মাঝৌলি গ্রামে এক দুপুরবেলায় সুকালো গোণ্ড তাঁর ইট-মাটির বাড়ির সামনে একখানা খাটিয়াতে বসে ঠাট্টা করে বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের আমাদের সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করার রায়টা উদযাপন করতে ৫ মার্চ আমরা রবার্টসগঞ্জে আমাদের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে গেলাম।”
তিনি আসলে বলছেন ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯-এর সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী আদেশটির কথা, যেটির জেরে উৎখাত হয়েছেন ভারতের ১৬টিরও বেশি রাজ্যের ১০ লক্ষেরও বেশি আদিবাসী। এর মূলে ছিল বন অধিকার আইন (এফআরএ)-এর ন্যায্যতা সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলা বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ নিয়ে কর্মরত কিছু গোষ্ঠীর জমা দেওয়া একটি দরখাস্ত। ২০০৬ সালের এফআরএ-র উদ্দেশ্য ছিল বনবাসী সম্প্রদায়গুলিকে তাদের প্রজন্মলালিত জমির অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, আর তাদের প্রতি ঐতিহাসিকভাবে ঘটে চলা সামাজিক অন্যায়গুলোর একটা মীমাংসার প্রচেষ্টা।
“ডিএমের অফিসে যাওয়াটা জরুরি ছিল,” নাতি-নাতনি পরিবেষ্টিত সুকালো বললেন। “একে অপরের পাশে, ও অন্যান্য বনবাসী সম্প্রদায়গুলির পাশেও দাঁড়াতে হবে আমাদের। [কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আপিল করার পর] সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দিলেও এখনও আমাদের সমানে বুঝিয়ে যেতে হয় যে আমরা নিজেদের অধিকারগুলো চেয়ে নিতে ভয় পাই না।” হাসেন তিনি। “আমরা প্রায় ৩০ জন ডিএমের অফিসে ঢুকে পড়েছিলাম, কিন্তু উনি রেগেও যাননি, আমাদের চলে যেতেও বলেননি। বলেছিলেন পরে এসে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে। হয়তো নতুন এসেছিলেন বলে।”
আমার সঙ্গে সুকালো গোণ্ডের প্রথম আলাপ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তর প্রদেশের রবার্টসগঞ্জে, অখিল ভারত বনজীবী ইউনিয়নের (অল ইন্ডিয়া ইউনিয়ন অব ফরেস্ট ওয়ার্কিং পিপল)-এর অফিসে ( পড়ুন ‘ আমি জানতাম সেদিন আমাকে জেলে ঢোকাবে...’ ) । এই সংগঠন (আদতে ১৯৯৬ সালে গঠিত অরণ্যজীবী ও বন শ্রমিকদের জাতীয় সংঘ) প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৩ সালে। প্রায় ১৫টি রাজ্য জুড়ে এই সংগঠনের সদস্যসংখ্যা প্রায় ১৫০০০০। উত্তর প্রদেশের ১৮টি জেলায় প্রায় ১০০০০ জন সদস্য নিয়ে এই ইউনিয়ন চলে।
২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী আদেশের জেরে ভারতের ১৬টিরও বেশি রাজ্য থেকে বিতাড়িত হওয়ার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন ১০ লক্ষেরও বেশি আদিবাসী
এখন ৫০-এর কোঠায় দাঁড়িয়ে সুকালো আর সংগ্রাম প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। ২০০৬ সালে তিনি ইউনিয়নে যোগ দেন, আর তখন থেকেই তিনি তার কোষাধ্যক্ষ। ইউনিয়নের একটি প্রধান লক্ষ্য হল সম্প্রদায়গুলি এফআরএ ব্যবহার করে নিজেদের জমির অধিকারের দাবি জানাচ্ছে কিনা তা সুনিশ্চিত করা।
২০১৫ সালের জুন মাসে কানহার সেচ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হওয়ার অপরাধে এক মাসের উপর জেলে ছিলেন সুকালো। ৮ জুন, ২০১৮ সালে তাঁকে ফের গ্রেফতার করা হয়, বছর তিরিশের কিসমৎ গোণ্ড ও ৫০-এর কোঠায় পৌঁছানো শুকদেব গোণ্ডের সঙ্গে।
এঁদের সকলেই ইউনিয়নের সদস্য ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। লখনউ বনবিভাগের অফিসারদের সঙ্গে মিটিং করে ফেরার পথে চোপান রেলস্টেশনে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। ১০টিরও বেশি কেস দেওয়া হয় তাঁদের বিরুদ্ধে, আইপিসি (শান্তি ব্যাহত করার উস্কানি) ধারা ৫০৪ সমেত। দিনের শেষে সুকালো আর কিসমৎকে পাঠানো হয় মির্জাপুর জেলে, আর শুকদেবকে সোনভদ্রা জেলে। কিসমৎ ও শুকদেবকে সেপ্টেম্বরে ছেড়ে দেওয়া হলেও, সুকালো ছাড়া পান ২০১৮ সালের নভেম্বরে।
“এইবারে জেলে ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। আমি জানতাম এটাই হবে, কিন্তু রেগে গিয়েছিলাম খুব। আমার সারা শরীর রাগে জ্বলছিল। আমাকে একজন সাধারণ আসামীর মতোই দেখছিল ওরা! সব মিথ্যে কেস ছিল। জানি আমাদের ভয় পাওয়ানোর জন্যই পুলিশ এটা করেছিল। আমি ন্যায়ের পথেই নিজের অধিকারের জন্য লড়ছি – এতে ভুলটা কোথায়? জেলের খাবার খাইনি আমি। বন্ধুরা যা ফল-টল আর জলখাবার নিয়ে আসত দেখা করার সময়, সেগুলোই শুধু খেতাম।”
তখনই শুকদেব আর কিসমৎ সুকালোর বাড়ি এলেন, তাঁদের বন্ধু নন্দু গোণ্ডকে নিয়ে কথা বলতে, পাঁচ দিন আগে গ্রেফতার হয়েছেন যিনি। তখনও তাঁরা জানতেন না ওঁকে কোন পুলিশস্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাই চিন্তা করছিলেন। হয়তো সম্প্রদায়ের মানুষদের এফআরএ ব্যবহার করতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন বলেই তাঁকে গ্রেফতার করা হল। সুকালো পরামর্শ দিচ্ছিলেন কাকে ফোন করা যায়, কেমন করে ‘ফোন ট্রি’ তৈরি করা যায় একের পর এক মানুষকে ফোন করে, কেন ব্যাপারটা নিয়ে লেগে থাকা দরকার। (নন্দু গোণ্ড পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।)
শুকদেব বলছিলেন জেলে থাকাটা কতখানি বিভীষিকাময়। “গ্রেফতার হওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগেই আমরা ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলাম। গ্রামের অন্যদের থেকে গল্প শুনে শুনে আমি ভয়ে ছিলাম, যদি আমাদেরও পেটানো হয়। ভালো করে খেতে দিত না ওরা।”
কিসমৎ বলছিলেন তাঁর জন্য ব্যাপারটা কিছুটা হলেও সহনীয় ছিল কারণ সুকালোও ছিলেন সেখানে, কিন্তু সন্তানদের জন্য মন কেমন করত তাঁর। “আমি জানতাম না সামনে কেমন দিন আসতে চলেছে, তবে সুকালোদিদি একেবারে শান্ত ছিলেন, আর আমরাও তাই। তবুও আমি ভেবেই যাচ্ছিলাম – কোনওদিন কি জেল থেকে ছাড়া পাব আমরা? কতদিন ওরা এখানে রাখবে আমাদের?”
তাঁরা নন্দুর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ করে চলে যান। লক্ষ্য করি সুকালো অনেকক্ষণ ফোন নিয়ে কাজ করেন, ইউনিয়নের সদস্যদের একজোট করার চেষ্টা করেন, নানা প্রশ্নের উত্তর দেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। সম্প্রদায়ের মানুষরা আধার কার্ড বা রেশন সংগ্রহ সংক্রান্ত কথা বলতেও ফোন করেন তাঁকে।
সুকালো বলেন ঘর-সংসার সামলে সংগ্রামের কাজ চালিয়ে যাওয়াটা মাঝে মাঝে ক্লান্তিকর হয়ে উঠতে পারে। “কিন্তু ইউনিয়নের কাজটা হওয়াটাও প্রয়োজন,” তিনি আরও বলেন, “যদিও এখন আমাকে বেশি এদিক-ওদিক করতে হয়, সন্তানদের নিয়ে চিন্তা তো হয়-ই।”
২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট পিটিশন অর্ডারটিকে স্থগিতাদেশ দেয়। রাজ্য সরকারগুলিকে বলে বন অধিকার আইনের আওতায় আদিবাসী পরিবারগুলির দাবি সম্বন্ধে রিপোর্ট পেশ করতে। এতে তাও কিছুটা স্বস্তি মেলে।
২৪ জুলাই, বুধবার সুপ্রিম কোর্টে আবার এই উচ্ছেদের বিষয়ে শুনানির কথা আছে।
সুকালো জানেন, সামনের রাস্তাটা বেশ লম্বা। “আমরা ফল খাব বলে গাছ পুঁতেছি, ব্যাপারটা এমন নয়। যারা আমাদের এই কঠিন পরিশ্রমের ফল ভোগ করবে তারা এখনও আসেনি। আমার নাতি-নাতনি তারা, আর তাদের জন্যই আমি এই কাজ করে চলেছি।”
অনুবাদ: শ্রীপূর্ণা মজুমদার