এই বছর, কোভিড-১৯ অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ ওসমানাবাদে আর কড়া নেড়ে অপেক্ষা করেনি, একেবারে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছে। তুলজাপুর তেহসিলে এই সঙ্কট বাড়িয়ে তোলার পেছনে তুলজা ভবানী মন্দিরের একটা ভূমিকা আছে।

কোভিড-১৯ সংক্রমণে প্রায় মরতে বসা জয়সিং পাতিল প্রতিজ্ঞা করেছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগে আর তিনি মন্দিরের ধারেকাছে যাবেন না। তাঁর কথায়, “দেখুন, আমি ভক্ত। মানুষের বিশ্বাসকে আমি শ্রদ্ধা করি বটে, কিন্তু অতিমারির মধ্যে মন্দির খোলা মোটেই নিরাপদ নয়।”

৪৫ বছর বয়সী পাতিল তুলজা ভবানী মন্দিরের অছি পরিষদে করণিকের কাজ করেন। তিনি জানালেন, “এ বছর ফেব্রুয়ারিতে আমাকে কয়েকশো মানুষের লাইন সামাল দিতে বলা হল।” মহারাষ্ট্রের এই জনপ্রিয় তীর্থস্থানটিতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ আসেন। “ভক্তরা রীতিমতো আক্রমণাত্মক। মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করতে বাধা দিলে তারা আপনার উপর চড়াও হবে। ওই ভিড় সামাল দিতে গিয়েই তো আমাকে কোভিড-১৯-এ ধরল।”

একটি হাসপাতালের ইন্টেনসিভ কেয়ার বিভাগে দুই সপ্তাহ তাঁকে অক্সিজেন দিতে হয়। রক্তে তাঁর অক্সিজেনের মাত্রা ৭৫-৮০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছিল — চিকিৎসকদের মতে ৯০ শতাংশের নিচে নামলেই তা চিন্তার বিষয়। তাঁর কথায়, “কোনোরকমে আমি বেঁচে যাই। কিন্তু এতগুলো মাস পেরিয়েও আমার দুর্বলতা কাটেনি।”

Jaysingh Patil nearly died of Covid-19 after he was tasked with managing the queues of devotees visiting the temple
PHOTO • Parth M.N.

মন্দিরে ভক্তদের ভিড় সামাল দেওয়ার দায়িত্ব বহন করে জয়সিং পাতিল কোভিড-১৯-সংক্রমণে প্রায় মরতে বসেছিলেন

তিনি অসুস্থ হওয়ার মাসখানেক আগে তাঁর ৩২ বছর বয়সী ভাই জগদীশও একইরকম ভয়াবহ অবস্থা থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৮০ শতাংশের নিচে নিয়ে তিনি তিন সপ্তাহ হাসপাতালে কাটিয়ে এসেছেন। "ও এই মন্দিরের পুরোহিত," বললেন জয়সিং। “কোভিড-১৯ আক্রান্ত এক ভক্তের সংস্পর্শে এসে ওর এই রোগ হয়। আমাদের দুজনেরই এই রোগ ঘিরে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছে।”

এই অভিজ্ঞতার ছিল যথেষ্ট ব্যয়বহুল। দুই ভাইয়ের চিকিৎসা বাবদ মোট খরচ হয়েছিল ৫ লাখ টাকা। জয়সিং বলছিলেন, “আমাদের কপাল খুব ভালো যে আমরা বেঁচে গেছি। কিন্তু হাজারও মানুষ মারা যাচ্ছে আর সর্বনাশ হচ্ছে সেই পরিবারগুলির। যতই সাবধান হোন না কেন, মন্দিরে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা অসম্ভব ব্যাপার।”

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী দ্বাদশ শতকে তৈরি এই তুলজা ভবানী মন্দিরটির মোট বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের (টার্নওভার) পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকা, জানালেন তুলজাপুরের তহসিলদার সওদাগর তান্ডলে। সার্বিকভাবে তুলজাপুর তহসিলের অর্থনীতি মন্দির নির্ভর। মিষ্টির দোকান, শাড়ির দোকান, খাবারের দোকান, হোটেল, থাকার জায়গাগুলি তো বটেই, এমনকি পুরোহিতরাও নিজেদের রুজির জন্য নির্ভর করেন তীর্থযাত্রীদের উপর।

কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে গড়ে প্রতিদিন মন্দিরে আসতেন ৫০,০০০ মানুষ, জানালেন তান্ডলে। তাঁর কথায়, “নবরাত্রি উৎসবের সময়ে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) প্রতিদিন মন্দিরে এক লাখ ভক্তের সমাগম হয়।” একবছর তো নাকি একদিনে সাত লাখ ভক্তের সমাগম হয়েছিল।

The Tuljapur temple has been shut since April
PHOTO • Parth M.N.

সেই এপ্রিল থেকে বন্ধ তুলজাপুর মন্দিরের ঝাঁপ

তুলজাপুরের স্থানীয় প্রশাসন স্থির করে যে তীর্থযাত্রীদের পূর্ব-অনুমোদিত ছাড়পত্র দিয়ে প্রতিদিন হাজার দুয়েক অবধি মানুষকে প্রবেশ করতে দেবে। এই সংখ্যা ক্রমে বাড়ানোর ফলে জানুয়ারি ২০২১ নাগাদ প্রতিদিন ৩০,০০০ দর্শনার্থীর আগমন শুরু হয়

তান্ডলে আরও জানান যে ৯০ শতাংশ তীর্থযাত্রী আসেন ওসমানাবাদের বাইরে থেকে। “তারা মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক ইত্যাদি নানান স্থান থেকে আসে।”

অতএব ২০২০ সালে, কোভিড-১৯ অতিমারির প্রথম ধাক্কার পর, নভেম্বরের মাঝামাঝি মন্দির পুনরায় খুলে দেওয়াটা ছিল যথেষ্ট ঝুঁকির ব্যাপার। বিশেষত যখন প্রথম প্রবাহের সময়ে সংক্রমণে তীর্থযাত্রীদের যথেষ্ট অবদান ছিল।

২০২০ সালের ১৭ই মার্চ মন্দির বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এর কিছুদিনের মধ্যেই দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হয়ে যায়, ভক্তরা দেবীকে একবার চোখের দেখা দেখতে আসছিলেন বটে। “ওরা মুখ্য প্রবেশদ্বারের কাছে এসে বাইরে থেকে প্রণাম জানিয়ে চলে যেত,” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলা আধিকারিক জানালেন। “ভক্তরা লকডাউনের মধ্যেও ঠিক এসে হাজির হত তুলজাপুরে। [২০২০ সালের] এপ্রিল-মে মাসে আমাদের এখানে প্রতিদিন, ৫,০০০ দর্শনার্থী উপস্থিত হত। কাজেই, লকডাউনের পরেও এখানে অসুস্থতার হার মোটে কমেনি।”

২০২০ সালের মে মাসে যখন জেলা প্রশাসন তুলজাপুরের পুরোহিতদের পরীক্ষা করা শুরু করল, দেখা গেল তাঁদের মধ্যে ৩,৫০০ জন, অর্থাৎ ২০ শতাংশই ছিলেন কোভিড-১৯ পজিটিভ, জানালেন তান্ডলে। কাজেই, জুন মাস থেকে কোভিড-১৯ নেগেটিভ রিপোর্ট না দেখে কাউকে তুলজাপুরে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিল তহসিল প্রশাসন। তাঁর কথায়, “এর ফলে অবস্থা খানিক নিয়ন্ত্রণে এল। কিন্তু প্রথম ধাক্কার সময়ে তুলজাপুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।”

এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছুই নেই।

Mandakini (left) and Kalyani Salunkhe make puran polis for the devotees. The temple's closure gives them a break but it has ruined the family income
PHOTO • Parth M.N.
Mandakini (left) and Kalyani Salunkhe make puran polis for the devotees. The temple's closure gives them a break but it has ruined the family income
PHOTO • Parth M.N.

মন্দাকিনী (বাঁদিকে) ও কল্যাণী সালুঙ্কে ভক্তদের জন্য পুরনপোলি বানাচ্ছেন। মন্দির বন্ধ হওয়ায় তাঁরা খানিক ছুটি পেয়েছেন বটে কিন্তু রসাতলে গেছে তাঁদের পারিবারিক রোজগার

কিছু কিছু আচার-অনুষ্ঠান রোগ ছড়াতে সাহায্য করেছে। পুরোহিতদের বাড়িতে বানানো পুরনপোলি নামের এক রকম মিষ্টি রুটি ভোগ দেওয়ার প্রথাটি এমনই একটি অনুষ্ঠান। এই খাবার তৈরি করার উপকরণ নিয়ে ভক্তরা হাজির হন, কয়েকটি পোলি নিজেরা সেখানেই খেয়ে বাকিটা ভোগ হিসেবে দেবীকে নিবেদন করেন।

কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে ৬২ বছরের মন্দাকিনী সালুঙ্কে প্রতিদিন প্রায় ১০০ ভক্তের জন্য পুরনপোলি বানাতেন। তাঁর ছেলে নাগেশ মন্দিরে পুরোহিত। “উৎসবের সময়ে কত সংখ্যক পোলি তৈরি হয় তার কোনও হিসাব নেই। আমার সারা জীবন এই করেই কেটেছে,” তিনি বললেন। “জীবনে এই প্রথম আমি একটু বিশ্রাম পেলাম। কিন্তু প্রথম ধাক্কার সময়েও কিছু মানুষ ঠিক হাজির হত।”

পুরনপোলি তৈরি করা সোজা কাজ না। তাছাড়া সঠিক স্বাদ আনতে গোল পোলিগুলিকে গরম তাওয়ায় এপিঠ ওপিঠ করে দু’দিক সমানভাবে ভাজতে হয়। “তুলজাপুরে হাতে পোড়া দাগ নেই এমন কোনও মহিলাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না,” বললেন নাগেশের ৩০ বছর বয়সী স্ত্রী, কল্যাণী। “আমরা খানিক ছুটি পাচ্ছি বটে কিন্তু আমাদের রোজগার পুরো রসাতলে গেছে।”

নাগেশের পূর্বপুরুষরাও মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন। এটাই তাঁর আয়ের একমাত্র পথ। “ভক্তরা নিজেদের সঙ্গে ডাল তেল চাল এবং অন্যান্য রসদ নিয়ে আসে,” তিনি বললেন। “আমরা তার থেকে খানিকটা ব্যবহার করি তাদের খাওয়ানোর জন্য, আর বাকিটা নিজেদের সংসারে কাজে লাগাই। আমরা যখন ভক্তদের হয়ে পূজা করি ওরা আমাদের দক্ষিণা দেয়। আমরা (পুরোহিতরা) মাসে মোটামুটি ১৮,০০০ টাকা করে আয় করতাম। এখন সে সব শিকেয় উঠেছে।”

Gulchand Vyavahare led the agitation to reopen the temple
PHOTO • Parth M.N.

গুলচাঁদ ভ্যাভাহারে মন্দির পুনরায় খোলবার জন্য আন্দোলনে নেমেছিলেন

তারপর তিনি ঝটিতি নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বললেন যে মানুষের জীবন বাজি রেখে তিনি অবশ্য মন্দির খোলার পক্ষে নন। “মানুষের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অর্থনীতির পুনরুত্থান ঘটানো যায় না। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মানে আমরা বুঝি,” তিনি বললেন। “তবে খানিক ত্রাণ পেলে আমরাও রেহাই পেতাম।”

তুলজাপুরে তীর্থযাত্রীদের প্রবেশ রোধ করতে তেহসিল কার্যালয় পুরোহিত ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সাহায্য নেয়। “প্রধান পুরোহিতদের সাহায্যে পুজোপাঠের কাজ আমরা চালিয়ে গেছি,” বললেন তান্ডলে। “গতবছর নবরাত্রীর সময়েও আমরা ভক্তদের প্রবেশ নিষিদ্ধই রেখেছিলাম। বাইরে থেকে কাউকে মন্দিরে ঢুকতে দিইনি। প্রতিবছর খুব ঘটা করে একটি পাল্কি আসে আহমেদনগর (বুরহননগর দেবী মন্দির) থেকে, কিন্তু এই বছর আমরা ওদের বলেছিলাম, কোথাও না থেমে একটা গাড়ি করে সেটা পাঠিয়ে দিতে।”

কিন্তু রোগের প্রথম প্রকোপ অক্টোবর ২০২০ নাগাদ খানিক কমে যাওয়া মাত্র সবাই অতিমারিকে একটি অতীত ঘটনা ভেবে সব সাবধানতা জলাঞ্জলি দিয়ে বসলেন।

তুলজাপুর মন্দির পুনরায় খোলার দাবি উঠতে শুরু করল এবং নভেম্বর ২০২০ নাগাদ শুরু হল প্রতিবাদ আন্দোলন। রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বে এই আন্দোলন হয়। “হোটেল, বার রেস্তঁরা খুলে গিয়েছিল। তাহলে মন্দির কেন বন্ধ থাকবে?” প্রশ্ন তুললেন, বিজেপির ওসমানাবাদ জেলা সম্পাদক গুলচাঁদ ভ্যাভাহারে। “মানুষের জীবনজীবিকা এটার সঙ্গে যুক্ত। কোভিড বুঝি কেবল মন্দির থেকেই ছড়ায়?”

নাম গোপন রাখার শর্তে এক তেহসিল আধিকারিক বললেন যে তুলজাপুরে অর্থনীতি, রাজনীতি, বিশ্বাস সব মিলে মিশে আছে। তাঁর কথায়, “কোনোটিকেই আলাদা করে দেখা যাবে না। মানুষ অর্থনীতির কথা বলে কারণ ধর্ম বিশ্বাসের চেয়ে এটা শুনতে অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। আসলে প্রতিরোধের পিছনে তিনটে কারণই মিলে মিশেছিল।”

মন্দির খোলার দাবিতে যে আন্দোলন গোটা মহারাষ্ট্র জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল তা অবশেষে সফল হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে ২০২০-এর নভেম্বরের মাঝামাঝি মন্দির খোলার অনুমতি দেন।

তুলজাপুরের স্থানীয় প্রশাসন স্থির করে যে তীর্থযাত্রীদের পূর্ব-অনুমোদিত ছাড়পত্র দিয়ে প্রতিদিন হাজার দুয়েক অবধি মানুষকে প্রবেশ করতে দেবে। এই সংখ্যা ক্রমে বাড়ানোর ফলে জানুয়ারি ২০২১ নাগাদ প্রতিদিন ৩০,০০০ দর্শনার্থী আসতে শুরু করেন। জয়সিং জানালেন যে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে যায়। “৩০,০০০ মানুষকে ছাড়পত্র দেওয়া মাত্র আরও ১০,০০০ জন বিনা ছাড়পত্রে প্রবেশ করার জেদ ধরে।” তিনি আরও বলছিলেন, “দূরদূরান্ত থেকে যে ভক্তরা এসেছে দেবীমায়ের আশীর্বাদ নিতে তারা কোনও অবস্থাতেই ‘না’ শুনতে রাজি ছিল না। এই দ্বিতীয় ধাক্কার জের কমে গেলেও আমাদের নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। কেউ কেউ এই ভাইরাসকে লঘুচালে নিয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই রোগ না হলে বোঝা যায় না যে এটা কতখানি ভয়ানক একটা অভিজ্ঞতা।”

Nagesh Salunkhe has been losing out on the earnings from performing poojas in the Tuljapur temple (right)
PHOTO • Parth M.N.
Nagesh Salunkhe has been losing out on the earnings from performing poojas in the Tuljapur temple (right)
PHOTO • Parth M.N.

নাগেশ সালুঙ্কে, তুলজাপুর মন্দিরে (ডানদিকে) পুজো করে যে আয় করতেন তা আর করতে পারছেন না

তুলজাপুর মন্দিরে মানুষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওসমানাবাদ জেলায় কোভিড রোগীর সংখ্যাতেও আধিক্য হল। ফেব্রুয়ারি মাসে ওই জেলায় ৩৮০ জন রোগীর সন্ধান মেলে। মার্চে সংক্রমিতের সংখ্যা নয়গুণ হয়ে দাঁড়ায় ৩,০৫০ জনে। এপ্রিলে ওসমানাবাদের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উপর চাপ পড়ে যখন সংখ্যা দাঁড়ায়, ১৭,৮০০।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলা আধিকারিক জানালেন, “ওসমানাবাদ জেলায় তুলজাপুর ছাড়া আর কোনও জায়গা নেই যেখানে এতো মানুষের ভিড় হয়। নিঃসন্দেহে এর ফলে কোভিড-১৯-অতিমারির দ্বিতীয় ধাক্কার জোর বেড়েছে। উত্তরপ্রদেশে কুম্ভ মেলায় যা হয়েছে এ যেন তারই এক ক্ষুদ্র সংস্করণ।”

তুলজাপুরের পুরোহিতদের পরীক্ষা করে দেখা যায় যে তাঁদের মধ্যে ৩২ শতাংশই কোভিড-১৯ পজিটিভ। ৫০ জনের মতো মারা যান," জানালেন তান্ডলে।

সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা এবং মৃত্যুহারে ওসমানাবাদ জেলার আটটি তেহসিলের মধ্যে তুলজাপুর তেহসিলের স্থান দ্বিতীয়। ওসমানাবাদ তেহসিলের স্থান সর্বোচ্চে কারণ জেলার সবচেয়ে বড়ো সরকারি হাসপাতাল, এবং সিভিল হাসপাতাল যেখানে সারা জেলার কঠিন অসুখের চিকিৎসা হয় সেটি এখানে অবস্থিত।

খরা, দুর্দশা, ঋণে জর্জরিত, মহারাষ্ট্রে সর্বাধিক কৃষক আত্মহত্যার ক্ষত বহন করে চলা কৃষিনির্ভর মারাঠাওয়াড়া অঞ্চলেই অবস্থিত ওসমানাবাদ জেলা। করোনাভাইরাসের আগমনের পূর্বেই জলবায়ুর চরিত্রে বদল, জলাভাব, কৃষি সংকট ইত্যাদি নানান কারণে ধুঁকতে থাকা এই জেলার মানুষের এমনই দুরবস্থা যে নিজেদের চিকিৎসার জন্যে এই অপ্রতুল স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর উপরে নির্ভরও করতে পারেন না।

Sandeep Agarwal does not mind losing sales from shutting his grocery shop until it is safe for the town to receive visitors
PHOTO • Parth M.N.

মানুষ সমাগমের জন্য শহর যতক্ষণ নিরাপদ না হচ্ছে, সন্দীপ অগরওয়াল ততদিন নিজের মুদিখানা বন্ধ রেখে লোকসান সইতেও রাজি আছেন

এইবছর এপ্রিলে তুলজাপুর ভবানী মন্দির আবার বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, শহরের গলিগুলি খাঁখাঁ করছে, দোকানের ঝাঁপ বন্ধ — সব মিলিয়ে দ্বিতীবারের জন্য এক অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে শহর জুড়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলা আধিকারিকের বক্তব্য, “চলতি (রাজনৈতিক) পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন মন্দির বন্ধ রাখাটাও ঝুঁকির বিষয়। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি পারে।”

কিন্তু তুলজাপুরের মানুষ অর্থনৈতিক ক্ষতির চেয়ে নিরাপদে থাকাটাকেই শ্রেয় মনে করেন।

৪৪ বছর বয়সী সন্দীপ অগরওয়াল শহরে একটি মুদিখানা চালান। তিনি জানালেন যে কোভিড পরিস্থিতির আগে দৈনিক ৩০,০০০ টাকার বিক্রি হত তাঁর দোকানে আর এখন তা প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে। “দেশের বেশিরভাগ মানুষের টিকা হওয়ার আগে মন্দির খুলুক তা কিন্তু আমি চাই না,” নিজের বন্ধ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন। “আমরা একবারই বাঁচি। যদি বেঁচে থাকি অর্থনীতিকে আবার চাঙ্গা করে তুলতে পারব। যারা মন্দির খোলার জন্য তাড়াহুড়ো করছে তারা কেউ ওসমানাবাদে থাকে না।”

সন্দীপ ঠিকই বলেছেন।

সারাটা দেশ থেকেই মন্দির কবে খুলবে জানতে চেয়ে দিনে ২০টি করে ফোন আসে তুলজাপুর মন্দিরের তুকোজিবুয়া নামের এক মহন্তের কাছে। তিনি বললেন, “আমি সমানে তাদের বলি যে মানুষের জীবন বিপন্ন সুতরাং ধরে নেওয়া যাক ২০২০- ২০২১ পুরোটাই আমরা স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যে সঁপে দিয়েছি। ভাইরাস আপনার ভক্তির পথে বাধা হতে পারে না। আপনি বাড়িতে থেকেও দিব্যি দেবীর পুজো করতে পারেন।”

কিন্তু দেবীর ভক্তকূল নিজেরা এসে দেবীর আশীর্বাদ নিতে, নিদেন পক্ষে মন্দিরের দরজাটা ছুঁতে মরিয়া বলে জানালেন মহন্ত।

Mahant Tukojibua has been convincing the temple's devotees to stay where they are and pray to the goddess from there
PHOTO • Parth M.N.

বাড়িতে থেকেই দেবীর পুজো করার কথা মানুষকে বোঝাচ্ছেন মহন্ত তুকোজিবুয়া

মহন্ত কথা শেষ করতে না করতেই তাঁর ফোন বেজে উঠল। ফোন এল তুলজাপুর থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে পুণে থেকে।

“সাষ্টাঙ্গ নমস্কার,” বলে তাঁকে অভিবাদন জানালেন সেই ভক্ত।

“কেমন আছেন?” জিজ্ঞাসা করলেন মহন্ত।

“মন্দির তো তাড়াতাড়ি খোলা উচিত এবার, নাকি?” বলে কাতর কণ্ঠে মিনতি করলেন পুণের সেই ভক্ত। তাঁর আরও বক্তব্য, “ঈশ্বর কোনও অমঙ্গল করতেই পারেন না। আমাদের ইতিবাচক চিন্তা করা উচিত। আমাদের সবকিছুই তো তুলজা ভবানীর কৃপায়। এমনকি ডাক্তাররাও তো আমাদের ঈশ্বরে আস্থা রাখতে বলেন।”

তুকোজিবুয়া তাঁকে বুঝিয়ে বলেন যাতে তিনি অনলাইন মাধ্যমে মন্দিরের পূজা-দর্শন সেরে নেন। কোভিড-১৯ অতিমারি জনিত লকডাউনের পর থেকে মন্দিরের তরফে পূজা সম্প্রচারের এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কিন্তু ভক্ত নাছোড়বান্দা। পুরোহিতের প্রতি তাঁর নিদান, “মন্দিরের ভিড়ের কারণে কোভিড ছড়াতেই পারে না।” তিনি পণ করেন, যে মুহূর্তে মন্দির আবার খুলবে, তখনই তিনি ৩০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে এখানে এসে হাজির হবেন।

অনুবাদ: চিলকা

Parth M.N.

பார்த். எம். என் 2017 முதல் பாரியின் சக ஊழியர், பல செய்தி வலைதளங்களுக்கு அறிக்கை அளிக்கும் சுதந்திர ஊடகவியலாளராவார். கிரிக்கெடையும், பயணங்களையும் விரும்புபவர்.

Other stories by Parth M.N.
Translator : Chilka

Chilka is an associate professor in History at Basanti Devi College, Kolkata, West Bengal; her area of focus is visual mass media and gender.

Other stories by Chilka