বেশ আজব ব্যাপারটা — দিল্লির জি টি কর্নল বাইপাসে, আমাদের চোখের সামনেই ঘটল ঘটনাটি।
ট্র্যাক্টরের একটা কাফিলা যাচ্ছিল দিল্লি অভিমুখে আর একটা যাচ্ছিল বিপরীত দিকে — দিল্লি থেকে সিংঘু। জাতীয় সড়কের এক স্থানে দুটি মিছিল সামনাসামনি হলে একটা গোলযোগের একটা আঁচ পাওয়া গেল। দিল্লি থেকে আসা মিছিলটি নেতাদের কথা মতো কর্মসূচি পালন করছিল। পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করে যে যাত্রাপথ স্থির হয়েছিল, তার থেকে ভিন্ন একটি পথে নেতারা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ভুলবশত এইকথা ভেবে অংশগ্রহণকারীদের একটি দল সকালেই রাজধানীতে চলে গিয়েছিল।
সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে যে তিনটি কৃষি আইনকে গায়ের জোরে সরকার বলবৎ করে, সেগুলির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত কৃষকরা টিকরি, সিংঘু, গাজিপুর, চিল্লা ও মেওয়াটের মতো দিল্লি সীমান্তের বিভিন্ন স্থান থেকে কৃষকদের নিজস্ব সাধারণতন্ত্র দিবসের প্যারেড অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেন। আর একটি মিছিল হচ্ছিল রাজস্থান-হরিয়ানা সীমান্তে অবস্থিত শাহজাহানপুরে, সেই মিছিলে এক একটি দল ভারতের এক একটি রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করে ৬০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। সারা ভারত কৃষকসভার মতে এইটি ছিল আমাদের ইতিহাসে প্রথম জনগণের অংশগ্রহণে এমন জনপ্রিয় সাধারণতন্ত্র দিবসের উৎসব অনুষ্ঠান।
এটি ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ একটি মিছিল - অভূতপূর্ব এই কর্মসূচিতে শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য সাধারণ মানুষ সাধারণতন্ত্র দিবসের দখল নেন। লক্ষাধিক মানুষ, কয়েক সহস্র ট্র্যাক্টরের এই মিছিলের সঙ্গে তাল মিলিয়েছিল ভারতবর্ষের প্রায় সব রাজ্যে ওই দিনই অনুষ্ঠিত একই ধরনের মিছিল।
অথচ একটি ছোটো গোষ্ঠী দিল্লিতে চমক দিয়ে একটি বিচ্ছিন্ন গোলযোগ ঘটিয়ে কৃষকদের ওই অবিশ্বাস্য ও ব্যাপক অনুষ্ঠান কর্মসূচি থেকে গণমাধ্যমের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এই গোলযোগ ও হিংসাত্মক পদক্ষেপ যা মিছিলের নির্দিষ্ট গতিপথ ভেঙে দিল্লি প্রবেশ করেছিল তার তীব্র নিন্দা করেছে দিল্লি সীমান্তে দুই মাস ধরে চলা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী ৩২টি কৃষক সংগঠনের যুক্ত মঞ্চ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। মোর্চা এই কাজকে “শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলনকে বিনষ্ট করার গভীর চক্রান্ত” হিসাবেও চিহ্নিত করেছে।
সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার ৩২টি কৃষক সংগঠনের অন্যতম, কীর্তি কিষাণ ইউনিয়নের সদস্য করমজিৎ সিং জানালেন, “মূল মিছিলটির রওনা হওয়ার কথা ছিল সকাল ১০টায়। কিন্তু দীপ সিধু, লাখা সিদানা (ও আরও কয়েকজন), যারা ৩২টি ইউনিয়নের যৌথ মোর্চার সদস্যই নয়, গোলমাল শুরু করে। তারা সকাল ৮টা নাগাদ, ব্যারিকেড ভেঙে দিল্লিরর রিং রোডের দিকে যেতে শুরু করে। কেবল তাই-ই নয়, তারা অন্যদেরও তাদের সঙ্গে যোগদানে উৎসাহিত করে। এরাই লালকেল্লায় ঢুকে নিজেদের পতাকা উড়িয়ে ছিল।”
দীপ সিধু যে সেসময় দিল্লিতে তার সেদিনের ক্রিয়াকলাপের দায় স্বীকার করছে তার প্রমাণও আছে। পঞ্জাবের গুরুদাসপুর নির্বাচনী ক্ষেত্রের সাংসদ, বিজেপির সানি দেওলের ঘনিষ্ঠ এই সিধু।
“আমরা মোটেই এদের সমর্থন করি না। আমরা ভালো করেই জানি ওরা যা করেছে তা অন্যায়। ২৬ তারিখ যা হয়ে গেছে তা আর হবে না। এই আন্দোলন আগে যেমন শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল, তেমনই চলবে। আমরা ব্যারিকেড ভাঙা বা লালকেল্লায় পতাকা লাগানো - এসব মোটেই সমর্থন করি না। এমন বিশ্রী ঘটনা যাতে আর না ঘটে তা আমরা নিশ্চিত করব,” বললেন করমজিৎ সিং।
ওই বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীটি তাদের মিছিল আগে শুরু করায় এবং ব্যারিকেড ভাঙায় বহু অংশগ্রহণকারী ধন্দে পড়ে যান, তাঁরা মনে করেন যে এটিই বুঝি নেতৃত্বের নতুন পরিকল্পনা। মিছিলের জন্য সিংঘু থেকে দিল্লির যাওয়ার পথটি পুলিশের অনুমতিক্রমে আগেই ঠিক করা ছিল। কিন্তু এই দলগুলি একটি অন্য পথ ধরে দিল্লিতে প্রবেশ করে লালকেল্লার দিকে এগোতে শুরু করে। তারা কেল্লায় ঢোকার সময়েই পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। ইতিমধ্যেই কেউ কেউ কেল্লায় প্রবেশ করতে সক্ষম হন এবং সেখানে জাতীয় পতাকার পাশেই একটি ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
অন্যদিকে, গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের সংখ্যাকে ছাপিয়ে সুবিশাল মূল মিছিলটি সগর্বে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে চলা একের পর এক ট্র্যাক্টরের কাফিলা নিয়ে এগোচ্ছিল, আর মিছিলে ক্রমাগত সামিল হচ্ছিলেন দলে দলে মানুষ।
“আমরা কৃষক। আমরা ফসল তুলি, আর সেটাই আপনাদের খাদ্য যোগায়। আমাদের উদ্দেশ্য তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করানো। লালকেল্লায় ঢুকে নিজেদের পতাকা উড়িয়ে আসা তো আর আমাদের লক্ষ্য ছিল না। কাল যা হয়েছে তা ভুল হয়েছে,” বললেন, পঞ্জাবের মোগা এলাকার গ্রাম শেরা শেরা থেকে আসা ৪৫ বছর বয়সী কৃষক বলজিন্দর সিং।
বলাই বাহুল্য, এরপর থেকেই গণমাধ্যমের দৃষ্টি সম্পূর্ণ ঘুরে যায় এই বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী ও তাদের এই নাটকীয় ঘটনার দিকে। অর্থাৎ, এর মানে দাঁড়াল শান্তিপূর্ণ মূল মিছিলটি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হল। ৩২টি কৃষক সংগঠনের কৃষকরা পূর্বনির্ধারিত এবং পুলিশের অনুমতিপ্রাপ্ত পথ ধরেই এগিয়েছে। অনেকেই ট্র্যাক্টরের পাশে হেঁটেছেন, আবার অনেকে যোগ দিয়েছেন নিজেদের সাইকেল বা মোটর সাইকেলে চেপে।
এই মিছিলে যোগদানকারী কৃষকেরা দিল্লিতে প্রবেশ করার পর থেকে আর কোনও মারামারি বা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। যাত্রাপথে তাঁরা যখনই কোনও বসতি এলাকায় প্রবেশ করেছেন সেখানকার বহু মানুষ তাঁদের ফুল ফল জল দিয়ে স্বাগত জানিয়েছেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন ৫০ বছর বয়সী বাবলি কৌর গিল। তিনি ট্র্যাক্টর যাত্রী কৃষকদের মধ্যে জলের প্যাকেট বিতরণ করেছেন। তিনি জানান, “আমি এঁদের জন্যই এখানে এসেছি। আমাদের যা দরকার তা তো এঁরাই জোগান দেন। ভোরে উঠে আমি চা খাই। তারপর সকালের জলখাবারে রুটি খাই। এসবই তো কৃষকদের দান। দেখুন সেই কৃষকদের অবস্থা আর তাকিয়ে দেখুন তাঁদের প্রতিবাদের দিকে। জনৈক মহিলা নিজের ১ বছরের শিশুকে নিয়ে সিংঘু সীমান্তে অবস্থান করছেন। কেন তিনি এমন করছেন? যদি জমি না থাকে তিনি কেমনকরে নিজের বাচ্চাকে বড়ো করে তুলবেন? যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সরকারের উচিত এই আইনগুলি প্রত্যাহার করা।”
“সরকারি ছুটির দিন ছিল, আমি তো আনন্দে নিজের পরিবারের সঙ্গেই দিনটা কাটাতে পারতাম। কিন্তু আমি স্বেচ্ছায় এখানে এসেছি কৃষকদের প্রতি সমর্থন জানাতে,” বললেন দিল্লির সর্দার বাজার এলাকার ৩৮ বছর বয়সী আশফাক কুরেশি। ‘দিল্লিতে স্বাগত’ লেখা একটি বোর্ড হাতে কুরেশি মিছিলটিকে অভ্যর্থনা জানান।
ট্র্যাক্টরগুলি ছিল দেখার মতো — রংবেরঙের কাগজ, ফিতে আর ফুল দিয়ে বেশ কয়েকটি ট্রাক্টর সাজানো হয়েছিল। ভারতীয় পতাকা উড়ছিল সেগুলির মাথায়। কৃষকরা সগর্বে সংহতির গান গেয়ে জানান দিচ্ছিলেন যে কৃষি আইনগুলি প্রত্যাহার না হলে তাঁরা কোনও মতেই নতি স্বীকার করবেন না। “আমাদের আবেদনে সরকারকে সাড়া দিতেই হবে। এ তো জোর করে আমরা যা চাই না সেই আইন আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া। ওরা তো ইতিমধ্যেই আম্বানি আদানির কাছে বিকিয়ে গেছে,” ট্র্যাক্টরের পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন পাতিয়ালা থেকে আসা ৪৮ বছর বয়সী মনিন্দর সিং। “কিন্ত এই লড়াইয়ে আমরা হারব না। আমরা আমৃত্যু এই লড়াই চালিয়ে যাব।”
অনুবাদ: চিলকা