রিতা আক্কা জীবন একটা বিরাট শিক্ষার মূর্তিমান প্রতীক – চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় প্রতিটি জীবনেরই কোনও উদেশ্য আছে। রিতা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী সাফাই কর্মচারী। তিনি মূক ও বধির। তাঁর স্বামী মারা গেছেন ও তাঁর ১৭ বছরের কন্যা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এখন নিজের দিদিমার সঙ্গে থাকছে। নিঃসঙ্গতা রিতা আক্কার জীবন জুড়ে রয়েছে বটে, কিন্তু তার কাছে হার মানতে তিনি নারাজ।
পাড়াপড়শির কাছে তাঁর পরিচয় রিতা আক্কা (দিদি) নামে (অবশ্য অনেকে তাঁকে হেয় করে উমাচি বা বোবা-কালা বলেও ডাকে)। প্রতিদিন সকালে রিতা ঘুম থেকে উঠে নিয়ম করে তাঁর চেন্নাই পুরসভার আবর্জনা সংগ্রহের কাজে লেগে পড়েন। অবশ্য সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর মাঝেমাঝে গায়ের ব্যথার কথা বলেন তিনি। কাজের প্রতি তাঁর নিষ্ঠার সাক্ষ্য বহন করছে তাঁর অদ্ভুতদর্শন সাইকেল রিকশার দুই পাশ। এই রিকশা ঠেলে ঠেলে তিনি আবর্জনা সংগ্রহ করেন সেই রিকশার দুই পাশে ভিন্ন ভিন্ন রং দিয়ে রিতা নিজের নাম তিনবার লিখেছেন। দিনের শেষে রিতা তাঁর কোট্টাপুরম এলাকার সরকারি হাউসিং বোর্ডের আবাসনের নিঃসঙ্গ এক চিলতে ঘরে ফিরে যান।
পোষ্যদের কাছে ফেরার আগে রিতা দুইটি নিত্যকর্ম সারেন। ছোট্ট একটা দোকান থেকে কুকুরদের জন্য বিস্কুট আর মাংসের দোকান থেকে বিড়ালদের জন্য মুরগির বর্জ্য ছাঁট কেনেন
এইসবের মাঝেই তিনি নিজের জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছেন। কাজের পর দমবন্ধ করা ঘরে ঢোকার আগে তিনি কুকুর বিড়াল পরিবেষ্টিত হয়ে বেশ কিছুটা সময় কাটান। তাদের খেতে দেন, তাদের সঙ্গে গল্প করেন। কোট্টাপুরমের রাস্তায় তাঁর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সারমেয়র দল - কখন রিতা কাজ সেরে তাদের কাছে আসবেন।
রিতা আক্কা আদতে তিরুভন্নমালাইয়ের একটি ছোটো শহরের মানুষ (২০১১ সালের আদমসুমারির মতে এই জেলার প্রায় ৮০ ভাগই গ্রামীণ মানুষ)। কুড়ি বছরেরও আগে রিতা তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজের সন্ধানে চেন্নাই চলে আসেন। স্মৃতি আবছা হয়ে এসেছে। সন তারিখ অত মনে থাকে না। কিন্তু এটা জানান যে এর বেশিরভাগ সময় তাঁর কেটেছে লোকের বাড়িতে সামান্য টাকায় কাজ করে। বছর সাতেক আগে তিনি চেন্নাই পুরসভায় (এখন বৃহৎ চেন্নাই পুরসভা) ঠিকাশ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দেন। শুরুতে দৈনিক মাত্র ১০০ টাকা পেতেন। এখন মাসে ৮০০০ টাকা রোজগার করেন।
কোট্টাপুরমের অন্তত ছয়খানা বিশাল বড়ো বড়ো রাস্তায় তিনি ঝাড়ু দিয়ে সাফ সাফাই করেন। এই কাজে তাঁর অস্ত্র হল ব্লিচিং পাউডার, ঝাঁটা ও বালতি। দস্তানা বা সুরক্ষা পোষাক না পরেই এই কাজ করেন আক্কা। আবর্জনা সংগ্রহ করে রাস্তায় রাখা পৌরসভার নির্দিষ্ট পাত্রে জমা করেন। ওখান থেকে পৌরসভার গাড়ি বা লরি এসে পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের জন্য নিয়ে যায়। সকাল ৮টায় কাজ শুরু করেন রিতা। শেষ হতে হতে দুপুর গড়িয়ে যায়। তিনি জানালেন যে রাস্তা পরিষ্কার করার সময়ে একটা দুর্ঘটনার ফলে একটি চোখে কম দেখছেন। তাছাড়া খালি পায়ে হেঁটে ফোস্কা হয়েছে। এসব বাদে তাঁর দাবি যে তাঁর শরীরস্বাস্থ্য বেশ ভালোই আছে, বিশেষ কোনও সমস্যা নেই।
তাঁর রোজগারের সিংহভাগ যায় কুকুর বিড়ালদের খাবার কেনার পিছনে। প্রতিবেশীদের আন্দাজ তিনি প্রায় দৈনিক ৩০ টাকা ওদের পিছনে খরচ করেন। অবশ্য রিতা এ ব্যাপারে নীরব।
পোষ্যদের সঙ্গে দেখা করার আগে রিতা দুই জায়গায় থামেন। একটা ছোট্ট দোকান থেকে কুকুরদের জন্য বিস্কুট আর মাংসের দোকান থেকে মুরগির বর্জ্য কেনেন রিতা। ‘কড়ি সিলরা’ কথাটার আক্ষরিক অর্থ ছাঁট মুরগি। মুরগি কেটে পরিষ্কার করে বিক্রি করার পর যা কিছু পড়ে থাকে তা রিতার মতো খদ্দেরের কাছে ১০ টাকায় বিক্রি হয়।
পোষ্যদের সঙ্গে সময় কাটানোর আনন্দের কাছে খরচের ব্যাপারটা রিতার কাছে নেহাতই নস্যি।
তাঁর স্বামী বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। রিতার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এসেছে। হয়তো এই প্রসঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছাও করে না তাঁর। তখন থেকেই তিনি একলা আছেন। প্রতিবেশীরা জানালেন রিতার স্বামী মদে আসক্ত ছিলেন। কালেভদ্রে তাঁর মেয়ে আসে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে।
তবু রিতার মুখে সর্বদাই হাসির রেশ। পোষ্য সারমেয়দের সঙ্গ পেলে রিতার উজ্জ্বল হাসি আরও আরও ঝলমলে হয়ে ওঠে।
অনুবাদ: মহুয়া মহারানা