সেই প্রথম যেবার বন্যার জন্য বাস উঠিয়ে ঠাঁই নিতে হয়েছিল অন্য জায়গায় — মহেশ্বর সামুয়ার স্পষ্ট মনে পড়ে সেবারের কথা। মোটে পাঁচ বছর বয়স তাঁর তখন। “আমাদের একজনের ঘর জলে ভেসে গেছিল প্রথমে। নৌকোয় উঠে একটু আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা; শেষে দ্বীপের খুব কাছে একটা জমিতে নতুন করে ডেরা বেঁধেছিলাম,” বললেন অধুনা ষাটের কোঠা পেরোনো মহেশ্বর সামুয়া।
আসামের নদী দ্বীপ মাজুলির অধিবাসী সামুয়ার মতো ১.৬ লাখ মানুষের জীবন ঘনঘন বন্যা আর ভূমি হ্রাসে বিপর্যস্ত। জেলা বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ (ডিস্ট্রিক্ট ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি) প্রদত্ত রিপোর্ট অনুযায়ী এই দ্বীপের স্থলভাগের ক্ষেত্রফল যেখানে ১৯৫৬ সালে ছিল ১,২৪৫ বর্গ কিলোমিটার সেখান থেকে সংকুচিত হতে হতে ২০১৭ সালে ৭০৩ বর্গ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে।
শেষ দশ বছর ধরে নিজের বউ, মেয়ে আর ছেলের পরিবারের সঙ্গে নতুন সালমোরা গাঁওয়ে থাকছেন মহেশ্বর কাকা। কিন্তু, “এটা সত্যি সত্যি সালমোরা নয়,” বলে রহস্যটা খোলসা করেন তিনি, “৪৩ বছর আগে ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে চলে গিয়েছে সালমোরা।” তারপর ব্রহ্মপুত্র আর তার উপনদী সুবনসিঁড়ি মিলেই গড়ে দিয়েছে এই নতুন সালমোরাকে।
সিমেন্ট আর মাটি দিয়ে একটা তৈরি একটা আধাপাকা কাঠামোই এখন তাঁর নতুন ঘর। বাইরে বানানো শৌচাগারটায় মই ছাড়া পৌঁছনো যায় না। “প্রতিবছর ব্রহ্মপুত্র জমি গিলছে আমাদের,” হতাশ কণ্ঠে বলেন তিনি।
বারবার বন্যা প্রভাব ফেলেছে গ্রামের কৃষিকাজে। “আমরা না পারছি ধান, মাটি ডাল [বিউলি] ফলাতে, না হচ্ছে বাঁইগন [বেগুন] কিংবা পাত্তাগোবির [বাঁধাকপি] মতো শাকসবজি; কারও তো আর জমিই নেই,” আক্ষেপ ঝরে সালমোরার সরপঞ্চ জিস্বর হাজারিকার গলায়। তাই, নৌকো বানানো, মৃৎশিল্প কিংবা মাছ ধরার মতো অন্যান্য নানান কাজ বেছে নিচ্ছেন অনেক বাসিন্দা।
“এই দ্বীপ জুড়ে সালমোরার নৌকোর চাহিদা আছে,” বলছেন মহেশ্বর কাকা। নিজেও নৌকো বানান তিনি। কারণ চাপোরির (অপেক্ষাকৃত ছোটো দ্বীপ) অনেক বাসিন্দার নৌকো লাগে নানান কাজের জন্য – নদী পেরোনো, বাচ্চাদের স্কুল পর্যন্ত পার করিয়ে দেওয়া, মাছ ধরা আর বন্যার সময় তো কথাই নেই।
নিজে নিজেই নৌকো বানানোর বিদ্যাটি রপ্ত করেছেন তিনি। তিনজন মিলে কাজ করেন তাঁরা। নৌকোগুলো তৈরি হয় হ্যাজাল গুঁড়ি দিয়ে। এই কাঠ খুব সহজে পাওয়া যায়না বটে কিন্তু তবু কাজে লাগে “শক্ত আর টেকসই বলে,” মত তাঁর। সালমোরা আর আশেপাশের গ্রামের বিক্রেতাদের থেকে এই কাঠ খরিদ করেন তাঁরা।
একটা বড়ো নৌকো বানাতে এক হপ্তা লেগে যায়, ছোটো হলে দিন পাঁচেক লাগে। অনেকে মিলে খাটলে মাসে ৫-৮ টা নৌকো বানিয়ে ফেলতে পারেন তাঁরা। একখানা বড়ো নৌকোর (মোটামুটি ১০-১২ জন লোক আর তিনটে মোটরসাইকেল বইতে পারার মতো) দাম পড়ে ৭০,০০০ টাকা আর ছোটো হলে ৫০,০০০ টাকা মতো মেলে। এই উপার্জন বাঁটোয়ারা হয়ে যায় তাঁদের দু-তিনজনের মধ্যে।
নৌকো বানিয়ে রোজগারের নিশ্চয়তা থাকে না কিছু। যেহেতু নৌকোর ফরমাশ পাওয়া যায় সেই বর্ষার (আর বন্যার মরসুমের) আগে আগে। সুতরাং, অনেক মাস কোনও কাজই জোটে না মহেশ্বর সামুয়ার। ধরাবাঁধা মাসিক রোজগারের প্রত্যাশাও তিনি আর রাখেন না।
বন্যা হলে, পঞ্চাশ পেরোনো দক্ষ মহিলা দাঁড়ি রুমি হাজারিকা নৌকো নিয়ে নদীতে বেরিয়ে পড়েন জ্বালানি কাঠ জোগাড় করে গ্রামের বাজারে বেচবেন বলে; প্রতি কুইন্টাল পিছু কয়েকশো মতো টাকা মেলে তাতে। কোলো মাটি (কালো মাটি) দিয়ে পাত্র বানিয়ে সেসবও তিনি পনেরো টাকা করে বিক্রি করেন এই দ্বীপের একেবারে মাঝবরাবর অবস্থিত গরামুর আর কমলাবাড়িতে, আর মাটির প্রদীপ বিক্রি করে প্রদীপ পিছু ৫ টাকা করে পাওয়া যায়।
“জমির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সাবেক কাজ-কারবারও হারাচ্ছে,” বলছেন রুমি, “আমাদের কোলো মাটি ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র।”
এই প্রতিবেদনে সহায়তার জন্য কৃষ্ণা পেগুকে প্রতিবেদকের ধন্যবাদ।
অনুবাদ: রম্যাণি ব্যানার্জী