“ঠিক সময়ে অসুখটা ধরা পড়লে ওঁর এই ছবিটা আজ দেওয়ালে থাকত না। আজ উনি এখানে আমাদের সঙ্গেই থাকতেন,” শীলা তারে বলছিলেন।
তাঁর স্বামী অশোকের ছবির নিচে নীলের ওপর মারাঠিতে লেখা: ‘মৃত্যু ৩০/০৫/২০২০’।
পশ্চিম মুম্বইয়ের বান্দ্রায় কে বি ভাবা হাসপাতালে মারা যান অশোক। ‘সন্দেহ করা হচ্ছে’ মৃত্যুর কারণ কোভিড-১৯। তাঁর বয়স ছিল ৪৬। গ্রেটার মুম্বইয়ের মিউনিসিপাল কর্পোরেশনে (বিএমসি) সাফাইকর্মী ছিলেন তিনি।
চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করছেন শীলা, বয়স ৪০। পূর্ব মুম্বইয়ের চেম্বুরে বস্তি পুনর্বাসন অথরিটির একটি আবাসনে তাঁদের ২৬৯ বর্গফুটের বাড়িতে ছেয়ে আছে অমোঘ নিস্তব্ধতা। নিকেশ এবং স্বপ্নিল, তাঁর ছেলেরা, আর তাঁর মেয়ে মনীষা মায়ের কথা বলার অপেক্ষায় রয়েছে।
“এপ্রিল মাসের আট থেকে দশ তারিখের মধ্যে একটা সময় যখন ভাণ্ডুপে ওনার অফিসের প্রধানের [কোভিড-১৯] পজিটিভ এল,” বলে চললেন শীলা, “ওরা চৌকি বন্ধ করে দিয়ে সমস্ত কর্মীদের বলল নাহুর চৌকিতে কাজে যেতে [একই অঞ্চলে, শহরের এস ওয়ার্ডে]। এক সপ্তাহ পর উনি জানান যে ওঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।”
আবর্জনা তোলার গাড়িতে একটা দলের সঙ্গে কাজ করতেন অশোক। ভাণ্ডুপের বিভিন্ন অংশে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে আবর্জনা তুলে আনার কাজ চলত কোনও সুরক্ষ গিয়ার ছাড়াই। তার উপর তিনি ছিলেন ডায়াবেটিক। নিজের উপসর্গগুলির দিকে প্রধান সুপারভাইজারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু অসুস্থতার কারণে ছুটি এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার আবেদন মঞ্জুর হয়নি। শীলার সেই দিনটার কথা মনে আছে যেদিন তিনি অশোকের সঙ্গে নাহুর চৌকিতে গেছিলেন।
“আমি সঙ্গে গেছিলাম সাহেবকে বলে ওঁর পাঁচ দিনের ছুটির ব্যবস্থা করতে,” তিনি বললেন। অশোক তাঁর একুশ দিনের বেতনসহ ছুটির একটিও খরচ করেননি, জানালেন শীলা। “চেয়ারে বসে সাহেব বললেন যে সবাই যদি ছুটি নেয়, তাহলে এই পরিস্থিতিতে কাজগুলো কে করবে?”
কাজেই এপ্রিল এবং মে মাস জুড়ে কাজ করে চললেন অশোক। তাঁর সহকর্মী শচীন বাঙ্কার [অনুরোধে নাম পরিবর্তন করা হয়েছে] বললেন যে তিনি খেয়াল করেছিলেন যে অশোক প্রাণপাত কাজ করার চেষ্টা করছেন।
“উনি খুব তাড়াতাড়ি হাঁপিয়ে উঠছিলেন এবং শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু সাহেব আমাদের কথা না শুনলে আমরা করবই বা কি?” শচীন ফোনে আমাকে বললেন। “আমাদের চৌকির কোনও কর্মীর, সে স্থায়ী হোক বা অস্থায়ী, কোভিড পরীক্ষা হয়নি। প্রধানের পজিটিভ আসার পর কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়নি যে তাদের কোনও উপসর্গ আছে কি না। আমাদের শুধু বলা হল অন্য আরেকটা চৌকিতে কাজে যেতে।” (প্রতিবেদক শচীন এবং অন্যান্য কর্মীদের মাধ্যমে প্রধান বা মুকাদমের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর স্বাস্থ্য বিষয়ে খবর সংগ্রহ করার চেষ্টা করলেও তা পাওয়া যায়নি)।
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে অবশেষে শচীন এবং তাঁর সহকর্মীদের কোভিড পরীক্ষা করা হয়। কর্মস্থলের কাছেই বিএমসি পরিচালিত একটি ক্যাম্পে পরীক্ষা হয়। “আমার কোনও লক্ষণ বা অসুস্থতা নেই,” বললেন শচীন, “কিন্তু মার্চ-এপ্রিলে যখন পরিস্থিতি খুব ভয়ানক ছিল তখনই আমাদের পরীক্ষা করানো উচিত ছিল।”
এপ্রিলের ৫ তারিখের মধ্যে এস ওয়ার্ডে ১২টি কোভিড পজিটিভ কেস পাওয়া যায়। এপ্রিলের ২২ তারিখ কেসের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০৩। জুন মাসের পয়লা তারিখ, অর্থাৎ অশোক মারা যাওয়ার পরের দিন, ওয়ার্ডে কেসের সংখ্যা ছিল ১৭০৫ এবং জুনের ১৬ তারিখের মধ্যে সেটা বেড়ে হয় ৩১৬৬ – এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন বিএমসির এক স্বাস্থ্য অধিকারিক।
কেসের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া মানে মুম্বইয়ের সমস্ত ওয়ার্ডেই বাড়ছিল কোভিড-১৯-সংক্রান্ত বর্জ্য পদার্থের স্তূপ। বিএমসির সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মার্চ মাসের ১৯ থেকে ৩১ তারিখের মধ্যে মুম্বইয়ে ৬৪১৪ কিলো কোভিড-১৯ বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছিল। এপ্রিল মাসে শহরের কোভিড-১৯ বর্জ্য (কোয়ারান্টাইন অঞ্চল-সহ) ছিল ১২০ টনেরও বেশি – ১১২,৫২৫ কিলো। মে মাসের শেষে, অশোক যখন মারা যান, তখন সেই মাসে বর্জ্যের পরিমাণ ছিল আন্দাজ ২৫০ টন।
এই আবর্জনা, যা আলাদা রাখার কথা ছিল, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা কার্যত মিশে ছিল মুম্বইয়ের অন্য আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই। আর এই বর্জ্য তোলার দায়িত্ব ছিল শহরের সাফাই কর্মীদের উপর। “প্রত্যেক দিন আবর্জনা তোলার নির্দিষ্ট জায়গায় আমরা মাস্ক, গ্লাভস আর ফেলে দেওয়া টিস্যু পেপার পাই,” বললেন শচীন।
সাফাইকর্মীদের মধ্যে অনেকেই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতালের দাবি জানাচ্ছেন। (দেখুন, অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আর অকিঞ্চিৎকর জীবন )। কিন্তু বিএমসির ২৯০০০ জন স্থায়ী কর্মী এবং ৬৫০০ জন চুক্তি কর্মী হিসেবে কর্মরত সাফাইকর্মী বহুক্ষেত্রেই ‘কোভিড যোদ্ধা’ হিসেবে ঘোষিত হলেও কোনও সুরক্ষা সরঞ্জাম অথবা চিকিৎসার সুবিধে পাচ্ছেন না।
“আমাদের দাবি কখনোই পূরণ হয় না। সব সাবধানতা আর যত্ন হচ্ছে অমিতাভ বচ্চনের মতো লোকেদের পরিবারগুলির জন্য। মিডিয়া আর সরকার ওদের কত পাত্তা দিল। আমরা কারা? সাফাই কামগার মাত্র!” বললেন এম-পশ্চিম ওয়ার্ডে বিএমসির আবর্জনা ট্রাকে কর্মরত ৪৫ বছর বয়সী দাদারাও পাটেকর।
“মার্চ-এপ্রিল মাসে আমরা কোনও মাস্ক, গ্লাভস, বা স্যানিটাইজার পাইনি,” সংযোজন শচীনের। তিনি জানাচ্ছেন যে তাঁদের চৌকিতে মে মাসের শেষ সপ্তাহে সাফাই কর্মীদের এন-৯৫ মাস্ক দেওয়া হয়। “তা-ও আবার সবাইকে দেওয়া হয়নি। ৫৫ জনের মধ্যে [এস ওয়ার্ডের নাহুর চৌকিতে] মাত্র ২০–২৫ জন মাস্ক, গ্লাভস, আর একটা ৫০ মিলিলিটারের স্যানাটাইজারের বোতল পেয়েছিল, সেটাও ৪–৫ দিনের মধ্যে ফুরিয়ে যায়। আমি আর অন্যান্য কর্মীরা জুন মাসে মাস্ক পেয়েছি। মাস্কগুলো ধুয়ে বারবার ব্যবহার করি। যখন মাস্ক আর গ্লাভস আর ব্যবহার করার মতো অবস্থায় থাকে না, আমাদের সুপারভাইসার নতুন স্টকের জন্য দু-তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে বলে।”
“সাফাই কর্মীরা কোভিড যোদ্ধা” – এসব ফাঁকাবুলি আউড়ে কিচ্ছু হবে না। [তাঁদের প্রতি] যত্ন এবং সুরক্ষা কোথায়?” ব্যাকুল প্রশ্ন শীলার। “উনি গ্লাভস আর এন-৯৫ মাস্ক ছাড়া কাজ করছিলেন। আর সাফাই কর্মচারী মরে যাওয়ার পর তার পরিবারের কথা কে-ই বা ভাবে?” তারে পরিবার নব বুদ্ধ সম্প্রদায়ের সদস্য।
মে মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যে অশোকের অবস্থার অবনতি ঘটল। “এই সময়ের মধ্যে পাপার জ্বরও হয়েছিল। ২-৩ দিন পর আমাদের সবার জ্বর এল। স্থানীয় [বেসরকারি] ডাক্তার বললেন, স্বাভাবিক জ্বর। ওষুধ খেয়ে আমরা সুস্থ হয়ে গেলাম। কিন্তু পাপার তখনও শরীর খারাপ ছিল,” জানাল ২০ বছর বয়সী মনীষা। ঘাটকোপার পূর্বে একটি কলেজে বি-কমের ছাত্রী সে। পরিবারের সবাই ভেবেছিল কোভিড হতে পারে, কিন্তু ডাক্তারের রেফেরাল ছাড়া [তখন আবশ্যক ছিল] সরকারি হাসপাতালে অশোকের পরীক্ষা করানো সম্ভব ছিল না।
মে মাসের ২৮ তারিখ। জ্বর ছেড়ে গেছিল। ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টোর শিফ্টে কাজ করে বিধ্বস্ত অশোক বাড়ি ফিরে, খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ৯টা নাগাদ যখন তাঁর ঘুম ভাঙে তখন তিনি বমি করতে আরম্ভ করেন। “জ্বর এসেছিল, মাথা ঘুরছিল। ডাক্তার দেখাতে রাজি হলেন না। ঘুমিয়ে পড়লেন,” বলছেন শীলা।
পরের দিন, অর্থাৎ মে মাসের ২৯ তারিখ সকালে শীলা, নিকেশ, মনীষা এবং স্বপ্নিল ঠিক করে যে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেই হবে। সকাল ২০টা থেকে দুপুর ১টা অবধি বাড়ির কাছাকাছি এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে চক্কর কাটতে থাকে পরিবারটি। “দুটো রিকশা নিয়েছিলাম আমরা। পাপা আর আই একটাতে, আর আমরা তিনজন আরেকটায়,” বলল ১৮ বছর বয়সী স্বপ্নিল, সে চেম্বুরের একটি কলেজে বি-এসসি পড়ছে।
“প্রত্যেকটা হাসপাতাল বলছিল যে বেড নেই,” বলছে ২১ বছরের নিকেশ, দু বছর আগে বিএসসি শেষ করে এখন সে চাকরি খুঁজছে। “আমরা রাজাওয়াড়ি হাসপাতাল, জয় হাসপাতাল, কে জে সোমাইয়া হাসপাতালে গেছিলাম। কে জে সোমাইয়াতে আমার বাবা ডাক্তারকে বলেওছিল যে প্রয়োজনে মেঝেতে শোবে, কিন্তু যেন তার চিকিৎসা করা হয়।” প্রতিটি হাসপাতালে নিজের বিএমসির পরিচয় পত্রও দেখিয়েছিলেন অশোক। তাতেও কোনও কাজ হয়নি।
শেষ পর্যন্ত বান্দ্রার ভাবা হাসপাতালে অশোককে পরীক্ষা করে দেখেন ডাক্তার। স্যোয়াব নেওয়া হয় তাঁর। “তারপর ওরা বাবাকে কোভিড-১৯ আইসোলেশান ঘরে নিয়ে গেল,” জানাচ্ছে স্বপ্নিল।
মনীষা ওই ঘরে গেছিল অশোককে একটা জামাকাপড়, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, আর সাবানের ব্যাগ দিতে। তখন, মনে আছে তার, “প্যাসেজে প্রস্রাবের তীব্র গন্ধ ছিল, মেঝেতে পড়ে ছিল আধ-খাওয়া খাবারের থালা। ঘরের বাইরে কোনও কর্মী ছিল না। আমি উঁকি মেরে বাবাকে ডেকে বললাম ব্যাগটা নিয়ে যেতে। বাবা অক্সিজেন মাস্ক খুলে দরজার কাছে এসে আমার থেকে ব্যাগটা নিল।”
তারে পরিবারের সদস্যদের চলে যেতে বলেন ডাক্তাররা। বলেন, পরীক্ষার রিপোর্ট না আসা অবধি অশোককে অবসার্ভেশানে রাখা হচ্ছে। সেই রাতে, ১০টা নাগাদ, স্বামীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন শীলা। “আমি ভাবিইনি যে এই শেষবারের মতো ওঁর গলার আওয়াজ শুনছি। উনি বলেছিলেন যে ওঁনার এখন ভালো লাগছে,” তিনি বললেন।
পরের দিন সকালে, মে মাসের ৩০ তারিখ, শীলা মনীষাকে নিয়ে হাসপাতালে যান। “ডাক্তার আমাদের বললেন যে তোমাদের রোগী গতকাল রাত ১:১৫টা নাগাদ মারা গেছে,” বললেন শীলা। “কিন্তু আগের রাতেই তো ওঁর সাথে কথা হয়েছিল আমার...”
শোকাতুর এবং নিথর হয়ে যাওয়া তারে পরিবার তখন অশোকের মৃত্যুর কারণ আর জিজ্ঞেস করতে পারেনি। “আমাদের কোনও হুঁশ ছিল না। বডি পাওয়ার জন্য কাগজপত্র ঠিক করা, অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করা, মাকে সান্ত্বনা দেওয়া – এসবের মধ্যে পাপার মৃত্যুর কারণ আর ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করা হয়নি,” বলছে নিকেশ।
অশোকের সৎকারের দুদিন পর তারে পরিবার আবার ভাবা হাসপাতালে যায়, মৃত্যুর কারণ লিখিত আকারে চাইতে। “জুন মাসের ১৫ দিন ধরে আমরা হাসপাতালে ঘুরেই যাচ্ছিলাম। ডাক্তার বলছিলেন, রিপোর্ট থেকে ঠিক করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না, নিজেরাই অশোকের ডেথ সার্টিফিকেট পড়ে নাও,” জানালো ২২ বছর বয়সী বসন্ত মাগারে, অশোকের ভাইপো।
জুন মাসের ২৪ তারিখ, মুলুন্দের টি-ওয়ার্ডের (যেখানে অশোক কর্মচারী হিসেবে নথিভুক্ত ছিলেন) বিএমসি আধিকারিকদের চিঠি পাওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে বলেন যে “কোভিড-১৯ মৃত্যুর কারণ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।” চিঠিতে লেখা আছে যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর অশোকের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। “মে মাসের ৩০ তারিখ রাত ৮:১১ মেট্রোপলিস ল্যাবরেটরি থেকে আমাদের ইমেল করে জানানো হয় যে গলার স্যোয়াব যথেষ্ট নয়। এবং তারা আমাদের বলে আবার পরীক্ষা করার জন্য রোগীর স্যোয়াব পাঠাতে। কিন্তু রোগী যেহেতু ততক্ষণে মারা গেছিলেন, আরেকবার স্যোয়াব পাঠানো সম্ভব ছিল না। তাই মৃত্যুর কারণ লেখার সময় আমরা “সন্দেহ করছি কোভিড-১৯” এই কথা বলেছি।
ভাবা হাসপাতালের যে ডাক্তার অশোককে দেখেছিলেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করা হয় এই প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে। কিন্তু তিনি ফোন বা মেসেজের উত্তর দেননি।
অশোকের মতো ‘কোভিড-১৯ যোদ্ধা’দের পরিবারগুলিকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার জন্য, স্বাস্থ্য এবং পরিবার সুরক্ষা মন্ত্রকের নির্দেশ অনুসারে ২০২০ সালের ২৯শে মে, একটি রেজোলিউশান পাশ করে মহারাষ্ট্র সরকার। এই রেজোলিউশানে বলা হয় যে “কোভিড-১৯ অতিমারিতে সার্ভে, ট্রেসিং, ট্র্যাকিং, টেস্টিং, প্রতিরোধ, চিকিৎসা অথবা ত্রাণ কার্যের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত যে কোনও কর্মচারীর পরিবারকে সামগ্রিকভাবে ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা কবচ হিসেবে ৫০ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে।”
৮ই জুন, ২০২০, বিএমসি একটি সার্ক্যুলারের মাধ্যমে এই রেজোলিউশান বাস্তবায়িত করার কথা বলে। ঘোষণা করা হয় যে “কোনও ঠিকা শ্রমিক/ আউটসোর্স্ড কর্মী/ দিনমজুর/ সাম্মানিকের নিরিখে নিযুক্ত কর্মী যদি কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কাজ করতে গিয়ে কোভিড-১৯-এ মারা যান” তাহলে কিছু শর্ত সাপেক্ষে তাঁর পরিবার ৫০ লক্ষ টাকা পেতে পারেন।
শর্তগুলির মধ্যে ছিল – হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বা মৃত্যুর ১৪ দিন আগে ডিউটি করা। অশোকের ক্ষেত্রে এই শর্ত প্রযোজ্য ছিল। যদি ঠিক করে কোভিড-১৯ পরীক্ষা না হয় বা বোঝা না যায় তাহলে বিএমসি আধিকারিকদের একটি কমিটি কেসের ইতিহাস এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র খতিয়ে দেখবে যে কোভিড-১৯-এর ফলে মৃত্যুর সম্ভাবনা কতখানি ছিল। এই কথাও সার্ক্যুলারে বলা হয়েছিল।
বিএমসির সলিড ওয়েস্ট ম্যানাজমেন্ট বিভাগের শ্রম আধিকারিকের থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে অগস্ট মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে ২৯০০০ স্থায়ী কর্মীর মধ্যে ২১০ জনের করোনা পরীক্ষা পজিটিভ আসে, ৩৭ জন মারা যান, ১৬৬ জন সেরে উঠে আবার কাজে যোগ দেন। এই আধিকারিক জানিয়েছেন যে ভাইরাস আক্রান্ত চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের ক্ষেত্রে কোনও তথ্য নথিভুক্ত হয়নি।
যে ৩৭ জন সাফাই কর্মী মারা গেছেন তাঁদের মধ্যে ১৪ জনের পরিবার ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের আবেদন জানিয়েছেন। ৩১শে অগস্ট অবধি ২টি পরিবার বিমার টাকা পেয়েছে।
অশোকের মৃত্যুর কারণ লিখিত আকারে পাওয়ার পর থেকে বিএমসিএর টি ওয়ার্ডের দপ্তরে ঘোরা শুরু হল তারে পরিবারের যাতে ৫০ লক্ষ টাকার জন্য আবেদন জমা দেওয়া যায়। এতদিন অবধি নোটারির টাকা, ফোটোকপি, অটোরিকশার ভাড়া আর অন্যান্য খরচ মিলিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে ৮০০০ টাকারও বেশি।
ব্যাঙ্কে অশোকের মাইনের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে না পেরে শীলা জানাচ্ছেন যে তিনি আধা তোলা ওজনের সোনার দুল আন্দাজ ৯০০০ টাকায় বন্ধক রেখেছেন। “প্রত্যেকবার নোটারাইজ্ করার পর আধিকারিকরা বলতেন কাগজে একটা কিছু পাল্টাতে হবে। যদি ৫০ লাখ টাকা নাও হয়, নিয়ম অনুযায়ী বাবার জায়গায় আমার বড়ো ছেলেকে একটা চাকরি দেওয়া উচিত বিএমসির,” আমাকে সমস্ত ফাইল আর কাগজ দেখিয়ে বললেন তিনি।
এই প্রতিবেদক যখন ২৭শে অগস্ট টি-ওয়ার্ডের অ্যাসিসট্যান্ট কমিশানারের দপ্তরের সঙ্গে কথা বলে তখন তাদের উত্তর ছিল এই – “হ্যাঁ, উনি আমাদের কর্মচারী ছিলেন এবং পরিবারের আবেদনের ফাইল আমরা জমা নিয়েছি। বিএমসি আধিকারিকদের একটা তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া বাকি আছে, বিএমসি এখনও এই নিয়ে কাজ করছে।”
অশোকের রোজগারেই পরিবার চলত। জুন মাস থেকে শীলা কাছাকাছির মধ্যে দুটি আবাসনের দুখানা ফ্ল্যাটে রান্নার কাজ নিয়েছেন। রোজগার মাত্র ৪০০০ টাকা। “এখন চালানো মুশকিল হয়ে গেছে। আমি আগে কখনও কাজ করিনি, কিন্তু এখন তো করতেই হবে। আমার দুই সন্তান লেখাপড়া করছে,” তিনি বললেন। তাঁর দাদা, ৪৮ বছর বয়সী ভগবান মাগারে, নভি মুম্বই মিউনিসিপাল কর্পোরেশানের সাফাই কর্মী। তিনি মাসিক ১২০০০ টাকা বাড়িভাড়ার কিছুটা দিয়ে সাহায্য করেছেন।
২০১৬ সালে অশোক ‘স্থায়ী’ সাফাই কর্মচারীর পদ পান। পেতে শুরু করেন ৩৪,০০০ টাকা। আগে, চুক্তিভিত্তিক কর্মী হিসেবে মাইনে ছিল ১০,০০০ টাকা। “যখন উনি মোটামুটি ভদ্রস্থ মাইনে পেতে আরম্ভ করলেন, আমরা মুলুন্দের বস্তি থেকে এই এসআরএ বিল্ডিংটিতে উঠে এলাম। ধাপে ধাপে এগোচ্ছিলাম আমরা,” বললেন শীলা।
অশোকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তারে পরিবারের এগোনোর পথও বন্ধ হয়ে গেছে। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন শীলা, “আমরা চাই সরকার আমাদের কথা শুনুক। ওঁকে ছুটিটা দেওয়া হয়নি কেন? কেন ওনার বাদবাকি কর্মচারীদের সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করানো হয়নি? কেনই বা হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করতে হয়েছিল? ওঁর মৃত্যুর জন্য আসলে দায়ী কে?”
অনুবাদ : সর্বজয়া ভট্টাচার্য