“হাসপাতালের খরচ মেটাতে পারব না আমরা, এর চেয়ে আমি মরে গেলেই ভালো,” মৃত্যুর দুদিন আগে স্ত্রী জয়শ্রীকে জানিয়েছিলেন হরিশ্চন্দ্র ধাওয়ারে। ৪৮ বছর বয়সী এই সাংবাদিকের অবস্থা কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে অত্যন্ত সংকটজনক হয়ে যাওয়ায় তাঁকে ভেন্টিলেটরে দেওয়া হয়েছিল।
এ হেন অবস্থাতেও তাঁর নিজেকে নিয়ে তেমন কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না। বরং হাসপাতালের বকেয়া রশিদ তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। “আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে কেঁদে ফেলেছিলেন উনি,” স্মৃতিচারণ করছিলেন ৩৪ বছরের জয়শ্রী, “বাড়ি ফেরার জন্য জোরজবরদস্তি করছিলেন।”
সাংবাদিকতায় অতিক্রান্ত বিশটা বছরের কোন মূল্যই ছিল না হরিশ্চন্দ্রের কাছে ২০২১ সালের মার্চ মাসের শেষে যখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন তিনি। বরং পেশাটাই তাঁকে এই বিপদের মুখে ঠেলে দেয়।
২০০১ সালের গোড়া থেকে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন হরিশ্চন্দ্র। মহারাষ্ট্রের ওসমানাবাদ জেলার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করার পর শেষমেশ “রাজধর্ম” নামে এক দৈনিক পত্রিকায় যোগ দেন তিনি। জয়শ্রী বললেন, “কোভিড-১৯ অতিমারির দ্বিতীয় তরঙ্গের উপরে কাজ করছিলেন আমার স্বামী। সাংবাদিক বৈঠকে যাওয়া ছাড়াও খবর জোগাড় করতে উনি হামেশাই বাইরে যেতেন। বাড়ির বাইরে পা রাখলেই আমাদের দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে যেত। সুগার আর রক্তচাপ, এই দুইয়ের সমস্যাই তাঁর ছিল। এতকিছুর পরেও তিনি বলেছিলেন যে দ্বায়িত্ব এড়াতে পারবেন না।”
মার্চের ২২ তারিখে ধাওয়ারের দেহে জ্বর, গায়ে হাতএ পায়ে ব্যথা জাতীয় কোভিডের উপসর্গগুলি ফুটে উঠতে থাকে এক এক করে। জয়ন্তী বলছিলেন, “যখন দেখলাম কোনও কিছুতেই কাজ হচ্ছে না, আমরা তাঁকে শহরের সরকারি সিভিল হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরীক্ষায় কোভিড পজিটিভ পাওয়া গেলে ওখানেই ভর্তি করা হয়। পরিষেবা খুব একটা ভালো ছিল না ওখানে, তাই ৩১শে মার্চ আমরা সবাই মিলে তাঁকে ৬০ কিমি দূরে সোলাপুরের একটা বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই।”
সেখানে ৬ দিন লড়াই করার পর এপ্রিলের ৬ তারিখ সকালবেলায় ধাওয়ারে মারা যান।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার খরচ বাবদ ৪ লাখ টাকার রশিদ ধরিয়ে দেয় হাতে। মারা যাওয়ার সময় হরিশ্চন্দ্র বেতন পেতেন মোটে ৪০০০ টাকা। স্বামীকে হারানোর পর জয়শ্রী নিজের সমস্ত গয়নাগাঁটি বিক্রি করে কোনওমতে ১ লাখ টাকা জোগাড় করেন। “আত্মীয়স্বজনেরা কিছু টাকা ধার দিয়েছিল। ওসমানাবাদের সাংবাদিকেরা সবাই মিলে ২০,০০০ টাকা দান করেন আমার সাহায্যার্থে,” বললেন জয়শ্রী, “কিন্তু পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মানুষটাকে হারিয়ে আমি বুঝতেই পারছি না যে এই পাহাড়-প্রমাণ ঋণ কেমন করে শোধ করব।”
পত্রিকার জন্য হরিশ্চন্দ্র যে কটা বিজ্ঞাপন জোগাড় করতেন তার কমিশন বাবদ ৪০ শতাংশ টাকা তাঁকে দেওয়া হতো বিজ্ঞাপন পিছু। এর সঙ্গে মাইনে মিলিয়ে বছরে তাঁর আয় ছিল মেরেকেটে ১ লাখ টাকা। বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া একটা ছোট্ট দোকান চালান জয়শ্রী, বিক্রি করেন বিস্কুট, চিপস্, ডিম ইত্যাদি টুকিটাকি জিনিসপত্র। “এর থেকে বলতে গেলে সেরকম কিছুই রোজগার হয় না,” দুঃখের সঙ্গে জয়শ্রী জানাচ্ছিলেন। আগে তিনি একটা বিউটি পার্লারও চালাতেন, যদিও অতিমারির কারণে গত দেড় বছর হল একটাও খদ্দের জোটেনি তাঁর।
ধাওয়ারে দম্পতি নব বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ, আর তাই তাঁরা মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে জন আরোগ্য যোজনার আওতায় পড়েন (এমজেপিজেএওয়াই)। এটি একটি বিমা যোজনা – যে সব পরিবারের আয় বছরে ১ লাখ টাকার কম, তাদের চিকিৎসার খরচ (২.৫ লাখ টাকা পর্যন্ত) রাজ্য সরকার বহন করে। রাজ্য সরকারের দ্বারা অনুমোদিত সাংবাদিকরাও এর আওতায় পড়েন। এই যোজনার নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালগুলি রোগীর চিকিৎসা করে এবং সেই চিকিৎসার রশিদ পাঠায় রাজ্য সরকারের কাছে।
জয়শ্রী জানালেন যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করে হরিশ্চন্দ্রের নাম একটি অপেক্ষারত তালিকায় ঢুকিয়ে দেয় যাতে ওই বিমার জন্য তাঁরা সরাসরি আবেদন না করতে পারেন। জয়শ্রী নিজেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিনদিন কাটিয়েছিলেন ওসমানাবাদের সিভিল হাসপাতালে। “আমরা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম স্বামীর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে। কিন্তু বিমার জন্য করা আবেদন মঞ্জুর হওয়ার আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন উনি। আমার পাক্কা বিশ্বাস ওরা ইচ্ছে করেই গড়িমসি করেছিল।” যেদিন হরিশ্চন্দ্র মারা যান সেদিনই জয়শ্রী হাসপাতাল থেকে ছুটি পান।
এই বছর ফেব্রুয়ারিতে কোভিড-১৯ অতিমারির দ্বিতীয় তরঙ্গ আছড়ে পড়ার পর থেকে দেশজুড়ে সাংবাদিক, বিশেষ করে মাটিতে নেমে কাজ করা ফিল্ড রিপোর্টারদের দুর্দশার কথা বার বার উঠে আসছে। কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামনের সারির অগ্রণী কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ হলেও ওড়িশা, উত্তরাখণ্ড, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক এবং বিহার সাংবাদিকদের এই স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সাংবাদিকদের প্রতিষেধক দেওয়ার ব্যাপারে প্রাথমিকতাকে বিবেচনা করে কাজ করতে শুরু করেছে।
বারংবার অনুরোধ ও প্রতিনিয়ত বিক্ষোভ দেখানো (যেখানে মন্ত্রীপরিষদের একাধিক সদস্যও সামিল ছিলেন) সত্ত্বেও মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে সাংবাদিকদের অগ্রণী কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেননি।
মহারাষ্ট্রে কর্মরত প্রায় ৮,০০০ সাংবাদিকদের একটি ইউনিয়ন মারাঠি পত্রকার পরিষদের (এমপিপি) অছি পরিষদের প্রধান এস.এম. দেশমুখ জানালেন, “অগস্ট ২০২০ থেকে মে ২০২১-এর মধ্যে এই রাজ্যে ১৩২ জন সাংবাদিক মারা গেছেন।” তবে গ্রামীণ সাংবাদিকদের মতে এই পরিসংখ্যানটি খুবই সংকীর্ণ – অপেক্ষাকৃত অজানা যেসব আঞ্চলিক সংবাদ মাধ্যমগুলি আছে, সেখানে কর্মরত সাংবাদিকের মধ্যে যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের নাম সম্ভবত এই তালিকায় যোগ করা হয়নি।
তবে দেশমুখ নিজেই স্বীকার করছেন: “এমনটা হতেই পারে যে গ্রামীণ অঞ্চলের সমস্ত খবর আমি পাইনি।” তাঁর মতে প্রায় ৬,০০০ সাংবাদিক – যাঁরা প্রায় কেউই এমপিপির সদস্য নন – ইতিমধ্যেই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন মহারাষ্ট্রে। উনি বললেন, “অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা নিজেরা সুস্থ হয়ে উঠলেও তাঁদের পরিবারের কেউ না কেউ প্রাণ হারিয়েছেন।”
১১ই মে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৯০ জন সাংবাদিক একটি অনলাইন সমাবেশে একত্র হন অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে থাকা অগ্রণী কর্মী হিসেবে নিজেদের স্বীকৃতির দাবিকে আরও জোরদার করে তুলতে। কোভিড-১৯ গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ার কারণে গ্রামীণ সাংবাদিকদের সুরক্ষার ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে উঠেছে আজ, ভরসাযোগ্য স্বাস্থ্য পরিষেবা তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগেরই নাগালের বাইরে, তাই প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য তাঁদের দূর দূরান্তে যেতে হয়।
ভারতবর্ষে কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে সাংবাদিকদের মৃত্যুর উপরে একটি গবেষণা করেছিল নিউ দিল্লির ইনস্টিটিউট অফ পারসেপশন স্টাডিজ। সেখান থেকে জানা যাচ্ছে যে ১লা এপ্রিল ২০২০ থেকে ১২ই মে ২০২১ অবধি যে ২১৯ জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ১৩৪ জন মেট্রোপলিটন অঞ্চলের ছিলেন না।
গ্রামীণ ভারতের সাংবাদিকেরা স্বীকৃতিহীন অবস্থায় কানাকড়ির বদলে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ওসমানাবাদে কর্মরত ৩৭ বছরের সাংবাদিক সন্তোষ যাদব জানালেন যে তাঁরা আজও কতখানি অবহেলার পাত্র, আরও জানালেন সেই সঙ্গে যে: “কোভিডের বিরুদ্ধ যুদ্ধরত সৈন্য এবং (গণতন্ত্রের) চতুর্থ স্তম্ভ মার্কা কিছু গালভরা তকমা ছাড়া কিছুই জোটে না আমাদের। সাংবাদিকতাকে একটি আবশ্যকীয় পরিষেবা বলে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও প্রতিষেধক বণ্টনের সময় আমাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না।” সন্তোষ মুম্বইভিত্তিক একটি মারাঠি টিভি চ্যানেলের জন্য সাংবাদিকতা করেন। খুবই দুঃখের সঙ্গে তিনি জানালেন যে: “আমাদের কাজ দ্বায়িত্ব সহকারে মানুষকে সচেতন করা আর যথাযথ তথ্য সবার সামনে তুলে ধরা। বাকহীনের কণ্ঠ আমরা। কিন্তু আমাদের দুর্দশার কথা কেউ কানেই তোলে না।”
জটিল এই পরিস্থিতি আরও কষ্টকর হয়ে ওঠে যাদবের মতো সাংবাদিকদের জন্য। “যাঁরা মুম্বই বা দিল্লিতে কাজ করছেন তাঁদের বক্তব্যের মূল্য আছে। কিন্তু যাঁরা এই অতিমারির মধ্যে গ্রামীণ অঞ্চলে কাজ করছেন তাঁদের সুরক্ষার জন্য চ্যানেল আর পত্রিকাগুলি কী ব্যবস্থা নিয়েছে শুনি? কতজন সম্পাদক তাঁর অধীনে থাকা সাংবাদিকদের সাহস জুগিয়েছেন? সাংবাদিকেরা যাতে প্রতিষেধকের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পান তার জন্য কতজন সম্পাদক আন্দোলন করেছেন?” যাদব একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছিলেন, “গ্রামীণ সাংবাদিকরা নামমাত্র বেতন পান, তাঁরা যদি প্রাণ হারান তাহলে তাঁদের সন্তানদের কী হবে?”
কোভিড-১৯ গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ার কারণে গ্রামীণ সাংবাদিকদের সুরক্ষার ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে উঠেছে আজ, ভরসাযোগ্য স্বাস্থ্য পরিষেবা তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগেরই নাগালের বাইরে, তাই প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য তাঁদের দূর দূরান্তে যেতে হয়।
ধাওয়ারের অষ্টাদশী কন্যা বিশাখা এখন দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে - ডাক্তার হতে চায়, তবে সে স্বপ্ন আজ ম্লান। “ওর পড়াশোনার খরচ বহন করা আমার পক্ষে অসম্ভব,” জানালেন জয়শ্রী, বিশাখা তখন থমথমে দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে।
স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে বিশাখা (কভারচিত্রে চশমা পরিহিত কিশোরী) বলছিল যে বাবা মারা যাওয়ার চারদিন আগেও ভিডিওকলে ওরা কত গল্প করেছিল। বিশাখার কথায়, “দোসরা এপ্রিল জন্মদিন ছিল বাবার। আমি শুভেচ্ছা জানাতে ফোন করেছিলাম। বাবা বলেছিল মন দিয়ে পড়াশোনা করতে, বলেছিল যে বাবা আমার সঙ্গে না থাকলেও আমি যেন বইপত্র থেকে চোখ না সরাই। বাবা চাইতেন যে আমি যেন শেষ অবধি পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যাই।”
শিক্ষা ঘিরে বিশাখার ভবিষ্যতের উপর মস্ত এক খাঁড়া তো ঝুলছেই, তার সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর চিকিৎসার জন্য নেওয়া ঋণ কীভাবে শোধ করবেন সেসব ভেবে জেরবার হয়ে যাচ্ছেন জয়শ্রী। “আমার আত্মীয়রা খুবই ভালো মানুষ, তাঁরা টাকা ফেরত চান না, তবে আজকের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে সবার আর্থিক অবস্থা শোচনীয়,” বললেন জয়শ্রী, “আমাকে সব ঋণ শোধ করতেই হবে, কিন্তু কীভাবে করব তা জানি না। আমি আজ বড্ড একা।”
ওসমানাবাদের বেশ কিছু সাংবাদিকের মতে এ হেন অবস্থায় বাইরে বেরিয়ে সাংবাদিকতা করাটা বিরাট ঝুঁকির কাজ। তাঁরা মোটেই চাইছেন না যে তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে যাক।
৬ ও ৪ বছরের দুই সন্তানের পিতা যাদব ফেব্রুয়ারিতে কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ আছড়ে পড়ার পর থেকেই বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছেন। ২০২০ সালে অতিমারির প্রথম প্রকোপের সময় এমনটা না করায় তাঁকে নিদারুণ মূল্য চোকাতে হয়েছিল। তাঁর কথায়, “আমার ঝুঁকি নেওয়ার কারণে আমার মা মারা যান, জুলাই মাসের ১১ তারিখ আমার কোভিড ধরা পড়ে, মা ঠিক তারপরেই সংক্রমিত হন। আমি সেরে উঠলেও মাকে বাঁচানো যায়নি। মায়ের শ্রাদ্ধের কাজেও আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। তাই এই পরিস্থিতিতে আবারও বাইরে বেরোনোর সাহস আমার নেই।” উনি এখন ওসমানাবাদ জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিডিও জোগাড় করেন। “আমি একমাত্র তখনই বেরোই যখন কোন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার নেওয়ার থাকে কিংবা কোনও খবরকে ক্যামেরাবন্দি করার প্রয়োজন হয়।”
তবে ৩৯ বছরের দাদাসাহেব বান পছন্দ করতেন অকুস্থলে পৌঁছে ফিল্ড রিপোর্টিং করতে। বীড জেলার অষ্ঠি তালুকের অন্তর্গত কাসারী গ্রামের এই সাংবাদিক লেখালেখি করতেন ওই জেলারই “লোকাশা” নামের একটি মারাঠি দৈনিক পত্রিকায়। প্রতিবেদনের জন্য হাতফেরতা কোনও খবর জোগাড় করাটা উনি পছন্দ করতেন না।
“উনি সমস্ত হাসপাতাল, পরীক্ষা কেন্দ্র এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য জায়গায় সশরীরে গিয়ে তৃণমূল স্তরে কোনটা কী অবস্থায় আছে সেটা নিয়ে লিখতেন,” বলছিলেন তাঁর ৩৪ বছর বয়সী স্ত্রী মীনা। “মার্চের শেষের দিকে কোভিডের এই নতুন তরঙ্গের উপর কাজ করতে গিয়ে তিনি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে পড়েন।”
বানের পরিবার তাঁকে কাসারী থেকে ৬০ কিমি দূরে আহমদনগরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। মীনা জানালেন, “কিন্তু কিছুতেই তাঁর অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না, রক্তে অক্সিজেনের ঘনত্ব নামতে নামতে ৮০তে পৌঁছে গিয়েছিল। তারপর ক্রমশ অবনতি হচ্ছিল।”
বানের কোনও কো-মর্বিডিটি না থাকা সত্ত্বেও চারদিন বাদে কোভিড-১৯ কেড়ে নেয় তাঁর প্রাণ। বানের ভাইপো ৩৫ বছরের দিলীপ গিরি বলছিলেন, “হাসপাতালের খরচ আর ওষুধপত্র বাবদ আমরা এক লাখ টাকা খরচা করি, বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়দের কাছে টাকা ধার করতে হয়েছিল সমস্ত কিছু সামলানোর জন্য। কাকু মাসে ৭,০০০-৮,০০০-এর বেশি পেতেন না। এতটা টাকা একসঙ্গে জোগাড় করার মতো সঞ্চয় আমাদের নেই।”
বানের চিকিৎসা এমজেপিজেএওয়াই-এর মাধ্যমেই হতে পারত, এই যোজনা বীড তথা মহারাষ্ট্রের অন্যান্য ১৪টি জেলার দুঃস্থ কৃষক-পরিবারগুলির জন্যই। যেহেতু গ্রামে বানের পরিবারের একটি পাঁচ একরের শালিজমি আছে তাই তাঁকে এই যোজনার অন্তর্ভুক্ত করা যেত সহজেই।
কিন্তু আহমদনগরের যে বেসরকারি হাসপাতালটিতে বানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেটি তাঁকে এমজেপিজেএওয়াই-এর আওতায় ভর্তি নিতে অস্বীকার করে। মীনার কথায়, “ওরা আমাদের বলল যে এই যোজনার সুবিধা পেতে হলে অন্য কোনও হাসপাতালে চলে যেতে। সেই মুহূর্তে, মানুষ যখন হন্যে হয়ে এমন একটা হাসপাতাল খুঁজছে যেখানে উপযুক্ত পরিষেবা আছে, তখন সে টাকাপয়সার কথা ভাবতে পারে না, সে শুধু একটাই কথা ভাবে যে রোগীকে কেমন করে বাঁচানো যায়। কিন্তু আমাদের পোড়া কপাল, রোগী বা টাকা দুটোর একটাও বাঁচানো গেল না।”
বান আর মীনার দুই সন্তান – ১৫ বছরের ঋষিকেশ আর ১৪ বছরের যশ – দিগন্ত জোড়া অন্ধকারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আজ। তাদের পিতার ইচ্ছে ছিল ওরা পড়াশোনা করে বড়ো হয়ে ডাক্তার হোক। দিলীপ বলছিলেন, “কাকু চাইতো না যে ছেলেরা বড়ো হয়ে সাংবাদিক হোক। তবে ওদের ভবিষ্যৎ এখন ওদের মায়ের উপর নির্ভরশীল, আর কাকিমার উপার্জনের একমাত্র রাস্তা চাষবাস। অথচ আমরা তো শুধু জোয়ার আর বাজরার চাষ করি, কোনও অর্থকরী ফসল নয়।”
পাশাপাশি বসে ওই দুই কিশোর চুপটি করে আমাদের কথোপকথন শুনছিল। দিলীপ বলছিলেন, “বাবাকে হারানোর পর থেকে ওরা অস্বাভাবিক রকম চুপচাপ হয়ে গেছে, অথচ ওরা প্রচণ্ড প্রাণবন্ত ছিল, সারাক্ষণ খেলাধুলা আর খুনসুটি করত। আর এখন থেকে থেকে বলে ওঠে যে ওরাও সেইখানে যেতে চায় যেখানে ওদের বাবা চলে গেছে।”
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)