“এ এক নরক
এ এক পাকচক্র
এ এক দুরূহ বেদনা
নর্তকীর ঘুঙুর বাঁধা পায়ের যন্ত্রণা...”
- নামদেও ধাসালের ‘কামাঠিপুরা’ কবিতার অংশবিশেষ
সদা ব্যস্ত রাস্তাটা বহু বছরে এই প্রথম একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সেখানকার বাসিন্দা মহিলারা কাজ না করে বেশিদিন তো থাকতে পারেন না। বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ে আছে, লকডাউনের কারণে বাচ্চারা হস্টেল থেকে বাড়ি ফিরে এসেছে, ফলে খরচও বেড়ে গেছে।
চারমাস পর, জুলাইয়ের মাঝামাঝি ২১ বছর বয়সী সোনি মধ্য মুম্বইয়ের কামাঠিপুরা অঞ্চলে, ফকল্যাণ্ড রোডের ফুটপাথে এসে আবার দাঁড়াতে শুরু করলেন প্রতি সন্ধ্যায়। নিজের পাঁচ বছর বয়সী কন্যা এশাকে বাড়িওয়ালির কাছে রেখে তিনি কাছের কোনো ছোট হোটেলে বা বন্ধুর ঘরে খদ্দের বসাতেন। তিনি এশার কারণেই তাদের আর নিজের ঘরে নিয়ে আসতে পারতেন না। (এই প্রতিবেদনে প্রত্যেকের নামই পরিবর্তিত।)
৪ঠা অগাস্ট রাত ১১টা নাগাদ, নিজের কাজ থেকে খানিকক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে নিজের ঘরে ফিরে তিনি দেখলেন এশা কাঁদছে। “ওর ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ার কথা, তাই আমি ওকে একবার দেখে যেতে এসেছিলাম,” বললেন সোনি। “কিন্তু (সেদিন রাতে) ও নিজের শরীর দেখিয়ে কেবলই বলতে লাগলো ব্যথা করছে। আমার খানিক সময় লেগেছিল পুরো বিষয়টা বুঝে উঠতে...”
সেদিন যখন সোনি কাজ করছিলেন তখন এশাকে ধর্ষণ করা হয়। অপর একজন যৌনকর্মী ওকে টুকিটাকি খাবারের লোভ দেখিয়ে ফুসলে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। ওর সঙ্গী সেখানে অপেক্ষায় ছিলো। “লোকটি নেশা করে ছিল, এশাকে ছেড়ে দেবার আগে শাসিয়ে দেয় যাতে ও কাউকে কিছু না জানায়,” বললেন সোনি। “ও বাড়িওয়ালিকে নিজের দিদিমার মতো দেখে, তাঁকেই বলে যে ওর খুব ব্যথা করছে। আমারই বোকামি যে ভেবেছিলাম আমাদের মতো মানুষেরও বিশ্বাস করার মতো কেউ থাকতে পারে। কী হত যদি ভয়ে আমার মেয়ে আমাকে কিছুই না বলতো? এশা ওদের চেনে আর বিশ্বাস করে বলেই ওদের ঘরে গিয়েছিল, নইলে ও ভালোকরেই জানে যে আমি না থাকলে এই অঞ্চলে ওর কারও সঙ্গেই কথা বলার অনুমতি নেই।
সোনির কথানুসারে, বাচ্চাটিকে ফুসলে নিয়ে যাওয়ার পুরো পরিকল্পনার কথাটা জানা ছিলো ওই অঞ্চলেরই ডলি নামের আর এক যৌনকর্মীর আর এখন সে সমঝোতা করে নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করছে। তিনি আরও বললেন, “এখানে মেয়েদের সঙ্গে কী হয় সবারই জানা আছে। তবুও সবাই না জানার ভান করে, আর অনেকে আসে আমদের মুখ বন্ধ করতে। কিন্তু আমি চুপ থাকবো না মোটেই।”
ওই দিনই, ৪ঠা অগস্ট সোনি নাগপাড়া পুলিশস্টেশনে অভিযোগ দায়ের করেন। পরের দিনই একটি এফ আই আর প্রস্তুত করা হয় যৌন অপরাধ থেকে শিশুদের রক্ষা করার আইন পকসো (প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট, POCSO) ২০১২ অনুসারে। এই আইন মোতাবেক পুলিশ, রাজ্য শিশুকল্যাণ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে কারণ তাদেরই আইনি সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়া, এবং শিশুটিকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা। এশাকে নিয়ে যাওয়া হয় সরকারি জে জে হাসপাতালে শরীরিক পরীক্ষার জন্য। ১৮ অগস্ট ওকে মধ্য মুম্বইয়ের রাজ্য সরকার পরিচালিত শিশু-আশ্রয় প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হয়।
****
এমন ঘটনা সাধারণভাবে ঘটেই থাকে। কলকাতার একটি যৌনপল্লিতে ২০১০ সালে করা একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে যে সেখানে যে ১০১টি পরিবারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে ৬৯টি পরিবার মনে করে যে তাঁদের সন্তানদের, বিশেষত কন্যা সন্তানদের বেড়ে ওঠার পক্ষে সেখানকার পরিবেশ মোটেই নিরাপদ নয়। “...মায়েদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেছে যে কোনও খদ্দের তাঁদের মেয়েদের গায়ে হাত দিলে, ওদের হেনস্থা করলে বা মৌখিকভাবেও জ্বালাতন করলে ওঁরা খুব অসহায় বোধ করেন,” জানাচ্ছে সমীক্ষাটি। সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে এমন শিশু জানিয়েছে যে ওরা ওদের বন্ধু, ভাই-বোন, অথবা অন্য বাচ্চাদের কাছে নিজেদের অঞ্চলে ঘটা যৌন নিপীড়নের কথা শুনেছে।
“কেউ না কেউ আমাদের মেয়েদের সঙ্গে কিছু একটা করেছে, কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেছে অথবা ওদের পর্নোগ্রাফি দেখতে বাধ্য করেছে – এসব শোনাটা আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। কেবল মেয়েরা না এখানে ছেলেদেরও হেনস্থা হতে হয় কিন্তু কেউ মুখ খোলে না,” আমাদের কথাবার্তার সময়ে এসে বসা এক যৌনকর্মী বললেন কামাঠিপুরায়।
২০১৮ সালের একটি পর্যালোচনামূলক গবেষণাপত্র জানাচ্ছে যে, যৌনকর্মীদের সন্তান, বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন কমবয়সী মেয়ে, কিশোর ছেলে, স্কুলছুট ও শ্রমজীবী বালিকাসহ সমাজের বিশেষ বিশেষ অংশের উপরে শৈশবকালীন যৌন হেনস্থার (চাইল্ড সেক্সুয়াল অয়াবুউজ, সিএসএ) ঘটনা বাড়ছে।”
লকডাউন বোধহয় ওদের বিপদ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ২০২০ সালের জুন মাসের ইউনিসেফ রিপোর্ট , স্ট্রাটেজি ফর এন্ডিং ভায়োলেন্স আগেন্সট চিল্ড্রেন অনুসারে, এপ্রিলের মাসে লকডাউনের দুই সপ্তাহে নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক দ্বারা পরিচালিত জরুরি পরিষেবা, চাইল্ডলাইনে নানান দুর্দশায় পড়া শিশুদের কাছ থেকে আসা ফোনের সংখ্যা ৫০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। ওই একই রিপোর্ট পৃথকভাবে জানাচ্ছে যে “শিশুদের উপর ঘটা যৌন নির্যাতনে নির্যাতনকারী ৯৪.৬ ক্ষেত্রে শিশুটির কোনোভাবে পূর্বপরিচিত; ৫৩.৭ শতাংশ ক্ষেত্রে তারা পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্য অথবা আত্মীয়/বন্ধু।”
লকডাউনের সময়ে শহরের অন্য হস্টেলগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে শিশুরা যখন বাড়ি ফিরে আসে তখন কামাঠিপুরায় যেসব এনজিও যৌনকর্মীদের কাজের সময়ে তাঁদের সন্তানদের রাতে বা দিনে আশ্রয় দেয় তারা এদের সারাদিন সেখানে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। এমনই একটি আশ্রয়কেন্দ্রে এশাও ছিলো কিন্তু যেহেতু সোনি তখন কাজ করছিলেন না সেহেতু তিনি জুন মাসের শুরুতে মেয়েকে নিজের ঘরে এনে রেখেছিলেন। জুলাই মাসে সোনি যখন আবার কাজ করতে শুরু করেন তিনি তখন এশাকে আবার সেই আশ্রয়কেন্দ্রে দিয়ে আসার চেষ্টা করেন। “করোনার ভয়ে তখন তারা আর এশাকে ফিরিয়ে নিতে চায়নি,” তিনি বললেন।
লকডাউনের সময়ে স্থানীয় অসরকারি সংগঠনগুলির কাছ থেকে কিছু খাদ্যসামগ্রী এসেছিলো কিন্তু রান্নার জন্য কেরোসিনের দরকার ছিল। যতদিনে সোনি আবার কাজ শুরু করবেন বলে স্থির করে উঠলেন, ততদিনে ওঁর দু’মাসের বাড়ি ভাড়া বাবদ বাকি পড়েছিলো ৭,০০০ টাকা। (যৌন নির্যাতনের ঘটনার পর সোনি কাছেই আর একটি গলিতে অন্য ঘর ভাড়া নেন ১০ই অগস্ট থেকে। নতুন বাড়ির ভাড়া দিনে ২৫০ টাকা হলেও বাড়ির মালকিন এখনই তা দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন না।)
এত বছরে বাড়িওয়ালি সহ এলাকার আর সবার কাছে সোনির মোট ধার জমেছে ৫০,০০০ টাকা যা তিনি কিছু কিছু করে শোধ করছেন। এই ধারের খানিকটা তাঁকে নিতে হয়েছে নিজের বাবার চিকিৎসার জন্য; তাঁর বাবা রিকশা চালাতেন কিন্তু নিঃশ্বাসের কষ্টের কারণে ফল বিক্রি করতে শুরু করেন এবং ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারা যান। “আমাকে কাজ শুরু করতে হল নইলে এই টাকা কে শুধবে?” তাঁর প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায় নিজের বাড়িতে সোনি গৃহকর্ত্রী মা এবং তিন বোনকে (দুজন পড়াশুনা করছেন আর একজনের বিয়ে হয়ে গেছে) টাকা পাঠান। কিন্তু লকডাউনের পর থেকে সেটাও বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
*****
কামাঠিপুরায় অন্যান্য যৌনকর্মীরাও একই লড়াই করে চলেছেন। সোনি যে গলিতে থাকেন সেই একই গলির বাসিন্দা ত্রিশের কোঠার শেষে বয়স প্রিয়া আশা করে বসে আছেন কবে কাছেই মদনপুরার স্কুলের হস্টেল খুলবে আর তাঁদের সন্তানরা সেখানে ফিরে যেতে পারবে। লকডাউনের শুরুতে হস্টেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর নয় বছর বয়সী শিশুকন্যা বাড়ি ফিরে আসে।
যা করার এখানেই কর, ঘরের বাইরে এক পাও যাবি না,” প্রিয়ার কঠোর নির্দেশ মেয়ের প্রতি। ঋদ্ধির উপর এই বিধিনিষেধ কোভিডের ভয়ে নয়। “আমরা এমন এক জায়গায় থাকি যেখানে এই লোকগুলো আমাদের মেয়েগুলোকে খেয়ে ফেললেও কেউ কিচ্ছু বলবে না,” বললেন, প্রিয়া যিনি নিজের নিয়মিত খদ্দেরদের কাছ থেকে সামান্য ধার নিয়ে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছেন।
লকডাউন এবং তার পরবর্তী দুর্দশার ছাপ এই পরিবারগুলির উপর এসে পড়েছে। “আমার অবস্থা খুব খারাপ, বাড়ি ভাড়া দিতে পারছি না, অগত্যা আমাকে কাজ শুরু করতেই হয়েছে। আমার কাজের সময়ে ঋদ্ধিকে তো কাছে রাখা যায় না। হস্টেলে অন্তত নিরাপদে থাকে,” মহারাষ্ট্রের অমরাবতী জেলার মানুষ প্রিয়া বলছিলেন, তিনি বিগত এক দশক যাবৎ কামাঠিপুরায় আছেন।
প্রিয়ার ১৫ বছর বয়সী ছেলে বিক্রমও তাঁর সঙ্গেই আছে। লকডাউনের আগে সে বাইকুল্লার পৌরসভা পরিচালিত একটি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। ওর মা যখন খদ্দেরদের সঙ্গে থাকেন তখন ও পাশের একটা ঘরে ঘুমোয়, বা চারদিকে ঘুরে বেড়ায় অথবা স্থানীয় এনজিও দ্বারা পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্রে সময় কাটায়।
এখানকার মহিলারা জানেন যে তাঁদের ছেলেদের উপরেও যৌন নির্যাতন হতে পারে, তারা ড্রাগের খপ্পরে বা অন্য বিপদে পড়তে পারে, আর সেজন্য ওদেরও তাঁরা অনেক সময়ে হস্টেলে ভর্তি করে দেন। প্রিয়া বছর দুয়েক আগে চেষ্টা করেছিলেন বিক্রমকে হস্টেলে দেওয়ার, কিন্তু ও পালিয়ে এখানে চলে আসে। এই বছর এপ্রিল থেকে পরিবারকে সাহায্য করার চেষ্টায় ও মাস্ক, চা ইত্যাদি বিক্রি করা বা বাড়িওয়ালির ঘর পরিষ্কার করার মতো টুকিটাকি কাজ করতে শুরু করে। (পড়ুন: দীর্ঘ যাত্রাপথে, বার বার )
চার বাই ছয়ের আয়তাকার খুপরিতে বিভক্ত নিজেদের দশ বাই দশ ফুটের ঘরগুলির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বললেন, “ওদের উচিত এই ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলার সময়ে আমাদের ঘরগুলি এসে দেখে যাওয়া।” প্রতিটি কুঠুরিতে পুরো জায়গা দখল করে রয়েছে একটা করে খাট আর আছে দুটি করে তাক। এরই একটি কুঠুরিতে মাথা গুঁজে থাকেন প্রিয়া আর অন্যটিতে থাকে আর একটি পরিবার। মাঝের ঘরটি ফাঁকা থাকলে ওঁরা সেটি ব্যবহার করেন খদ্দের বসাতে আর না হলে নিজেদের ঘরেই খদ্দেরকে আনতে হয়। সবার জন্য একটা বারোয়ারি কোণা আছে স্নান আর রান্নার জন্য। এখানকার সমস্ত কাজ আর থাকার জায়গা একই রকম, কোনো কোনোটা এর চেয়েও ছোটো।
সদ্য নেওয়া একটা ঋণের টাকা থেকে সামান্য খানিকটা শোধ দেওয়া ছাড়া আজ ছয় মাস হল প্রিয় তাঁর ছোট্ট খুপড়িটির জন্য বারাদ্দ মাসিক ৬,০০০ টাকা ভাড়া দিয়ে উঠতে পারছেন না। “প্রতি মাসে আমার ৫০০ থেকে ১,০০০ টাকা ধার নিতে হয়েছে কিছু না কিছুর জন্য। ফলে বিক্রমের আয় এখন কাজে লাগছে,” তিনি বললেন। “কখনও আমরা [স্থানীয় দোকানে] খাদ্য সামগ্রী (এনজিও বা অন্য কারও কাছ থেকে পাওয়া) খানিক বিক্রি করে দিই কেরোসিন কেনার জন্য।”
২০১৮ সালে প্রিয়া ৪০,০০০ টাকা ধার করেছিলেন যা এখন সুদে আসলে বেড়ে হয়েছে ৬২,০০০ টাকা। আর এখন অবধি তিনি শোধ দিয়ে উঠতে পেরেছেন কেবল ৬,০০০ টাকা। প্রিয়ার মতো অনেকেরই নিদারুণ নির্ভরতা এলাকার মহাজনদের উপর।
পেটে একটা যন্ত্রণাদায়ক সংক্রমণের কারণে প্রিয়া বেশি কাজ করতে পারেন না। “আমি এতবার গর্ভপাত করিয়েছি যে তার মাসুল এখন গুনতে হচ্ছে,” তিনি বললেন। “আমি হাসপাতালে গেছিলাম কিন্তু ওরা এখন করোনা নিয়ে ব্যস্ত আর অপারেশনের (হিস্টেরেক্টমি) জন্য চাইছে ২০,০০০ টাকা যা আমি মোটেই দিতে পারব না।” লকডাউনের কারণে তাঁর যৎসামান্য সঞ্চয়ও খরচ হয়ে গেছে। অগস্ট মাসে তিনি পাড়ার একটা বাড়িতে ৫০ টাকা দৈনিক মজুরিতে গৃহশ্রমিকের কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু সেই কাজ ছিল মাত্র একমাস।
প্রিয়া এখন ভরসা করে আছেন হস্টেল আবার খোলার উপর। “আমি চাই না ভাগ্যের চাপে ঋদ্ধির কোনও বড়ো ক্ষতি হয়ে যাক,” তিনি বললেন।
ঠিক যখন লকডাউনের কারণে তাঁর ও সোনির মেয়ে হস্টেল থেকে মায়েদের কাছে ফিরে আসে তখনই ওই অঞ্চলে কাজ করা প্রেরণা নামের একটি এনজিও একটি ‘ দ্রুত সমীক্ষা ’ করে জানতে পারে যে যৌনকর্মীদের ৭৪ জন সন্তানের মধ্যে (৩০টি পরিবারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল) ৫৪ জন লকডাউনের সময়ে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছে। তাছাড়া ভাড়া ঘরে থাকা ১৮টি পরিবারের মধ্যে ১৪টি এই সময়ে ভাড়া দিতে পারছে না এবং ১১টি পরিবার অতিমারির সময়ে আরও বাড়তি ঋণ নিয়েছে।
চারুর তিন বছরের মেয়ে শীলাকেও অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে কামাঠিপুরার একটি এনজিও পরিচালিত আশ্রয় গৃহ থেকে মে মাসে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। “ওর অ্যালার্জি’র কারণে সারা গায়ে গুটি বেরোয়। ওকে ন্যাড়া করে দিতে হয়েছিল,” চার সন্তানের মা ৩১ বছর বয়সী চারু বললেন; তাঁর একটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছেন বদলাপুরের কেউ আর তিন ছেলে বিহারের কাটিহারে আত্মীয়দের সঙ্গে থেকে দিনমজুরি করে। প্রতিমাসে তিনি ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ টাকা ওদের জন্য পাঠাতেন কিন্তু লকডাউনের সময়ে তাঁর আরও ধার করতে হয়েছে। “আর ধার করতে পারব না, এই ধারই বা কেমন করে শুধবো আমি জানি না,” বললেন তিনি।
ফলে চারুকেও বাড়িওয়ালির কাছে শীলাকে রেখে অগস্ট থেকে কাজে যেতে হচ্ছে। “আমার কাছে আর কোনও পথ আছে?” তাঁর প্রশ্ন।
কাজ করে তাঁরা খুব বেশি রোজগার করতে যে পারছেন এমন নয়। “সপ্তাহে আমি মাত্র এক কি দুজন খদ্দের পেয়েছি,” সোনি জানালেন। খুব কম ক্ষেত্রেই সংখ্যাটা চার কিম্বা পাঁচ হয়। আগে এই মহিলারা দিনে ৪০০ থেকে ১,০০০ টাকা আয় করতেন — তাঁদের ছুটি থাকে একমাত্র মাসিক ঋতুস্রাবের সময়ে, বা খুব অসুস্থ হলে অথবা বাচ্চারা বাড়ি ফিরলে। “এখন দিনে ২০০-৫০০ টাকা হলেই মনে হয় বিরাট ব্যাপার,” বললেন সোনি।
*****
“আমরা অতি প্রান্তিক পরিবারগুলির কথা বলছি, যারা নিজেদের সমস্যার কথা বললেও কোনো গুরুত্ব পাবে না,” মজলিস লিগ্যাল সেন্টারের আইনজীবী, ও যৌন নির্যাতনের শিকার মানুষদের আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য ওই কেন্দ্রের রাহত প্রকল্পের পরিচালক, জসিন্তা সলদানহা জানালেন। তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা এখন এশার মামলাটি দেখছেন। “সোনি, বিষয়টি প্রকাশ্যে এনে সত্যিই খুব সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। অনেকেই এক্ষেত্রে হয়তো কিছুই বলতেন না। অন্নের সংস্থান করার বিষয়টি খুবই জরুরি হয়ে ওঠে। আরও নানা বিষয় এই বড়ো বিষয়গুলিকে এক সুতোয় গেঁথে রাখে।”
তিনি আরও বললেন যে এনজিও, আইনজীবী, স্থানীয় পৌর প্রতিনিধি - সবাই মিলে যৌনকর্মীদের অধিকারের বিষয়টি নিয়ে কাজ করা দরকার। “ওঁদের বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধগুলি ওঁদের এমন সন্ত্রস্ত করে রাখে যে ঠিক ভুলের ফারাক করতে ওঁরা ভুলে যান। যৌনকর্মী বা তাঁদের সন্তানদের কিছু হলে এইসব ক্ষেত্রে সাধারণ মনোভাবটাই হল এ আর এমন কী কথা? যদি বাচ্চাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ ঘটে, সেক্ষেত্রে সবাই ওদের মায়েদের দোষ দেয়।”
ইতিমধ্যে পকসো আইনের অধীনে এশার ক্ষেত্রে যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল, তাতে মূল অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে ৫ই জুলাই থেকে লকআপে রাখা হলেও তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট গঠিত হয়নি এখনো এবং মামলায় অপর অভিযুক্তদের (ওর সঙ্গীনী, ও প্রাক্তন এক যৌনকর্মী - অপরাধে সহায়তা করার জন্য) গ্রেপ্তার করাও হয়নি। পকসো অনুসারে মূল অভিযুক্তর ‘অন্ততঃ দশ বছর কারাদণ্ড যা বেড়ে যাবজ্জীবন অবধি হতে পারে’ বাধ্যতামূলক এবং এই আইনে অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড অবধি দেওয়া যেতে পারে ও ক্ষতিগ্রস্তের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য এমন জরিমানা অপরাধীর উপর আরোপ করার অনুমতি দেয় যা ‘ন্যায্য ও যথাযথ’। এই আইন অনুসারে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত ও তার পরিবারকে ৩ লক্ষ টাকা অবধি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা।
“আইনী ব্যবস্থা সহ পুরো কাঠামোটির উপর যথেষ্ট ভরসা না থাকাই” অপরাধের শিকার শিশুদের পরিবারগুলির (যারা পকসো আইনের অধীনে অভিযোগ দায়ের করেছেন) কাছে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা বলে জানাচ্ছে বেঙ্গালুরু জাতীয় আইন বিদ্যালয়ের শিশু ও আইন সংক্রান্ত ২০১৮ ফেব্রুয়ারির রিপোর্ট । “বিলম্ব ঘটিয়ে, মামলা স্থগিত রেখে, আর বারবার আদালতে টেনে এনে” এই ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত শিশুটিকে বারবার হেনস্থা করে।
সলদানহা এই বিষয়ে একমত হয়ে বলেন, “শিশুর বক্তব্য চারবার রেকর্ড করা হয়, প্রথমে পুলিশের কাছে, তারপর চিকিৎসকের কাছে পরীক্ষার সময়ে, আর দুবার আদালতে (একবার ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আরেকবার বিচারকের সামনে)। এক এক সময়ে শিশুরা সন্ত্রস্ত হয়ে সব অভিযুক্তর নাম বার বার মনে করে বলতেও পারে না, যেমন পারেনি এশা। মাত্র কিছুদিন আগে সে এ বিষয়ে বাড়িওয়ালির জড়িত থাকার কথাটি জানাতে পেরেছে (তিনি ঘটনাটিতে বাধা দেননি বা জানামাত্র অভিযোগ দায়ের করেননি)।
তাছাড়া, অভিযোগ দায়ের করা থেকে মামলার ফল প্রকাশ হওয়া অবধি কেটে যায় এক দীর্ঘ সময়। ২০১৯ সালের জুন অবধি, আইন মন্ত্রকের হিসাব মতো পকসো আইনের অধীনে জমা পড়ে থাকা মামলার সংখ্যা ১৬০,৯৮৯টি, এরমধ্যে (উত্তরপ্রদেশের পরই) জমা পড়ে থাকা ১৯,৯৬৮টি মামলা নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে মহারাষ্ট্র।
“মামলার সংখ্যা এমনিতেই এতো বেশি আর তার উপর রোজ নতুন নতুন মামলা যোগ হতে থাকে,” বললেন সলদানহা। “আমরা সবাই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ঘটাতে চাই এবং এর জন্য দরকার বেশি সংখ্যায় বিচারপতিদের নিয়োগ বা হয়তো প্রয়োজনে বাড়তি সময় কাজ করা।” একেই লকডাউনের কারণে মাঝে আদালতের শুনানি স্থগিত ছিল, তারউপর মার্চ ২০২০ সালের আগের জমা মামলা আর তার সঙ্গে গত ছয়মাসে দায়ের হওয়া মামলা আদালত কীভাবে সামাল দেবে - এসবই ভাবছেন তিনি এখন।
*****
সোনির যখন বয়স সবে ১৬ তখন তাঁর বন্ধু তাঁকে কলকাতায় বিক্রি করে দেয়। তাঁর বিয়ে হয় ১৩ বছর বয়সে। “আমার স্বামীর (একটি জামাকাপড়ের কারখানায় তিনি মাঝেসাঝে সহায়ক হিসাবে কাজ করতেন) সঙ্গে আমার কেবলই ঝগড়া হত আর আমি আমার মা বাবার কাছে পালিয়ে যেতাম। এরকমই একদিন যখন আমি স্টেশনে বসেছিলাম, আমার বন্ধু এসে বলল যে সে আমাকে একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবে।” এক ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে বিক্রির বন্দোবস্ত করে বন্ধুটি সোনিকে শহরের এক যৌনপল্লিতে এনে ফেলে। বছরখানেকের মেয়ে এশা তখন সোনির সঙ্গে ছিল।
চার বছর আগে সোনি শেষ অবধি মুম্বইয়ের কামাঠিপুরায় এসে পৌঁছান। তাঁর কথায়, “আমার ইচ্ছা করে বাড়ি ফিরে যেতে, কিন্তু আমি তো না এখানকার না ওখানকার। এখানে [কামাঠিপুরায়] আমি ধার নিয়ে বসে আছি, এই দেনা আমাকে শোধ করতে হবে আর তাছাড়া আমার দেশে সবাই জানে আমি কী কাজ করি, সেজন্যই তো আমাকে এখানে চলে আসতে হয়েছে।”
এশাকে যে শিশু-সুরক্ষা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে সেখানে (কোভিড সংক্রান্ত বিধিনিষেধের জন্য) সোনি দেখা করতে যেতে পারছেন না বলে তার সঙ্গে ভিডিওকলেই কথা বলেন। “আমার যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমি তো নষ্ট মেয়েমানুষ হয়েই গেছি, কিন্তু আমার মেয়েটাকে তো ওরা সর্বনাশ থেকে রেহাই দিতে পারে,” তিনি বললেন। “আমি যে জীবন কাটিয়েছি সেই জীবন ও কাটাক তা আমি চাই না। আমি লড়াই চালাচ্ছি যাতে আমার মতো ওর একথা কখনও এমন না মনে হয় যে আমার পাশে কেউ দাঁড়ায়নি।”
নির্যাতনকারী গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর সঙ্গিনীটি (যে বাচ্চাটিকে ফুসলে নিয়ে গিয়েছিল) সোনিকে হয়রান করা শুরু করেছে। “ও আমার ঘরে ঢুকে ঝগড়া লাগানোর তাল করে, ওর মরদকে জেলে পাঠাবার জন্য আমাকে শাপশাপান্ত করে। কেউ বলছে আমি ওর উপর শোধ তুলছি, কেউবা বলছে আমি মাতাল এবং মা হয়ে মেয়ের যত্ন নিই না। এরা যে আমাকে অন্তত মা বলে স্বীকার করছে এটাই আমার সৌভাগ্য!”
কভারচিত্র: মেয়ে শীলার সঙ্গে চারু (আলোকচিত্র: আকাঙ্ক্ষা)
বাংলা অনুবাদ : চিলকা