সকাল ৯টা বাজে, সপ্তাহান্তের ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠেছে মুম্বইয়ের আজাদ ময়দান। ব্যাটবল হাতে নেমে পড়েছে উঠতি ক্রিকেটাররা। থেকে থেকে রব উঠছে — কখনও মহানন্দে, কখনও বা হতাশায়।
মোটে ৫০ মিটার দূরে আরও বড়ো একটা ‘খেলা’ চলছে, খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৫,০০০, কারও মুখে টুঁ শব্দটি নেই। ক্রিকেটের বহু আগে শুরু হয়েছে এটা, কবে খতম হবে কেউ জানে না, হারজিতের বাজি আরও অনেকখানি বৃহৎ। এটা গতমাসের কথা, হাজার হাজার স্বীকৃত সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী (আশা) আন্দোলনে নেমেছিলেন। ৯ ফেব্রুয়ারি এই সংগ্রাম শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই ৫০ জনেরও বেশি মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল।
ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে সরগরম রাজপথ, বছর তিরিশের এক আশাকর্মী মাটিতে বসে আছেন। পথচলতি মুসাফিরদের নজর এড়িয়ে কেমন যেন ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে ইতিউতি তাকাচ্ছিলেন। দেখতে দেখতে মহিলারা ঘিরে ধরলেন তাঁকে, ওড়না আর চাদরে ঢেকে চটজলদি বদলে দিলেন তাঁর গায়ের পোশাকখানি।
তার ঘণ্টাকয়েক পর, দুপুরের কাঠফাটা রোদ্দুর সয়ে রিতা চাউরের চারিদিকে জড়ো হলেন তাঁর সহ-আশাকর্মীরা। প্রত্যেকের হাতে হাতে ফাঁকা টিফিন বাক্স, প্লেট, কারও কারও হাতে ঢাকনাও রয়েছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন তাঁরা, কখন রিতাতাই (৪৭) তাঁর ঘরে-বানানো খাবার পরিবেশন করবেন। “এখানে আন্দোলনরত ৮০-১০০ আশাকর্মীর জন্য খাবার রেঁধে আনি,” জানালেন তিনি। হররোজ ১৭ জন আশাকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে সুদূর থানে জেলার তিসগাঁও থেকে দুঘণ্টার পথ পেরিয়ে আসেন তিনি।
“আমরা পালা করে কাজ করছি, যাতে একজন আশাকর্মীও অভুক্ত না থাকেন। কিন্তু একে একে অসুস্থ হয়ে পড়ছি। বড্ড ক্লান্তও,” ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এর শেষের দিক তিনি বলেছিলেন পারি-কে।
২১ দিন পর, মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে ঘোষণা করেন, “আশা চি নিরাশা সরকার কারনার নাহি [সরকার কখনওই আশাকর্মীদের নিরাশ করবে না]।” এটা শুনে বাড়ি ফিরে যান আশাকর্মীরা। সিএম সাহেব সেদিন মহারাষ্ট্র বিধানসভার বাজেট সেশন চলাকালীন এই বক্তব্যটি রেখেছিলেন।
আশাকর্মীদলের প্রত্যেকেই মহিলা, ৭০টিরও অধিক স্বাস্থ্যমূলক সেবা প্রদান করেন তাঁরা। অথচ সমন্বিত শিশু উন্নয়ন সেবা কার্যক্রম (আইসিডিএস) এবং জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের (এনআরএইচএম) আওতায় তাঁদের ‘স্বেচ্ছাকর্মী’-র তকমা দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। তাই স্বাস্থ্যমূলক সেবা প্রদান করা সত্ত্বেও তাঁরা যে মজুরিটুকু পান সেটা কেবলই ‘সাম্মানিক’, বেতন কিংবা মাইনে নয়।
এই সাম্মানিক বাদে খানিক পিবিপি-ও (কাজভিত্তিক উৎসাহ ভাতা) পাওয়ার কথা। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন মোতাবেক, সর্বজনীন টিকাকরণের প্রচার, প্রজনন ও শিশুস্বাস্থ্য (আরসিএইচ) পরিষেবা তথা অন্যান্য কর্মসূচির খাতে আশাকর্মীদের কর্মক্ষমতার ভিত্তিতে তাঁদের উৎসাহ ভাতা দেওয়া হয়।
স্পষ্টতই টাকাটা যৎসামান্য, নইলে আশাকর্মী রমা মানতকর বলতেন না, “বিন পগারি, ফুল অধিকারী [মাসমাইনে নেই, শুধু দায়-দায়িত্ব আছে]! বাবুরা ভাবেন আমরা অফিসারদের মতন কাজ করব, অথচ আমাদের পয়সাকড়ি দিতে হাত সরে না।”
মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক আশ্বাস, গত কয়েক মাসে গাদাগুচ্ছের সরকারি আশ্বাস, এতকিছুর পরেও শেষমেশ একখান সরকারি সিদ্ধান্ত (জিআর) মিলল না, অন্তত এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়া অবধি তো হয়নি। যতদূর বোঝা যাচ্ছে, আশাকর্মীদের কেবল আশা নিয়েই ঘর করতে হবে।
আন্দোলনরত হাজার হাজার আশাকর্মীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, মহারাষ্ট্র প্রশাসনকে তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি (প্রথম আশ্বাসটি মিলেছিল ২০২৩-এর অক্টোবরে) রাখতে বাধ্য করবেন, যাতে বেতনবৃদ্ধি সংক্রান্ত একটি সরকারি সিদ্ধান্ত (গভর্নমেন্ট রেজেলিউশন বা জিআর) নেওয়া হয়।
“লোকে তাঁদের নিজের পরিবারের থেকেও আশাকর্মীদের উপর বেশি ভরসা করে! স্বাস্থ্য দফতরও আমাদের উপর নির্ভরশীল,” বনশ্রী ফুলবান্ধে বললেন। আরও জানালেন যে প্রান্তবাসী সম্প্রদায়ের কাছে স্বাস্থ্যমূলক পরিষেবা পৌঁছে দেওয়াটা তাঁদের বুনিয়াদি দায়িত্বের অন্যতম। “নতুন কোনও ডাক্তার নিয়োগ করা হলেই তাঁরা জিজ্ঞেস করেন: আশাতাই কই? ওঁর নম্বরটা একটু পাওয়া যাবে?”
১৪ বছর ধরে আশাকর্মীর দায়িত্বে বহাল বনশ্রীতাইয়ের কথায়: “১৫০ টাকা মজুরি দিয়ে শুরু করেছিলাম...আপনিই বলুন, এও তো একরকম বনবাস, তাই না? রাম যখন ১৪ বছর পর অযোধ্যায় ফেরেন, বিশাল ঢাকঢোল পিটিয়ে স্বাগত জানানো হয়েছিল, তাই না? আমাদের অত্ত আড়ম্বরে কাজ নেই, আর কিছু না হোক অন্তত মানধন-টুকু [সাম্মানিক মজুরি] দিন যাতে ইজ্জতের সঙ্গে সৎভাবে বাঁচতে পারি।”
এছাড়া আরও একটি দাবি রয়েছে: আর পাঁচজন কর্মীর মতো এঁদের মজুরিটাও কি টাইমমাফিক দেওয়া যায় না? প্রতিবার এমন তিনমাস দেরি করে করে পারিশ্রমিক মিললে যে বড্ড মুশকিল হয়ে যায়।
“সাম্মানিক পেতে এমন দেরি হলে ঘরকন্না চালাব কেমনে?” আশাকর্মী প্রীতি কর্মঙ্কর সওয়াল করলেন, তিনি ইয়াবতমালের জেলা উপ-অধ্যক্ষ। “একজন আশাকর্মী পরিষেবা দেয়, কিন্তু তাঁকে তো নিজের পেটটাও চালাতে হয়। পয়সাকড়ি না পেলে সে মানুষ টিকে থাকবে কেমনভাবে?”
এমনকি বাধ্যতামূলক কর্মশালা এবং স্বাস্থ্য দফতরের জেলাস্তরের সভা-টভায় যাওয়ার রাহাখরচ-টাও পেতে পেতে তিন থেকে পাঁচমাস বিলম্ব হয়। “২০২২ থেকে স্বাস্থ্য দফতর যতগুলো কর্মসূচির আয়োজন করেছিল, সেসব বাবদ আজ পর্যন্ত একটা পয়সাও পাইনি,” ইয়াবতমালের কালাম্ব-নিবাসী অন্তকলা মোরে জানিয়েছিলেন, “ডিসেম্বর ২০২৩-এ ধর্মঘটে নেমেছিলাম। কুষ্ঠ সমীক্ষা চালাতে হবে বলে ওরা বাধ্য করল হরতাল তুলে দিতে। অথচ মজুরি বাবদ একটা ফুটোকড়িও দেয়নি আমাদের।” প্রীতি কর্মঙ্করের যোগ করলেন: “গতবছর পোলিও, হাত্তিরোগ [লিমফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস বা গোদ] আর জন্ত-নাশক [কৃমিনাশক] ইত্যাদি যা যা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল, একটারও মজুরি মেলেনি।”
*****
৫০০ টাকা সাম্মানিক নিয়ে ২০০৬ সালে আশাকর্মের জগতে পা রাখেন রিতাতাই। “আজ মাস গেলে ৬,২০০ টাকা পাই, যার মধ্যে থেকে ৩,০০০ দেয় কেন্দ্র সরকার আর বাকিটা আসে পৌরসভা থেকে।”
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তানাজিরাও সাবন্ত ঘোষণা করেন, মহারাষ্ট্রের ৮০ হাজার আশাকর্মী এবং ৩,৬৬৪ জন গট প্রবর্তকদের (দল-প্রচারক) যথাক্রমে ৭,০০০ এবং ৬,২০০ টাকা বেতনবৃদ্ধি হবে, উপরন্তু সব্বাই দীপাবলির বোনাস বাবদ ২,০০০ টাকা পাবেন।
যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে মমতা জিজ্ঞেস করলেন, “দিওয়ালি হৌন আতা হোলি আলি [দিওয়ালি পেরিয়ে দোল উৎসব চলে এসেছে] অথচ হাতে একটা পয়সাও আসেনি। ৭ হাজারি ১০ হাজারি ইনক্রিমেন্ট চাই না। অতিরিক্ত অনলাইন কাজের বিরুদ্ধে পয়লাবার ধর্মঘটে নেমেছিলাম অক্টোবরে। আমাদের হুকুম দেওয়া হয়েছিল, হররোজ যেন প্রধানমন্ত্রী মাত্রু বন্দনা যোজনায় (পিএমএমভিওয়াই) ১০০ জন গ্রামবাসীর নাম নথিভুক্ত করি।”
পিএমএমভিওয়াই-এর সরকারি ওয়েবসাইটে বলা আছে, “গর্ভাবস্থা চলাকালীন যেটুকু মজুরিহানি হবে, তার আংশিক ক্ষতিপূরণ স্বরূপ নগদ উৎসাহ ভাতা পাওয়া যাবে” এই যোজনা আওতায়। সদ্য সদ্য চালু হওয়া ইউ-উইন অ্যাপটির জন্যও অনুরূপ লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হয়েছিল — পোয়াতি মা ও শিশুদের টিকাকরণের সমস্ত তথ্য জমা রাখা হয় এই অ্যাপটিতে।
ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এর গোড়ায়, দশ হাজারেরও অধিক আশাকর্মীর মিছিল শাহপুর থেকে ৫২ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছিল থানের জেলা-কালেক্টরের দফতরে। “চালুন আলোই, টাংড়্যা টুটল্যা [পুরো রাস্তাটা হেঁটে কাবার করেছিল আমরা, পাগুলো যেন ভেঙে পড়ে যাচ্ছিল]। গোটা রাত থানের পথে-পথে কাটিয়েছিলাম,” স্মৃতিচারণ করছিলেন মমতাতাই।
মাসের পর মাস চলতে থাকা আন্দোলন ছাপ রেখে যাচ্ছে শরীরে। “গোড়ায় আজাদ ময়দানে পাঁচ হাজারেরও বেশি আশাকর্মী ছিল। অনেকেই পোয়াতি ছিলেন, অনেকে তো সদ্যোজাত বাচ্চাও কোলে নিয়ে এসেছিলেন। ওভাবে খোলা আসমানের নিচে দিনের পর দিন কাটানো বড্ড কঠিন, তাই ওঁদের অনুরোধ করেছিলাম ফিরে যেতে,” উজ্জ্বলা পদলওয়ার বললেন। তিনি ভারতীয় সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস বা সিটু’র রাজ্য সম্পাদক তথা এই আন্দোলনগুলির অন্যতম সংগঠক। তিনি এটাও জানালেন যে বহু মহিলার বুকে ও পেটে যন্ত্রণা শুরু হয়, অনেকের আবার এমন মাথাব্যথা এবং ডিহাইড্রেশন (নিরুদন) হয় যে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল।
তবে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে না পেতেই তাঁরা আজাদ ময়দানে ফিরে এসে স্লোগান তোলেন: “আতা আমচা একচ নারা, জিআর কাধা! [মোদের কণ্ঠে একটাই ডাক! জিআর এবার ছাড়া হোক!]।”
*****
খাতায় কলমে আশাকর্মীর ভূমিকা সকলের কাছে জনস্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া। তবে বছরের পর বছর সমাজের দেখভাল করতে করতে হামেশাই তাঁদের কাজ উক্ত কর্মসীমা অতিক্রম করে। আশাকর্মী মমতাতাইয়ের কথাই ধরুন না হয়, সেপ্টেম্বর ২০২৩-এ তিনি বদলাপুরের সোনিভালি গাঁয়ের এক আদিবাসী মহিলাকে ঘরের বদলে হাসপাতালে গিয়ে প্রসব করতে রাজি করিয়েছিলেন।
তাঁর মনে পড়ে, “ওই মহিলার বর আমাদের সঙ্গে আসতে চাননি, সাফ সাফ জানিয়ে দেন, ‘আমার বৌয়ের কিছু হলে কিন্তু আপনাকে দোষী ঠাউরাব।’” মহিলাটির প্রসবযন্ত্রণা শুরু হতেই, “আমি একাই তাঁকে বদলাপুর থেকে উল্লাসনগরে নিয়ে যাই,” মমতাতাই জানালেন। কিন্তু মৃতসন্তান প্রসব করে মা-ও প্রাণ হারান।
তাঁর কথায়, “আমি বিধবা মানুষ, আমার ছেলেটা তখন ক্লাস টেনে পড়ত। ভোর ৬টায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম, মহিলাটি মারা যান রাত ৮টা নাগাদ। আমায় রাত ১.৩০টা পর্যন্ত হাসপাতালের বারান্দায় বসিয়ে রেখেছিল। পঞ্চনামা তৈরি হয়ে গেলে ওঁরা জিজ্ঞেস করে, ‘আশা তাই, এখন আপনি যেতে পারেন।’ দীড় ওয়াজতা মি একতী জাউ? [রাত্তির দেড়টার সময় একা একা বাড়ি যাব কীভাবে শুনি?]”
পরদিন নথিপত্র হালনাগাদ করতে সোনিভালি গ্রামে যেতেই সেই মহিলার স্বামী সমেত বেশ কিছু লোক মিলে তাঁকে গালিগালাজ করতে থাকে, মা ও সন্তান মারা যাওয়ার দোষ এসে চাপে মমতাতাইয়ের ঘাড়ে। একমাস পর, জেলা সমিতি থেকে তাঁকে জেরা করতে ডেকে পাঠায়। “ওঁরা জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘ওই পোয়াতি মহিলা কেমন ভাবে মারা গিয়েছিল? আশা তাই ঠিক কী ধরনের ভুলচুক করেছিল?’ তা দিনান্তে যদি সব দোষ এই নন্দ ঘোষেরই হয়, তবে আমাদের মানধন-টা (সাম্মানিক) বাড়াচ্ছে না কেন?” সোজা সওয়াল তাঁর।
অতিমারির পুরো সময়টা জুড়ে আশাকর্মীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল সরকার বাহাদুর। ওষুধপত্র বণ্টন ও রাজ্যময় প্রত্যন্ত সব গাঁয়ের সংক্রামিত রোগীদের সাকিন হদিস নেওয়ার মতো মহা গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি করতেন আশাকর্মীরা, তাই “করোনা যোদ্ধা”-র তকমায় তাঁদের ভূষিত করে সরকার। অথচ নিজেরা যে কোভিড ভাইরাস থেকে বাঁচবেন, তার জন্য সুরক্ষা সরঞ্জামটুকুও পেতেন না বললেই চলে।
কল্যাণের নন্দীভলি গ্রামের দুই আশাকর্মী মন্দা খাতান ও শ্রদ্ধা ঘোগালে তাঁদের করোনাকালীন অভিজ্ঞতার কথা জানালেন আমাদের, “একবার এক গর্ভবতী মহিলার প্রসবের পর পরীক্ষা করে দেখা যায় যে তিনি করোনা পজিটিভ। ভাইরাসে সংক্রামিত হয়েছেন, এটা জানতেই ঘাবড়ে গিয়ে [নবজাতক] সন্তান সহ হাসপাতাল ছেড়ে চম্পট দেন।”
“তিনি ভেবেছিলেন, তাঁকে [আর তাঁর সন্তানকে] বুঝি লোকে ধরপাকড় করে মেরে ফেলবে,” জীবাণু ঘিরে এমনই সব আতঙ্ক ও ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছিল বলে জানালেন শ্রদ্ধাতাই।
“কেউ একটা আমাদের খবর দেয়, সেই মহিলা তাঁর ঘরেই লুকিয়ে আছেন। আমরা পড়িমড়ি দৌড়ে গিয়ে দেখি, উনি দরজা-টরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছেন,” মন্দা খাতান জানালেন। পাছে তিনি ভুলভাল কিছু করে বসেন, তাই আশাকর্মীদ্বয় রাত দেড়টা পর্যন্ত তাঁর দোরগোড়ায় ঠায় বসেছিলেন। “আমরা ওঁকে জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি আপনার বাচ্চাটাকে ভালোবাসেন তো?’ উপদেশ দিই, যে উনি যদি এভাবেই তাঁর নবজাতকটিকে নিজের কাছে রেখে দেন, তবে শিশুটিও সংক্রমিত হয়ে পড়বে, তাতে তার প্রাণ গেলেও যেতে পারে।”
টানা তিনঘণ্টা বোঝানোর পর সেই মহিলা দোর খোলেন। “অ্যাম্বুল্যান্সটা দাঁড়িয়েই ছিল। কোত্থাও কোনও মেডিক্যাল আধিকারিক বা গ্রামসেবকের টিকিটিও দেখতে পাইনি, শুধু আমরা দুজনেই ছিলাম,” ছলছল চোখে বলছিলেন মন্দাতাই, “অ্যাম্বুল্যান্স ছাড়ার আগে মহিলা আমার হাত ধরে বলেন, ‘আপনার উপর ভরসা করি বলেই আমার সোনাকে আপনার হেফাজতে রেখে যাচ্ছি। দয়া করে ওর যত্ন নেবেন।” পরবর্তী আটদিন, হররোজ ওঁর বাড়ি গিয়ে গিয়ে সদ্যোজাত শিশুটিকে বোতলে করে খাইয়ে আসতাম। ভিডিও কল করে তাঁকে বাচ্চাটাকে দেখাতাম। আজও সেই মা আমাদের ফোন করে কৃতজ্ঞতা জানান।”
মন্দা খাতানের কথায়, “গোটা একটা বছর আমরা নিজেদের বাচ্চার থেকে দূরে দূরে থেকেছি। কিন্তু অন্যের সন্তানকে আগলে রেখে বাঁচিয়েছি।” লকডাউনের সময় তাঁর সন্তান ক্লাস এইটে পড়ত, আর শ্রদ্ধাতাইয়ের বাচ্চাটি তো নেহাত শিশু ছিল তখন, সবে পাঁচ বছরের হয়েছিল।
আরও এক আজব ঘটনার কথা মনে আছে শ্রদ্ধা ঘোগালেরর। তাঁদেরকে দেখলেই গাঁয়ের লোকজন কপাটে খিল তুলে দিত। “গায়ে পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইক্যুপমেন্ট (পিপিই) কিট চড়িয়ে এলেই লোকে লেজ গুটিয়ে পালাত, ভাবত আমরা বুঝি ওদের ধরতে এসেছি।” শুধু তাই নয়, “আমরা সারাদিন ওই ধরাচূড়া পরে থাকতাম। কখনও কখনও দিনে চারবার কিট বদলাতে হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টার কিট পরে থাকতে থাকতে চোখমুখ ভুষোকালির মতো হয়ে গিয়েছিল। ওসব পরে রোদ্দুরে হাঁটতাম তো। সারাটা গা চুলকাত, মনে হত চামড়াটা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে।”
তাঁর কথার মাঝে মন্দাতাই বলে উঠলেন, “তবে ওসব পিপিই আর মাস্ক-টাস্ক কিন্তু অনেক পরে হাতে আসে। অতিমারির সিংহভাগটাই মুখে ওড়না আর আঁচল জড়িয়ে ঘুরেছি।”
“তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? তখন [কোভিড-১৯ অতিমারির সময়] আমাদের প্রাণের বিশেষ মূল্য ছিল না, তাই তো?” মমতাতাইয়ের সওয়াল। “করোনা মোকাবিলায় আপনারা অন্য কোনও ধরনের কবচ দিয়েছিলেন আমাদের? অতিমারি শুরু হতে আপনারা [সরকারপক্ষ] ঘোড়ার ডিম দিয়েছিলেন আমাদের। আশাতাইরা যখন কোভিডে সংক্রমিত হতে শুরু করে, আর পাঁচজন রোগীর মতনই হাল হয়েছিল। টিকার তখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হয়নি, স্বেচ্ছাকর্মীর ভূমিকায় প্রথম আশাকর্মীরাই এগিয়ে আসে।”
একটা সময় বনশ্রী ফুলবান্ধে প্রায় মনস্থির করেই ফেলেছিলেন যে আশাকর্মীর জীবনে এবার ইতি টানবেন। “আমার মানসিক আর শারীরিক স্বাস্থ্য খারাপ হতে আরম্ভ করেছিল,” জানালেন তিনি। নাগপুর জেলার ওয়াদোডা গ্রামে প্রায় ১,৫০০ মানুষের দেখভাল তাঁর একার দায়িত্বে। “মনে আছে, একবার কিডনিতে পাথর জমে ব্যথায় মরে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কামকাজ থামাইনি, কোমরে একফালি কাপড় কষে বেঁধে রেখেছিলাম।”
একবার এক রোগী তাঁর বরের সঙ্গে বনশ্রীতাইয়ের বাড়িতে আসেন। “মহিলা এই প্রথম মা হতে চলেছেন। দুশ্চিন্তায় নাজেহাল হয়ে গেছে দম্পতিটি। ওঁদের বোঝাই যে আমার হালত খারাপ, কিছু করার মতো অবস্থায় নেই, তা সত্ত্বেও প্রসবকালে আমায় থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। মুখ ফুটে আর ‘না’ বলতে পারিনি, অগত্যা গেলাম তাঁদের সঙ্গে। প্রসব না হওয়া পর্যন্ত দুটো দিন ওই হাসপাতালেই পড়েছিলাম। সেই মহিলার বাড়ির লোকজন আমার কোমরে আঁটা কাপড় দেখে ঠাট্টা করে বলত, “প্রসব কে করবে? রোগী না আপনি!”
বনশ্রী ফুলবান্ধের স্মৃতিচারণায় উঠে এল লকডাউন চলাকালীন তাঁর রোজনামচার কথা, সেই যখন আশাকর্মীর দায়-দায়িত্ব চুকিয়ে অন্তরণে (কোয়ারেন্টিন) থাকা রোগীদের খাবার বিলি করে ফিরতেন। “শেষমেশ আমার শরীর-স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। দিনের পর দিন রক্তচাপ তুঙ্গে উঠেছিল, তখন ভাবি যে এবার এ কাজ ছেড়েই দেবো।” কিন্তু তাঁর মাসি তখন তাঁকে মনে করান, “যেটা করছি সেটা পুণ্য। তিনি বলেছিলেন, দু-দুটো [মা ও সন্তান] জীবনের ভার আমার হাতে। কখনওই এই কাজ আমার ছাড়া উচিত নয়।”
গল্পটা বলতে বলতে একঝলক তাঁর ফোনের উপর চোখ বুলিয়ে নিলেন বনশ্রীতাই। “আমার বাড়ির লোক তো সারাটাক্ষণ জিজ্ঞেস করে, আমি কখন ঘরে ফিরব। এখানে ৫,০০০ টাকা নিয়ে এসেছিলাম। আজ মেরেকেটে শ-দুয়েক পড়ে আছে।” ডিসেম্বর ২০২৩-এর পর থেকে তিনি আর মাসিক অনারারিয়াম [সাম্মানিক দক্ষিণা] পাননি।
অতীতের এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির কথা জানালেন নাগপুরের পান্ধুরনা গাঁয়ের আশাকর্মী পূর্ণিমা ওয়াসে (৪৫)। “চলন্ত অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতর এক এইচআইভি পজিটিভ মহিলার বাচ্চা প্রসাব করাই। হাসপাতালের লোকজন যখন জানতে পারে যে মহিলা এইচআইভি পজিটিভ, ওরা বেজায় হাঁউমাঁউ শুরু করে। আমি তখন সপাটে বলি, ‘একজন আশাকর্মী হয়ে আমি যখন শুধু দস্তানা আর নিজের ওড়নার সাহায্যে বাচ্চাটা প্রসব করিয়েছি, তখন আপনারা খামোকা এমন উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?’”
২০০৯ থেকে আশাকর্মে নিযুক্ত পূর্ণিমাতাই, সাড়ে চার হাজারেরও অধিক মানুষের দায়িত্ব সামলান। তাঁর কথায়, “আমি গ্র্যাজুয়েট। অসংখ্য চাকরির ডাক পাই। কিন্তু স্বেচ্ছায় আশাকর্মী হয়েছি, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা অবধি এই আশার কাজ চালিয়ে যাব। টাকাকড়ি পাই বা না পাই, আগর মুঝে করনি হ্যায় সেওয়া তো মরতে দম তক্ আশা কা কাম করুঙ্গি [যেহেতু সেবা করতে চাই, মৃত্যু পর্যন্ত আশাকর্মীর কাজ করে যাব]।”
আজাদ ময়দানে তখনও ক্রিকেটের খেল খতম হয়নি। আশাকর্মীরা অবশ্য ততক্ষণে লড়াইয়ের এই মাঠ ছেড়ে অন্য এক যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য কোমর বাঁধছেন।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র