“এহ্ কিসে হোর নু জিতা রহে নে, সাডে আগ্গে কোই হোর নহি সি [ওরা জোর করে অন্য কাউকে জিতিয়ে দিচ্ছে, আমাদের আগে একটা মেয়েও ছিল না],” বন্ধুদের গলায় গলা মিলিয়ে প্রশিক্ষকের কাছে নালিশ জানাচ্ছেন জসপাল ও রমাদীপ। চণ্ডিগড়ে ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিতে সুদূর অমৃতসর জেলা থেকে ২০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এসেছেন ডজনখানেক দৌড়বাজ। পাশের মঞ্চ থেকে ভেসে আসছে জসপাল কৌরের নাম, ৫ কিমির দৌড়ে দ্বিতীয় হয়েছেন তিনি, অথচ প্রত্যেকেরই চোখেমুখে লেগে আছে ক্ষোভ। সব্বাই জানে যে রেসের শুরু থেকে শেষ অবধি জসপালই পয়লা নম্বরে ছিলেন, অথচ ৫,০০০ টাকার প্রথম পুরস্কারটা পেল অন্য কেউ।
মঞ্চে উঠে দ্বিতীয় পুরস্কার নিতে সাফ সাফ মানা করে দিলেন জসপাল কৌর, তার বদলে তিনি কোচের সঙ্গে এর-তার কাছে ঘুরে ঘুরে সংগঠক মণ্ডলীর সিদ্ধান্ত নিয়ে সওয়াল করতে লাগলেন। আপন বয়ান রাখার পাশাপাশি তাঁদের দাবি ছিল একটাই — ইনসাফ। যেন অবিলম্বে ভিডিও ফুটেজ দেখে সত্যাসত্য যাচাই করা হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য প্রশিক্ষকের পিড়াপিড়িতে দ্বিতীয় পুরস্কার গ্রহণ করেন জসপাল — ইয়াব্বড় একখান থার্মোকলের বোর্ডে সাঁটা ৩,১০০ টাকার চেক।
এর একমাস পর, এপ্রিল ২০২৩-এ তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আচমকা ৫,০০০ টাকা ঢোকায় তাজ্জব বনে যান জসপাল! নাহ্, স্থানীয় খবরের কাগজে কিছু লেখা-টেখা নেই, কেউ তাঁকে কিছু জানায়ওনি। অথচ রুনিজেনের ওয়েবসাইটে সেবারের সেই ৫ কিমি রেসের লিডারবোর্ডের শীর্ষে জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম; সঙ্গে গানটাইম, অর্থাৎ দৌড়ের বখতটাও লেখা আছে: ২৩.০৭ সেকেন্ড। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের যত ছবি আছে, সেখানে তিনি গরহাজির বটে, তবে অসংখ্য পদকের পাশাপাশি আজও সেই পেল্লায় চেকটি সযত্নে রেখে দিয়েছেন জসপাল।
২০২৪ সালে, ওই মেয়েগুলির পিছু পিছু পরবর্তী ম্যারাথনের আসরে গিয়ে আয়োজকদের থেকে জানতে পারি যে ২০২৩ সালের শেষের দিকে তাঁরা সেই দৌড়ের ভিডিও ফুটেজটি খুঁটিয়ে দেখে টের পান, জসপালের সঙ্গীসাথীরা ঠিক কথাই বলেছিল। ধরা পড়ে যায় যে রেসের বিব, অর্থাৎ দৌড়বাজদের গায়ে সাঁটা সনাক্তকরণ সংখ্যায় কারচুপি করা হয়েছিল, ফলে জসপালের প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়েটি অযোগ্য প্রমাণিত হয়। যাক্, শেষমেশ তাহলে জসপাল কৌরের অ্যাকাউন্টে জমা পড়া সেই রহস্যময় টাকাটার উৎস জানা গেল!
তাঁর জীবনে খেতাব বাবদ হাতে আসা পয়সাকড়ির মূল্য অপরিসীম। যথেষ্ট সঞ্চয় করতে পারলে আবার তিনি কলেজে ভর্তি হতে পারবেন। বছর দুই আগে, এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন বিএ পড়তে ঢোকেন জসপাল। “কিন্তু প্রথম সেমেস্টারের পর আর পড়তে পারিনি,” জানালেন তিনি, “সেমেস্টার-পিছু ১৫,০০০ টাকা না দিলে পরীক্ষায় বসতে দেবে না। পয়লা সেমেস্টারে পুরস্কারের [জাতীয় খেতাব জেতায় যে টাকাটা গ্রাম তথা স্কুল থেকে দেওয়া হয়] পয়সা জমিয়ে মাইনে ভরেছিলাম। তারপর পকেট পুরো ফাঁকা হয়ে যায়, তাই আর একটাও সেমেস্টার খতম করতে পারিনি।”
জসপাল কৌরের পরিবারে তিনি প্রথম প্রজন্মের কলেজপড়ুয়া। কোহালি গাঁয়ের মজহবি শিখ সমাজে তিনি বাদে আর হাতে-গোনা ক’টি মেয়ে কলেজের চৌকাঠ ডিঙিয়েছে। এই সম্প্রদায়টি পঞ্জাবে সবচাইতে বঞ্চিত তফসিলি জাতির তালিকায় নিবন্ধিত। জসপালের মা বলজিন্দর কৌর (৪৭) ক্লাস ৫ অবধি পড়েছেন। বাবা বলকার সিং (৫০) নির্মাণ-মজুর, স্কুলের মুখ দেখার সুযোগটাও কখনও পাননি। জসপালের দাদা অমৃতপাল সিং (২৪) দ্বাদশ শ্রেণির পর বাবার কাজে হাত লাগাবেন বলে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ভাই আকাশদীপ সিং (১৭) সদ্য ক্লাস ১২ পাশ করেছে।
জসপালের পরিবারে আজ আরও দুই সদস্য যোগ হয়েছে — দাদার স্ত্রী ও সন্তান। বলকার ও অমৃতপাল কতটা ঘনঘন কাজ জোটাতে পারছেন, গোটা বাড়ি সেই আশায় মুখিয়ে থাকে। তবে হামেশা ঠিকমতন কাজ জোটে না। হাতে কাজ এলে কিছুটা স্বস্তি মেলে, মাসে হাজার ৯-১০ রোজগার হয়।
প্রতিযোগিতার প্রবেশিকা মূল্য, গাঁ থেকে সেখানে যাওয়ার রাহাখরচ, নিজের পড়াশোনা — সাধারণত খেতাবের টাকাতেই এতকিছু সামলান জসপাল কৌর। মাঠে অনুশীলন করতে যেতে হবে, তার আগে গায়ে খেলোয়াড়ের পোশাক-আশাক চাপাতে চাপাতে তিনি বললেন, “রেসে নাম লেখালে গেঞ্জি দেয় ঠিকই, তবে হাফপ্যান্ট, ট্র্যাকস্যুট প্যান্ট আর জুতোর জন্য মা-বাবার কাছে হাত পাততে হয় আমাদের।”
আমাদের চারপাশে তরুণ যত খেলোয়াড়, কেউ ওয়ার্ম-আপ করছে, কেউ মাঠ ঘিরে মন্থর গতিতে দৌড়চ্ছে, কেউ বা দৈনিক ট্রেনিংয়ের জন্য প্রশিক্ষক রাজিন্দর সিংকে ঘিরে জড়ো হয়েছে। প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা গাঁ থেকে এসেছে। জসপাল কৌর ৪০০ মিটার, ৮০০ মিটার আর ৫ কিলোমিটারের দৌড়ে অংশ নেন, গত সাত বছরে অসংখ্য খেতাব আর পদক জিতেছেন। কোহালির বহু মানুষকে তিনি অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন। তাঁর পদক, শংসাপত্র আর পুরস্কারে পাওয়া টাকাকড়ি দেখে আর্থিক অনটনে থাকা পরিবারের অনেকেই নিজেদের বাচ্চাকে খেলাধূলার জগতে ঠেলে দিয়েছেন।
অথচ জসপালের নিজের জীবন অন্য কথা বলে। আজ অবধি তিনি যা যা জিতেছেন, তা সংসারের ঘানি টানার জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাই ফেব্রুয়ারি ২০২৪ থেকে অমৃতসরের একটি গোশালায় যাতায়াত শুরু করেছেন। সেখানকার হালখাতা দেখেন, মনিবরা কথা দিয়েছে মাস গেলে ৮,০০০ টাকা মাইনে দেবে। জসপালের লব্জে, “ঘরের আয়-ইনকামে কিছুটা সহায় হবে বলে চাকরি ধরলাম। কিন্তু এখন তো পড়াশোনার জন্য সময়ই পাচ্ছি না।”
তবে নতুন চাকরির মাইনে দিয়ে ঘরকন্নার দায়-দায়িত্ব সামলে সেমেস্টারের ফি যে মেটানো না-মুমকিন, সেটা তিনি বিলক্ষণ জানেন। মার্চ ২০২৪-এ জসপাল আবারও সিদ্ধান্ত নেন যে চণ্ডিগড়ে গিয়ে ১০ কিলোমিটারের দৌড়ে ভাগ নেবেন। এবার দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ১১,০০০ টাকার পুরস্কার জেতেন, তবে টাকাটা এখনও অবধি ব্যাংকে জমা পড়েনি।
*****
হর্সে ছিনা গাঁয়ে রাজিন্দর সিং ছিনা (৬০) যে জনা ৭০ খেলোয়াড়কে প্রশিক্ষিত করে তুলছেন, তাদের মধ্যে জসপাল কৌর অবশ্যই একজন ‘তারকা’। রাজিন্দর সাহেব খোদ একজন আন্তর্জাতিক মানের দৌড়বাজ, ১৫০০ মিটারের ইভেন্টে দৌড়তেন এককালে। বিগত এক দশক ধরে তিনি প্রান্তবাসী গোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীদের তালিম দিয়ে চলেছেন।
গ্রামীণ পঞ্জাবের যুব সমাজ আজ মাদকের গ্রাসে জর্জরিত, এ বিষয়ে চণ্ডিগড়ের এক বরিষ্ঠ আধিকারিক খিল্লি করায় রাজিন্দর সাহেব আর থাকতে না পেরে তরুণদের প্রশিক্ষিত করার কাজে লেগে পড়েন, সালটা ছিল ২০০৩। অমৃতসরের হর্সে ছিনা গাঁয়ে অবস্থিত কমরেড আছার সিং ছিনা সরকারি উচ্চমাধ্যমিক স্মার্ট স্কুলের খেলার মাঠের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি জানালেন, “বাচ্চাগুলোকে গোড়াতে এই মাঠে নিয়ে আসি। মজুর সন্তান, প্রান্তিক সমাজের ছেলেমেয়ে, ওদের একজনও কেউ স্কুলে পড়ত না। প্রথমেই ওদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিলাম, তারপর শুরু হল তালিম, ধীরে ধীরে ব্যাপারটা বড়ো হতে থাকল।”
“আজ বিভিন্ন সরকারি স্কুলে প্রান্তিক গোষ্ঠীর বহু বাচ্চাকাচ্চা পড়ে। প্রত্যেকেই খুব মেহনতি, শক্তপোক্ত ধাতের। দল বানাতে লেগে পড়ি, ভেবেছিলাম ওদের অন্তত রাজ্যস্তর পর্যন্ত যাওয়া উচিত। গুরুদ্বারায় সেবা চড়ানোর ফুরসৎটুকুও পেতাম না। আমার বিশ্বাস, ক্ষমতা থাকলে বাচ্চাদের লেখাপড়ায় মদত অবশ্যই করা উচিত,” বললেন তিনি।
“আমার কাছে অন্তত ৭০জন ক্রীড়াবিদ প্রশিক্ষণ নেয়। ওদের কয়েকজন তো বেশ সফল হয়েছে, ভালো ভালো চাকরিও পেয়ে গেছে। কয়েকজন তো প্রো কাবাডি লীগেও খেলার সুযোগ পেয়েছে,” গর্বিত কণ্ঠে জানাচ্ছেন রাজিন্দর সাহেব, “আমাদের কেউই সাহায্য করে না। লোকজন দেখতে আসে, বাচ্চাদের সম্মানিত করে, মদতের কথা দেয়, অথচ বাস্তবে কিসুই হয় না। নিজেদের সাধ্য মাফিক যেটুকু করার তা করছি।”
বিএএমএস ডিগ্রিধারী এই মানুষটি অমৃতসরের সন্নিকটে রাম তীরথে নিজস্ব একটি ক্লিনিকও চালান। তাঁর কথায় সেখান থেকে যেটুকু রোজগার হয়, তা দিয়ে ঘরখরচা বাদে এই প্রশিক্ষণ প্রাঙ্গনের খরচাপাতি কুলিয়ে যায়। “হার্ডল, ওজন, মাটিতে দাগ কাটার চুন ইত্যাদি সাজসরঞ্জামের পিছনে মাসিক ৭-৮ হাজার টাকা খরচা করি।” তাঁর তিন সন্তানের প্রত্যেকেই প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রতিষ্ঠিত, থেকে থেকে তাঁরাও খানিক খরচ জোগান।
“আমি চাই না একটা বাচ্চাও মাদক সেবন করুক। আমি চাই ওরা আমার এই মাঠে আসুক, যাতে জীবনে কিছু না কিছু একটা হতে পারে।”
নিজেদের সংগ্রামের কথা জানাচ্ছেন কোচ রাজিন্দর সাহেব ও তাঁর অল্পবয়সি মেয়ে দৌড়বাজের দল
*****
তবে ১০ কিলোমিটার দূর কোহালি থেকে এই মাঠে আসতে অবশ্য জসপালকে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়। “দূরত্ব সামলাতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যাই। মাঠ থেকে আমার গ্রাম বহুত দূর,” কোহালির একপ্রান্তে, তাঁদের দু-কামরার দালানবাড়ির বাইরে বসেছিলেন এই দৌড়বাজ। “মাঠে যেতে আসতে ৪৫ মিনিট করে লাগে,” বললেন তিনি, “প্রতিদিন ভোররাত ৩.৩০টেই উঠে পড়ি, যাতে ৪.৩০টের মধ্যে মাঠে পৌঁছতে পারি। বাবা-মা সাবধান হতে বলে, তবে আজ পর্যন্ত কখনও অসুরক্ষিত বোধ করিনি। কাছেই একটা আখড়া আছে, ছেলেরা পেহেলওয়ানি [কুস্তি] করে। ওদের জন্য সড়কটা কোনদিনও জনমাবনশূন্য হয় না। আমরা ঘণ্টা দুই প্র্যাক্টিস করে ৭.৩০টা নাগাদ বাড়ি ফিরি হেঁটে হেঁটে।”
দুবছর আগে বাবার সেকেন্ড-হ্যান্ড মোটরসাইকেলটা চালাতে শেখেন জসপাল, তারপর থেকে মাঝেমাঝে বাইক চালিয়ে প্রশিক্ষণ মাঠে গেছেন — যেতে আসতে মোটে দশ-দশ কুড়ি মিনিট লাগে। তবে আপাতদৃষ্টিতে ওই দিনগুলো পয়মন্ত মনে হলেও বাস্তবটা খানিক প্যাঁচালো। কোনও কারণে মোটরবাইকটা বাড়ির পুরুষদের প্রয়োজন হলে মাঝপথে তালিম থামিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাঁকে। এভাবে বেশ কয়েক দফা প্রশিক্ষণ বাদ পড়েছে জসপালের।
কোচ রাজিন্দর সাহেবের জবানে: “এখনও এমন কিছু গ্রাম আছে যেখানে না সরকারি না বেসরকারি, কোনও বাসই চলে না। অল্পবয়সিরা মাঠে আসতে নাজেহাল তো হয়ই, উপরন্তু ওদের অনেকেরই এতে পড়াশোনার ক্ষতি হয়ে যায়।” চৌহদ্দির ভিতর কলেজ না থাকায় এসকল গাঁয়ের অসংখ্য মেয়ে দ্বাদশ শ্রেণি অবধি পড়েই থেমে যেতে বাধ্য হয়। জসপাল কৌরের হাতের কাছে যে বাসস্ট্যান্ডটা আছে সেটা কোহালির অন্য প্রান্তে, তার উপর সেখান থেকে বাস ধরে সময়মতো প্রশিক্ষণের মাঠে যাওয়াটা আরেক সমস্যার, বোঝালেন তিনি।
এ গাঁয়ের আরেক তরুণ অ্যাথলিট রমনদীপ কৌরও হররোজ দশ-দশ কুড়ি কিলোমিটার পথ ঠেঙিয়ে তালিম নিতে যান। "একেকদিন পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে চৈনপুর গাঁয়ে যাই, তারপর সেখান থেকে আরেকটি মেয়ে কোমলপ্রীতের স্কুটিতে চেপে মাঠে পৌঁছই। তারপর ট্রেনিং শেষে আবার পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে ফিরি,” রমনদীপ বুঝিয়ে বললেন।
“ডর তন লগদা ইকাল্লে আউন্দে-জান্দে, পর কিসে কোল টাইম নহি নাল জান আউন লায়ি [একা একা যাতায়াত করতে বড্ড ভয় লাগে, বিশেষ করে অন্ধকারে, কিন্তু বাড়ির কারোরই এত সময় নেই যে রোজ রোজ আমায় সঙ্গ দেবে],” জানাচ্ছেন তিনি। তালিমের খাটাখাটনি, তার উপর কুড়ি কিলোমিটার করে হাঁটা, রমনদীপের শরীর-মনে এর ছাপ বিদ্যমান, “সারাটাক্ষণ ক্লান্তি লেগে থাকে।”
তাছাড়া দৌড়ের অনুশীলনটাই শেষ নয়, ২১ বছরের এই মেয়েটি ঘরকন্নার কাজেও হাত লাগায়, ঘরের গরু-মোষের দেখভাল করে। ভিটের ঠিক সামনেই, ৩-৪ ফুট চওড়া ইটের রাস্তা পেরিয়ে একচিলতে জায়গায় বাঁধা রয়েছে গবাদি পশুদুটি।
জসপালের মতন রমনদীপ কৌরও মজহবি শিখ জাতির মানুষ। রমনদীপের দুই ভাই মজুরি করে যেটুকু রোজগার করেন, তা দিয়েও দশ সদস্যের পরিবারটি চলছে। “ওরা মূলত ছুতোরের কাজ করে, কিংবা সবচাইতে কম টাইমে হাতে যে কাজ আসে সেটাই। যেদিন যেদিন কাজকম্ম জোটে, দিনে ৩৫০ টাকার মতো ইনকাম হয়।”
২০২২ সালে ক্লাস ১২ পাশ করেই পড়াশোনায় ইতি টানতে বাধ্য হন রমনদীপ, সেবছর তাঁর বাবাও মারা যান। “লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না আমাদের,” একরাশ হতাশায় গলা ভরে ওঠে তাঁর। গাঁয়ের একপ্রান্তে, দু-কামরার পারিবারিক ভিটেয় বসেছিল মেয়েটি, চারধারে দেওয়াল সব ফুটিফাটা। “মা ১৫০০ টাকার বিধবা-ভাতা পায়, তাই দিয়েই আমার খেলাধূলার সাজসরঞ্জাম কেনে।”
“ক্যাশ প্রাইজ জিত কে শুজ লায়ে সি ৩১০০ দে, হুন টুট্ট গয়ে, ফের কোয়ি রেস জিত্তুঙ্গি তে শুজ লাউঙ্গি [একটা দৌড়ে ৩১০০ টাকা জিতে বুটজুতো কিনেছিলাম, ওগুলো ছিঁড়ে-ফেটে গেছে, আবার একটা রেস জিতলে জুতো কিনব],” পায়ের ছেঁড়া-ফাটা জুতোজোড়ার দিকে আঙুল দেখিয়ে জানালেন রমনদীপ কৌর। বুটজুতো থাক বা না থাক, দারিদ্র্যের জিন্দেগি থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যেই ছুটে চলেছেন এ দৌড়বাজ।
“পুলিশ ফোর্সে চাকরি পাকা করার জন্য দৌড়চ্ছি,” বললেন তিনি।
চৈনপুরের কোমলপ্রীত কৌর (১৫), কোহালির গুরকির্পাল সিদ (১৫), রানেওয়ালির মনপ্রীত কৌর (২০) ও সাঁইসরা কালান গাঁয়ের মমতার (২৫) কাহিনিগুলোও ঠিক তাই। প্রত্যেকেই রাজিন্দর সিং ছিনার হাতে প্রশিক্ষিত হতে আসে। তরুণ এই দৌড়বাজদের কাছে রেস মানে সামাজিক স্থিতির বদল, সরকারি চাকরি মানে গোটা পরিবারের আর্থিক সুরক্ষা। তবে এসকল চাকরির প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলো কিন্তু আরেক হার্ডল রেস।
খেলোয়াড়দের জন্য ৩ শতাংশ সংরক্ষিত থাকলেও রাজ্য ও জাতীয় স্তরে চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি না জিতলে তা উপলব্ধ নয়, আর সেসবের জন্য অন্যান্য ধরনের রসদ প্রয়োজন। অতকিছু না থাকায় মেয়েগুলি আপ্রাণ মেহনত করে, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ৫ আর ১০ কিলোমিটারের দৌড়ে অংশ নেয়। তাদের আশা, জিতে আসা খেতাব আর পদকের জোরে একদিন না একদিন শারীরিক সুস্থতা পরীক্ষার বেড়া টপকে পুলিশের চাকরিটা পাকা হবে।
এই জাতীয় কাজে মজহবি শিখদের জন্য কোটাও রয়েছে। ২০২৪-সালের রাজ্য নিয়োগ অভিযানে পঞ্জাব পুলিশ কনস্টেবলের যে ১৭৪৬টি শূন্য পদের বিজ্ঞাপন বেরোয়, তার মধ্যে ১৮০টি সংরক্ষিত ছিল এই তফসিলি জাতিটির জন্য। আর তার মধ্যে থেকে ৭২টি পদ মজহবি শিখ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত।
প্রতিটি রাজ্য তার পুলিশ, বিচার বিভাগ, কারাগার এবং আইনি সহায়তার মতো মুখ্য ন্যায়বিচার প্রদান ব্যবস্থার পদপূরণে কতটা এগিয়েছে, ভারত বিচার রিপোর্ট ২০২২ সেই নিরিখে তাদের মূল্যায়ন দ্বারা ক্রমিক সংখ্যায় সাজিয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের ভিতর ৪র্থ স্থান হারিয়ে ১২তম স্থানে এসে ঠেকেছে পঞ্জাব। রিপোর্টে এও বলা আছে, “সে জাতপাত হোক বা লিঙ্গ, যেদিকেই দেখি সেদিকেই অন্তর্ভুক্তির ঘাটতি লক্ষণীয়, আর মেরামতির গতি হিমবাহের মতো মন্থর। দশকের পর দশক উত্তেজিত তর্কবিতর্ক চলেছে, কিছু রাজ্য একটি বা দুটি সংরক্ষণের ধারা পূরণে সক্ষম হলেও সমস্ত সাবসিস্টেম মিলিয়ে তিনটে কোটাই পূরণ করেছে এমন একটিও রাজ্য নেই। মহিলারা সমতালাভের ধারেকাছেও নেই। পুলিশ বাহিনীতে মেয়েদের সংখ্যা ৩.৩ শতাংশ থেকে ৮ হয়ে ১১.৮ শতাংশে পৌঁছতে ১৫টা বছর কেটে গেছে — জানুয়ারি ২০০৭ থেকে জানুয়ারি ২০২২।” ওদিকে ২০২২এ পঞ্জাব পুলিশে মহিলার সংখ্যা ৯.৯ শতাংশে পড়ে আছে।
গতবছর থেকেই জসপাল ও রমনদীপ পঞ্জাব পুলিশে কনস্টেবল পদে ঢোকার চেষ্টা করছেন। ২০২৩ সালে তাঁরা দুজনেই পঞ্জাবি ভাষার লিখিত পরীক্ষায় বসেছিলেন, তবে পাশ করতে পারেননি। “আমি বাড়িতে বসেই লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি,” রমনদীপ কৌর জানালেন।
২০২৪ সালে নিয়োগ অভিযানের বিজ্ঞাপনে একটি কম্পিউটার-ভিত্তিক পরীক্ষার কথা বলা আছে, যেটা ত্রিস্তরীয় বাছাই প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপের শারীরিক স্ক্রিনিং পরীক্ষা এবং শারীরিক পরিমাপ পরীক্ষায় বসার যোগ্যতা অর্জন করতে গেলে তফসিলি জাতি ও অনগ্রসর শ্রেণির পরীক্ষার্থীদের ন্যূনতম ৩৫ নম্বর পেতেই হবে। ফিজিক্যাল টেস্টে আছে দৌড়, লং-জাম্প, হাই-জাম্প, ওজন ও উচ্চতা।
মেয়ে ঠিকমতন খাওয়াদাওয়া করেন না, ফলে রমনদীপের খেলাধূলা নিয়ে তাঁর মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। দ্য অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়াজ গাইডবুক অন নিউট্রিশন নিয়ে ভাসা ভাসা ধারণা আছে রমনদীপের, সেখানে বলা আছে যে অল্পবয়সি খেলোয়াড়দের পুষ্টি ও শক্তির চাহিদা মেটাতে শাকসবজি, ফল, শুঁটি, কলাই, ডাল, চর্বিহীন মাংস, মাছ ও দুগ্ধজাত খাদ্য প্রয়োজন। এতকিছু কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই রমনদীপদের। মাসে একবার বই মাংস আসে না ঘরে। “ডায়েট নহি মিলদি, বাস্ রোটি যা জো ভি ঘরে মিল জান্দা [আমরা উপযুক্ত খাবারদাবার পাই না; বাড়িতে স্যাঁকারুটি বা যা-কিছু রান্না করা হয়, ওটুকুই মেলে],” জানাচ্ছেন তিনি। “ঘরে যা রান্না হয় তা-ই খাই, সঙ্গে ভেজানো-ছোলা থাকে,” যোগ করলেন জসপাল।
এবছরের বিজ্ঞাপনে যে কম্পিউটার-ভিত্তিক পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে, এঁদের কেউই সে বিষয়ে অবগত নন। “গেল বছর তো পঞ্জাবিতে লিখিত পরীক্ষা হয়েছিল, কম্পিউটার-ভিত্তিক নয়,” গতবছরের অভিজ্ঞতার কথা বললেন জসপাল কৌর, “আমাদের হাতের নাগালে থোড়াই না কম্পিউটার আছে?” গতবছর ওই লিখিত পরীক্ষা পাশ করতে কড়কড়ে ৩,০০০ টাকা খসিয়ে দুমাস টিউশনি পড়েছিলেন তিনি।
এবছরের বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক পঞ্জাবি ভাষার কোয়ালিফাইং পেপার ছাড়াও আরেকটি পেপার থাকবে। এর মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের সাধারণ সচেতনতা, পরিমাণগত যোগ্যতা ও সংখ্যাগত দক্ষতা, মানসিক ক্ষমতা ও যৌক্তিকতা, ইংরেজি ভাষার দক্ষতা, পঞ্জাবি ভাষার দক্ষতা ও ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং সচেতনতা যাচাই করা হবে।
এ বিষয়ে জসপালের প্রশ্ন, “ফিজিক্যাল টেস্ট রিটেন টেস্ট ক্লিয়ার হোন তোন বাদ লাইন্দে নে, রিটেন টেস্ট হি ক্লিয়ার নহি সি হোয়া ইস কর্কে ফিজিক্যাল টেস্ট তক্ পঁহচে হি নহি [লিখিত পরীক্ষায় সফল হলে তবেই শারীরিক পরীক্ষা হয়; যেখানে লিখিত পরীক্ষাই পাশ করতে পারছি না, সেখানে ফিজিক্যাল টেস্টের কথা আসছে কোত্থেকে]?”
“গতবছরের কেতাব আছে আমার কাছে। এবছরও আবেদনপত্র দাখিল করেছি [পুলিশের চাকরির জন্য],” রমনদীপ বললেন, “দেখা যাক।” আশা ও সংশয়ের দ্বৈরথে গলাখানা ভারি হয়ে এল তাঁর।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র