আইনুল যখন সকাল সকাল কাশী বিশ্বনাথ এক্সপ্রেসে অমরোহা থেকে দিল্লি আসার জন্য উঠে বসেন, তখন তাঁর মনে নানান আশঙ্কা দানা বাঁধছিল। “আমি ভয় পেয়েছিলাম, ভাবছিলাম বম্বই তো চললাম। এত দূরে একটা শহরে যাচ্ছি, না জানি ওখানকার লোকজন আমার সাথে কেমন আচরণ করবে? আমি কেমন করেই বা জীবন চালাব?” এইসব সাতপাঁচ চিন্তায় ১৭ বছরের আইনুল সারারাত ট্রেনের সাধারণ মহিলা কামরায় শুয়ে দুই চোখের পাতা এক করতে পারেননি।

তাঁর শ্বশুরমশাই আলীমও একই ট্রেনে যাত্রা করছিলেন। দিল্লি থেকে আরেকটি ট্রেন বদল করার পর তাঁরা অবশেষে মুম্বইয়ের বান্দ্রা টার্মিনাসে এসে পৌঁছন। এরপর তিনি আইনুলকে মাহিমের নয়ি বস্তির কলোনিতে তাঁর নতুন বাসায় নিয়ে আসেন এবং তারপর আলী মাহিমী দরগার বাইরে তাঁর ভিক্ষুকের কাজে ফিরে যান।

তিন বছর পর আইনুল শেখ নিজেও এই ভিক্ষাজীবীর কাজটি কিছুদিনের জন্য করেন। এই কাজ করেই তিনি বেশ কয়েক সপ্তাহ কেন্দ্রীয় মুম্বইয়ের কস্তুরবা হাসপাতালে ভর্তি থাকা তাঁর ১৮ মাসের অসুস্থ শিশুপুত্রের চিকিৎসার খরচ বহন করেছেন – ছেলের ঠিক কি হয়েছিল, তা আইনুল জানেন না। “কেউ আমাকে ঋণ দিতে রাজি হয় নি [চিকিৎসার ব্যয়ভার বাবদ], কারণ কেই বা তা পরিশোধ করবে?” তাঁর প্রশ্ন।

মুম্বইয়ে আসার পথে ট্রেনে তাঁর আশঙ্কাগুলি মোটেই অমূলক ছিল না।

সেই দিন ট্রেনে, আইনুলের সঙ্গে সম্বল বলতে ছিল একটা কাপড়ের ব্যাগে কিছু জামাকাপড় মাত্র। যেসব বাসনপত্র তিনি কিনেছিলেন বিয়ের পর তাঁর বরের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য, এক এক করে সেসব বিক্রি হয়ে গেছে। কিশোর বয়স থেকেই তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন, অন্য মানুষের ব্যবহার করা বাসনপত্র মেজেছেন, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করেছেন, খেতে কাজ করেছেন। “এইসব কাজ করে বিনিময়ে কিছু খাবার পেতাম, অথবা কয়েক টাকা। সেই টাকা আমি বাক্সে জমিয়ে রাখতাম, এবং এই করে করে আমি আমার বিয়ের জন্য অর্থ সঞ্চয় করি। বিয়ের জন্য ৫০০০ টাকা জমানো দরকার ছিল। অল্প অল্প টাকা নিয়ে গিয়ে আমি স্থানীয় দোকান থেকে এক এক করে পেতলের বাটি, থালা, হাতা এমনকি তামার একটা ডেকচিও কিনেছিলাম।”

A woman and her son and daughter
PHOTO • Sharmila Joshi

ছোট ছেলে জুনেইদ ও কন্যা মাহজবীনের সঙ্গে আইনুল শেখ ; তাঁর বড় ছেলে মহম্মদ ছবি তুলতে রাজি হয়নি

বিবাহের পর যখন তিনি আমরোহার একই পাড়ায় তাঁর স্বামী জমিলের বাড়িতে এসে উঠলেন, তখন জমিল তাঁর মদের নেশার চক্করে এক এক করে সব বিক্রি করে দেন। বান্দ্রা টার্মিনাসে এসে পৌঁছানোর পর দশ বছরেরও বেশি সময় পর্যন্ত যতক্ষণ না রক্তারক্তি হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি স্বামীর মারধোর সহ্য করেছেন। মুম্বইয়ে আসার পর এই অত্যাচার  শুরু হয়, সঠিক সময়টি তিনি মনে করতে পারেন না। আইনুল বলেন, “আমি আমার মাকে ফোন করে জানিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি বলেন তোমাকে এইসব মেনে নিয়ে ওখানেই থাকতে হবে...”

বিক্রি হয়ে যাওয়া বাসনপত্র ছাড়াও আইনুল পেছনে ফেলে এসেছিলেন উত্তরপ্রদেশের জ্যোতিবা ফুলে নগর জেলার আমরোহা গ্রামের (তৎকালীন) উপকণ্ঠে গ্রামীণ এলাকা, বটওয়াল মোহল্লার বাড়িতে বসবাসকারী তাঁর পরিবারটিকে – পরিবার বলতে - তাঁর মা, দুই বোন এবং তিন ভাই। আইনুলের বাবা বছর কয়েক আগে মারা গেছেন, তিনি ছিলেন পেশায় নাপিত। ধারাভির এক প্রান্তে টিন ও অ্যাসবেস্টস দিয়ে ছাওয়া এক কামরার মেজেনাইন ঘরের মেঝেতে বসে তিনি বলেন, ““আমরা হলাম সলমানি জাট সম্প্রদায়ের মানুষ, আমাদের সমাজে পুরুষরা পরম্পরাগতভাবেই নাপিতের কাজ করেন। আব্বা একটা ছাউনির নিচে বসে লোকের দাড়ি কামিয়ে, চুল কেটে অল্প কিছু টাকা উপার্জন করতেন। আমরা ছিলাম খুব গরিব। আম্মি আমাদের ছয় ভাইবোনকে কখনও পেট ভরানোর জন্য গরম জল খেতে দিতেন, আবার কখনও খিদে মেটানোর জন্য দিতেন এক টুকরো গুড়। আমাদের ভদ্রস্থ জামাকাপড় বলতে কিছুই ছিল না, দুই পায়ে পরতাম দুই রকম চপ্পল – একটা নীল তো অন্যটা কালো – সেফটিপিন দিয়ে আটকে রাখা।”

ভাইবোনদের ছয়জনের মধ্যে কনিষ্ঠতম আইনুল স্কুলের মুখুটুকু দেখার সুযোগ পাননি। খুব ছোট বয়সেই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, সব ভাইবোন কাজ শুরু করে দেন - এক দাদা গাড়ির একটি গ্যারেজে সহায়কের করতেন, অপর দুই ভাই রিকশা চালাতেন। আইনুলের মা এবং তাঁর বড় দিদি (উভয়েরই পরবর্তীকালে যক্ষ্মা রোগ হয়) বাড়িতে বসে বিড়ি বাঁধার কাজ করতেন, ১০০০টি বিড়ি বাঁধার জন্য দালাল তাঁদের দিত ৫০ টাকা মাত্র। আইনুল, তাঁর বড় দিদির সঙ্গে নিকটবর্তী জোয়া গ্রামের খেতে একজন শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে শুরু করেন, কাজের বিনিময়ে তাঁরা পেতেন কিছু খাদ্যশস্য যা তাঁদের যৎসামান্য পরিবারিক মাসিক রসদে খানিকটা আরও জোগান দিত। তাঁর কথায়, “তখন আমি দিব্যি কাজ করে যেতাম কোনও কিছুর চিন্তা না করেই, মনটা বেশ হালকা থাকত, আর হাসতাম।”

সময়ের সাথে সাথে, আইনুলের বাবার ছাউনি আকারে বাড়িয়ে  শেখ পরিবার মোটামুটি ভদ্রস্থ আয়তনের একটি বাড়ি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়। তাঁর মা একটি স্থানীয় সংস্থার পরিচালিত যোজনার অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়ে ধাত্রীর কাজ শুরু করেন এবং এই কাজ থেকে তাঁর অল্পবিস্তর আয় হতে থাকে। কিন্তু যখন তাঁর ১৩ বছর বয়স (আইনুলের বয়স এখন ৩০-এর কোঠায়, ছোটখাটো ঘটনা মনে রাখার মত গভীর স্মৃতি থাকলেও বয়স এবং সাল স্পষ্ট মনে করতে পারেন না) তাঁর রুগ্ন অসুস্থ পিতা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে দুই বছরের বেশি সময় শয্যাশয়ী হয়ে পড়েন। এর ফলে তাঁদের পরিবার আবার নিদারুণ দারিদ্রের সম্মুখীন হয়। “আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, আমাদের পাড়াপড়শিরাও সাহায্য করেছেন, কিন্তু শেষরক্ষা হয় নি, তাঁকে বাঁচানো যায় নি।” আইনুলের বয়স যখন ১৫, তাঁর বাবা মারা যান। ১৬ বছর বয়স হওয়া মাত্র আইনুলের দাদারা তাঁর বিয়ে পাকা করে ফেলেন।

কিছুদিনের জন্য আইনুল তার শ্বশুর আলীমের বাড়িতে থাকেন। আইনুল জানান, আলীম কয়েক মাস মুম্বইয়ে ভিক্ষা করে টাকা উপার্জন করতেন, তারপর ফিরে এসে কয়েক মাস আমরোহাতে থেকে সেই অর্থে দিন গুজরান করতেন। তাঁর স্বামী জামিলের মা কিছুদিন আগে মারা গিয়েছিলেন, তাঁর ভাইও বাটওয়াল মোহাল্লায় নাপিতের কাজ করতেন। বিয়ের এক বছর পর, আলীম আইনুলকে মুম্বই নিয়ে আসেন।

A road in Dharavi, a slum in Mumbai

এই রাস্তার উপরেই আইনুলের এক কামরার বাসাটি অবস্থিত

জামিলের বাঁধাধরা কাজ ছিল না, যখন যা কাজ পেতেন করতেন তিনি। ধারাভির রিসাইক্লিং ক্ষেত্রে মোটবাহকের কাজ করে দৈনিক ১৫০-২০০ টাকা উপার্জন করতেন, অথবা উত্তর প্রদেশে চাল ও গম সরবরাহকারী ট্রাকগুলিতে সহায়ক হিসাবে কাজ করতেন। আলীম মাঝেমধ্যেই তাঁদের কিছু টাকা দিয়ে অর্থ সাহায্য করতেন। যদিও তিনি উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির লোক ছিলেন এবং জুয়া খেলতেন, তবু আইনুলের দুর্দিনে তিনি পাশে থেকেছেন।

মুম্বই আসার পর বেশ কয়েক বছর আইনুল অর্থ উপার্জন করেন নি। তিনি বলেন, “আমি আমার স্বামীকে অনুরোধ করতাম দরগায় গিয়ে ভিক্ষে করার অনুমতি দিতে। আমি তাকে বলেছিলাম, আমি বাড়িতে বাড়িতে গৃহশ্রমিকের কাজ করতে পারি, কিন্তু সে আমাকে কোথাও যেতে দিতে রাজি ছিল না। দৈনিক আমাকে সে ৩০ টাকা হাতে দিত, এই সামান্য টাকায় আমায় সবকিছু বন্দোবস্ত করতে হত। আমাদের প্রতিবেশীরা খুব ভালো মানুষ ছিলেন, মাঝেমাঝেই আমাদের বেঁচে যাওয়া খাবার দাবার দিয়ে সাহায্য করতেন।” যখন তাঁর প্রথম সন্তান খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন জামিলের নিষেধ অগ্রাহ্য করেই আইনুল দরগায় গিয়ে ভিক্ষে করার কাজ শুরু করেন।

প্রায় আট বছর আগে আলীম মারা গেলে, “খুব খারাপ সময় শুরু হয়েছিল।” জামিল বরাবরই হিংস্র প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, এবারে তাঁর অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে গেল। আইনুল বলেন, “আমি অনেক মার খেয়েছি, আমি তার কাছ থেকে অনেক নোংরা কথা শুনেছি, অপমান সহ্য করেছি। সে আমাকে একবার মাহিমে রেললাইনে ধাক্কা মেরে ফেলে রেখে বলেছিল আমি যেন মরে যাই।” তখন পড়ে গিয়ে তাঁর হাঁটু ভেঙে খুলে আসে; আমাকে আইনুল সেই পুরানো আঘাতের ক্ষতচিহ্ন দেখান। “সে আমাকে কখনও খালি হাতে, কখনও লাঠি বা চিমটে দিয়ে, হাতের নাগালে যখন যা পেত তাই দিয়ে আঘাত করত। আমি কীই বা করতাম? নীরবে সহ্য করতাম।”

এই সবের মধ্যেই, আইনুলের তিন সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর দুই ছেলে - মহম্মদ, এখন তার বয়স ১৫ বছর, এবং ৯ বছর বয়সী জুনেদ, মেয়ে মাহজবীনের বয়স ১১। তিনি বলেন, “অনেক সময়, লোকজন আমাকে বলতেন স্বামীকে ছেড়ে দিতে, কিন্তু তাহলে আমার সন্তানদের কী হবে? স্বামীকে ছেড়ে দিলে, আমাদের সমাজে আমার সন্তানদের আর কেউ বিয়েই হতে দেবে না।”

এরপর কিছু সময় অতিবাহিত হলে, আইনুল দরগায় আলাপ হওয়া এক ভদ্রমহিলার বাড়িতে মাসিক ৬০০ টাকা মজুরিতে গৃহকর্মীর কাজে নিযুক্ত হলেন। সেই থেকে আইনুল নানান কাজ করেছেন – ‘ওয়াদি লাইন’-এ ক্যাটারিং কর্মীর কাজ যেখানে ঠিকাদাররা শ্রমিকদের ভাড়া করে নিয়ে যান বিয়েবাড়িতে বাসনপত্র মাজার কাজ করার জন্য, এছাড়া আইনুল সাবআর্বান জোগেশ্বরী এলাকায় একটি বাড়িতে সেবাকর্মীর (নার্স) কাজও করেছেন।

বেশ কয়েক বছর ধরে, কখনও তিনি তাঁর সন্তানদের সঙ্গে মাহিম-ধারাভির ছোট্ট ভাড়ার ঘর নিয়ে থেকেছেন, আবার কখনও ঘর নিতে না পেরে ফুটপাথেও বাস করেছেন; তাঁর স্বামী কাছাকাছি ফুটপাথে ঘুমোন। ধারাভিতে ঘর ভাড়া নিতে গেলে সাধারণত ৫,০০০ টাকা আমানত হিসেবে জমা রাখতে হয় অগ্রিম। এই ক্ষুদ্র অঙ্কের টাকাটি দেওয়ার ক্ষমতাও আইনুলের প্রায়শই থাকত না। “ক্রমশ যেমন যেমন আমার সঙ্গে লোকজনের পরিচয় বাড়তে থাকল, তখন বিনা আমানতেই ঘর পেতে শুরু করলাম। আমি অনেকবার ঘর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি [ভাড়া দিতে না পেরে], পথে নেমে আসতে হয়েছে, সেখানেই থেকেছি, অন্য ঘর খুঁজেছি, তারপর রাস্তা ছেড়ে আবার ঘরে উঠে গেছি...”

A woman crouching on the floor of her house
PHOTO • Sharmila Joshi

নিজের বাড়িতে আইনুল , এই বাসাতেই তিনি কিছুটা হলেও খুঁজে পেয়েছেন স্থিতি এবং স্বস্তি

বিগত বহু বছর ধরে, কখনও মাহিম-ধারাভির এক চিলতে ভাড়াটে ঘরে, কখনও বা রাস্থাতেই আইনুল তাঁর পরিবার নিয়ে বসবাস করেছেন। ‘আমি অনেকবার ঘর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি [ভাড়া দিতে না পেরে], পথে নেমে আসতে হয়েছে, সেখানেই থেকেছি, অন্য ঘর খুঁজেছি, তারপর রাস্তা ছেড়ে ঘরে উঠে গেছি...’

২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে, তাঁদের বস্তিতে আগুন লাগল। আইনুল সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন: “তখন ভোর ৩টে, সবাই ঘুমাচ্ছিল। আমরা ছাদে উঠে দৌড় লাগালাম।” এই অগ্নিকান্ডের পর, তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে টানা আট মাস মাহিম-সিয়ন ব্রিজের ফুটপাথে থেকেছেন; তাঁর স্বামীও সেখানেই ছিলেন। আইনুলের কথায়, “বর্ষার সময়টা খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়াত, বৃষ্টি হলে আমি সন্তানদের নিয়ে কাছাকাছি এক রদ্দি বিক্রির দোকানে ছাউনির নিচে গিয়ে বসে থাকতাম।”

স্থানীয় সংগঠন ও নেতানেত্রীরা অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীর সাহায্যে এগিয়ে আসেন বলে আইনুল জানান। তিনিও শস্য, বাসনপত্র, বালতি, স্টোভ, মাদুর ইত্যাদি পান সাহায্য হিসেবে। ধীরে ধীরে, আইনুলের বন্ধু ও পরিচিতদের সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, তাঁদেরই মাধ্যমে, প্রায় বছর দুয়েক আগে, ব্রিজের উপর এই বাড়িটির সন্ধান পান যেখানে বর্তমানে তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে থাকেন। আর পাঁচটা আলোবাতাসহীন বদ্ধ ঘরের মতো নয় তাঁর বর্তমান ঘরটি, এই ঘরে একটা বড় জানালা আছে, তাই হাওয়াও খেলে। সগর্বে আইনুল জানান, ঘরটা ঠিক যেন একটা ছাদের মতো।”

২০১৫ সালের মার্চ মাস থেকে আইনুল বর্জ্য পদার্থ পুনর্প্রক্রিয়াকরণ (রিসাইক্লিং) এবং অন্যান্য বিষয়গুলিতে কাজ করে এমন একটি স্থানীয় অলাভজনক সংস্থায় বর্জ্য কাগজ বাছাইয়ের কাজ করছেন। এই কাজ থেকে তিনি স্থায়ী মাসিক বেতন বাবদ ৬০০০ টাকা উপার্জন করেন, এই কাজ তাঁকে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস এবং ভরসা। বেতন থেকে, প্রতি মাসে ঘর ভাড়া বাবদ ৩,৫০০ টাকা এবং শস্য, ময়দা, কিছু শাকসব্জি ইত্যাদি রসদ বাবদ ১০০০ টাকা খরচ হয়; অগ্নিকান্ডে তাঁদের পরিবারের রেশন কার্ড পুড়ে যাওয়ার পর নতুন রেশন কার্ড আইনুল পাননি। এতসব করে বেতনের যে টাকাটুকু বেঁচে থাকে তাই দিয়ে বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য খরচ চলে। তিনি বলেন, “আমার সন্তানরা ভরপেট খেতে পাচ্ছে, এতেই আমি খুশি।”

পরিবারটি নিকটস্থ সাধারণ শৌচালয় ব্যবহার করে। পাড়ার কল থেকে জল খরচ বাবদ মাসে ২০০ টাকা লাগে (জনৈক স্থানীয় প্রভাবশালী মহিলাকে এই অর্থ দিতে হয়); প্রতি সন্ধ্যায় ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে আইনুল বালতি, জ্যারিকেন, বোতল ইত্যাদি পাত্রে জল তোলেন। তিনি বলেন, “আমার ছেলে মহম্মদ জল ভর্তি করে নিয়ে আসতে সাহায্য করে।” ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত কন্যা মাহজবীন, আমার ভ্রমণকালে তার স্কুলের বইপত্র নিয়ে ব্যস্ত ছিল; ছোট ছেলে জুনেদ লাজুক, মুখে হাসি। সে ২য় শ্রেণির ছাত্র, এই ভাইবোন উভয়েই কাছাকাছি পৌরসভা পরিচালিত স্কুলে পড়াশোনা করে।

A woman standing on a ladder amidst hutments in Dharavi, a slum in Mumbai
PHOTO • Sharmila Joshi
The view from a hutment room in Dharavi
PHOTO • Sharmila Joshi

আইনুলের বাসায় পৌঁছানোর জন্য , আপনাকে এই দুটি খাড়া মই বেয়ে উপরে উঠতে হবে, মইয়ের গায়েই ভর রেখে আইনুল দাঁড়িয়ে আছেন। ডান দিকে : তা র জানালা থেকে দৃশ্যমান এক চিলতে ‘বম্বই’

৫ম শ্রেণির পর মহম্মদ স্কুল ছেড়ে দেয় এবং এখন মাঝে মাঝে একজন ওয়েলডারের সহকারী হিসাবে ঝালাইয়ের কাজ করে দিনে ১০০ টাকা মজুরির বিনিময়ে আবার কখনও কখনও জনৈক প্রতিবেশীর বই বিতরণ করে অল্পসল্প কিছু টাকা পায়। তার বিশেষ উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই – প্রতিবেশীর মতোই ফুটপাথে তার একখানি বইয়ের দোকান হলেই সে খুশি, অথবা তার নিজের কাকার মতো মিস্ত্রি হতেও বাধা নেই। সে বলে, “আমাদের সমাজের বাদবাকি পুরুষের মতো আমিও নাপিত হতে চাই, কিন্তু সে কাজ তো আমায় শিখতে হবে...সুতরাং, যে কাজই পাই না কেন আমি করব, আর উপার্জিত অর্থ থেকে কিছুটা মায়ের হাতে দেব।”

মায়ের গায়ে হাত তুললেই মহম্মদ এখন তার বাবাকে থামানোর চেষ্টা করে। তাই জামিল আইনুলের উদ্দেশ্যে চিৎকার চেঁচামেচি করেই ক্ষান্তি দেন। বছরের পর বছর স্বামীর নিদারুণ অত্যাচার, হাড়ভাঙা পরিশ্রম, এবং ক্ষুধার জ্বালা – এইসব মিলিয়ে আইনুলের স্বাস্থ্যের উপর দিয়ে খুব ধকল গেছে; ফ্যাকাশে চেহারা, রক্তচাপের সমস্যা, ঘন ঘন মাথাব্যাথা এসব সমস্যা লেগেই রয়েছে তাঁর।

বেশ কয়েকবার, আইনুল বাটওয়াল মোহল্লায় ফিরে গেছেন। সেখানে, তাঁর মা যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা যাওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর মায়ের কাছেই ছিলেন। “আমাকে তিনি টাকা পাঠাতেন, সাহায্য করার চেষ্টা করতেন... আমার আম্মি,” ধরা গলায় আনিনুল বলেন। এখনও কয়েক বছর অন্তর তিনি তাঁর নিজের শহরে যান, এই যেমন, বর্তমানে তাঁর ভাইঝির বিবাহ উপলক্ষ্যে আমরোহার ট্রেন ধরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

“আমার মনের একান্ত ইচ্ছা যে, আমার নিজের শহরে আমি নিজের জন্য একদিন একটা ছোট বাড়ি নির্মাণ করব। যে মাটিতে আমি মারা যাব, সেটা হবে আমার নিজের মাটি। আমার মন বম্বইয়ে নেই মোটেই... এই শহরে আমার দমবন্ধ লাগে... আমার গ্রামে পেট ভরে খেতে না পেলেও আমরা চালিয়ে নিতে পারতাম। আমার গ্রামের সঙ্গে মিশে আছে আমার সব স্মৃতি, আমার শৈশব সেই গ্রামে কেটেছে। আমার গ্রামে, আমি সহজেই মনপ্রাণ খুলে হাসতে পারতাম।”

বাংলা অনুবাদ: স্মিতা খাটোর

Sharmila Joshi

ஷர்மிளா ஜோஷி, PARI-ன் முன்னாள் நிர்வாக ஆசிரியர் மற்றும் எழுத்தாளர். அவ்வப்போது கற்பிக்கும் பணியும் செய்கிறார்.

Other stories by Sharmila Joshi
Translator : Smita Khator

ஸ்மிதா காடோர், பாரியின் இந்திய மொழிகள் திட்டமான பாரிபாஷாவில் தலைமை மொழிபெயர்ப்பு ஆசிரியராக இருக்கிறார். மொழிபெயர்ப்பு, மொழி மற்றும் ஆவணகம் ஆகியவை அவர் இயங்கும் தளங்கள். பெண்கள் மற்றும் தொழிலாளர் பிரச்சினைகள் குறித்து அவர் எழுதுகிறார்.

Other stories by Smita Khator