ফেব্রুয়ারির এক ভ্যাপসা নিঝুম বিকেল, কোলাপুর জেলার রাজারাম চিনি কারখানা চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে শয়ে-শয়ে খোপ্যা (আখ-কাটাইকারি মজুরদের ঝুপড়ি), অধিকাংশই খালি। এক ঘণ্টার পায়ে হাঁটা পথ পেরিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকেরা তখন আখ কাটতে ভাডানাগে গাঁয়ে গেছেন।
দূর থেকে ভেসে আসা বাসনকোসনের ধাতব শব্দ বলে দিচ্ছে, জনাকয় মজুর বোধহয় বাড়িতেই আছেন। শব্দ শুনে শুনে গিয়ে পৌঁছলাম স্বাতী মাহারনোরের কাছে, ১২ বছরের মেয়েটি তখন রাতের খাবার বানাতে ব্যস্ত। পারিবারিক ঝুপড়ির চৌকাঠে একলা বসে আছে কিশোরী, পান্ডুর চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রান্নার বাসনপত্র।
কোনওমতে হাই চেপে সে জানালো, “ভোর ৩টে থেকে একটানা জেগে আছি।”
সক্কাল সক্কাল তার মা-বাবা, ভাই ও ঠাকুরদার সঙ্গে একটি গরুর-গাড়িতে চেপে মহারাষ্ট্রের বাভডা তালুকে আখ কাটতে গিয়েছিল ছোট্ট স্বাতী। পাঁচ সদস্যের এই পরিবারটির ভাগে দৈনিক ২৫ মোলি (বান্ডিল) আখ কাটার দ্বায়িত্ব এসে চেপেছে, সব্বাই মিলে হাত না লাগালেই নয়। মধ্যাহ্নভোজ বলতে গতরাতের ভাকরি ও বেগুনের তরকারি, সেটাই সঙ্গে করে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা।
খালি স্বাতীই ফিরে এসেছিল দুপুর ১টা নাগাদ, এক নাগাড়ে ৬ কিলোমিটার হেঁটে কারখানা চত্বরে তার পারিবারিক খোপ্যায় এসে পৌঁছয়। “আমায় ছেড়ে বাবা [ঠাকুরদা] আবার মাঠে ফিরে যায়।” বাড়ির সব্বার জন্য রাতের খাবার বানাতে হবে, তাই বাকিদের আগেই সে ফিরে এসেছে। ১৫ ঘণ্টা আখ কাটার পর, একটু পরেই পরিশ্রান্ত দেহে ফিরে আসবে সবাই। “সকাল থেকে মোটে এক পেয়ালা করে চা খেয়েছি আমরা [সমগ্র পরিবারটি],” জানালো সে।
প্রতিদিন ঘর থেকে খেত, খেত থেকে ঘর, আখ কাটা আর রান্না করা — গত পাঁচ মাস ধরে এটাই স্বাতীর রোজনামচা। নভেম্বর ২০২২এ, বীড জেলার সাকুনওয়াড়ি গাঁ থেকে এখানে এসে ওঠে তার পরিবার, সেদিন থেকেই এটাই তার রোজনামচা। কারখানা চত্বরে এদিক সেদিক ছড়িয়ে থাকে সবাই। মহারাষ্ট্রের অভিবাসী শ্রমিকেরা যে অধিকাংশ সময়েই দল বেঁধে ত্রিপল-ছাওয়া অস্থায়ী ঝুপড়িতে থাকেন, একথা বলা আছে অক্সফাম থেকে ২০২০ সালে প্রকাশিত চিনির মানবিক মূল্য ( হিউমান কস্ট অফ সুগার ) নামের একটি রিপোর্টে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই জাতীয় বসতিতে পানি, বিদ্যুৎ ও শৌচালয়ের অভাব লক্ষ্য করা যায়।
“আখ কাটতে আমার মোটেও ভাল্লাগে না,” স্বাতী বলল, “আমাদের গাঁয়েই রয়ে যেতে ইচ্ছে করে, আসলে ওখানে স্কুলে যাই তো।” পাতোডা তালুকের সাকুনওয়াড়ি গ্রামের এই কিশোরীটি ওখানকার জেলা পরিষদ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া। ছোটভাই কৃষ্ণ ওই একই বিদ্যালয়ে পড়ে ক্লাস থ্রিয়ে।
আখ-কাটার মরসুমে স্বাতীর বাবা-মা ও ঠাকুরদার মতন প্রায় ৫০০জন অভিবাসী মজদুর রাজারাম চিনি কারখানায় চুক্তিমাফিক কাজ করেন। মজুরদের সঙ্গে তাঁদের বাচ্চাকাচ্চারাও থাকে। “মার্চে [২০২২] আমরা সাঙ্গলিতে ছিলাম,” জানাল স্বাতী। ফি বছর প্রায় ৫ মাস করে স্কুলছুট হয়ে পড়ে স্বাতী ও কৃষ্ণ।
“মার্চ মাস পড়লেই বাবা [ঠাকুরদা] আমাদের গাঁয়ে নিয়ে যায়, যাতে আমরা পরীক্ষায় বসতে পারি। সেসব মিটলেই আমরা ফিরে আসি, মা-বাবার সঙ্গে কাজে হাত লাগাই,” স্বাতী ও তার ছোটোভাই এতকিছুর পরেও যে কেমন করে স্কুলে থেকে গেছে, সেটা জানা গেল তার কথায়।
নভেম্বর থেকে মার্চ অবধি বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকায় ফাইনাল পরীক্ষায় পাশ করতে নাভিশ্বাস উঠে যায়। স্বাতীর কথায়, “মারাঠি আর ইতিহাসের মতো বিষয়গুলোয় মোটামুটি ভালোই নম্বর আসে, কিন্তু অঙ্ক বুঝতে বড্ড অসুবিধে হয়।” গাঁয়ের কিছু বন্ধুরা সাহায্য করে বটে, কিন্তু ও দিয়ে তো আর বাদ পড়ে যাওয়া ক্লাসের ঘাটতি মেটে না।
“কী আর করব বলুন? বাবা-মাকে তো কাজ করতেই হবে,” অসহায় কণ্ঠে জানাল স্বাতী।
মেয়েটির মা-বাবা বর্ষা (৩৫) ও ভাউসাহেব (৪৫) যে মাসগুলোয় কাজের খোঁজে অভিবাসী হন না, সে সময়টায় তাঁরা সাকুনওয়াড়ির আশপাশের খেতমজুরি করে পেট চালান। “বর্ষার মরসুমে কাপানি [ফসল-কাটা] পর্যন্ত দেশগাঁয়ের মাঠঘাটে কাজ জুটে যায়, হপ্তায় অন্তত ৪-৫টা দিন,” জানালেন বর্ষা।
এই পরিবারটি ধাঙড় জাতির অন্তর্গত, মহারাষ্ট্রে এটি যাযাবর জনজাতির তালিকায় নিবন্ধিত। দিন গেলে ৩৫০ টাকা রোজগার করেন এই দম্পতি — বর্ষা পান ১৫০ টাকা ও ভাউসাহেব ২০০ টাকা। গ্রামের আশপাশে দিনমজুরি বাড়ন্ত হলে আখ-কাটার কাজের খোঁজে গাঁ ছাড়েন তাঁরা।
*****
“৬ থেকে ১৪ বছর বয়সি প্রতিটি বাচ্চার জন্য বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষা” — হ্যাঁ, এমনটাই আদেশ দিয়েছে আমাদের বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিশুশিক্ষা অধিকার আইন (আরটিই), ২০০৯। অথচ বাবা-মায়ের সঙ্গে পেটের টানে অভিবাসী হলে, ইস্কুল নামক বস্তুটি স্বাতী ও কৃষ্ণের মতো পরিযায়ী আখ-মজুরদের প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার সন্তানের (৬-১৪ বছর বয়সি) অধরাই থেকে যায়।
ইস্কুলছুট বাচ্চাদের সংখ্যা কমাতে ‘এডুকেশন গ্যারান্টি কার্ড’-এর (ইজিসি) প্রবর্তন করেছিল মহারাষ্ট্র সরকার। শিক্ষা অধিকার আইন, ২০০৯ সালের নীতির ভিত্তিতে ২০১৫ সালে নেওয়া একটি আইনি সংকল্প থেকে জন্ম নেয় এই ইজিসি। বাচ্চারা যাতে নতুন জায়গায় গিয়ে সহজেই সেখানকার ইস্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে — এ কার্ডের লক্ষ্য ছিল সেটাই। পড়ুয়াদের সমস্ত অ্যাকাডেমিক বিবরণী লেখা থাকে এই কার্ডে, এবং এটি সরবরাহ করেন তাদের নিজ নিজ গাঁয়ের ইস্কুল-শিক্ষকরা।
বীড-কেন্দ্রিক সমাজকর্মী অশোক তাঙ্গডে বুঝিয়ে বললেন, “বাচ্চাটি যে জেলাতেই যাক না কেন, এই কার্ডটা সঙ্গে রাখলেই হল।” নতুন ইস্কুলের প্রশাসনকে এই কার্ডটি দেখালে, “বাবা-মাকে ভর্তির ঝক্কিও সামলাতে হয় না, আর বাচ্চাটি একই শ্রেণিতে লেখাপড়া চালিয়েও যেতে পারে,” যোগ করলেন তিনি।
তবে বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলে। “আজকে অবধি একটা শিশুও ইজিসি কার্ড পায়নি,” জানালেন অশোক। পরিযানে বেরোলে, বাচ্চাটি আদতে যে ইস্কুলের পড়ুয়া, এই কার্ডটি সেখান থেকেই দেওয়ার কথা।
মাসের পর মাস ইস্কুলছুট হয়ে বসে থাকা স্বাতীর কথায়: “আমায় বা আমার বন্ধুদের, জেলা পরিষদের মাধ্যমিক স্কুলের টিচার কাউকেই ওরকম কোনও কার্ড দেননি।”
চিনি কারখানাটি যে অঞ্চলে অবস্থিত, সেখান থেকে স্থানীয় জেলা পরিষদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দূরত্ব মোটে তিন কিলোমিটার। কিন্তু হাতে কোনও কার্ড না থাকায় স্বাতী বা কৃষ্ণের পক্ষে সেখানে দাখিল হওয়া অসম্ভব।
আরটিই ২০০৯ সালের আদেশ থাকা সত্ত্বেও, বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিবাসী হলে স্কুল নামক বস্তুটি পরিযায়ী আখ-মজুরদের প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার সন্তানের (৬-১৪ বছর বয়সি) অধরাই থেকে যায়
তবে পুণের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আধিকারিকের গলায় অবশ্য অন্য সুর শোনা গেল: “যোজনাটা রীতিমতো রমরমিয়ে চলছে। ইস্কুল প্রশাসন আলবাত কার্ড তুলে দিচ্ছে পরিযায়ী পড়ুয়াদের হাতে।” অথচ আজ পর্যন্ত কজন শিশু এই কার্ড পেয়েছে, এই বিষয়ে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করতেই তিনি সাত-তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন: “সমীক্ষাটা এখনও চলছে; ইজিসির ব্যাপারে তথ্য জোগাড় করছি, আপাতত সেসব সংকলন করা হচ্ছে।”
*****
“এখানে থাকতে আমার অসহ্য লাগে,” বলল অর্জুন রাজপুত। ১৪ বছরের এই কিশোরটির পরিবার কোলাপুর জেলার যাধভওয়াড়ি এলাকার একটি দুই একরের ইটভাটায় কাজ করে।
তার সাত সদস্যদের পরিবারটি ঔরঙ্গাবাদ জেলার ওয়াডগাঁও গ্রাম থেকে এসেছে এখানে। কোলাপুর-বেঙ্গালুরু সড়কের পাশেই অবস্থিত ইটভাটায় এখন চরম ব্যস্ততা, গড়ে ২৫,০০০ ইট তৈরি হয় এখানে প্রতিদিন। অর্জুনের পরিবার সহ ভারত জুড়ে ১ কোটি থেকে ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ইটভাটায় মজুরি করেন। মানুষ-মারা তাপমাত্রা, হাড়ভাঙা খাটনি — সব মিলিয়ে এমন বিপজ্জনক কর্মক্ষেত্র খুব কমই আছে। উপরন্তু মজুরি এতই কম যে কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরলেও পারতপক্ষে ইটভাটার পথ মাড়ান না কেউ।
বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজে বেরোতে হয়, তাই নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত স্কুলে যেতে পারে না অর্জুন। “গাঁয়ের একটা জেডপি ইস্কুলে ক্লাস এইটে পড়ি আমি,” জানালো অর্জুন। পাশ দিয়ে তখন দম-আটকানো ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে একের পর এক জেসিবি মেশিন।
অর্জুনের মা-বাবা সুমন ও আবাসাহেব গঙ্গাপুর তালুকে তাঁদের গ্রাম ওয়াডগাঁওয়ে আশপাশে খেতমজুরের কাজ করেন। বীজ রোপন ও ফসল কাটার মরসুম এলে মাসিক দিন কুড়ির মতো কাজ জোটে, সারাটাদিন ঘাম ঝরালে তবেই গিয়ে মাথা-পিছু ২৫০-৩০০ টাকার মতন মজুরি আসে হাতে। এই ক’মাস গাঁয়ের বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পায় ছেলেটি।
গতবছর, অর্জুনের বাবা-মা তাঁদের কুঁড়েঘরটির পাশে একখান দালানবাড়ি তুলবেন বলে অগ্রিম বাবদ খানিকটা টাকা (উচল) নিয়েছিলেন। “১.৫ লাখ টাকার উচল নিয়ে বাড়ির ভিতটা বানিয়েছিলাম,” সুমন জানালেন, “এবছর আরও একলাখ টাকা অগ্রিম নিয়েছি, যাতে দেওয়ালগুলো তোলা যায়।”
তাঁদের পরিযানের হাল-হকিকত বোঝাতে গিয়ে তিনি বললেন, “আর কোনওভাবে বছরে এক লাখ [টাকা] রোজগার করতে পারব না। এটাই একমাত্র উপায়।” যতদূর মনে হচ্ছে, আসছে বছর আবার এখানেই ফিরে আসতে হবে — এটাও জানালেন সুমন: “যাতে পলেস্তারার জন্য খানিক টাকাকড়ির ইন্তেজাম করতে পারি।”
পাকাবাড়ি তুলতে গিয়ে ইতিমধ্যেই দু-দুটো বছর কেটেছে, কাটতে চলেছে আরও দুটো বছর — এদিকে হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে অর্জুনের পড়াশোনা। পাঁচ সন্তানের মা সুমন, তাদের মধ্যে চারজন পড়াশোনায় ঢ্যাঁড়া কেটে ২০ বছর বয়সে পা দেওয়ার আগেই বিয়েথা করে ফেলেছে। অর্জুনের ভবিষ্যৎ নিয়ে একাধারে উদ্বিগ্ন ও হতাশ তিনি। “আমার দাদু-দিদাও ইটভাটায় কাজ করতেন; তারপর আমার মা-বাবাও, আর আজ আমিও সেই ইটভাটায় এসে ঠেকেছি। পেটের দায়ে দূর-দূরান্তে পাড়ি দেওয়ার এই সিলসিলাটা কীভাবে যে ভাঙব, তা বুঝেই উঠতে পারি না।”
সন্তানদের মধ্যে একমাত্র অর্জুনেরই লেখাপড়া জারি আছে, তবে “ছ’টা মাস স্কুলের মুখ দেখিনি, বাড়ি ফেরার পর তো পড়াশোনা করতে আর ইচ্ছেই করে না।”
অবনী নামের একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ইটভাটার ওখানে একটি ডে-কেয়ার কেন্দ্র খুলেছে, মায়ের দিকের তুতো-বোন অনীতার সঙ্গে প্রতিদিন ছ’ঘণ্টা করে সেখানেই কাটায় অর্জুন। ২০টিরও বেশি ইটভাটার পাশাপাশি কোলাপুর ও সাঙ্গলির বেশ কয়েকটি আখ-খেতে একইরকম ডে-কেয়ার কেন্দ্র চালায় অবনী। অবনীতে পাঠরত পড়ুয়াদের অনেকেই হয় কাতকারি —বিশেষভাবে অসুরক্ষিত ট্রাইবাল গোষ্ঠী (পিভিটিজি) — কিংবা বেলদার — যাযাবর জনজাতি রূপে নিবন্ধিত — জনজাতির সদস্য। অবনীর প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর সাত্তাপ্পা মোহিতে বোঝালেন: কোলাপুরে প্রায় ৮০০টি রেজিস্টার্ড ইটভাটা থাকায় অসংখ্য কর্মসন্ধানী পরিযায়ী মজুর এসে হাজির হন এখানে।
“এখানে আমি ক্লাস ফোরের বই-টই কিসুই পড়ি না। তবে দিব্যি খেতে পাই, খেলাধুলোও করি,” মুচকি হেসে জানাল অনীতা। প্রায় ২৫টি ৩ থেকে ১৪ বছর বয়সি অভিবাসী পরিবারের সন্তান সারাদিন এই কেন্দ্রেই কাটায়। মিড-ডে মিল ছাড়াও এখানে তাদের খেলতে দেওয়া হয়, আবার হরেক প্রকারের গল্প-টল্পও শুনতে পায়।
কেন্দ্রে কাটানো এ হেন মজাদার দিনগুলো শেষ হলেই, “আই-বাবার [ইট বানানোর] কাজে হাত লাগাই,” খানিক ইতস্তত করে জানালো অর্জুন।
অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে সাত বছরের রাজেশ্বরী নায়নেগেলিও রয়েছে এই কেন্দ্রে। তার কথায়: “মাঝেসাঝে রাত্রিবেলায় মায়ের সঙ্গে ইট বানাই।” কর্ণাটকে তার দেশে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে ছোট্ট রাজেশ্বরী। ইট বানানোর মত শ্রমনিবিড় কাজে সে বেশ দক্ষ। “বিকেলবেলায় আই আর বাবা মিলে মাটিটা তৈরি করে, তারপর রাত্তিরে ইট বানায়। ওঁদের দেখাদেখি আমিও কাজে হাত লাগাই।” ইটের ছাঁচে মাটি ভরে একটানা চাবড়াতে চাবড়াতে সেটা বসিয়ে দেয় সে। কিন্তু ছাঁচ থেকে কাঁচা ইট বার করা চাট্টিখানি কাজ নয়, বড্ড ভারি যে! তাই সেটা হয় তার মা কিংবা বাবা এসে করেন।
“কটা [ইট] বানাই তা নিজেই জানি না, কিন্তু ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়ি, আর আই-বাবা খেটে যায় একনাগাড়ে,” রাজেশ্বরী জানালো।
কোলাপুরে এসে ওঠার পর ইজিসি কার্ড ছাড়া লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া না-মুমকিন, কিন্তু অবনীতে পঠনরত ২৫টি বাচ্চার একজনের কাছেও সেসব নেই। উপরন্তু ইটভাটার নিকটতম স্কুলটি পাঁচ কিলোমিটার দূরে।
“ওটা যে বড্ড দূর। ওখানে আমাদের কে নিয়ে যাবে শুনি?” প্রশ্ন করে অর্জুন।
অথচ নিকটতম বিদ্যালয়ের দূরত্ব এক কিলোমিটারেরও অধিক হলে ইজিসি কার্ডটি এই বলে বাবা-মা ও সন্তানদের ভরসা দেয় যে, “পরিযায়ী পড়ুয়াদের জন্য ক্লাসরুম তথা যানবাহনের ইন্তেজাম করার দায়িত্ব বর্তায় স্থানীয় শিক্ষা বিভাগ, জেলা পরিষদ কিংবা পৌরসভার উপর।”
কিন্তু বাস্তবটা যে এক্কেবারে উল্টো, সেকথা জানালেন অবনী বেসরকারি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহক অনুরাধা ভোসলে, “এই জাতীয় নীতিবিধানের দেখা শুধু কাগজেই মেলে।” ইনি আজ ২০ বছর ধরে এখানে কাজ করে আসছেন।
আহমেদনগর জেলা থেকে কোলাপুরের ইটভাটায় মজুরি করতে আসেন আরতি পাওয়ার, ২৩। “২০১৮ সালে আমার মা-বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দেয়,” জানালেন তিনি। সপ্তম শ্রেণিতেই স্কুলজীবন শেষ হয়ে গিয়েছিল তাঁর।
“এককালে স্কুলে যেতাম। আর আজ ইটভাটায় খেটে মরি,” বললেন আরতি।
*****
“দুই বছর কিছুই পড়তে পারিনি। আমাদের কোনও স্মার্টফোন নেই,” মার্চ ২০২০ থেকে জুন ২০২১ সালের সেই সময়টার কথা বলছিল অর্জুন, যখন শিক্ষাদীক্ষার পুরোটাই চলে যায় অনলাইনের কব্জায়।
“করোনার আগেও পাশ করতে খুব কষ্ট হত আমার, কারণ মাসের পর মাস স্কুলে যাওয়া হয় না তো। ক্লাস ফাইভ-টা তো দুবার করে পড়তে হল,” ক্লাস এইটে পড়া অর্জুন জানাচ্ছে। মহারাষ্ট্রের অসংখ্য পড়ুয়ার মতো, সরকারের হুকুমে বিদ্যালয়ে না যাওয়া সত্ত্বেও দুইবার প্রমোশন (ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি) পেয়েছিল এই কিশোর।
এ দেশের মোট জনসংখ্যার (জনগণনা ২০১১) ৩৭ শতাংশ (৪৫ কোটি) অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু, আন্দাজ বলছে যে এদের মধ্যে অনেকেই নাবালাক। এই সংখ্যাটি এতটাই বৃহৎ যে ফলপ্রসূ নীতি বানিয়ে তা এক্ষুনি বাস্তবায়িত না করলেই নয়। অভিবাসী শ্রমিকদের সন্তানরা যাতে একটানা পড়াশোনা করে যেতে পারে, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতির বাস্তবায়ন রূপে ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে সুপারিশ করেছিল আইএলও ।
“সে রাজ্যস্তরেই বলুন বা কেন্দ্রে — পরিযায়ী বাচ্চাদের শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়, এমন নীতি রূপায়িত করার ব্যাপারে সরকার একফোঁটাও উৎসাহী নয়,” জানালেন অশোক তাঙ্গডে। অভিবাসী পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার অধিকার হাঁড়িকাঠে তো চড়ছেই, এমনকি অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিবেশেও থাকতে বাধ্য হচ্ছে তারা।
ওড়িশার বারগড় জেলার সুনালারম্ভা গাঁ থেকে, মা-বাবা ও বোনের সঙ্গে সারা দেশ ঘুরে শেষে কোলাপুরের ইটভাটায় এসেছে ছোট্ট গীতাঞ্জলি সুনা, তখন ২০২২ সালের নভেম্বর। যন্ত্রের হুড়ুমদুড়ুম সয়ে, অবনীর ঘরে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছিল সে। কোলাপুরের ইটভাটার এই ধুলোয় ভরা বাতাস কয়েক মুহূর্তের জন্য ভরে উঠল বাচ্চাদের হাসি-মাখা কলতানে।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র