পশ্চিমবঙ্গে শৈব, শাক্ত তথা ধর্ম উপাসনার একটি বিশেষ রীতি হল গাজন। এ পার্বণের সমাপ্তি ঘটে চড়কে, প্রথাগত নিয়মে যেটি পালিত হয় চৈত্র সংক্রান্তির দিন। ঘটনাচক্রে এবছর ১৪ এপ্রিল চড়ক পড়েছে, যেটা কিনা বাবাসাহেব আম্বেদকরের জন্মদিবস।

গাজন দেখতে পুরুলিয়া জেলার রঘুডিহি গ্রামে গিয়েছিলাম, এখানকার জনসংখ্যার পাঁচভাগের প্রায় চারভাগই বাউরি — হিন্দুধর্মের জাতবর্ণের নিরিখে এ জাতি নিদারুণ নিপীড়িত। বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলাতেও তাঁদের বসবাস। ভক্তদের বাদবাকি শুঁড়ি, গোয়ালা ও কুমোর জাতির মানুষ। এঁরা প্রত্যেকেই অন্ত্যজ, তবে মেদিনীপুর জেলার প্রভাবশালী কৃষক সমাজ মাহিষ্য গোষ্ঠীর মানুষজনও এই পরবে যোগ দিয়ে থাকেন।

হিন্দু সমাজে সাধারণত যাঁরা বঞ্চিত, অবহেলিত ও বৈষম্যের শিকার, এ প্রতিবেদনে আমরা দেখতে পাব গাজনের দ্বারা কীভাবে তাঁরা শিবের পুজো ও অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সয়ে সমাজের চোখে সাময়িক ইজ্জত আদায়ের রাস্তা খুঁজে নেন।

ভক্তদের সকলেই অল্পবয়সি, অধিকাংশই তরুণ, কিংবা কুড়ির কোঠায় বয়স। এঁরা টানা ১৫ দিন ব্রহ্মচর্য পালন করেন, একই সঙ্গে ভোর থেকে সন্ধ্যা অব্দি চলে নির্জলা উপোস। রাত হলে তবেই গিয়ে চাট্টি দানাপানি পড়ে পেটে, তাও নিরামিষ, মোটের ওপর ফলমূল আর দুধ।

চৈত্র সংক্রান্তি এ উপোসের অন্তিম দিন, সেদিন বিকেল ৩টে থেকে শুরু হয় গাজন। গাঁয়ের বাইরে এক নির্জন স্থান থেকে প্রদক্ষিণ করতে করতে শিবমন্দির লাগোয়া মাঠে এসে হাজির হয় ভক্তের দল, অনেককে আবার বাঁশে করে বয়েও আনা হয়। গাজন তুঙ্গে উঠলে শৈব উপাসনায় প্রাপ্ত দৈব ক্ষমতা প্রদর্শন করতে থাকেন ভক্তরা।

PHOTO • Madhabi Maity

নিমপাতায় সজ্জিত গাজনযাত্রা। জনাকয় ভক্তকে চাগিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এ তাঁদের আধ্যাত্মিক উন্নতির ইঙ্গিতবাহী

ভক্তদের মধ্যে বিশেষ একটি দল আছে যাঁরা স্বেচ্ছায় অশেষ যন্ত্রণা সহ্য করেন, এঁদের অধিকাংশই জাতিতে বাউরি। তাঁরা ব্রহ্মচর্য পালন তো করেইছেন, উপরন্তু চারদিন ধরে নির্জলা উপোস দিয়ে থেকেছেন। সাত সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি খাবারদাবার বা পানি তো দূর অস্ত, এমনকি নিজেদের থুতু অব্দি গেলেননি। চড়কের দিন এঁদের সাধুসন্তের নজরে দেখা হয়, প্রাঙ্গনে তাঁরা পা রাখতেই সব্বাই দেখলাম চুপটি মেরে গেল। সক্কলের চোখে চোখে ভক্তি ও বিস্ময়। বিশেষ এ ক'জন ভক্তের চোখেমুখে মনঃসংযোগের ছাপ স্পষ্ট, কারও মুখে রা কাড়ছে না। শিব ছাড়া আর কিচ্ছুটি নেই কারও মনেপ্রাণে।

এঁদের কয়েকজনকে মাঠে আসার আগেই ফুঁড়ে দেওয়া হয়ে গেছে। বাকিদের শিবমন্দিরের সামনে ফোঁড়া হল। তবে এ জিনিসটার সাক্ষী থাকা বা ভক্তদের গায়ে হাত দেওয়ার অধিকার নেই মেয়েদের। তাই দেউলের সামনে যা যা হচ্ছিল তা আমি স্বচক্ষে দেখেছি বটে, তবে অনেকটা দূর থেকে। বিশেষ এ ক'জন ভক্তর সিংহভাগই দেখলাম পুরোপুরি নিশ্চুপ, চোখেমুখের ভাবভঙ্গিও পালটাচ্ছে না। তবে বাকিরা যে কতটা উদ্বিগ্ন, সেটা পরিষ্কার ঠাহর হল।

PHOTO • Madhabi Maity

এক ভক্তের জিভে গাঁথা আছে বাণ। পাশাপাশি দুজনেরই বুকের চামড়া ফুঁড়ে বাণ গাঁথা রয়েছে

PHOTO • Madhabi Maity

এই দুজন ভক্তের বগলে লোহার তার গাঁথা আছে, সামনেরজনের ক্ষত বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। কাফিলার পিছনে থাকা ব্যক্তিরা সারাটাক্ষণ ওই তার ধরে টানতে থাকেন

PHOTO • Madhabi Maity

এই ভক্তের গায়ে ফুঁড়ে রাখা লোহার তার সামনের দিক থেকেও টানা হচ্ছে

PHOTO • Madhabi Maity

এক ভক্তের পিঠে সরু সরু বাণ গাঁথা আছে

PHOTO • Madhabi Maity

ভক্তদের পিঠে ফোঁড়ার জন্য বিশেষ ভাবে বানানো হয়েছে এই বৃহদাকার বঁড়শিগুলি। সেই বঁড়শিতে দড়ি বেঁধে তাঁরা একটি রিকশা টানতে টানতে নিয়ে চলেছেন

PHOTO • Madhabi Maity

বঁড়শি গাঁথা দুই ভক্ত একটি রিক্সা টানছেন

PHOTO • Madhabi Maity

দুই হাতে বাণ ফোঁড়া এক ভক্ত জ্বলন্ত ধূপকাঠি নিয়ে চলেছেন, গলায় গুলঞ্চ বা কাঠগোলাপের মালা

পরবের চরম মুহূর্তে, জনাকয় পুরুষ মিলে একজন ভক্তকে একটি বিশালাকার কাঠের খুঁটিতে বাঁধতে থাকেন — এর নাম চড়ক গাছ বা গজারি। পবিত্র চড়ক গাছটি কেবলমাত্র এই আচারের জন্যই নির্মিত হয় এবং গ্রামবাসীরা এটি সাবধানে গুছিয়ে রাখেন। এবার পালা ঝুলন্ত ভক্তর বুক আর উরুতে ফুঁড়ে রাখা বঁড়শির সাহায্যে আস্ত একখান সাইকেল ঝুলিয়ে, তাঁকে শূন্যে তুলে তিন-চারবার বাঁইবাঁই করে ঘোরানোর।

PHOTO • Madhabi Maity
PHOTO • Madhabi Maity

বাঁদিকে: চড়ক গাছে ঝুলন্ত এক ভক্ত, তাঁর শরীরে গাঁথা আংটার সাহায্যে ঝুলছে একটি সাইকেল। ডানদিকে: ঊর্ধ্ব গগনে ঘুরতে থাকা ভক্তের বুক ও উরুতে ফুঁড়ে রাখা আংটায় ঝুলন্ত একটি সাইকেল। সাথে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝুলছে অতিরিক্ত খানিকটা দড়ি

পরব মিটলে দুজন ভক্তকে জিজ্ঞেস করলাম যে তাঁদের ব্যথা লেগেছিল কিনা। দুজনেই মুচকি হেসে জানালেন, ব্যথা-বেদনা শুধু দর্শকদের ভাগেই থাকে, ভক্তদের নয়। তাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে শিবঠাকুরের আশীর্বাদই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয় এবং তাঁদের উপর মহাদেবের বরকত রয়েছে। বছরের পর বছর তাঁরা এভাবেই উপাসনা করে চলেছেন।

গৌতম বাউরি ও আশীষ বাউরি দুজনেই ২২ বছর বয়সি, তাঁরা যথাক্রমে আট ও পাঁচ বছর ধরে গাজনে অংশগ্রহণ করছেন। আঠারো বছরের সত্যজিৎ বাউরি পুরুলিয়ার শর্বরী কলেজে (পঞ্চকোট মহাবিদ্যালয়) পড়ে, এবারের চড়কে সেও ভক্ত হয়েছিল। তারও বিশ্বাস, শিবের আশীর্বাদেই ব্যথা-ট্যথা কিছু টের পাওয়া যায়নি। তিন যুবকের মতে চড়ক জিনিসটা মোটেও বেদনাদায়ক বা ক্ষতিকারক নয়, বরং শিবঠাকুরের পায়ে নিজেদের সঁপে দিয়ে তাঁরা পুণ্য কুড়িয়েছেন।

PHOTO • Madhabi Maity

তিন ভক্ত: গৌতম বাউরি, সত্যজিৎ বাউরি ও আশীষ বাউরি

বানে ফোঁড়া ভক্তরা পরবের আগে বা পরে না নেন বিষহর টিকা, না খান কোনও ওষুধপত্র। জখম শুকোতে কেবল নিমপাতা বেটে, হলুদ দিয়ে ঘি মিশিয়ে তার প্রলেপ লাগান। গাজনের শোভাযাত্রাটাও যে শুধু নিমপাতা দিয়ে সাজানো ছিল, তা লক্ষ্য করেছিলাম। ভক্তদের গলায় কেবলমাত্র গুলঞ্চ বা গড়ুরচাঁপা ফুলের (প্লুমেরিয়া এসপি.) মালা। ভেষজ উদ্ভিদ হওয়ায় নিম, হলুদ আর গুড়ুচির মূল্য গ্রামবাসীদের কাছে অনেকখানি।

নিপীড়িত অন্ত্যজ সমাজের আর পাঁচজন সদস্যের মতোই জ্বালাযন্ত্রণা জিনিসটা ভক্তদের গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে তাঁদের এই মুখ বুজে হাজার যাতনা সহ্য করার ক্ষমতাটাকে শুধু এরকম পালাপার্বণের সময়েই সমাজ কুর্নিশ ঠোকে। সারা বছরে এই একটা সমইয়েই তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা খানিকটা হলেও সম্মান দেয় বাউরিদের, বাদবাকি সময় তো সবর্ণের মন্দিরে ঢোকার অনুমতিটুকুও পান না তাঁরা — এমনকি যে শিব মন্দিরে আজ চড়ক হল, সেখানেও। অথচ গাজনের পরব চলাকালীন সেই অচ্ছুৎ মানুষগুলোই কিনা হয়ে ওঠেন পবিত্র, স্পর্শযোগ্য, গ্রামীণ সমাজের চোখে জাতপাত নির্বিশেষে তাঁরা হয়ে ওঠেন ইজ্জতের পাত্র। গাজনের সময় ভক্তদের প্রত্যেকেই পৈতে পরেন, সাধারণত যে উপবীত কেবল বামুনের গলাতেই দেখা যায়। এই পৈতেই তো পুরুতদের সকল ক্ষমতার উৎস ও প্রতীক। মজার কথা, বামুনরা চাইলেও কিন্তু গাজনের ভক্ত হতে পারে না, এ অধিকার শুধুমাত্র অবর্ণের।

দলিত সমাজের কাছে প্রকৃত অর্থে নিজের বলতে শুধু শরীরটুকুই পড়ে আছে, আর বছরে একটিবার এভাবেই তাঁরা উৎসবের মাধ্যমে সে অধিকার উদযাপন করেন। এই যে ছিনিয়ে আনা ক্ষণিকের মুক্তি, তা উপভোগ করার সুযোগ মেলে।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Translator : Joshua Bodhinetra

ஜோஷுவா போதிநெத்ரா, பாரியின் இந்திய மொழிகளுக்கான திட்டமான பாரிபாஷாவின் உள்ளடக்க மேலாளராக இருக்கிறார். கொல்கத்தாவின் ஜாதவ்பூர் பல்கலைக்கழகத்தில் ஒப்பீட்டு இலக்கியத்தில் ஆய்வுப்படிப்பு படித்திருக்கும் அவர், பன்மொழி கவிஞரும், மொழிபெயர்ப்பாளரும், கலை விமர்சகரும், ச்மூக செயற்பாட்டாளரும் ஆவார்.

Other stories by Joshua Bodhinetra