তিনি হাজির হলেন যেভাবে, আজ অবধি কোনও সিনেমার দৃশ্যে হিরোর আবির্ভাবও ওভাবে হয়েছে বলে তো মনে হয় না। এই তো, পাঁচ মিনিট আগেই জনা ছয় পুরুষ মিলে দিব্যি কেটে বলেছিল যে কাঁঠালের কারবারে মেয়েমানুষের কোনও জায়গা নেই — বওয়ানি, ভারি ওজন তোলাপাড়া, ঝুঁকি, এসবের জন্য আর কি। অথচ গায়ে হলুদ একখান শাড়ি, মাথায় ধূসর চুলের খোঁপা আর নাকে আর কানে সোনার গয়না পরে এ. লক্ষ্মী দোকানে পা রাখতেই সসম্ভ্রমে একজন চাষি বলে উঠলেন, “এ ব্যবসায় তাঁর মতো গণ্যমান্য আর কেউ নেই।”
“আমাদের ফসলের দরদাম সব উনিই ঠিক করেন।”
এ. লক্ষ্মী শুধুই যে পানরুটির সবেধন মহিলা কাঁঠালচাষি, তা নয়, কৃষিনির্ভর বাণিজ্যে তাঁর মতো প্রবীণ মহিলা ব্যাপারী খুব কমই আছেন।
তামিলনাড়ুর কুড্ডালোর জেলার পানরুটি শহরটা কাঁঠালের জন্যই বিখ্যাত। ফসলের মরসুমে শত শত টন কাঁঠাল কেনাবেচা হয় প্রতিদিন। যে ২২টি দোকান এ শহরের কাঁঠাল-মাণ্ডি হিসেবে কাজ করে, সেখানে ঠিক কত টাকায় হাজার হাজার ফল বিকবে, সেটা লক্ষ্মীই ঠিক করেন। ক্রেতাদের থেকে অল্প একটু কমিশন পান — প্রতি ১,০০০ কাঁঠালে ৫০ টাকা, চাইলে চাষিরাও আরও খানিকটা টাকা ধরে দেন তাঁর হাতে। লক্ষ্মীর আন্দাজ, কাঁঠালের মরসুমে রোজ ১,০০০-২,০০০ টাকা আয় তো হয়-ই।
তবে সেটার জন্য ১২ ঘণ্টা খাটতেও হয়, রাত ১টা বাজলেই দিন শুরু হয়ে যায় তাঁর। “সরাক্কুর [পণ্য] পরিমাণ খুব বেশি হলে তো ব্যবসায়ীরা তারও আগে বাড়ি থেকে আমায় ডেকে নিয়ে যায়,” বুঝিয়ে বললেন লক্ষ্মী। অটোয় চেপে মাণ্ডি পৌঁছতে ভোররাত ৩টে পেরিয়ে গেছে, এমনটা কক্ষনো হয়নি। লক্ষ্মীর ‘দিন’ শেষ হতে হতে দুপুর ১টা বেজে যায়, তারপর ঘরে ফিরে চাট্টি খেয়েদেয়ে ঘুমানোর পালা। দেখতে দেখতেই আবার বাজারে ছোটার সময় চলে আসে।
“কাঁঠালের চাষের ব্যাপার খুব একটা বেশি কিছু জানি না,” তিনি বললেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বকবক করে আর চিল্লিয়ে গলাখানা কেমন যেন ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে হয়ে গেছে। “তবে বিক্রিবাটার ব্যপারে অল্প একটু জানি বৈকি।” বড্ড বিনয়ী তিনি। আরে বাবা, তিন দশক ব্যবসা করে পেট চালাচ্ছেন লক্ষ্মী। তবে তারও আগে, ২০ বছর ধরে চলন্ত রেলগাড়িতে কাঁঠাল বেচতেন লক্ষ্মী।
কাঁঠালের জগতে সেই ১২ বছর বয়সে পা রেখেছিলেন তিনি। আধা-শাড়ি গায়ে, খানকতক পালা পাড়ম (কাঁঠালের তামিল নাম) নিয়ে বাষ্পচালিত ভান্দিতে (প্যাসেঞ্জার ট্রেন) উঠে পড়তেন ছোট্ট লক্ষ্ণী। আর আজ সেই মানুষটাই নিজের বানানো দালানে থাকেন — সামনের দিকে দেখলাম ‘লক্ষ্মী ভিলাস’ লেখা আছে।
নিজের রোজগারে এ বাড়িটি বানিয়েছেন তিনি। কাঁঠাল, যা নাকি পৃথিবীর বৃহত্তম ফলের মধ্যে অন্যতম, সেটি কেনাবেচার শ্রমেই গড়ে উঠেছে এই বসত বাড়িটি।
*****
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি নাগাদ শুরু হয় কাঁঠালের মরসুম, চলে পুরো ছয়মাস ধরে। তবে ২০২২ সালের উত্তরপূর্ব বর্ষায় বেমরসুমি অতিবৃষ্টির ফলে গাছে গাছে ফুল ফোটা ও ফলনের সময়টা পিছিয়ে গিয়েছিল আট সপ্তাহ। পানরুটির মাণ্ডিতে যতদিনে কাঁঠাল এসে পৌঁছয়, ততদিনে এপ্রিল গড়িয়ে গেছে। অগস্ট আসতে না আসতেই ফুরিয়ে যায় পালা পড়মের ঋতু।
স্থানীয় লোকজনের কাছে এই ফলের নাম ‘জ্যাক’, আদি নিবাস ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা। মালায়লাম ভাষার ‘চাক্কা’ শব্দ থেকে এই নামটি এসেছে। তবে এর বেশ একটা গালভরা বৈজ্ঞানিক নামও আছে: আর্টোকার্পাস হেটেরোফাইলাস।
২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ব্যবসায়ী ও চাষিদের সঙ্গে মোলাকাত করতে প্রথমবার পানরুটিতে গিয়েছিল পারি। তাঁর দোকানে পা রাখতেই আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন চাষি ও কমিশন এজেন্ট আর. বিজয়কুমার (৪০)। কাঠামোটা বেশ সাদামাটা — দুরমুশ করা মাটির মেঝে, চাঁচের (বাঁশের বাখারি) চালা, চাঁচের দেওয়াল। তবে বছর গেলে কিন্তু ৫০,০০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। বিলাসিতার চিহ্ন বলতে একখানা বেঞ্চি আর খানকতক চেয়ার।
ফিকে হয়ে আসা উৎসবের স্মৃতি হয়ে ঝুলছে কিছু ফিতে, মালায় সজ্জিত বাবার ছবি, একটা মেজ, আর ঢিপি ঢিপি কাঁঠাল। ঢোকার মুখেই ১০০টা কাঁঠালের স্তূপ — যেন ছোট্টখাট্টো একখান পান্নাসবুজ টিলা।
বিজয়কুমারের কথায়: “ওটার দাম ২৫,০০০ টাকা।” একেবারে শেষের স্তূপে ৬০টা কাঁঠাল আছে, ইতিমধ্যেই প্রায় ১৮,০০০ টাকা দিয়ে সেটা কিনে নিয়েছে দুইদল খদ্দের — অচিরেই চেন্নাইয়ের আদিয়ারে পাঠানো হবে ফলগুলো।
খবর কাগজের ভ্যানে চেপে ১৮৫ কিলোমিটার দূর চেন্নাই শহরে যাবে কাঁঠালগুলি। “আরও উত্তরে যেতে হলে টাটা কোম্পানির এস্ ট্রাকে পাঠাই। দিনের সিংহভাগ খাটাখাটনিতেই বেরিয়ে যায়। মরসুম এলে ভোররাত ৩-৪টে থেকে রাত ১০টা অবধি কাজ করি,” বলছিলেন বিজয়কুমার, “এই ফলের চাহিদা বিশাল। সব্বাই খায়। এমনকি যাদের সুগার (মধুমেহ) আছে, তাঁরাও খান চারেক সোল্লাই [কোয়া] সাঁটিয়ে দেন। শুধু আমাদেরই,” মুচকি হেসে জানালেন, “অরুচি ধরে গেছে খেয়ে খেয়ে।”
পানরুটিতে ২২টা পাইকারি দোকান আছে, জানা গেল তাঁর থেকে। এই চালাঘরটি আদতে তাঁর বাবার ছিল, প্রায় ২৫ বছর দোকান চালিয়ে তিনি দেহ রাখলে ব্যবসার লাগাম ধরেন বিজয়কুমার, সে আজ ১৫ বছর আগেকার কথা। দিন গেলে প্রতিটা দোকানেই টন দশেক কাঁঠাল কেনাবেচা হয়। তাঁর কথায়: “গোটা তামিলনাড়ুতে পানরুটি ব্লকের মতো এত কাঁঠাল আর কোত্থাও নেই।” বেঞ্চিটায় কয়েকজন পুরুষ চাষি বসেছিলেন খদ্দেরের অপেক্ষায়, এটা শোনামাত্র তাঁরা ঘাড় নেড়ে আমাদের কথোপকথনে যোগ দিলেন।
প্রত্যেকেরই পরনে জামা, নিম্নাঙ্গে ভেস্টি কিংবা লুঙ্গি। সব্বাই সবাইকে চেনেন, প্রায় প্রত্যেকেরই কাম-ধান্দা কাঁঠালকে ঘিরে। আড্ডার স্বর ছিল চড়া, ফোনের রিংটোন ছিল তারও এককাঠি উপরে, তবে সবকিছুই ছাপিয়ে যাচ্ছিল বাইরে দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া লরির আওয়াজ — রিনরিনে কর্কশ হর্নের শব্দে কান পাতা দায়।
কাঁঠালচাষে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানালেন কে. পাট্টুসামী (৪৭)। পানরুটি ব্লকের কাট্টান্ডিকুপ্পাম গ্রামের এই মানুষটি ৫০খানা গাছের মালিক। উপরন্তু ইজারায় আরও ৬০০টা গাছ নিয়েছেন। প্রতি ১০০টা গাছ-পিছু ইজারার চলতি বাজারদর ১.২৫ লাখ টাকা। তাঁর বক্তব্য: “২৫টা বছর এই কারবারে আছি। শুনুন, একটা কথা বলি আপনাকে, এ ধান্দায় অনিশ্চয়তার কোনও শেষ নেই।”
প্রচুর পরিমাণে ফলন হলেও, “১০টা পচে যাবে, ১০টা ফেটে যাবে, ১০টা পড়ে যাবে, জন্তু-জানোয়ারের পেটে যাবে আরও খান দশেক,” তর্ক জুড়েছিলেন পাট্টুসামী।
অতিরিক্ত পেকে গেল সে ফল পশুখাদ্য বাদে আর কোনও কাজে লাগে না। গড়পড়তা ৫-১০ শতাংশ কাঁঠাল তো বাদ পড়েই। অর্থাৎ ফি মরসুমে দোকান-পিছু আধা টন থেকে এক টন নষ্ট হয় প্রতিদিন। এমন পাহাড়প্রমাণ কাঁঠাল, অথচ পশুদের খাওয়ানো ছাড়া কোনও উপায় নেই আর — বলে উঠলেন চাষিরা।
গবাদি পশুর মতো গাছগুলিও একপ্রকারের বিনিয়োগ। গ্রামীণ মানুষের কাছে উভয়েই সমান — বছর বছর যার মূল্য বৃদ্ধি হয়, শেষে গিয়ে বেচলে পরে মোটা অঙ্কের মুনাফাও হাতে আসে। বিজয়কুমার ও তাঁর সাথীরা বললেন — কাঁঠাল গাছের ঘের ৮ হাত আর উচ্চতা ৭-৯ হাত হয়ে গেলে, “শুধু কাঠ বেচেই ৫০,০০০ টাকা রোজগার হয়ে যায়।”
তবে পারতপক্ষে কৃষকেরা গাছ কাটেন না, জানলাম পাট্টুসামীর থেকে: “আমরা চেষ্টা করি যাতে [গাছের] সংখ্যাটা বাড়ানো যায়। কিন্তু পুঁজির দরকার পড়লে — যেমন হঠাৎ করে অসুখ-বিসুখ কিংবা বাড়িতে কারও বিয়ে-শাদি — বড়ো দেখে গোটা কতক গাছ বাছি, তারপর কাঠ চেরাইয়ের জন্য বেচে দিই।” এর থেকে এককালীন লাখ দুয়েক টাকা হাতে আসে। সে রোগজ্বালাই হোক বা কল্যাণম (বিয়ে), সামলে ওঠা যায় সবকিছুই…
দোকানের পিছন দিকে হেঁটে গিয়ে, “এদিকে আসুন,” বলে আমাকে ডাকলেন পাট্টুসামী। এককালে ডজন খানেক ইয়াব্বড়ো বড়ো কাঁঠালগাছ ছিল এদিকটায়। অথচ আজ এখানে পালা কান্নু (কাঁঠাল গাছের চারা) ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। এই জমিটা যাঁর, তিনি কিছু খরচাপাতি সামলাতে গিয়ে গাছগুলো বেচে দিয়েছিলেন। সবকিছু সামলে-টামলে এই চারাগাছগুলি লাগিয়েছিলেন তিনি। খুদে খুদে রোগাসোগা চারাগুলির দিকে আঙুল তুলে পাট্টুসামী বলে উঠলেন: “এগুলো মোটে দুই বছরের। আর কয়েক বছর না কাটলে কাঁঠাল গাছে ফল ধরবে না।”
ফি বছর, পয়লা ফলনটা পশুপ্রাণীর পেটেই যায়। “বাঁদরের দল দাঁতে করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে হাত দিয়ে ধরে খায়। কাঁঠাল খেতে কাঠবেড়ালিও খুব ভালোবাসে।”
পাট্টুসামীর কথায় ইজারায় গাছ নিলে সবারই মঙ্গল, “গাছের মালিক এককালীন থোক হিসেবে টাকা পায় প্রতিবছর, আর এদিক থেকে একটা, ওদিক থেকে একটা ফল কেটে সময়মতো বাজারে ছোটারও কোনও প্রয়োজন নেই। উল্টোদিকে আমার মতো যাদের এমনিতেই অসংখ্য গাছ নিয়ে কারবার — তারা একই সঙ্গে ১০০-২০০টা ফল কেটে মাণ্ডিতে ধরে দিতে পারে।” যতক্ষণ অবধি গাছ ও আবহাওয়া কোনও বেগড়বাঁই না করছে, যতক্ষণ অবধি শান্তিতে ফল ধরছে, ততক্ষণ অবধি এ হেন ব্যবস্থাপনায় সবার লাভ।”
দুঃখটা কোথায় জানেন? সবকিছু ঠিকঠাক চললেও দরদাম ঠিক করাটা চাষিদের হাতে নেই। নয়ত বাজারদরের হেরফের এরকম তিনগুণ ওঠানামা করত না, ঠিক যেমনটা হয়েছিল ২০২২ সালে। এক টন কাঁঠালের দাম ঢেঁকির মতো ওঠানামা করেছিল ১০,০০০ আর ৩০,০০০ টাকার মধ্যে।
“দরটা চড়া থাকলে মনে হয় অনেক টাকার খেলা,” তাঁর কাঠের ডেস্কের দেরাজের দিকে ইঙ্গিত করলেন বিজয়কুমার। ক্রেতা-বিক্রেতা দুজনের থেকেই ৫ শতাংশ কমিশন নেন তিনি। “কিন্তু একজন মক্কেলও যদি ফেরেববাজি করে, পুরোটাই জলে যায়। তখন পুরো তহবিলটাই খালি করে,” ঈষৎ কাঁধ ঝাঁকিয়ে দেরাজের উপর আঙুল বাজিয়ে বললেন, “চাষিকে তার নায্য দামটুকু মেটাতে হয়। নীতিগত একটা দায় তো আছে আমাদের, তাই না?”
২০২২-এর এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকে কাঁঠাল চাষি ও উৎপাদকেরা মিলে একটি সঙ্গম, অর্থাৎ সমিতি বানিয়েছেন। বিজয়কুমার সেটার সচিব। “মোটে দশদিন হল গঠন করেছি,” জানালেন তিনি, “এখনও অবধি রেজিস্টার করা হয়নি।” সমিতি ঘিরে অনেক উচ্চাশা আছে তাঁদের। “দরদাম বেঁধে দিতে চাই। তারপর কালেক্টর সাহেবকে গিয়ে বলব, তাঁরা যেন চাষি আর এই ক্ষেত্রটার সাহায্য করেন। উৎপাদকদের খানিক সুযোগ-সুবিধা দিলে ভালো হয়, কিছু পরিকাঠামোও দরকার — যেমন কাঁঠালগুলো তাজা রাখার জন্য হিমঘর। সংঘবদ্ধ হলে তবেই তো এসব দাবি করা যাবে, তাই না বলুন?”
আপাতত ফলগুলো দিন পাঁচেকের বেশি টাটকা রাখা যায় না। আশায় বুক বেঁধে লক্ষ্মী জানালেন, “কোনও না কোনও উপায়ে এই সময়সীমাটা বাড়াতেই হবে।” ছয় মাস হলে সবচাইতে ভালো হয়। নিদেনপক্ষে তার আধা হলেও সন্তুষ্ট হবেন বিজয়কুমার। এই মুহূর্তে দিনকতকের মধ্যেই তাঁরা বাধ্য হন কাঁঠালগুলো হয় ফেলে দিতে, কিংবা খুচরো ব্যবসায়ীদের দিয়ে দিতে – যাঁরা সেগুলি কুচি কুচি করে কেটে রাস্তার ধারে বেচেন।
*****
“কাঁঠালের জন্য হিমঘর — এই মুহূর্তে এটা কেবলই আকাশকুসুম কল্পনা। আলু বা আপেল হলে বহুদিন ধরে তাজা রাখতে পারবেন। কিন্তু কাঁঠালের উপর ওই জাতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেউ করে দেখেনি। সত্যি কথা বলতে কাঁঠালের শুকনো পাঁপড়ও মরসুমের দুই মাস পর আর মেলে না,” জানালেন সাংবাদিক তথা কন্নড় ভাষার অনন্য কৃষি-পত্রিকা আড়িকে পত্রিকের (সুপুরি পত্রিকা) সম্পাদক শ্রী পাদ্রে।
“খেলা পুরো ঘুরে যাবে,” বলছিলেন তিনি, “যদি কাঁঠাল দিয়ে বানানো নিদেনপক্ষে এক ডজন সামগ্রীও সারাটা বছর পাওয়া যায়।”
পারি’র সঙ্গে একটি দূরাভাষ সাক্ষাৎকারে কাঁঠালচাষ ঘিরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথা চমকপ্রদ বিষয় তুলে ধরেছিলেন পাদ্রে। প্রথমত, কাঁঠাল ঘিরে তেমন কোনও তথ্য নেই। “পরিসংখ্যান বানানো যতটা গোলমেলে, ততটাই মুশকিল। এ ফসল বছর দশেক আগেও বেশ অবহেলিত ছিল, চাষ হত খাপছাড়া ভাবে। তবে পানরুটি একটি অবাক-করা ব্যতিক্রম।”
কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের এক নম্বরে আছে ভারতের নাম, জানিয়েছিলেন পাদ্রে। “যেদিকেই চোখ রাখবেন, দেখা মিলবে কাঁঠালগাছের, অথচ মূল্য সংযোজনের মানচিত্রে আমাদের নামগন্ধও নেই।” দেশের মধ্যে কেরালা, কর্ণাটক আর মহারাষ্ট্র খানিক খানিক মূল্য সংযোজন করেছে বটে, তবে তামিলনাড়ুতে এ শিল্প আজ অবধি তার প্রাথমিক স্তরেই রয়ে গেছে।
কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহারের নিরিখে একথা সত্যিই লজ্জাজনক, স্বীকার করলেন তিনি: “জ্যাক ঘিরে কোনও গবেষণা হয়নি বললেই চলে। একেকটা বড়োসড়ো গাছে হেসেখেলে এক থেকে তিন টন কাঁঠাল ফলে।” উপরন্তু প্রতিটা গাছ থেকে পাঁচ ধরনের কাঁচামাল পাওয়া যায়: প্রথমে আসে কচি এঁচোড়; তারপর খানিক বড়ো হলে আসে এঁচোড় — যেটা সবজি রূপে ভারতীয় হেঁশেলে সুপরিচিত; এরপর পালা বুড়ো বা ডাঁসা এঁচোড়, যা দিয়ে পাঁপড় বা চিপস্ বানানো হয়; চার নম্বরে নাম রয়েছে সর্বজনবন্দিত পাকা কাঁঠালের; শেষে রয়েছে বীজ।
“এটাকে যে ‘সুপারফুড’ বলা হয়, এতে আর আশ্চর্যের কী?” বলে উঠলেন পাদ্রে, “অথচ কোত্থাও কোনও গবেষণাগার নেই, কোনও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। না আছে কোনও জ্যাকফ্রুট বিজ্ঞানী বা উপদেষ্টা, এই যেমন ধরুন কলা বা আলুর ক্ষেত্রে রয়েছে।”
কাঁঠালচাষ ঘিরে একাধিক শূন্যস্থান রয়েছে, সমাজকর্মীর ভূমিকায় একে একে সেগুলি পূরণ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন পাদ্রে: “আমি লেখালেখি করছি, তথ্য বণ্টন করছি, সর্বোপরি গত ১৫ বছর ধরে মানুষকে কাঁঠাল বিষয়ে উৎসাহিত করার চেষ্টা করে চলেছি। অর্থাৎ আমাদের আড়িকে পত্রিকা যতদিন [৩৪ বছর] শুরু হয়েছে, তার প্রায় আধা সময় ধরে এইসব কর্মকাণ্ড চলছে। প্রথম পাতায় শুধু কাঁঠালের উপরেই ৩৪টারও বেশি প্রতিবেদন (কভারস্টোরি) বার করেছি আমরা।”
কথোপকথন চলাকালীন উঠে এলো কাঁঠালের হাজারো মাহাত্ম্য, যেমন কাঁঠাল দিয়ে বানানো সুস্বাদু আইসক্রিমের কথা — এ ফলের ইতিবাচক দিকটার উপর আলোকপাত করতে তিনি মুখিয়ে আছেন ঠিকই, তবে সমস্যাগুলোকে কিন্তু অন্ধকারে রাখেননি পাদ্রে। “ভবিষ্যতে সাফল্য পেতে হলে হিমঘরের অন্তরায়টা টপকাতেই হবে। সারাটা বছর বরফে জমানো কাঁঠাল যাতে পাওয়া যায়, সেটাই আমাদের প্রথম লক্ষ্য। এটা রকেট বিজ্ঞান নয় বটে, কিন্তু এ দিশায় হাঁটিহাঁটি পা-পা করাটাও যে আমরা এখনও অবধি শুরু করতে পারিনি।”
এছাড়াও একটি বিচিত্র জটিলতা আছে, অন্য কোনও ফলে যার দেখা মেলে না — ফলটা আদৌ টাটকা আছে না পচন ধরেছে, তা বাইরে থেকে দেখে বোঝাই যায় না। এটা ঠিকই যে পানরুটিতে যত্ন সহকারে কাঁঠালচাষ হয়, বাজারে এর চাহিদা ও সরবরাহ, দুটোই বেশ পাকাপোক্ত — তবে দেশের আর যে যে প্রান্তরে এ ফল উৎপাদিত হয়, সেখানে কিন্তু চটজলদি বিক্রিবাটার কোনও নিশ্চয়তা নেই। নেই কৃষক-বান্ধব সরবরাহের পরিকাঠামোও। ফলত বহুল পরিমাণে ফসল নষ্ট হয়ে যায়।
এ হেন ফসল নষ্ট আটকাতে আদৌ কিছু করেছি আমরা? একের পর এক সওয়াল ছুঁড়লেন পাদ্রে: “এটাও তো খাদ্য, তাই না? কেবল ধান আর গমের প্রতিই কেন এত দরদ দেখাই আমরা?”
কারবার চাঙ্গা করতে হলে, প্রতিটি রাজ্য, প্রতিটি দেশে পৌঁছে দিতে হবে পানরুটির কাঁঠাল জানালেন বিজয়কুমার: “আরও প্রচার করা উচিত। ওটা করলে তবেই আমরা ভালো দর পাব।”
বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চেন্নাইয়ের কোয়াম্বেডু হোলসেল মার্কেট কমপ্লেক্স, এরই একাংশের নাম আন্না ফ্রুট মার্কেট। একই দাবি-দাওয়ার প্রতিধ্বনি শোনা গেল এখানকার কাঁঠাল বিক্রেতাদের গলাতে: দরকার হিমঘর আর উচ্চমানের মাণ্ডি চত্বর। এখানকার ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি সি. আর. কুমারাভেলের কথায় ফলের দাম নাকি যাচ্ছেতাই ওঠানামা করে, ফল-পিছু কখনও ১০০ তো কখনও ৪০০ টাকা।
“কোয়াম্বেডুতে আমরা এ ফল নিলামে চড়াই। বহুল পরিমাণে সরবরাহ হলে খুব স্বাভাবিকভাবেই দাম পড়ে যায়। নষ্টও হয় প্রচুর — প্রায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ। ফলগুলো রেখে রেখে বেচতে পারলে দর বাড়বে, লাভবান হবেন চাষিরা।” কুমারাভেলের আন্দাজ: দিন গেলে দশটা দোকানের প্রত্যেকটায় ন্যূনতম ৫০,০০০ টাকার লেনদেন হয়। “এটা কিন্তু কেবলমাত্র কাঁঠালের মরসুমেই হয় — বছরে ওই ধরুন পাঁচটা মাস।”
তামিলনাডুর কৃষি ও কৃষক কল্যাণ দফতরের ২০২২-২৩শের নীতি খসড়ায় কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন কাঁঠাল চাষি সহ ব্যবসায়ীরা। এ খসড়ায় বলা আছে: “জ্যাক চাষ ও প্রক্রিয়াকরণে লুকিয়ে থাকা বহুল সুযোগ কাজে লাগাতে পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে একটি বিশেষ কেন্দ্র খোলা হচ্ছে কুড্ডালোর জেলার পানরুটি ব্লকের পানিকঙ্কুপ্পাম গ্রামে।”
খসড়ায় এই কথাও বলা আছে যে পানরুটির কাঁঠাল যাতে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) রূপে চিহ্নিত হয় — যাতে “আন্তর্জাতিক বাজারে তার মূল্য বৃদ্ধি হয়” — ইতিমধ্যেই তার জন্য কাজ শুরু হয়ে গেছে।
অথচ “অসংখ্য মানুষ এটাই জানে না যে পানরুটি জায়গাটা কোথায়,” এটা ঠিক হজম করে উঠতে পারেন না লক্ষ্মী। জোরগলায় বলে উঠলেন, ২০০২ সালে ‘সোল্লা মারান্ধা কঢাই’ (ভুলে যাওয়া এক গল্প) নামের একটি তামিল চলচ্চিত্র বেরিয়েছিল, আর সেখান থেকেই নাকি পানরুটির এত খ্যাতি। “পরিচালক থঙ্কর বচন এই এলাকারই মানুষ। সিনেমায় আমাকেও দেখা গেছে,” চাপা গর্বের সঙ্গে বলে উঠলেন তিনি, “শুটিংয়ের সময় বড্ড গরম ছিল বটে, কিন্তু বেশ মজা হয়েছিল।”
*****
ফলনের মরসুমে লক্ষ্মীর চাহিদাও তুঙ্গে ওঠে। কাঁঠাল প্রেমীদের ফোন ঘাঁটলে ওঁর ফোন নম্বরটা স্পিড ডায়ালে পাবেন। তাঁরা জানেন, সবচাইতে ভালো কাঁঠালের খোঁজ একমাত্র তিনিই রাখেন।
লক্ষ্মী কিন্তু সত্যিই সেটা পারেন। পানরুটিতে কুড়িটারও বেশি মাণ্ডি আছে, তাদের প্রত্যেকটার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তো আছেই, এমনকি যে চাষিরা ওখানে কাঁঠাল সরবরাহ করেন তাঁদের অধিকাংশই লক্ষ্মীর চেনা। বেশিরভাগ সময় ফল পাকলে তিনি আগাম খবর পেয়ে যান।
কিন্তু এতকিছুর হিসেব রাখেন কেমনভাবে? কোনও জবাব দিলেন না বটে, তবে ব্যাপারটা জলবৎ তরলং — দশকের পর দশক ধরে কাজ করছেন লক্ষ্মী, খোঁজ রাখাটাই তো ওঁর রুজিরুটি, তাই দিব্যি হিসেব রাখেন সবকিছুর।
কিন্তু যে ক্ষেত্রটি পুরুষদের করায়ত্ত, সেখানে তিনি এমন পসার বানালেন কেমন করে? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দিয়েছিলেন: “আপনার মতো লোকেরা ফল কিনতে হলে আমায় এসে ধরে। আর তাঁদের হয়ে ঠিকঠাক দামে আমি কাঁঠাল জোগাড় করে দিই।” ব্যবসায়ীদের হয়েও যে খোঁজখবর নেন, সেটাও পরিষ্কার করে জানালেন লক্ষ্মী। তিনি যা-ই সিদ্ধান্ত নেন না কেন, কারবারি ও চাষি দুপক্ষই যে সেটার সম্মান করে, তা বলাই বাহুল্য। সব্বাই ওঁর খাতির করে, সব্বার মুখে মুখে শোনা যায় লক্ষ্মীর সুখ্যাতি।
তিনি যে এলাকায় থাকেন, সেখানে যাকেই জিজ্ঞেস করবেন ওঁর বাড়িটা দেখিয়ে দেবে। তাঁর কথায়, “আমার কারবারটা কিন্তু নিতান্তই চিল্লারাই ভ্যাপারম (ক্ষুদ্র ব্যবসা), ওই আর কি, সব্বার জন্য ঠিকঠাক দর বেঁধে দিই।”
ঢিপির পর ঢিপি কাঁঠাল এসে ওঠে মাণ্ডির দরবারে, ফলের গুণমান খুঁটিয়ে দেখে দাম নির্ধারণ করেন লক্ষ্মী। এর জন্য একখান ছুরি বাদে আর কিছুই লাগে না তাঁর। কয়েকবার টোকা মেরেই বুঝে যান ফলটা কাঁচা না পাকা, নাকি তার পরেরদিন খাওয়া যাবে। কোথাও কোনও সন্দেহ হলে আরেক ধাপ পরীক্ষা করে দেখেন — ছোট্ট করে কেটে একটা কোয়া বার করলেই কেল্লাফতে। এর চেয়ে নিখুঁত কোনও পরীক্ষা হয় না বটে, তবে ফলগুলো কাটাছেঁড়া করতে হয় বলে সচরাচর এইটা কেউ করে না।
“গতবছর যে সাইজের কাঁঠাল ১২০ টাকায় বিকিয়েছিল, এবছর সেটার দামই ২৫০। দামটা একটু চড়া, কারণ সৃষ্টিছাড়া বর্ষায় খুব ক্ষতি হয়েছে ফসলের।” তাঁর হিসেব বলছে, মাসদুয়েকের (জুন) মধ্যেই প্রতিটা দোকানেই ১৫ টন করে কাঁঠাল পৌঁছে যাবে। দামটাও হুড়মুড় করে পড়ে যাবে।
তিনি ব্যবসায় পা রাখার পর থেকে কাঁঠালের কারবার অনেকটাই বেড়েছে। বেড়েছে গাছের সংখ্যা, ফলের পরিমাণ, তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে বিকিকিনি। তা সত্ত্বেও চাষিরা যে একজন কমিশন এজেন্টের কাছেই তাঁদের ফসল নিয়ে আসেন, তার পিছনে কারণ হিসেবে আনুগত্য তো রয়েইছে, একই সঙ্গে বলা যেতে পারে ঋণের কথা — দরকার পড়লেই ঋণের বন্দোবস্ত করে দেন এই কমিশন এজেন্টটি। বাৎসরিক ফলনের পরিমাণ অনুযায়ী ১০,০০০ থেকে এক লাখ টাকা অবধি ধার করে থাকেন চাষিরা, বোঝালেন লক্ষ্মী। তারপর বিক্রিটিক্রি হলে টাকাটা ‘অ্যাডজাস্ট’ হয়ে যায়।
এছাড়াও আরেকটি কারণ আছে বলে জানালেন লক্ষ্মীর ছেলে রঘুনাথ: “পালা মারামের বিস্তীর্ণ বাগান আছে যে চাষিদের, তাঁরা শুধুই ফল বেচে ক্ষান্ত হতে চান না — তাঁরা চান যাতে মূল্য সংযোজন করে মুনাফাটা বাড়ানো যায়।” ওঁরা জ্যাক দিয়ে পাঁপড় এবং জ্যাম বানান, এছাড়াও এঁচোড় রাঁধলে সেটা দিব্যি মাংসের বদলে খাওয়া যায়।
“বেশ কিছু কারখানা আছে যারা কোয়া শুকিয়ে গুঁড়ো করে,” জানালেন রঘুনাথ। তারপর সেটা জাউয়ের (পরিজ) মতো ফুটিয়ে খাওয়া হয়। “টাটকা ফলের তুলনায় এই জাতীয় খাদ্যসামগ্রী ততটাও জনপ্রিয় হয়নি বটে — তবে কারখানার মালিকদের বিশ্বাস, একদিন না একদিন সেটা হবেই।”
এই কাঁঠালের দৌলতে আসা উপার্জন দিয়েই দালানবাড়িটি গড়ে তুলেছেন লক্ষ্মী।
মেঝেয় আঙুল ছুঁইয়ে লক্ষ্মী বললেন, “এটার বয়স ২০ বছর হয়ে গেল।” অবশ্য, তাঁর স্বামী এই বাড়িটা দেখে যেতে পারেননি। তাঁদের আলাপ হয়েছিল লক্ষ্মীর কাজের সুত্রেই। তখন ট্রেনে ট্রেনে কুড্ডালোর থেকে পানরুটি অবধি কাঁঠাল ফেরি করতেন তিনি, আর পানরুটি স্টেশনেই ছিল তাঁর হবু স্বামীর চায়ের দোকান।
হ্যাঁ, বিয়েটা প্রেম করেই হয়েছিল। পানরুটির এক শিল্পীকে দিয়ে দুটো ছবি আঁকিয়েছিলেন লক্ষ্মী, তার রেখায় রেখায় ফুটে উঠেছে অপূর্ব এক প্রণয়ের দাস্তান। স্বামীর ছবিটা আঁকাতে ৭,০০০ টাকা লেগেছিল, আর ৬,০০০ লেগেছিল অন্যটায় — যেটায় স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আছেন। খ্যাসখ্যাসে অথচ প্রাণবন্ত স্বরে নানান গল্প বলছিলেন লক্ষ্মী। পোষা কুকুরের গল্পটা তো আমার সবচেয়ে প্রিয়: “এত বিশ্বস্ত, এত বুদ্ধিমান, বড্ড মনে পড়ে ওর কথা।”
দুপুর প্রায় ২টো বাজতে চলল, এখনও একদানা মুখে দেননি। এই তো, একটু পরেই খাব — বললেন বটে, কিন্তু গল্পগাছায় রাশ টানলেন না। ফলনের মরসুমে যখন ঘরকন্নার কাজ সামলানোর ফুরসৎটুকুও মেলে না, তখন একা হাতে পুরোটাই সামলান তাঁর বৌমা কয়ালভিড়ি।
কাঁঠাল দিয়ে কোন কোন পদ রাঁধেন তাঁরা, দুজনের কাছেই শুনলাম সেই গল্প। “বীজগুলো দিয়ে একধরনের উপমা বানাই। কোয়াগুলো কাঁচা হলে, আমরা ছাল ছাড়িয়ে, হলুদ গুঁড়ো দিয়ে ফুটিয়ে, হামানদিস্তায় বেটে তারপর উলুথাম পারুপ্পু [বিউলি] দিয়ে সাঁৎলে নিই, শেষে নারকেল বাটা ছড়িয়ে দিই খানিক। কোয়াগুলো শুকনো শুকনো হলে খানিক তেল ছিটিয়ে লঙ্কাগুঁড়ো দিয়ে খাওয়া যায়।” সম্বর বানাতে কাজে লাগে বীজ, বিরিয়ানিতে দেওয়া যায় কাঁচা কোয়াগুলো। কাঁঠাল দিয়ে বানানো খাবারগুলি লক্ষ্মীর মতে “অরুমাই” (অসামান্য) ও “সুস্বাদু”।
তবে সাধারণত খাবারদাবার নিয়ে খুব একটাও মাথা ঘামান না লক্ষ্মী। সে চা হোক বা দুপুরের খাবার, হাতের কাছে যে কোনও দোকান হলেই চলে যায়। “প্রেসার আর সুগার” দুটোই আছে তাঁর, অর্থাৎ রক্তাচাপ ও মধুমেহ। “সময় মাফিক না খেলে মাথাটা বড্ড ঘোরে।” আজ সকালেই হঠাৎ মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠেছিল, তড়িঘড়ি বিজয়কুমারের দোকান ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেটে মরেন, সময়ের কোনও ঠিকঠিকানা থাকে না, তবে কোনওকিছুতেই লক্ষ্মীর ভয়ডর নেই। “সব ঠিক আছে।”
এককালে যখন ট্রেনে ট্রেনে কাঁঠাল ফেরি করে বেড়াতেন, প্রায় ৩০ বছর আগে, তখন একেকটা ফলের দাম ছিল ১০ টাকা। (দামটা ২০ থেকে ৩০ গুণ বেড়ে গেছে এখন।) লক্ষ্মীর মনে আছে, কামরাগুলো তখন পেট্টির (বাক্স) মতো ছিল, ভেস্টিবিউলের নামগন্ধ ছিল না। অলিখিত আইন মান্য করে কামরা-পিছু একজন করেই ফেরিওয়ালা উঠতেন। তিনি না নামলে অন্য কোনও বিক্রেতা উঠতেন না। “টিকিট চেকাররা ভাড়া বা টিকিটের জন্য জোরাজুরি করতেন না। বিনেপয়সাতেই যাতায়াত করতাম। কিন্তু,” ঈষৎ নিচুস্বরে বলে উঠলেন, “খানিক খানিক কাঁঠাল দিতাম তাঁদের...”
সবকটাই প্যাসেঞ্জার ট্রেন ছিল; মন্থর গতিতে যেত, এক্কেবারে ছোটো জায়গা বাদে সব স্টেশনেই দাঁড়াত। যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই কাঁঠাল কিনে নিয়ে যেতেন বটে, তবে রোজগার খুব সামান্যই ছিল লক্ষ্মীর। দৈনিক কতটা আয় হত, সেটা ঠিক আর মনে নেই তাঁর, শুধু এটুকু বললেন: “তখনকার দিনে ১০০টা টাকার মূল্য ছিল অনেক।”
“ইস্কুলের চৌকাঠ ডিঙোইনি কখনও। খুব ছোট্টবেলায় মা-বাবা দুজনকেই হারিয়েছি।” অনটন ঘোচাতে একাধিক শাখার ট্রেনে ফল ফেরি করতেন: চিদাম্বরম, কুড্ডালোর, চেঙ্গেলপুট, ভিল্লুপুরম। “খিদে পেলে স্টেশনের ক্যান্টিন থেকে তেঁতুল-ভাত বা দই-ভাত কিনে নিতাম। দরকার হলে কাঁঠালের ট্রে-টা উপরের ওই মালপত্তর রাখার তাকে গুঁজে দিয়ে কামরার লাগোয়া ল্যাট্রিনে ঢুকে পড়তাম। বড্ড খাটাখাটনি হত। কিন্তু, আর কোনও উপায়ও তো ছিল না?”
উপায় অবশ্য আজ তিনি অর্জন করেছেন — কাঁঠালের মরসুম ফুরোলে বাড়িতে আরাম করেন। “চেন্নাই গিয়ে পালা করে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকি, সপ্তাহ দুই করে। বাকি সময়টা এখানেই কাটাই, নাতি সর্বেশের সঙ্গে,” কাছেই খেলা করছিল একটি বাচ্চা ছেলে, মুচকি হেসে তার দিকে তাকালেন লক্ষ্মী।
আরও বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেল কয়ালভিড়ির কাছ থেকে: “আত্মীয়দের প্রত্যেককেই তো তিনি সাহায্য করেন; গয়নাগাঁটি কিনে দেন। কেউ ওঁর কাছে সাহায্য চাইলে কক্ষনো ফেরান না...”
তবে কর্মজীবনের গোড়ার ‘না’ শব্দটা নিশ্চয়ই বহুবার শুনেছেন লক্ষ্মী। “সোন্ধা উড়াইপ্পু”-র (নিজের মেহনত) জোরে নিজেই নিজের জীবন পাল্টাতে পেরেছেন, এমনই এক আশ্চর্য মানুষ তিনি। তাঁর জীবনকাহিনি শোনার সঙ্গে কাঁঠাল খাওয়ার বেশ মিল আছে — এত্ত মিষ্টতা কেউই আশা করে না, আর রসাস্বাদন একবার করলে সে আর ভোলা যায় না।
২০২০ সালের রিসার্চ ফান্ডিং প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে গবেষণামূলক এই প্রতিবেদনটি রূপায়িত করতে আর্থিক অনুদান জুগিয়েছে বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রচ্ছদে ব্যবহৃত আলোকচিত্র: এম. পালানী কুমার
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)