পাঁচই অগস্ট জাপানের মাটিতে দাঁড়িয়ে কুস্তিগির রবি দাহিয়া যখন অলিম্পিকের রূপোর পদক গলায় পরছিলেন, ঋষিকেশ ঘাডগে তা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। এমন আনন্দ বহুদিন পরে মিলল।
বছর কুড়ির ঋষিকেশ মহারাষ্ট্রের লাতুর জেলার একজন উঠতি কুস্তিগির। ২০২০ সালের মার্চ মাসে কোভিড অতিমারি শুরু হবার পরে টানা আঠেরোটা মাস তাঁর কেটেছে হতাশায় আর বিরক্তিতে। অদূর ভবিষ্যতে যে পরিস্থিতি খুব পালটাবে এমন সম্ভাবনাও কম। ঋষিকেশের কথায়, “গোটা ব্যাপারটাই হতাশার। মনে হচ্ছে আমার সময় যেন ফুরিয়ে আসছে।”
ম্লান হাসি হেসে ঋষিকেশ জটিল একটা সমস্যার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, “একইসঙ্গে কুস্তি চালিয়ে যাওয়া আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা আদৌ সম্ভব?”
ওসমানাবাদ শহরের উপকণ্ঠে “হাতলাই কুস্তি সংকুল” কুস্তির একাডেমিতে বসে ঋষিকেশ তাই নিজের মনের জ্বালা কাটাতে বন্ধুদের সঙ্গে ২০২০ টোকিও অলিম্পিক দেখেছেন। ৮ই অগস্ট ভারত যে সাতটা পদক সমেত নিজেদের সর্বসেরা পদক তালিকা নিয়ে অলিম্পিক শেষ করে, সেই পদকের মধ্যে দুটো কুস্তিতেই এসেছিল।
পুরুষদের ফ্রিস্টাইল কুস্তির ৫৭ কেজি বিভাগে দাহিয়ার রূপো আর ৬৫ কেজি বিভাগে বজরং পুনিয়ার ব্রোঞ্জ ঋষিকেশের মতো সাদামাটা পরিবারের কুস্তিগিরদের কাছে প্রেরণার উৎস। ২৩ বছরের দাহিয়া হরিয়ানার নাহরি গ্রামের এক ভাগচাষির সন্তান। টোকিওতে পদক জয়ের পরে তিনি প্রেস ট্রাস্ট অফ ইণ্ডিয়াকে এক সাক্ষাৎকারে জানান, তাঁর সাফল্যের জন্য তাঁর পরিবারকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তাঁর গ্রাম থেকে তিনজন অলিম্পিক ক্রীড়াবিদ উঠে এলেও, সেখানে বহু নিত্যপ্রয়োজনীয় পরিষেবাই নেই। “সবকিছুই দরকার এখানে - ভালো স্কুল থেকে শুরু করে খেলা সংক্রান্ত পরিষেবা,” তিনি জানান।
![Left: Rushikesh Ghadge moved from Latur to Osmanabad to train in wrestling. Right: Practice session in the wrestling pit at Hatlai Kusti Sankul in Osmanabad](/media/images/02a-IMG_20210708_163819-Crop-PMN.max-1400x1120.jpg)
![Left: Rushikesh Ghadge moved from Latur to Osmanabad to train in wrestling. Right: Practice session in the wrestling pit at Hatlai Kusti Sankul in Osmanabad](/media/images/02b-IMG_20210708_170556-PMN.max-1400x1120.jpg)
বাঁদিকে: ঋষিকেশ ঘাডগে কুস্তির তালিমের জন্য লাতুর থেকে ওসমানাবাদে এসেছেন। ডানদিকে: ওসমানাবাদের হাতলাই কুস্তি সংকুলে কুস্তি অভ্যাস চলছে
দাহিয়া যে যে বিষয়গুলোর কথা বলছেন, ঋষিকেশ তা ভালোই জানেন। তিন বছর আগে কুস্তির জন্যে তিনি লাতুর জেলার তাকা গ্রামের নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন। “আমাদের গ্রামে কোনও পরিষেবাই নেই”, কেন যে তিনি ৬৫ কিলোমিটার দূরে ওসমানাবাদ শহরে এসে উঠেছেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঋষিকেশ জানালেন, “ওসমানাবাদে ভালো প্রশিক্ষক রয়েছে, ফলে আমার এখানে (সফল কুস্তিগির হবার) সুযোগ অনেক বেশি।”
ঋষিকেশ কোলি সম্প্রদায়ের মানুষ। বাড়ি ছেড়ে আসার সিদ্ধান্তটা তাঁর জন্যে সহজ ছিল না। তাঁর বাবা তখন কর্মহীন। মা সেলাইয়ের কাজ করে মাসে সাত আট হাজার টাকা উপার্জন করেন, তাই দিয়েই সংসার চলে। “ভাগ্যক্রমে, আমি এমন একজন প্রশিক্ষক পাই যিনি বিনামূল্যে আমাকে কুস্তি অ্যাকাডেমির হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দেন,” ঋষিকেশ জানালেন। “ফলে আমার মাকে মাসে শুধু আমার খাওয়া-পরার খরচটুকুই পাঠাতে হচ্ছিল (২০০০ - ৩০০০ টাকা)। ভালোই চলছিল সবকিছু।”
ঋষিকেশের প্রশিক্ষক, বছর আঠাশের কিরণ জওয়ালগে হাতলাই কুস্তি সংকুল চালান। তিনি জানালেন, ওসমানাবাদে এসে অবধি ঋষিকেশ দারুণ নিষ্ঠা আর সম্ভাবনা দেখিয়েছেন। “জেলাভিত্তিক প্রতিযোগিতাগুলোয় ও ভালো ফল করছিল। পরের ধাপ ছিল জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতা। জাতীয় স্তরেও ভালো করলে খেলোয়াড় কোটার মাধ্যমে একটা সরকারি চাকরি পাওয়ার সুযোগ থাকে।”
কিন্তু তারপরেই অতিমারি এসে জীবন স্তব্ধ করে দেয়। ঋষিকেশের মা কাজ হারালেন। যে সমস্ত প্রতিযোগিতা জিতে ঋষিকেশের পক্ষে কিছু টাকা উপার্জন করা সম্ভব ছিল, সেগুলোও সব বন্ধ হয়ে গেল। জওয়ালগের কথায়, “এই অতিমারির সময়ে অনেক কুস্তিগির কুস্তি ছেড়ে মজুরের কাজ শুরু করেছে। (কুস্তির তালিম) চালিয়ে যাওয়া আর তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।”
![Many students of the wrestling academy have stopped training because they cannot afford the expensive diet anymore](/media/images/03-IMG_20210708_170631-PMN.max-1400x1120.jpg)
কুস্তি একাডেমির বহু ছাত্র কুস্তির খরচসাপেক্ষ ডায়েটের ব্যয়ভার বহন না করতে পেরে অনুশীলন ছেড়ে দিয়েছেন
কুস্তিগিরদের জন্যে সুষম আহার অত্যন্ত দরকারি, পাশাপাশি এটি খরচসাপেক্ষও বটে। জওয়ালগে জানালেন, “একজন কুস্তিগির মাসে চার কিলো কাঠবাদাম খায় গড়পড়তা হিসেবে। তার সঙ্গে রোজ চাই দেড় লিটার দুধ আর আটটা করে ডিম। শুধু খাবারের খরচই মাসে পাঁচ হাজার টাকা। আমার বহু ছাত্র কুস্তি ছেড়ে দিয়েছে কারণ এমন খরচ করার সামর্থ্যই নেই আর তাদের।” একাডেমির আশি জন ছাত্রের মধ্যে তাঁর কাছে এখনও তালিম নিতে আসেন মাত্র জনা কুড়ি ছাত্র।
যেসব ছাত্ররা এখনও আশায় বুক বেঁধে আছেন, ঋষিকেশ তাঁদেরই একজন।
নিজের খরচ বহন করতে ঋষিকেশ একাডেমির কাছেই একটি পুকুরে মাছ ধরে বিক্রি করেন। “ওসমানাবাদের একটা কাপড়কলে আমি একটা ঠিকা কাজও নিয়েছি। সব মিলিয়ে আমি দশ হাজার টাকার মতো উপার্জন করি।” ঋষিকেশ আরও জানালেন যে, এই টাকার থেকে পাঁচ হাজার নিজের জন্যে রেখে বাকিটা তিনি গ্রামে পাঠিয়ে দেন। এর পাশাপাশি ঋষিকেশ ওসমানাবাদের মাকানি গ্রামের ভারত বিদ্যালয়ের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রও বটে। তাঁর নিজের স্মার্টফোন না থাকায় বন্ধুদের ফোনে অনলাইন ক্লাস করছেন।
ঋষিকেশের মা ছেলের এত কষ্টের ব্যাপারে জানেন না। “এমনিতেই কোনও প্রতিযোগিতা হচ্ছে না বলে মা আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় আছেন। আমি সেই চিন্তা আরো বাড়াতে চাই না”, ঋষিকেশ জানাচ্ছেন, “আমার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে আমি সব করতে রাজি। অতিমারি শেষেও যাতে কুস্তির অভ্যাস থাকে, সেজন্য আমি রোজ তালিম নিচ্ছি।”
![Tournaments used to be a good source of income for aspiring wrestlers says Kiran Jawalge (left), who coaches the Hatlai Kusti Sankul students](/media/images/04a-IMG_20210706_191344-PMN.max-1400x1120.jpg)
![Tournaments used to be a good source of income for aspiring wrestlers says Kiran Jawalge (left), who coaches the Hatlai Kusti Sankul students](/media/images/04b-IMG_20210708_170853-PMN.max-1400x1120.jpg)
হাতলাই কুস্তি সংকুলের প্রশিক্ষক কিরণ জওয়ালগে (বাঁদিকে) জানাচ্ছেন যে কুস্তি শিক্ষার্থীদের কাছে কুস্তি প্রতিযোগিতাগুলো টাকা উপার্জনের একটা ভালো উপায় ছিল
মহারাষ্ট্রের গ্রামের কুস্তিগিরদের বেশিরভাগই কৃষক বা কৃষিশ্রমিক পরিবারের সন্তান। তাঁরা ঋষিকেশের মতোই কুস্তি নিয়ে উদ্যমী। গোটা মহারাষ্ট্র জুড়েই কুস্তির জনপ্রিয়তা প্রবল। হাজার হাজার, কখনও বা লাখের উপ র মানুষ আখড়ায় আখড়ায় কুস্তির প্রতিযোগিতা দেখতে আসেন।
কুস্তির আখড়াগুলোয় সাধারণত প্রতিবছর নভেম্বর থেকে মার্চ অবধি নানা বয়সভিত্তিক কুস্তি প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়। জওয়ালগে জানালেন, “এই ছয়মাস ভালো ফল করতে পারলে প্রতিযোগিতার পুরস্কার থেকেই এক লাখ টাকা অবধি রোজগার থাকে। তাতেই খাবারদাবারের খরচের বন্দোবস্ত হয়ে যায়।” কিন্তু কোভিড অতিমারি শুরু হবার পরে কুস্তিগিরদের উপার্জনের এই মূল পথটাই বন্ধ হয়ে গেছে। “সমস্যা হচ্ছে, আমরা ব্যস্ত শুধু ক্রিকেট নিয়ে, বা খুব বেশি হলে হকি। কিন্তু কুস্তি বা খো খো জাতীয় চিরাচরিত খেলার কথা কেউ ভাবে না,” সংযোজন জওয়ালগের।
খো-খো’র জাতীয় দলে নির্বাচিত না হওয়া অবধি ওসমানাবাদ শহরের ২৯ বছর বয়সি সারিকা কালে রিজার্ভেশন ছাড়াই ট্রেনে যাতায়াত করে এবং কমিউনিটি হলে রাত কাটিয়ে আন্তঃরাজ্য ম্যাচ খেলতে যেতে বাধ্য হতেন। “আমরা নিজেদের খাবারদাবার নিজেরাই নিয়ে যেতাম। এমনও দিন গেছে যে টিকিট নেই বলে ট্রেনে বাথরুমের পাশে বসে যেতে হয়েছে,” সারিকা বললেন।
খো-খো খেলার সূত্রপাতও মহারাষ্ট্রে। ভারতের চিরাচরিত খেলার মধ্যে তার জনপ্রিয়তাও আছে। অসমের গুয়াহাটিতে সারিকা ২০১৬ দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে ভারতীয় খো-খো দলকে নেতৃত্ব দেন। ২০১৮ সালে লন্ডনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি ভারতীয় দলের হয়ে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে খেলেন। ২০২০ সালের অগস্ট মাসে ভারত সরকার তাঁকে অর্জুন সম্মানে ভূষিত করেছে। সারিকা জানাচ্ছেন, “গত দশ বছরে ক্রমশ আরও বেশি বেশি মেয়েরা খো-খো খেলা শুরু করেছে।”
![Left: Sarika Kale is a former national kho-kho captain and an Arjuna awardee. Right: A taluka sports officer now, Sarika trains and mentors kho-kho players](/media/images/05a-IMG_20210706_183147-Crop-PMN.max-1400x1120.jpg)
![Left: Sarika Kale is a former national kho-kho captain and an Arjuna awardee. Right: A taluka sports officer now, Sarika trains and mentors kho-kho players](/media/images/05b-IMG_20210706_175726-PMN.max-1400x1120.jpg)
বাঁদিকে: সারিকা কালে ভারতীয় খো-খো দলের প্রাক্তন অধিকানায়ক এবং অর্জুন পুরস্কার প্রাপক ক্রীড়াবিদ। ডানদিকে: তালুকের ক্রীড়া আধিকারিরক হিসাবে সারিকা এখন খো-খো খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেন
ওসমানাবাদের তুলজাপুর তালুকে সারিকা এখন তালুক ক্রীড়া আধিকারিরক হিসাবে কাজ করেন। তরুণ খেলোয়াড়দের পরামর্শ, প্রশিক্ষণ দেন তিনি। কোভিড অতিমারির পরে তিনিও প্রশিক্ষণ নিতে আসা খেলোয়াড়দের সংখ্যা ক্রমাগত কমে যেতে দেখেছেন। তাঁর নিজের কথায়, “এদের বেশিরভাগই খুব গরিব ঘরের মেয়ে, গ্রামে মেয়েদের খেলাধূলায় কোনও উৎসাহ দেওয়া হয় না। অতিমারির ফলে বাবা-মায়েরাও সন্তানদের খেলা থেকে নিরস্ত করার একটা ছুতো পেয়ে গেছেন।”
অতিমারির ফলে প্রশিক্ষণ বাদ পড়লে তা তরুণ খেলোয়াড়দের উন্নতির ক্ষেত্রে গুরুতর বাধা সৃষ্টি করে। সারিকা জানালেন, “২০২০ সালের মার্চের পরে মোটামুটি পাঁচ মাসের জন্য প্রশিক্ষণ পুরোপুরি বন্ধ ছিল। খেলোয়াড়রা যখন ফেরত এল, তখন অনেকের ক্ষেত্রেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে তাদের দক্ষতা কমে গেছে। আবার যখন গোড়া থেকে ট্রেনিং শুরু হল, তখন কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ এল। আরও একবার কয়েক মাসের জন্যে ট্রেনিং বন্ধ রইল। (২০২১ এর) জুলাই মাসে আমরা আবার শুরু করলাম। এইরকমভাবে প্র্যাকটিস বারবার চালু আর বন্ধ হওয়া মোটেই কাম্য নয়।”
যে সব খেলোয়াড়রা বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে খেলেন, প্র্যাকটিসের অভাবে তাঁদের ক্ষতি হয়। “হয়তো একজন অনুর্ধ্ব-১৪ খেলোয়াড় একটাও ম্যাচ না খেলে অনুর্ধ্ব-১৭ স্তরে পৌঁছে গেল,” সারিকা বললেন, “এরা জীবনের বহুমূল্য সময় হারাচ্ছে। খো-খো খেলোয়াড়রা একুশ থেকে পঁচিশ বছর বয়সের মধ্যে নিজেদের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় পৌঁছায়। আর বয়সভিত্তিক স্তরে ফলাফলের ভিত্তিতেই সর্বোচ্চ (জাতীয়) স্তরে খেলোয়াড়দের নির্বাচন করা হয়।”
কোভিডকালীন অনিশ্চয়তার ফলে সম্ভাবনাময় তথা প্রতিভাধর বহু খেলোয়াড়ের জীবনে আঁধার ঘনিয়েছে। গ্রামীণ মহারাষ্ট্রে বিভিন্ন ক্রীড়াব্যক্তিত্বরা যে অগ্রগতি সাধন করেছেন, তা নষ্ট করে দিচ্ছে।
![Promotion of kho-kho in Osmanabad district has brought more players to the sport, but Covid-19 is affecting the progress of recent years](/media/images/06-IMG_20210706_183232-PMN.max-1400x1120.jpg)
ওসমানাবাদ জেলায় খো-খো খেলায় উন্নতি আর নতুন নতুন খেলোয়াড়দের টেনে এনেছে, কিন্তু কোভিড অতিমারি খো-খো’র সাম্প্রতিক প্রগতিকে ব্যহত করছে
প্রায় দুই দশক আগে সারিকা বাবা মায়ের থেকে লুকিয়ে খো-খো খেলা শুরু করেন। “গ্রামগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতাও খুব কম, আর তেমন কোনও পরিষেবাও নেই,” তিনি জানাচ্ছেন। “পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ চায় - আমার জন্য আমার বাবাও তাইই চাইত। আমি যখন বড়ো হচ্ছিলাম, তখন আমাদের পরিবারের জন্য যথেষ্ট খাবারদাবারটুকুর বন্দোবস্তও ছিল না।” সারিকার বাবা কৃষিশ্রমিক আর মা গৃহশ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন।
সারিকার মতে মেয়েদের জন্যে খেলাধূলা করা অপেক্ষাকৃত বেশি কঠিন। “মানসিকতাটাই হচ্ছে সে একজন মেয়ে, অগত্যা বাচ্চার দেখাশোনা করবে আর রান্নাঘর সামলাবে। মেয়ে হাফপ্যান্ট পরে খেলাধূলা করবে, এই ধারণাটাই পরিবার হজম করতে পারে না।” কিন্তু ইস্কুলে প্রথমবার খো-খো খেলা দেখার পর কোনও কিছুই দশ বছর বয়সি সারিকাকে খেলায় নামা থেকে আটকাতে পারেনি। তাঁর কথায়, “আমার মনে আছে যে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। আমি এমন একজন প্রশিক্ষককে খুঁজে পেয়েছিলাম যিনি আমার প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।”
সারিকার প্রশিক্ষক চন্দ্রজিৎ যাদব ভারতীয় খো-খো ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক। তাঁর বাড়ি ওসমানাবাদ শহরেই, এবং ওসমানাবাদে খো-খো খেলার উন্নতিকল্পে তাঁর অবদান প্রচুর। তাঁর সহায়তায় ওসমানাবাদ খো-খো খেলার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। শহরের সীমানার মধ্যে এখন দুটি খো-খো প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। জেলাজুড়ে প্রায় একশোটা ইস্কুলে খো-খো খেলা হয়। যাদব জানাচ্ছেন, “গত দুই দশকে, বিভিন্ন বয়স গ্রুপ মিলিয়ে, ওসমানাবাদের দশজন খেলোয়াড় জাতীয় স্তরে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েছে। চারজন মেয়ে রাজ্য সরকারের শিব ছত্রপতি পুরস্কার জিতেছে, আমি ক্রীড়া প্রশিক্ষক হিসাবে জিতেছি। আমাদের মধ্যে একজন অর্জুন পুরস্কারপ্রাপকও আছে।”
ক্রিকেট বা হকি ছাড়া অন্য খেলাকে গ্রামের লোকজন যে নজরে দেখেন, সারিকা তাতে একটা লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন খেয়াল করেছেন। তিনি বললেন, “আগের তুলনায় কম লোক এখন এই খেলাকে সময় নষ্ট করার সামিল হিসাবে দেখে।”
![Left: Ravi Wasave (in grey t-shirt) from Nandurbar wants to excel in kho-kho. Right: More girls have started playing the sport in the last decade](/media/images/07a-IMG_20210706_182523-Crop-PMN.max-1400x1120.jpg)
![Left: Ravi Wasave (in grey t-shirt) from Nandurbar wants to excel in kho-kho. Right: More girls have started playing the sport in the last decade](/media/images/07b-IMG_20210706_183406-PMN.max-1400x1120.jpg)
বাঁদিকে: নন্দুরবারের রবি ওয়াসাভে (ধূসর টি-শার্ট পরিহিত) খো-খো খেলায় মস্ত উন্নতি করতে চায়। ডানদিকে: গত দশকে আরও বেশি বেশি করে মেয়েরা খো-খো খেলা শুরু করেছে
খো-খো খেলায় প্রশিক্ষণ নেবেন বলে উনিশ জন তরুণ তরুণী আদিবাসী অধ্যুষিত জেলা নন্দুরবার থেকে ছশো কিলোমিটার দূরে ওসমানাবাদে এসে থাকছেন - এই একটা ঘটনা থেকেই পরিস্থিতির প্রগতি বিষয়ে ধারণা করা যায়। এই উনিশ জনের মধ্যেই একজন ভিল আদিবাসী সম্প্রদায়ের রবি ওয়াসাভে। তাঁর মতে, “বাড়ির পরিবেশ খেলাধূলার জন্যে ভালো নয়। ওসমানাবাদ থেকে বেশ কিছু খো-খো চ্যাম্পিয়ন বেরিয়েছে। আমি তাদেরই একজন হতে চাই।”
অতিমারি না হলে যে রবি ২০২০ সালে জাতীয় স্তরে খেলতে পারতেন, তা নিয়ে সারিকার একফোঁটা সন্দেহ নেই। রবির কথায়, “নিজেকে প্রমাণ করার জন্য আমার হাতে বেশি সময় নেই। আমার বাবা মায়ের পাঁচ একর চাষের জমি আছে, কিন্তু তা একেবারেই ঊষর। তাঁরা দিনমজুর হিসাবে খেটে উপার্জন করেন। আমাকে নিজের এই পছন্দের বিষয় অনুসরণ করতে দিয়ে তাঁরা বড় ঝুঁকি নিয়েছেন।”
রবি ওসমানাবাদের ডায়েট কলেজ ক্লাবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তিনি জানালেন যে, বাবা-মা তাঁর ভালো চান বটে, কিন্তু পরিস্থিতি এরকমই চলতে থাকলে তার সুরাহায় কোনও ব্যবস্থা হবে কিনা তা নিয়ে তাঁরা চিন্তায় আছেন। রবির কথায়, “ওঁনারা মনে করেন যে আমি যদি প্রতিযোগিতায় অংশ না নিতে পারি, তাহলে এত দূরে থাকা অর্থহীন। আমার প্রশিক্ষকরা আপাতত ওঁনাদের আশ্বস্ত করেছেন। তবে এটা জানি যে যদি শিগগির প্রতিযোগিতা শুরু না হয়, তাহলে ওঁনারা দুশ্চিন্তায় পড়বেন। আমি ভালো খো খো খেলতে চাই, এমপিএসসি [রাজ্য সিভিল সার্ভিস] পরীক্ষায় বসতে চাই আর খেলোয়াড়দের জন্য সংরক্ষিত কোটায় একটা চাকরি পেতে চাই।”
সারিকার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চাইছেন রবি, ইতিমধ্যেই সারিকা সারা মহারাষ্ট্রে তরুণ খো খো খেলোয়াড়দের আদর্শে পরিণত হয়েছেন। তিনি যে গোটা একটা প্রজন্মের খো-খো খেলোয়াড়দের কাছে প্রেরণার উৎস, তা ভালো করে সারিকা জানলেও, খো-খো খেলার উপর অতিমারির প্রভাব নিয়ে তিনি ভীষণ চিন্তিত। তাঁর বক্তব্য, “অতিমারি কবে শেষ হবে, সেই অবধি অপেক্ষা করার সময় সুযোগ বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের কাছেই নেই। তাই আমি নিজে প্রতিভাবান তথা দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করছি যাতে তাদের অন্তত খেলার সঙ্গে যুক্ত থাকতে খানিক সুরাহা হয়।”
প্রতিবেদক এই নিবন্ধটি পুলিৎজার সেন্টারের স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা অনুদানের সহায়তায় রচিত একটি সিরিজের অংশ হিসেবে লিখেছেন।
অনুবাদ: শাশ্বত গাঙ্গুলী