেতে সাতমাস গড়িয়ে যায় তাঁর।

সিং সাহেবের জবানে: “কোম্পানিরা কর্মচারীদের চুক্তিপত্রের সঙ্গে সঙ্গে আগাম পদত্যাগপত্রে সই করতে বলছে যদিও তাঁরা মাস গেলে ৯২০ ইউরোর ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছেন, তবে কে যে কখন ছাঁটাই হবেন, তা কেও জানে না।” তিনি নিজেও পদত্যাগপত্রে সইসাবুদ সেরে রেখেছেন। সিং সাহেব আপাতত আবাসিক ভিসার জন্য আবেদন জানিয়েছেন, উমিদ আছে অচিরেই আইনি তকমা জুটে যাবে।

“বস্ হুন তান আহহি সপনা আহ্ কি, ঘর বন্ যায়ে, সিস্টার দা ভিয়াহ্ হো জে, তে ফের ইথে অপনে ডকুমেন্টস্ বনা চে ফ্যামিলি নু ভি বুলা লাইয়ে [এখন আমার স্বপ্ন পঞ্জাবে একখান দালান তোলা, বোনটার বিয়েথা দেওয়া, আর আইনি কাগজপত্তর বানানো যাতে বাড়ির লোকজনদের এখানে নিয়ে আসতে পারি],” নভেম্বর ২০২৩-এ জানিয়েছিলেন তিনি।

২০২৪ থেকে ঘরে টাকাকড়ি পাঠানো শুরু করেছেন সিং সাহেব, ইদানিং মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হয়েছেন, তাঁরা দেশগাঁয়ে নিজেদের ভিটেখানও গড়ছেন। দালানের নকশায় তাঁর পর্তুগালের রোজগারপাতি অনেকখানি সহায় থেকেছে।

পর্তুগাল থেকে অতিরিক্ত প্রতিবেদন করণ ধীমানের।

ভারত ও পর্তুগালের মধ্যে এই তদন্তটি সম্পন্ন হয়েছে মডার্ন স্লেভারি গ্রান্ট আনভেইলড্ প্রোগ্রামের আওতায় থাকা জার্নালিজম ফান্ডের সহায়তায়।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Pari Saikia

பாரி சைகியா ஒரு சுயாதீன பத்திரிகையாளர். தென்கிழக்கு ஆசியா மற்றும் ஐரோப்பாவில் சட்டவிரோத குடியேற்றம் குறித்து ஆவணப்படுத்துகிறார். Journalismfund Europe-ன் மானியப் பணியாளராக 2023, 2022 மற்றும் 2021ம் ஆண்டுகளில் இருந்தவர்.

Other stories by Pari Saikia
Sona Singh

சோனா சிங் ஒரு சுயாதீன பத்திரிகையாளரும் ஆய்வாளரும் ஆவார். Journalismfund Europe-ன் மானியப் பணியாளராக 2022 மற்றும் 2021-ல் இருந்தவர்.

Other stories by Sona Singh
Ana Curic

ஆனா குரிக் சுயாதீன துப்பறியும் இதழியலாளர். செர்பியாவின் தரவு இதழியலாளர். தற்போது அவர் Journalismfund Europe மானியப் பணியாளராக இருக்கிறார்.

Other stories by Ana Curic
Photographs : Karan Dhiman

கரன் திமான் ஒரு காணொளி ஊடகவியலாளரும் இமாச்சலப் பிரதேசத்தை சேர்ந்த ஆவணப்பட இயக்குநரும் ஆவார். சமூகப் பிரச்சினைகள், சூழலியல் மற்றும் மக்கள் வாழ்க்கைகளை ஆவணப்படுத்தும் விருப்பத்தில் இருப்பவர்.

Other stories by Karan Dhiman
Editor : Priti David

ப்ரிதி டேவிட் பாரியின் நிர்வாக ஆசிரியர் ஆவார். பத்திரிகையாளரும் ஆசிரியருமான அவர் பாரியின் கல்விப் பகுதிக்கும் தலைமை வகிக்கிறார். கிராமப்புற பிரச்சினைகளை வகுப்பறைக்குள்ளும் பாடத்திட்டத்துக்குள்ளும் கொண்டு வர பள்ளிகள் மற்றும் கல்லூரிகளுடன் இயங்குகிறார். நம் காலத்தைய பிரச்சினைகளை ஆவணப்படுத்த இளையோருடனும் இயங்குகிறார்.

Other stories by Priti David
Editor : Sarbajaya Bhattacharya

சர்பாஜயா பட்டாச்சார்யா பாரியின் மூத்த உதவி ஆசிரியர் ஆவார். அனுபவம் வாய்ந்த வங்க மொழிபெயர்ப்பாளர். கொல்கத்தாவை சேர்ந்த அவர், அந்த நகரத்தின் வரலாற்றிலும் பயண இலக்கியத்திலும் ஆர்வம் கொண்டவர்.

Other stories by Sarbajaya Bhattacharya
Translator : Joshua Bodhinetra

ஜோஷுவா போதிநெத்ரா, பாரியின் இந்திய மொழிகளுக்கான திட்டமான பாரிபாஷாவின் உள்ளடக்க மேலாளராக இருக்கிறார். கொல்கத்தாவின் ஜாதவ்பூர் பல்கலைக்கழகத்தில் ஒப்பீட்டு இலக்கியத்தில் ஆய்வுப்படிப்பு படித்திருக்கும் அவர், பன்மொழி கவிஞரும், மொழிபெயர்ப்பாளரும், கலை விமர்சகரும், ச்மூக செயற்பாட்டாளரும் ஆவார்.

Other stories by Joshua Bodhinetra