মহারাষ্ট্রের ইয়াভাতমাল জেলা থেকে ২৩ জন অদিবাসী কৃষক দিল্লির দক্ষিণে নিজামুদ্দীন রেলওয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছোন ২৭শে নভেম্বর সকালবেলায়। তারপর তাঁরা ৩০ মিনিট পায়ে হেঁটে সরাই কালে খান এলাকায় শ্রী বালা সাহেবজী গুরুদোয়ারায় আসেন। ২৯-৩০ নভেম্বর, ২০১৮ তারিখের কিষান মুক্তি যাত্রায় আগত কৃষকদের জন্য গুরুদোয়ারা লাগোয়া একটা নির্মীয়মান চত্বর প্রস্তুত রাখা হয়েছিলো।
সর্বপ্রথম ইয়াভাতমাল থেকে আগত কৃষকদের এই দলটি-ই এখানে এসে পৌঁছোল সকাল ১০টা নাগাদ। এঁদের এখানে এসে পৌঁছোনো, রাত্রিবাস এবং আহারাদির বন্দোবস্ত করেছিলেন সর্ব ভারতীয় কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির সদস্য ও নেশান ফর ফার্মারস গোষ্ঠীর স্বেচ্ছাকর্মীরা।
মহারাষ্ট্র আর অন্ধ্রপ্রদেশের সীমানায় কেলাপুর তালুকের পিমপালকুটি গ্রাম থেকে নন্দীগ্রাম এক্সপ্রেসে চেপে সাত ঘণ্টার পথ পেরিয়ে কোলাম আদিবাসী কৃষকেরা নাগপুর এসে পৌঁছালেন ২৬ নভেম্বর সন্ধেবেলায়। সেখান থেকে আবার কেরালা থেকে আগত ট্রেনে করে নিজামুদ্দীন স্টেশন।
“আমরা এখানে সংসদ ভবন ঘেরাও করতে এসেছি,” বলছেন মাহারাষ্ট্র রাজ্য কিষানসভার ইয়াভাতমাল জেলার সভাপতি চন্দ্রশেখর সিদাম, তিনি নিজেও একজন চাষি। তিনি আরো বললেন “চাষিদের মূল বিষয়গুলি হল ঋণ মুকুব, গবাদি পশুর খাদ্যের জোগান, উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, কর্মসংস্থান এবং খাদ্য সুরক্ষা ঘিরে। এই সব দাবিদাওয়া নিয়েই আমাদের দলটি ইয়াভাতমাল থেকে এখানে এসেছে।”
তিনি আরও বললেন যে তাঁর জেলাতে কৃষকদের শোচনীয় অবস্থার কারণ বিগত ২-৩ বছর ধরে চলা একটানা খরা । সরকার থেকে যে ঋণ মুকুব করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে, বস্থার মোকাবিলায় তা একটা নিতান্তই অসম্পূর্ণ একটা পদক্ষেপ। তিনি বলছেন, “মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ এলাকাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। আর এই অঞ্চলের মধ্যে ইয়াভাতমাল জেলাই সবচেয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এখানকার বর্ষানির্ভর কৃষি এবং জলসেচের বন্দোবস্ত না থাকায় বেশিরভাগ কৃষককেই নিজের ব্যবস্থা নিজেকে দেখতে হয়।”
ইয়াভাতমাল জেলার অন্তর্গত কেলাপুর তালুকের পাঠানপুর গ্রামের বাসিন্দা চন্দ্রশেখর মোটামুটি তিন একর জমির মালিক। “এই বছর বীজ বোনার অনেক পরে, খুব দেরিতে বৃষ্টি নেমেছে। ফলে সেই বীজ থেকে আর ফসল জন্মায়নি। তিনি জানাচ্ছেন, “আমরা তারপরে আবার বীজ বুনি। কিন্তু সে সময় এতো বেশি বৃষ্টি নামল যে সব জলমগ্ন হয়ে গেল। যেবার বৃষ্টি নামতে খুব দেরি হয় সে বার মাঠ শুকিয়ে এতটাই ফুটিফাটা হয়ে যায় যে ফসলের গোড়া শুকিয়ে যায় জলের অভাবে। আর তুলোর গুটিগুলোও শুকিয়ে, অকেজো হয়ে যায়। জলস্তরও ভীষণভাবে নেমে নষ্ট হয়ে গেছে একটানা অনাবৃষ্টির কারণে।
কেবলমাত্র গুটিকয়েক তালুক নয়, গোটা ইয়াভাতমালই খরাপ্রধান এলাকা বলে ঘোষণা করা হোক বলে তিনি জানাচ্ছেন। তাঁর কথায়, “অন্যান্য তালুক এখনও [খরা-কবলিত] বলে ঘোষিত হয়নি, অন্তত আমাদের জানা নেই। আমরা অন্যান্য তালুকের কৃষকের পাশেও আছি। কারণ তাঁরাও আমাদের মতোই ভুক্তভোগী। আমারা মনে করি সরকারের উচিত অবিলম্বে প্রতিটি তালুকের অবস্থা সরেজমিনে খুঁটিয়ে দেখা।”
তাঁদের সঙ্গে গ্রামের মেয়ে কৃষকেরা আসেননি কেন? আমরা সমস্ত পুরুষ কৃষকদের মুখ থেকে শুনেছি তাঁদের জমিতে মেয়েদের ছাড়া কৃষিকাজের কিছুই এগোবে না। “মেয়েদের ছাড়া কৃষিকাজ সম্ভব নয়। তাঁরা আগাছা পরিষ্কার করে জমি নিড়ান এবং ফসলের দেখাশোনা করেন। তাঁরা তুলো তোলেন। বীজ বোনার কাজটাও প্রায়শই তাঁরা করে থাকেন। সুতরাং মেয়েদের ছাড়া কৃষিতে কোনও উপায় নেই,” বলছেন চন্দ্রশেখর। “আমাদের সমস্ত কর্মসূচিগুলিতে মেয়েরা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। কিন্তু এই সময়ে অনেক মেয়েরাই মুম্বইয়ের মহিলা কৃষকদের জমায়েতে গিয়েছেন। পরিবারের সবকিছুই নির্ভর করে তাঁদের ওপরে। এমনকি যদি তিনি বাড়ির কর্ত্রী না হলেও পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তিনিই, তাঁর উপরে গোটা পরিবার নির্ভরশীল। সেজন্যই আমরা কোনও মহিলাকে আমাদের সঙ্গে আনতে পারিনি। দিল্লিতে যাওয়া-আসা মিলে মোট ছয় দিনের ধাক্কা।”
গুরুদোয়ারাতে অন্যান্য চাষিদের মতো প্রভাকর বাওনেও বললেন খরার কথা। মানেগাঁও তালুকের হিওরা মাজোলা গ্রাম থেকে এসেছেন। তিনি তুলোর চাষ করেছিলেন এবং বলছেন যে কয়েকবার ভালো বৃষ্টি হলেও এই বছর খরা লেগেই ছিল। “এখন চাষিদের রবিশস্য তোলার সময়, অথচ গ্রামে গেলে দেখবেন সমস্ত তুলোর ফসল শুকিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে...” তিনি আরও বলেন যে তাঁদের মতো চাষিদের মুল সমস্যা খেতমজুর হিসেবে নিয়মিত কাজের অনিশ্চয়তা, ঋণের বোঝা, বিদ্যুতের অপর্যাপ্ত সরবরাহ তথা উঁচু দর ইত্যাদি। “আমরা দিল্লিতে এসেছি এইসব কিছুই সরকারকে জানাব বলে।”
কবে শেষবারের মতো ভালো ফসল পেয়েছেন? এ প্রশ্নর উত্তরে জবাব আসে, “কী আর বলব আপনাদের? এবারের অবস্থা গত বছরগুলোর থেকেও খারাপ। একজন চাষি কোনওদিনই পেটভরে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারবে না।”
বাংলা অনুবাদ : শৌভিক পান্তি