মেঝেয় বসে পাখা নেড়ে নিজেকে ঠান্ডা করার চেষ্টার লেগেছিলেন নিশা। জুনের কাঠফাটা বিকেলবেলা, চড়চড়িয়ে উঠছে পারদ, এদিকে তামাক আর শুকনো পাতার ধুলোয় ভারি হয়ে আসছে বাতাস। “এ সপ্তাহে এর চেয়ে বেশি বিড়ি আর বাঁধতে পারলাম না,” বিড়ির বান্ডিলগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন তিনি। একেকটা বান্ডিল ১৭টা করে বিড়ি বাঁধা আছে, মোট ৭০০টার মতো। ৩২ বছর বয়সি এই বিড়ি-মজুরের কথায়, “মেরেকেটে ১০০টা টাকাও পাব না বোধহয়।” মধ্যপ্রদেশের দামোহ জেলার এই গাঁয়ে ১০০০টা বিড়ি বাঁধলে তবেই গিয়ে ১৫০ টাকা মেলে।

বুধবার আর শুক্রবার করে বিড়ি-শ্রমিকের দল এসে হাজির হয়। মাথা-পিছু কে কটা বিড়ি বেঁধেছেন, সেটা যেমন গোনা হয়, পরের খেপের কাঁচামালও তাঁরা সংগ্রহ করে নিয়ে যান। দামোহ শহর লাগোয়া অসংখ্য বিড়ি-কারখানায় বহাল ঠিকেদাররা বিড়ি-মজুরের মধ্যে চুক্তিমাফিক কাজ ভাগ করে দেন। শ্রমিকদের অধিকাংশই মহিলা।

এই মহিলারা কাঁচামাল নিয়ে সারাটা সপ্তাহ গতর খাটান, চলতে থাকে তেন্দুপাতায় (অন্য নাম কেন্দু) কাটা-তামাক ভরে পাকানো, তারপর সরু-সরু সুতোয় বেঁধে সেই বিড়ি সযত্নে একত্রিত হয় কাট্টায় (বান্ডিল)। ঘরকন্নার সমস্ত কামকাজ আগে সামলে নেন, তারপর শুরু হয় বিড়ি বাঁধার পালা। মাস গেলে গড় হিসেবে ১০-২০,০০০ টাকা উপার্জন করে ৮-১০ সদস্যের একেকটা গেরস্থালি, বিড়ি-বাঁধার মজুরিটা উপরি রোজগার। মেয়েদের সিংহভাগ হয় খেতমজুর কিংবা ক্ষুদ্র চাষি।

“যতক্ষণ না শিরা ফুটে বেরোচ্ছে, ততক্ষণ অবধি শুখা তেন্দুপাতাগুলো পানিতে চুবিয়ে রাখি। এবার ফারমা [লোহার চৌকো পাত] বসিয়ে ছোট্ট ছোট্ট চৌকো-আকারে কাটি। তারপর ভিতরে জর্দা [সুগন্ধী তামাক] পুরে, পাতাগুলো পাকিয়ে বিড়ি বাঁধা হয়,” বুঝিয়ে বললেন নিশা। প্রতিটা বিড়ি রংবেরঙের সুতো দিয়ে বাঁধা হয়, নইলে কোন বিড়িটা কোন ব্র্যান্ডের সেটা বোঝা যাবে না। সুতোর রং দেখেই চেনা যায় বিড়িটা কোন কোম্পানির।

বাঁধা বিড়ি এবার কারখানায় এনে বেচা হয়। বিড়ি ‘কারখানা’ মানে কিন্তু কেবলই বিড়ি-নির্মাতা ব্র্যান্ডের প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিং-ঘর ও গুদাম। মজুররা নিজের নিজের ভাগের বিড়ি ঠিকেদারের হাতে তুলে দেয়, এরপর ঠিকেদাররা হয় শ্রমিকের সঙ্গে কারখানায় আসেন, কিংবা সরাসরি টাকা মিটিয়ে দেন। কারখানার ভিতর বিড়ি বাছাই করে, তাপ দিয়ে, বাঁধে-টেঁধে মজুত করে রাখা হয়।

PHOTO • Priti David
PHOTO • Kuhuo Bajaj

তেন্দুপাতার উৎস সন্নিকটেই ছিন্দওয়ারা ও অন্যান্য এলাকার একাধিক তেন্দুবন। তামাক পাকাতে এই পাতা কাজে লাগে, তাই বিড়ি উৎপাদনে এই পাতার গুরুত্ব বিশাল। ডানদিকে: ঘরকন্নার কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিড়ি বাঁধছেন নিশা

এখানকার বেশিরভাগ মহিলা বিড়ি-মজুরই মুসলিম। তবে অন্যান্য ধর্মের মেয়েরাও বিড়ি বেঁধে পেট চালাচ্ছেন।

দামোহ জেলায় প্রায় ২৫টা বিড়ি কারখানা আছে, আশেপাশের জেলার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য তেন্দুগাছের জঙ্গলই তাদের উৎস। মধ্যপ্রদেশের মোট ৩১ শতাংশ বনভূমি। সেওনি, মান্ডলা, সেহোর, রাইসেন, সাগর, জবলপুর, কাটনি ও ছিন্দওয়ারা থেকে প্রচুর পরিমাণে তেন্দুপাতা আসে — তামাকটা এই পাতা দিয়েই পাকানো হয়, তাই বিড়ির উৎপাদনে এটি অত্যাবশ্যক উপাদান।

*****

গ্রীষ্মের এক উত্তপ্ত বিকেলে, ঝলমলে সালোয়ার-কামিজ গায়ে বিড়ি গুনতি হওয়ার অপেক্ষায় বসে আছেন জনা ছয় মহিলা। ঠিকেদারের কথা কাটাকাটি ছাপিয়ে কাছের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে জুম্মার নামাজ। কারখানা চত্বরে বসা মেয়েদের হাতে হাতে ধরা আছে সারা সপ্তাহের কাজ-ভর্তি তাসলা (কড়াইয়ের মতো দেখতে লোহার পাত্র)।

আজকের বিড়ি গোনায় কিন্তু মোটেই খুশি নন আমিনা (নাম পরিবর্তিত): “আরও অনেকগুলো [বিড়ি] ছিল, কিন্তু ঠিকেদার ব্যাটা বাছাই করার সময় ওগুলো বাতিল করে দিয়েছে।” নিজেদের বিড়ি মজদুর বলে পরিচয় দেন এই মহিলারা, সঙ্গে এটাও জানান যে ঘামরক্ত জল করে ১,০০০টা বিড়ি বানিয়ে মোটে ১৫০ টাকা মজুরিটা নেহাতই অন্যায়।

“এর চেয়ে সেলাই-ফোঁড়াই শুরু করা ভালো। ওসবে রোজগার আরও বেশি,” জানালেন দামোহ-নিবাসী প্রাক্তন বিড়ি-মজুর জানু। তবে ১৪ বছর বয়সে যখন এ কাজের জগতে পা রাখেন, তখন “না জানতাম অন্য কোনও কাজ, না ছিল আর কোনও উপায়।”

PHOTO • Kuhuo Bajaj

তেন্দুপাতায় জর্দা (বাঁদিকে), অর্থাৎ সুগন্ধী তামাক পাকিয়ে তৈরি হয় বিড়ি

ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওভাবে পিঠ ঝুঁকিয়ে বসে থাকায় মজুরদের ঘাড়-পিঠ ছিঁড়ে যায় যন্ত্রণায়, হাতদুটোও কেমন একটা অসাড় হয়ে যায়, ফলে দৈনন্দিন ঘরকন্নার কাজ সামলানোটা আরও কষ্টের হয়ে ওঠে। না আছে সে জখমের কোনও ক্ষতিপূরণ, না রয়েছে সেবা-চিকিৎসা, উল্টে কারখানার মালিকরা তো এ সমস্যার কথা সরাসরি উড়িয়েই দিচ্ছেন। এক কারখানার মালিক তো বলেই বসলেন মহিলারা তো “ঘরে শুধু শুয়ে-বসে থাকে আর বিড়ি বাঁধে।” অর্থাৎ যে অসুস্থতা এ মজদুরির দোসর, সে বিষয়ে তিনি একেবারেই অবগত নন।

“হপ্তা গেলে ওরা ৫০০ টাকা অবধি রোজগার করে।” এই কারখানা-মালিকটির বিশ্বাস, ঘরখরচা সামলানোর ক্ষেত্রে এই মজুরিটা বেশ ভালোই। তবে সাপ্তাহিক ৪,০০০ বিড়ি না বাঁধলে এই ৫০০ টাকার হিসেবটা খাটে না — আর এতগুলো বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে সপ্তাহ নয়, বরং মাস গড়িয়ে যায়।

যতজন মহিলার সাক্ষাৎকার নিয়েছি, সব্বার মুখে সেই একই ধকল আর আঘাতের কথা। একটানা ভেজা পাতা পাকিয়ে আর তামাক ঘেঁটে ঘেঁটে ত্বকের সমস্যাও দেখা দেয়। “হাথ অ্যাইসে কাটে রেহতে হ্যাঁয়, নিশান তক্ পড় যাতে হ্যাঁয় [হাতদুটো কাটাকুটি ভরা, একেকসময় তো রীতিমতো দাগ রয়ে যায়],” বলে তাঁর হাত দুখানি আমার সামনে মেলে ধরলেন একজন। দেখলাম, হাজারটা কড়ায় আর ফোস্কা ধরে রেখেছে ১০ বছরের শ্রমের চিহ্ন।

অন্য আরেক শ্রমিক সীমা (নাম পরিবর্তিত) জানালেন, “শুতে যাওয়ার আগে বোরোলিন ডলে নিই, নইলে তামাকপাতা আর ভেজা তেন্দুপাতা ঘেঁটে ঘেঁটে চামড়াটা ঠিক খোসার মতো উঠে যায়। আমি নিজে তামাক খাই না, কিন্তু ওর গন্ধটা নাকে গেলেই কাশি শুরু হত।” তাই বছর ১২-১৩ আগে এ কাজে ইতি টেনে শহরে গৃহশ্রমিকের কাজ আরম্ভ করেন, মাস গেলে আজ ৪,০০০ টাকা উপার্জন করছেন এই ৪০ বছরের এই প্রাক্তন বিড়ি শ্রমিক।

রাজিয়া (নাম পরিবর্তিত) যে ঠিক কতদিন ধরে বিড়ি আজ বেঁধে আসছেন, তার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। বিড়ি কারখানায় তাঁর জন্য তেন্দুপাতা মাপতে বসা ঠিকেদারকে বকঝকা করতে করতে তিনি বলে উঠলেন, “এটা কেমন পাতা দিচ্ছেন, হ্যাঁ? এটা দিয়ে ভালো বিড়ি বাঁধব কেমন করে? আপনি তো বাছতে বসে সবকটাই বাতিল করে দেবেন।”

PHOTO • Kuhuo Bajaj

প্রতি বুধ ও শুক্রবারে কাঁচামাল, অর্থাৎ তেন্দুপাতা ও জর্দা সংগ্রহ করতে কারখানায় হাজির হন বিড়ি-মজুরেরা

আরেকটা দুশ্চিন্তার বিষয় বর্ষা। “জো উওহ্ বারিষ কে ৪ মহিনে লাগতে থে, মানো পুরি বিড়ি কচরে মেঁ জাতি থি [বর্ষার ৪টে মাসে মনে হয় সবকটা বিড়িই আস্তাকুঁড়ে পৌঁছে যাবে]।” ভেজা তেন্দুপাতায় পাকানো তামাক শুকোতেই চায় না, উল্টে ছাতা (ছত্রাক) পড়ে আর গোটা বান্ডিলটাই বাতিল হয়ে যায়। “[বর্ষাকালে] কাপড়জামাই শুকোতে পারি না, অথচ এই বিড়িগুলো শুকোতেই হবে,” নইলে একটা পয়সাও জুটবে না।

ঠিকেদার একটা বিড়ি বাতিল করা মানে মেহনত ও সময় নষ্ট তো বটেই, উপরন্তু সেটা বানাতে যেটুকু কাঁচামাল লেগেছিল, সেটাও সেই শ্রমিকের মজুরি থেকে বাদ যাবে। “খুব লম্বি লাইন লাগতি থি গিনওয়াই কে দিন। জৈসে তৈসে নম্বর আনা থা, তোহ্ তব্ আধি বিড়ি তো নিকাল দেতে হ্যায় [বিড়ি গোনানোর লম্বা লম্বা লাইন পড়ত। শেষমেষ আমাদের সময় এলে ঠিকেদাররা আধা বিড়ি বাতিল করে দিত],” উৎকণ্ঠায় কাটানো সেই অনন্ত অপেক্ষার কথা মনে করে বলে উঠলেন জানু।

দৈর্ঘ্য, বেধ, পাতার গুণমান ও বাঁধা — এমন নানান বিষয়ের উপর নির্ভর করছে বিড়িটা বাতিল হবে কিনা। “পাতাটা ধরুন পলকা, বাঁধতে গিয়ে এট্টুখানি ফেটে গেল, কিংবা সুতোটা তেমন আঁটোসাঁটো করে বাঁধা হয়নি, ওমনি বিড়িটা বাদ পড়ে যাবে,” বছর ষাটেকের এক মজুর জানালেন। তবে ‘বাতিল’ বিড়িগুলো যে আদতে বাতিল নয়, বরং ঠিকেদাররা সেগুলো নিজেরা বেচবেন বলে আলাদা করে তুলে রাখেন, মজুররা সেটাও জানাচ্ছেন আমাদের। “ওগুলোর জন্য ফুটোকড়িও পেতাম না। এমনকি বাতিল বিড়িগুলো আমাদের ফেরতও দিত না।”

*****

১৯৭৭ সালে, বিড়ি-মজুর কল্যাণ তহবিল আইন, ১৯৭৬ এর খাতে সকল বিড়ি-বাঁধিয়ের হাতে হাতে বিড়ি-কার্ড তুলে দিতে শুরু করে কেন্দ্র সরকার। বিড়ি কার্ডের মূল লক্ষ্য মজুরদের চিহ্নিত করা, তবে সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা, প্রসবকালীন সুযোগ-সুবিধা, সৎকারের নিমিত্তে আর্থিক অনুদান, চক্ষু-পরীক্ষা ও চশমা, ইস্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের বৃত্তি ইত্যাদির মতো নানান সরকারি যোজনার সুবিধেও তাঁরা পেতে পারেন। বিড়ি ও চুরুট শ্রমিক (কর্মসংস্থানের শর্তাবলী) আইন, ১৯৬৬ -এর আওতায় এমনটা সম্ভবপর হয়েছে। যে যে বিড়ি-শ্রমিকের হাতে এই কার্ড আছে, তাঁরা বিশেষ কয়েকটি ওষুধের দোকান থেকে হয় বিনেপয়সায় কিংবা ভর্তুকিযুক্ত ওষুধপত্র কিনতে পারেন।

“জ্যাদা কুছ নহিঁ লেকিন বদন দর্দ, বুখার কি দাওয়াই তো মিল যাতি হ্যায় [বিশেষ কিছু না হলেও অন্তত হা-হাত-পা ব্যথা, জ্বরজ্বালা, এসবের ওষুধপাতি পেয়ে যাই],” বললেন ৩০ বছরের খুসবু রাজ। দামোহ জেলার এই বিড়ি-মজুরটির কাছে অনুরূপ একটি কার্ড আছে। ১১ বছর ধরে বিড়ি বাঁধার পর এই কদিন আগে দামোহ শহরে একটি ছোট্ট চুড়ির দোকানে বিক্রয়-সহকারীর কাজ নিয়েছেন।

PHOTO • Kuhuo Bajaj

বিড়ি-শ্রমিকের পরিচয়পত্র এই বিড়ি-কার্ড

এই কার্ড নানান সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে অধিকাংশ বিড়ি-শ্রমিকই এই কার্ড দিয়ে বিশেষ কিছু ডিস্পেন্সারি থেকে বিনামূল্যে অথবা ভর্তুকিযুক্ত ওষুধপত্র কেনেন। তবে এই কার্ড তৈরির প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত শোষণমূলক

এ কার্ড পেতে গেলে, “অফিসারের সামনে আমাদের কয়েকটা করে বিড়ি বাঁধতে হয়,” জানালেন খুসবূ, “সরকারি অফিসার দেখতে হ্যায় কি হমসে সহি মেঁ বিড়ি বনতি ভি হ্যায় ইয়া সির্ফ অ্যাইসেহি কার্ড বনবা রহে হ্যায় [সরকারি বাবু যাচাই করে নেন যে আমরা সত্যি সত্যি বিড়ি বানাতে জানি, নাকি ফোকোটিয়া সুযোগ-সুবিধা পেতে মিথ্যে মিথ্যে কার্ড বানাতে এসেছি]।”

“কার্ড বানালে আমাদের পয়সাকড়ি কেটে নেয়,” যিনি জানালেন তাঁর পুরোনো গাঁয়ে একখান কার্ড ছিল। বেশ সতর্ক ভাবেই অন্যায়-অসাধু বন্দোবস্তের দিকে আঙুল তুলছিলেন মানুষটি, তবে কারখানা-মালিকরা যে মজুরদের মজুরি কেটে তহবিলে ঢোকান, সেটা না বলে আর থাকতে পারলেন না। ১৯৭৬ সালের আইন মোতাবেক সরকারও এই তহবিলে সমমূল্যের টাকা প্রদান করে। মজদুরবৃন্দ হয় উপরোক্ত কোনও একটি যোজনার খাতে খানিক খানিক করে টাকা তোলেন, কিংবা বিড়ি বাঁধার পালা চিরতরে চুকিয়ে পুরোটাই তুলে নেন।

মাস দুই আগে বিড়ি-বাঁধায় ইতি টেনে তহবিল থেকে ৩,০০০ টাকা পেয়েছিলেন খুসবূ। কারও কারও কাছে এই তহবিলের ইন্তেজামটা খুবই সুবিধাজনক, তবে অন্যান্য সকলের জন্য তা একেবারেই নয় — তাঁদের মনে হয়, এর ফলে তাঁরা হাতে হাতে আরোই কম মজুরি পাচ্ছেন। উপরন্তু ভবিষ্যতে তহবিলের টাকাটা যে মিলবেই, সেটার কোনও নিশ্চয়তা নেই।

বিড়ি-কার্ডের হাজার সুযোগ-সুবিধা থাকলেও এটা বানানোর পদ্ধতিটা নিতান্তই তত্ত্বাবধানহীন, কারও কারও জন্য শোষণমূলকও বটে। একজনের থেকে শুনলাম যে তিনি স্থানীয় কেন্দ্রে কার্ড বানাতে গিয়ে সেখানকার সাহেবের (আধিকারিক) হাতে রীতিমতো যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন। “আমার গোটা শরীরটার উপর চোখ বুলিয়ে বলল, আমি যেন পরেরদিন আসি। পরদিন ছোটোভাইকে নিয়ে গেলাম। তখন সে ব্যাটা বলতে লাগল, কেন আমি ভাইকে নিয়ে এসেছি, [ইঙ্গিত করেছিলেন] আমার একলা আসা উচিত ছিল,” সেই মহিলা মজুর জানালেন।

কার্ড বানাবেন না বলার পরেও সেই ‘সাহেব’ বিরক্ত করা ছাড়েননি, লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। সেই মহিলার কথায়: “আরেকদিন ওই এলাকা দিয়ে যাচ্ছি, সাহেব হঠাৎ আমায় দেখতে পেয়ে ডাকতে লাগল। বিচ্ছিরি একটা অবস্থা তৈরি করল।” এরপর সেই অফিসারকে তিনি বলেছিলেন, “আমায় বোকা-হাঁদা ভাববেন না যেন, আপনার নোংরা প্রস্তাবে রাজি হতে মোটেই আসিনি। আপনি যদি এসব করা না থামান, তাহলে আপনার বদলি করিয়ে ছাড়ব।” স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুঠিদুটো শক্ত হয়ে এল তাঁর, গলাটাও ক্রমশ চড়ছিল, “বহুত হিম্মত লাগি থি [বিস্তর সাহস লেগেছিল]। লোকটা আরও ২-৩জন মেয়ের সঙ্গে এমনটা করেছিল, তারপর গিয়ে ব্যাটার বদলি হয়।”

*****

PHOTO • Kuhuo Bajaj
PHOTO • Kuhuo Bajaj

বাঁদিকে: বাঁধছাঁদ করে বিক্রির জন্য প্রস্তুত বান্ডিল বান্ডিল বিড়ি। ডানদিকে: বিড়ি-বাঁধার অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন দুই প্রাক্তন বিড়ি-শ্রমিক অনীতা (বাঁদিকে) ও জৈনবতী (ডানদিকে)

বিড়ি বেচতে পরস্পরের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় মশগুল হন মহিলারা, একত্রে লাইনে দাঁড়িয়ে যেন কয়েক লহমার জন্য ভুলে যান পিঠ-ব্যথা আর অসাড় হয়ে আসা হাতের কথা। দ্বিমাসিক এই মোলাকাতে ফুটে ওঠে যৌথতার ছবি।

“এই মোলাকাতে এত গপ্পগুজব, এত হাসি-মজাক...খুব ভাল্লাগে, আনন্দ হয়। ঘর ছেড়ে বেরোনোর সুযোগ মেলে,” জনৈক মহিলা জানিয়েছিলেন।

আড্ডায় আড্ডায় সরগরম কারখানার আবহাওয়া — টাটকা ঘরোয়া কুটকাচালি, বাচ্চাকাচ্চা বা নাতিনাতনির দুষ্টুমি, পরস্পরের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে নির্ভেজাল উদ্বেগ। সীমার মেয়ে সাতসকালে গরুর দুধ দুইতে বসেছিলেন, হঠাৎই তাঁর চার বছরের ছেলেটা এমন দস্যিপনা শুরু করে যে গরুটা আর থাকতে না পেরে সটান পা চালিয়ে দেয়! সীমার এই কাহিনি শুনে আরেকজন বলতে লাগলেন তাঁর পড়শির মেয়ের বিয়ের গপ্পো।

যে যার বাড়ির পথে পা বাড়ালে আড্ডার হাল্কা মেজাজ পরিণত হয় দুশ্চিন্তায় — খোলামকুচি রোজগারে সংসারের জাঁতাকল যে ঘুরতেই চায় না। স্বাস্থ্য ও শ্রম বেচে দু-চারটে পয়সা হাতে ফিরে আসেন মহিলারা, এ এক চরম অনায্য পরিস্থিতি।

জ্বালা-যন্ত্রণা ও যাবতীয় মুসিবতের কথা বলছিলেন সীমা, “পিঠ, হাতের তালু, গোটা হাত...বড্ড ব্যথাবেদনা হত আগে। এই যে আঙুল ক’খানি দেখছেন, বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে কেমন সরু সরু হয়ে আব গজিয়ে যেত।”

হাজার উদ্বেগ, হাজার দুর্দশা সয়ে বিড়ি বেঁধেই চলেছেন মধ্যপ্রদেশের বিড়ি-মজুরেরা। নামমাত্র মজুরি দিয়ে পেট চালনার এক অনন্ত সংগ্রাম। তাঁদেরই একজনের কথায়, “অব্ ক্যয়া করেঁ, সবকি অপনি মজবুরি হোতি হ্যায় [আর কীই বা করতে পারি, আমরা সবাই যে নিরুপায়]।”

এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত বেশ কয়েকটি নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Student Reporter : Kuhuo Bajaj

குஹுவோ பஜாஜ், அஷோகா பல்கலைக்கழகத்தில் பொருளாதாரம், நிதி மற்றும் சர்வதேச உறவுகள் படிக்கிறார். கிராமப்புற இந்தியா பற்றிய செய்திகள் எழுதும் ஆர்வத்தில் இருக்கிறார்.

Other stories by Kuhuo Bajaj
Editor : PARI Desk

பாரி டெஸ்க், எங்களின் ஆசிரியப் பணிக்கு மையமாக இருக்கிறது. இக்குழு, நாடு முழுவதும் இருக்கிற செய்தியாளர்கள், ஆய்வாளர்கள், புகைப்படக் கலைஞர்கள், பட இயக்குநர்கள் மற்றும் மொழிபெயர்ப்பாளர்களுடன் இணைந்து இயங்குகிறது. பாரி பதிப்பிக்கும் எழுத்துகள், காணொளி, ஒலி மற்றும் ஆய்வு அறிக்கைகள் ஆகியவற்றை அது மேற்பார்வையிட்டு கையாளுகிறது.

Other stories by PARI Desk
Translator : Joshua Bodhinetra

ஜோஷுவா போதிநெத்ரா, பாரியின் இந்திய மொழிகளுக்கான திட்டமான பாரிபாஷாவின் உள்ளடக்க மேலாளராக இருக்கிறார். கொல்கத்தாவின் ஜாதவ்பூர் பல்கலைக்கழகத்தில் ஒப்பீட்டு இலக்கியத்தில் ஆய்வுப்படிப்பு படித்திருக்கும் அவர், பன்மொழி கவிஞரும், மொழிபெயர்ப்பாளரும், கலை விமர்சகரும், ச்மூக செயற்பாட்டாளரும் ஆவார்.

Other stories by Joshua Bodhinetra