বাড়ির সামনের আম গাছের তলায় আঁধার মুখে বসে আছেন সারু। কোলে শিশুপুত্র ছটফট, কলকল করছে। “যে কোনও দিন মাসিক হয়ে যেতে পারে, হলেই কুর্মাঘরে চলে যেতে হবে,” বলছেন তিনি। কুর্মাঘর মানে আক্ষরিক অর্থেই ঋতুকালীন ঘর, যেখানে ঋতুস্রাব-চলাকালীন ৪-৫ দিনের জন্য তাঁকে নির্বাসনে যেতে হবে।
আগতপ্রায় নির্বাসন নিয়ে চিন্তায় আছেন সারু (নাম পরিবর্তিত)। “কুর্মাঘরের ভিতর দমবন্ধ হয়ে আসে, আর ছেলেমেয়েকে ছাড়া ঘুম আসে না,” নয় মাসের ছোট্ট ছেলেকে সামাল দিতে গিয়ে বলেন তিনি। তাঁর একটি মেয়েও আছে, সাড়ে তিন বছরের কোমল (নাম পরিবর্তিত), নার্সারি স্কুলে পড়ে। “ওরও একদিন পালি [ঋতুচক্র] শুরু হবে; ভয় করে আমার,” বলছেন ৩০ বছর বয়সি সারু। মাড়িয়া জাতির সনাতন প্রথার অত্যাচার একদিন মেয়েকেও সইতে হবে, এই দুশ্চিন্তা কুরে কুরে খায় তাঁকে।
সারুদের গ্রামে চারটি কুর্মাঘর আছে – একটি তাঁর বাড়ি থেকে ১০০ মিটারেরও কম দূরত্বে। এই মুহূর্তে এই গ্রামের মোট ২৭ জন কিশোরী এবং ঋতুমতী মহিলা এই চারটি ঘর ব্যবহার করেন। “আমি ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি আমার মা আর দিদা কুর্মাঘরে যাচ্ছে। এখন আমি যাচ্ছি। আমি চাই না কোমল এই প্রথার কবলে পড়ুক,” বলছেন সারু।
আদিবাসী মাড়িয়া গোষ্ঠীতে ঋতুমতী নারীকে অশুদ্ধ এবং অস্পৃশ্য বলে গণ্য করা হয়, তাই ঋতু চলাকালীন তাঁদের নির্বাসনে পাঠানো হয়। “১৩ বছর বয়স থেকে কুর্মাঘরে যাচ্ছি আমি,” জানালেন সারু। তখন বাবা-মার বাড়িতে ছিলেন তিনি, মহারাষ্ট্রের গড়চিরোলি জেলার পূর্বপ্রান্তে তাঁর বর্তমান ঠিকানা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে।
গত ১৮ বছরে সারু তাঁর জীবনের প্রায় ১০০০টি দিন – মাসে পাঁচ দিন করে – কাটিয়েছেন এমন একটা কুঁড়েঘরে যেখানে শৌচাগার নেই, জল নেই, বিজলি নেই, খাট বা ফ্যানও নেই। “ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, রাত্রিবেলা ভয় করে। মনে হয় অন্ধকার ঘরটা আমায় গিলে খেতে আসছে,” বলছেন তিনি। “ইচ্ছে করে ছুট্টে বাড়ি চলে গিয়ে বাচ্চাগুলোকে আঁকড়ে ধরি… কিন্তু পারি না।”
গ্রামের অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে ভাগাভাগি করা কুর্মাঘরের ভিতরে সারু একটু পরিচ্ছন্নতা খুঁজে মরেন, যন্ত্রণাকাতর শরীরের জন্য নরম একটা বিছানা, প্রিয়জনের ওম মাখা একটা কম্বল। কিন্তু টালির চাল দেওয়া মাটি-বাঁশের নড়বড়ে কুঁড়েঘরটা যে কাউকে অবসাদে ডুবিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। যে মেঝেতে শুতে হয় তাঁকে সেটা পর্যন্ত এবড়ো-খেবড়ো। “ওরা [স্বামী বা শ্বাশুড়ি] একটা চাদর পাঠায়, সেটা পেতেই শুই। পিঠে, মাথায় ব্যথা করে, গায়ে খিঁচ ধরে। ওই পাতলা চাদরে শুয়ে কি আর আরাম হয়,” বলছেন তিনি।
সারুর অস্বস্তি আর ব্যথাবেদনার সঙ্গে জোড়ে একাকীত্ব আর ছেলেমেয়ের থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণা। “কাছের লোকেরাও আমার যন্ত্রণাটা বোঝে না, খুব কষ্ট হয়,” বলছেন তিনি।
মুম্বইয়ের সাইকোথেরাপিস্ট ড. স্বাতী দীপক জানাচ্ছেন, মেয়েদের ঋতুচক্র শুরু হওয়ার আগে এবং চলাকালীন উদ্বেগ, মানসিক চাপ এবং অবসাদের মতো মনস্তাত্ত্বিক নানা উপসর্গ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। “উপসর্গের তীব্রতা নানান মহিলার ক্ষেত্রে নানান রকম। কিন্তু যথাযথ যত্ন না হলে অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়,” যোগ করছেন তিনি। ড. দীপকের মতে, এই সময়টায় বিশেষ করে পরিবারের কাছ থেকে মেয়েদের যত্ন এবং শুশ্রুষার প্রয়োজন, তা না করে একঘরে করে, পৃথক রেখে দিলে বরং প্রবল মানসিক আঘাত লাগতে পারে তাঁদের।
মাড়িয়া নারীরা নিজেদের বাড়িতে পর্যন্ত ঋতুকালে ব্যবহার্য কাপড়ের প্যাডও রাখতে পারেন না। “আমরা সবাই ওগুলো [কুর্মা]ঘরে রেখে আসি,” জানালেন সারু। প্লাস্টিকের ব্যাগ ভর্তি করে পুরনো সায়ার কাপড়ের টুকরো গুঁজে রাখা হয় কুর্মাঘরের মাটির দেওয়ালের ফাটলে কিংবা বাঁশের পাটাতন থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। “ঘরে টিকটিকি আর ইঁদুরের উৎপাত, প্যাডের উপর চলাফেরা করে।” দূষিত প্যাড থেকে প্রায়ই চুলকুনি এবং সংক্রমণ হয় মেয়েদের।
কুর্মাঘরে কোনও জানালা নেই, তাই বায়ু চলাচলের অভাবে কাপড়ের প্যাডগুলি থেকে দুর্গন্ধ বার হয়। “বৃষ্টির সময় তো আরও খারাপ অবস্থা হয়,” জানালেন সারু। “আমি বর্ষার সময় [স্যানিটারি] প্যাড ব্যবহার করি, কারণ কাপড় সহজে শুকোতে চায় না,” জানালেন তিনি। ৯০ টাকা দিয়ে ২০টি প্যাডের একটি প্যাকেট কেনেন সারু, তাতে তাঁর মাস দুয়েক চলে যায়।
সারু যে কুর্মাঘরে যান সেটি প্রায় ২০ বছরের পুরনো। কিন্তু সেটার কেউ রক্ষণাবেক্ষণ করে না। ছাদের বাঁশের কাঠামো ফেটে পড়ছে, মাটির দেওয়ালে ফাটল ধরছে। “বুঝতেই পারছেন কত পুরনো এই ঘরটা। কিন্তু কোনও পুরুষ এই ঘর মেরামত করতে আসবে না, যেহেতু ঋতুমতী মেয়েরা এটাকে অশুদ্ধ করেছে,” জানালেন সারু। মেরামতি যা করার মেয়েদের নিজেদেরই করতে হবে।
*****
সারু নিজে একজন গণস্বাস্থ্যকর্মী – গত চার বছর ধরে আশা বা অ্যাক্রেডিটেড সোশ্যাল হেল্থ অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু ঋতুজনিত অস্পৃশ্যতা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। “আমি নিজে আশা কর্মী, কিন্তু এত বছর ধরে এখানকার পুরুষ-নারী কারও মানসিকতা বদলাতে পারিনি,” বলছেন তিনি। ঋতুচক্র নিয়ে কুসংস্কারই এই প্রথা এখনও প্রচলিত থাকার মূল কারণ, মনে করেন তিনি। “বয়স্করা বলেন, [ঋতুমতী নারী ঘরে থাকলে] গ্রামদেবী কূপিতা হবেন, এবং সারা গ্রামের উপর তাঁর অভিশাপ এসে পড়বে।” সারুর স্বামী কলেজ স্নাতক, কিন্তু তিনিও কুর্মা প্রথার পক্ষে।
কুর্মা না পালন করলে প্রায়শ্চিত্ত বাবদ গ্রামদেবীর কাছে মুরগি বা ছাগল দান করতে হয়, যা বলি চড়বে। আকার অনুসারে একটা ছাগলের দাম চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে, জানালেন সারু।
মজার কথা হল, ঋতুচক্র চলাকালীন বাড়িতে থাকতে না পারলেও সারুর কিন্তু পারিবারিক খামারের কাজকর্ম আর গরুছাগল চরানো থেকে নিস্তার নেই। পরিবারের দুই একর বর্ষাপুষ্ট চাষজমি আছে, যেখানে মূলত ধান চাষ করা হয়, যা এই জেলার মূল শস্য। “কাজেই এমন নয় যে আমি এইক’টা দিন একটু বিশ্রাম পাই। বাড়ির বাইরে কাজ করতেই হয়; খুব যন্ত্রণা হয়,” বলছেন তিনি। সারুর মতে এটা দ্বিচারিতা ছাড়া কিছু নয়, “কিন্তু এটা বন্ধই বা করা যায় কেমনভাবে? আমি জানি না।”
আশাকর্মীর কাজ করে মাসে ২,০০০-২,৫০০ টাকা পান সারু, কিন্তু দেশের আরও হাজার হাজার আশাকর্মীর মতোই ঠিক সময়ে বেতন হাতে আসে না তাঁর। পড়ুন: সুস্থতায় অসুস্থতায় সর্বদা গ্রামের সেবায় । “৩-৪ মাস পর পর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা এসে পৌঁছায়,” জানালেন তিনি।
সারু এবং তাঁর মতো মহিলাদের ক্ষেত্রে এই প্রথা অত্যন্ত ক্ষতিকর। দেশের সবচেয়ে অনুন্নত জেলাগুলির মধ্যে অন্যতম গড়চিরোলির অধিকাংশ গ্রামেই আদিম কুর্মা প্রথা পালিত হয়। এই জেলার জনসংখ্যার ৩৯ শতাংশ মাড়িয়া-সহ বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী। জেলার প্রায় ৭৬ শতাংশ ভূমি অরণ্যাবৃত, আর প্রশাসনিক পরিভাষায় তার তকমা ‘অনগ্রসর’। পাহাড়ি এলাকাগুলিতে সেনা ও আধা-সেনা ঘন ঘন টহল দিয়ে থাকে, কারণ একাধিক নিষিদ্ধ মাওবাদী সংগঠন এখানে সক্রিয়।
গড়চিরোলি জেলায় কতগুলি গ্রামে কুর্মা প্রথা পালিত হয় সে বিষয়ে কোনও সমীক্ষায় কোনও হদিশ নেই। “এখনও পর্যন্ত আমরা এমন ২০টা গ্রামে পৌঁছতে পেরেছি যেখানে এই প্রথা পালিত হয়,” জানালেন সমাজবন্ধের প্রতিষ্ঠাতা শচীন আশা সুভাষ – ২০১৬ সাল থেকে গড়চিরোলির ভামরাগড় তালুকে কাজ করছে অলাভজনক সংগঠনটি। সমাজবন্ধের স্বেচ্ছাকর্মীরা আদিবাসী মেয়েদের ঋতুচক্রের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস তৈরি বিষয়ে সচেতন করেন, বয়স্ক নারী-পুরুষদেরকে কুর্মা প্রথা মেয়েদের স্বাস্থ্যের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর তা বোঝানোর চেষ্টাও করেন।
কাজটা সহজ নয়, মেনেই নিচ্ছেন শচীন। এইসব সচেতনতা প্রসার কর্মসূচি এবং কর্মশালাগুলি চালাতে গিয়ে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁদের। “হঠাৎ করে ওঁদের কুর্মা প্রথা বন্ধ করে দিতে বলাটা কঠিন। ওঁরা বলেন, এটা আমাদের সংস্কৃতির ব্যাপার, বহিরাগতরা এতে নাক গলাবে না।” গ্রামের বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি, যেমন ভুমিয়া বা মোড়ল আর পারমা বা প্রধান পুরোহিতদের হুমকি ও শাসানির মুখে পড়েছেন তাঁরা। “আমরা যতটা সম্ভব ওঁদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে চেষ্টা করি, কারণ এই সিদ্ধান্তে মেয়েদের কোনও মতামতই গ্রাহ্য করা হয় না,” ব্যাখ্যা করলেন শচীন।
দীর্ঘদিনের চেষ্টায় কিছু ভুমিয়াকে কুর্মাঘরগুলিতে বিদ্যুৎ, জল, টেবিল ফ্যান ও বিছানা জোগান দিতে রাজি করাতে পেরেছেন শচীন ও তাঁর স্বেচ্ছাকর্মীরা। মেয়েরা যাতে নিজেদের ঘরে তালাবন্ধ তোরঙ্গের ভিতরে নিজেদের কাপড়ের প্যাড রাখতে পারেন তার জন্য সম্মতিও তাঁরা জোগাড় করেছেন কিছু ক্ষেত্রে। “কিছু ভুমিয়া লিখিতভাবে এইসব ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন। কিন্তু যে মেয়েরা কুর্মাঘরে যেতে চান না তাঁদের একঘরে না করার সম্মতি পেতে আমাদের আরও অনেকদিন লাগবে।”
*****
বেজুরে, ১০ ফুট বাই ১০ ফুটের এক কুর্মাঘরে বিছানা পাতছেন পার্বতী। “এখানে থাকতে ভালো লাগে না,” ১৭ বছরের কিশোরীর গলা বিচলিত শোনায়। ৩৫টি পরিবার আর দুশোরও কম জনসংখ্যার বেজুর ভামরাগড় তালুকের ছোট্ট একটি গ্রাম। তবে এখানকার মেয়েরা জানাচ্ছেন, গ্রামে নয়টি কুর্মাঘর আছে।
রাতে দেওয়ালের একটা ফাটল দিয়ে একফালি চাঁদের আলো এসে পড়ে – কুর্মাঘরে থাকাকালীন এইটুকুই পার্বতীর মনে আনে সামান্য স্বস্তি। “রাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। জঙ্গল থেকে জন্তু-জানোয়ারের আওয়াজ আসে, ভয় করে,” বলছেন পার্বতী।
কুঁড়েঘর থেকে ২০০ মিটারেরও কম দূরত্বে তাঁর নিজের শক্তপোক্ত একতলা পাকা বাড়ি, সেখানে বিদ্যুৎ আছে। “বাড়িতে নিরাপদ লাগে, এখানে নয়। কিন্তু বাবা-মা সমাজের নিষেধের ভয় পান,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন পার্বতী। “কোনও উপায় নেই। গ্রামের লোকে এইসব নিয়ম নিয়ে খুব কড়াকড়ি করে,” জানালেন তিনি।
পার্বতী ভগবন্তরাও আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী, বেজুর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে গড়চিরোলির এটাপল্লি তালুকে অবস্থিত। সেখানে হোস্টেলে থাকেন তিনি, ছুটিছাটায় বাড়ি আসেন। “কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না,” বলছেন তিনি। “গরমকালে এখানে প্রচণ্ড গরম পড়ে, এই ছোট্ট ঘরে সারারাত ঘাম হয় আমার।”
কুর্মাঘরে মেয়েদের যে সব অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়, জল আর শৌচাগারের অভাব তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো। শৌচ করতে পার্বতীকে কুঁড়ের পিছনের ঝোপঝাড়ে যেতে হয়। “রাতে একেবারে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার থাকে, একা একা যেতে নিরাপদ লাগে না। দিনের বেলা আবার পথচারীদের খেয়াল রাখতে হয়,” বলছেন পার্বতী। তাঁর বাড়ি থেকে সাফ-সাফাইয়ের জন্য এক বালতি জল দিয়ে যাওয়া হয়, আর খাওয়ার জল রাখা হয় স্টিলের একটি কলসিতে। “কিন্তু স্নান করতে পারি না,” জানালেন তিনি।
কুঁড়ের বাইরে একটা মাটির উনুনে রান্না করেন তিনি। ঘরের ভিতর অন্ধকারে রান্না করা কঠিন, বলছেন তিনি। “বাড়িতে সাধারণত লংকাগুঁড়ো আর নুন দিয়ে ভাত খাই। সঙ্গে পাঁঠার মাংস, মুরগি, নদীর মাছ…” রোজকার খাবারের তালিকা দেন পার্বতী। মাসিকের সময়ে সেই তালিকায় কোনও পরিবর্তন হয় না, কিন্তু এইবেলা রান্নাটা তাঁকে পুরোটাই নিজেকে করতে হয়। “বাড়ি থেকে এই দিনগুলোর জন্য আলাদা বাসন পাঠানো হয়,” জানালেন তিনি।
কুর্মাঘরে থাকার সময় বন্ধু, প্রতিবেশী, বা বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ। “দিনের বেলা কুঁড়ে ছেড়ে বেরনো, গ্রামে এদিক-ওদিক যাওয়া, কারও সঙ্গে কথা বলা – সব বারণ,” নিষেধের তালিকা গুনে গুনে বলছেন পার্বতী।
*****
ঋতুমতী মেয়েদের অস্পৃশ্য বলে দাগিয়ে একঘরে করে দেওয়ার এই প্রথার কারণে ভামরাগড়ে একাধিক দুর্ঘটনা, এবং মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। “গত পাঁচ বছরে চারজন মহিলা কুর্মাঘরে থাকাকালীন সাপ বা বিছের কামড়ে মারা গেছেন,” জানাচ্ছেন ভামরাগড়ের শিশুকল্যাণ প্রকল্প অফিসার (চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট অফিসার বা সিডিপিও) আর. এস. চহ্বান। রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের প্রতিনিধি তিনি।
জরাজীর্ণ কুর্মাঘরগুলির পরিবর্তে ২০১৯ সালে জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে সাতটি ‘বাড়ি’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, জানালেন চহবান। এই প্রতিটি ঘরে এক সময়ে ১০ জন করে ঋতুমতী মহিলা থাকতে পারবেন। গোলাকৃতি বাড়িগুলিতে বায়ু চলাচলের জন্য জানলা আছে; সেখানে শৌচাগার, বিছানা, কলের জল, বিদ্যুৎ সবই থাকার কথা।
২০২২ সালের জুন মাসে একটি সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে গড়চিরোলিতে কুর্মাঘরগুলির বিকল্প হিসেবে ২৩টি ‘মেয়েদের বিশ্রামাগার’ বা মহিলা বিসভা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তায় এবং ইউনিসেফ মহারাষ্ট্রের তরফে প্রদত্ত কারিগরি সহযোগিতায় আগামী দুই বছরে এমন মোট ৪০০টি কেন্দ্র খোলার পরিকল্পনা করছে জেলা প্রশাসন।
কিন্তু ২০২৩ সালে ভামরাগড় তালুকের তিনটি গ্রাম কৃষ্ণর, কিয়ার আর কুমারগুড়ায় গিয়ে পারি দেখেছে এখানকার তিনটি কুর্মাঘরের একটিও সম্পূর্ণ হয়নি, এবং কোনওটিই বাসযোগ্য নয়। সিডিপিও চহ্বান বলতে পারলেন না সাতটি কুর্মাঘরের কোনওটি আদৌ বাসযোগ্য আছে কিনা। তাঁর কথায়, “এরকম স্থির করে বলা মুশকিল। হ্যাঁ, রক্ষণাবেক্ষণ ভালোমতো হয় না। আমি নিজে দেখেছি দুয়েকটার অবস্থা খুব খারাপ। কিছু জায়গায় কাজ শেষ হয়নি তহবিলের অভাবে।”
প্রশ্নটা হল, এমন একটা বিকল্প আদৌ কেমনভাবে কুর্মা প্রথা বন্ধ করতে সাহায্য করবে? “এটাকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলা দরকার,” বলছেন সমাজবন্ধের শচীন আশা সুভাষ। “সরকারি কুর্মাঘর কোনও সমাধান নয়। একদিক দিয়ে দেখলে এটা বরং এই প্রথাকেই ইন্ধন দেয়।”
ভারতীয় সংবিধানের ১৭ নম্বর ধারায় সবধরনের অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধ; সেই হিসেবে ঋতুকালীন নির্বাসন অসাংবিধানিকও বটে। ২০১৮ সালে কেরালা সরকার বনাম ইন্ডিয়ান ইয়ং লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল : “ঋতুকালীন পরিস্থিতির ভিত্তিতে মেয়েদের সামাজিকভাবে বর্জন করা অস্পৃশ্যতারই একটা রূপ, যা সাংবিধানিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিরোধী। ‘বিশুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা’র ধারণা, যা ব্যক্তিমানুষের উপর কলঙ্কলেপন করে, একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থায় তার কোনও জায়গা নেই।”
কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বৈষম্যমূলক কুর্মা প্রথা বহাল তবিয়তে টিকে আছে।
“এটা ভগবানের ব্যাপার। আমাদের ভগবান চান আমরা [এই প্রথা] মেনে চলি, আর আমরা তার অন্যথা করলে ফল ভোগ করতে হবে,” বলছেন লক্ষ্মণ হোয়ামি, ভামরাগড় তালুকের গোলাগুডা গ্রামের পারমা বা বংশানুক্রমিক প্রধান পুরোহিত। “আমরা নানা সমস্যায় পড়ব, মানুষের ক্ষতি হবে। রোগবালাই বাড়বে, আমাদের ভেড়া-মুরগি মরে যাবে… এটা আমাদের প্রথা। আমরা একে অমান্য করতে পারি না, নাহলে শাস্তি হিসেবে খরা, বন্যা, বা কোনও দুর্যোগ নেমে আসবে আমাদের উপর। এই প্রথা বরাবর চলবে…” দৃঢ় গলায় ঘোষণা করলেন তিনি।
হোয়ামির মতো অনেকেই কুর্মা প্রথা চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর, কিন্তু রুখে দাঁড়াচ্ছেন কিছু অল্পবয়সি মেয়ে। যেমন কৃষ্ণর গ্রামের ২০ বছর বয়সি অশ্বিনী ভেলাঞ্জে। “আমি একটাই শর্তে বিয়ে করেছিলাম, যে আমি কুর্মা প্রথা অনুসরণ করব না, ওটা বন্ধ করতে হবে,” বলছেন অশ্বিনী। ২০২১ সালে দ্বাদশ শ্রেণির পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেছেন তিনি। চলতি বছরের মার্চ মাসে ২২ বছরের অশোককে বিয়ে করেছেন তিনি এই শর্তে রাজি হওয়ার পরেই।
১৪ বছর বয়স থেকে কুর্মা পালন করতে শুরু করেন অশ্বিনী। “বাবা-মার সঙ্গে ঝগড়া করতাম, কিন্তু সমাজের চাপের মুখে ওঁরা অসহায় ছিলেন,” বলছেন তিনি। বিয়ের পর থেকে অশ্বিনী মাসিকের দিনগুলি বাড়ির বারান্দায় কাটান। পরিবারের দিকে ধেয়ে আসা সব কুকথা সহ্য করেও এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। “কুর্মাঘর থেকে বারান্দা পর্যন্ত এসেছি; এবার মাসিকের সময়ে ঘরের ভিতরেও ঢুকে আসব,” বলছেন অশ্বিনী। “নিজের ঘরে অন্তত পরিবর্তনটুকু আনব আমি।”
অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী