২৩ বছর বয়সি ভারতী কাস্তের কাছে তাঁর পরিবারের চেয়ে বড়ো কিছু ছিল না। দশম শ্রেণির পর স্কুল ছেড়ে দিয়ে কাজ করতে শুরু করেন যাতে তার বোনেরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। একটি সংস্থায় সহায়িকার কাজ করতেন, উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন যাতে বাবা আর দাদার ভার কিছুটা লাঘব হয়। পরিবারের মঙ্গল ছাড়া আর কিছু নিয়েই তাঁর চিন্তা ছিল না। তবে সেটা ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত।
তার পর থেকে চিন্তা করার জন্য তাঁর কাছে আর পরিবারই নেই।
১৩ মে ২০২১ তারিখ রাতে নিখোঁজ হয়ে যান মধ্যপ্রদেশের দেওয়াস জেলার নেমাওয়ার গ্রামের বাসিন্দা ভারতীর পরিবারের পাঁচ সদস্য। দুই বোন রুপালি, (১৭) ও দিব্যা (১২), মা মমতা (৪৫), এবং তুতো ভাইবোন পূজা (১৬) আর পবন (১৪)। তাঁর কথায়, “কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। একদিন কেটে যাওয়ার পরেও যখন ওরা বাড়ি ফিরল না প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
থানায় নিখোঁজের অভিযোগ দায়ের করেন ভারতী, তদন্ত শুরু হয়।
একদিন, দুইদিন, তিনদিন কেটে যায় – কেউ বাড়ি ফেরে না। এক-একটা দিন যায় আর ভারতীর ভয় বাড়ে। বুকের উপর পাথরের মতো চেপে বসতে থাকে দুশ্চিন্তা, শুনশান ঘরের নিস্তব্ধতা যেন গিলে খেতে আসে।
চরম কোনও পরিণতির আশঙ্কা আরও দৃঢ়বদ্ধ হয়।
২৯ জুন ২০২১ তারিখে, তাঁরা নিখোঁজ হওয়ার পুরো ৪৯ দিন পর পুলিশের তল্লাশি শেষ হয়। গ্রামের প্রভাবশালী রাজপুত জাতির এক অন্যতম হর্তাকর্তা সুরেন্দ্র চৌহানের মালিকানাধীন এক চাষজমি থেকে খুঁড়ে বার করা হয় পাঁচজনের শবদেহ। চৌহান নানা দক্ষিণপন্থী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, এবং এলাকার বিজেপি বিধায়ক আশিস শর্মার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
“ভিতরে ভিতরে এই আশঙ্কাটা ছিলই, কিন্তু তাও খবরটা যখন এল, প্রবল ধাক্কা খেয়েছিলাম,” জানাচ্ছেন গোণ্ড আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্য ভারতী। “একরাতের মধ্যে পরিবারের পাঁচজনকে হারানোর যন্ত্রণা ঠিক কেমনভাবে বর্ণনা করা যায় জানি না। আমরা সবাই একটা অলৌকিক কিছুর আশায় বসেছিলাম।”
একটি রাতের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন নেমাওয়ারের এক আদিবাসী পরিবারের পাঁচজন মানুষ।
হত্যাকাণ্ডের দায়ে সুরেন্দ্র এবং আরও ছয়জন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
*****
মধ্যপ্রদেশে আদিবাসী জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২১ শতাংশ, এর মধ্যে পড়ে গোণ্ড, ভীল এবং সহরিয়া-সহ নানান আদিবাসী গোষ্ঠী। রাজ্যের জনসংখ্যার একটা বড়ো অংশ হওয়া সত্ত্বেও নিরাপদ নন তাঁরা: ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া ২০২১ রিপোর্ট বলছে ২০১৯-২০২১ সালের সময়কালের তফসিলভুক্ত জনজাতিদের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনায় সর্বোচ্চ স্থানে আছে মধ্যপ্রদেশ।
২০১৯ সালে তফসিলি জনজাতিগুলির বিরুদ্ধে হিংসার ১৯২২টি ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে, যা দু’বছর পর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬২৭টি। সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে এটা ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি, এই কালখণ্ডে এইধরনের হিংসা বৃদ্ধির জাতীয় গড় ১৬ শতাংশের প্রায় দ্বিগুণ।
২০২১ সালে সারা ভারতে মোট ৮৮০২টি তফসিলি জনজাতির বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে – তার মধ্যে ২৬২৭টি ঘটনা, অর্থাৎ ৩০ শতাংশ ঘটেছে মধ্যপ্রদেশে। অন্যভাবে বললে, দিনপ্রতি সাতটি করে ঘটনা। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাগুলিই শুধু শিরোনামে উঠে এসেছে, রোজকার দমন-পীড়নের ঘটনাগুলির বেশিরভাগই নথিভুক্ত হয় না।
জাগ্রিত আদিবাসী দলিত সংগঠনের নেত্রী মাধুরী কৃষ্ণমূর্তি জানাচ্ছেন, মধ্যপ্রদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলির উপরে হিংসার পরিমাণ এতটাই বেশি যে সংগঠনগুলির পক্ষেও হিসেব রাখা মুশকিল হয়ে যায়। “যে বিষয়টা তাৎপর্যপূর্ণ, সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাগুলির বেশিরভাগই ঘটছে শাসকদল বিজেপির নেতাদের রাজনৈতিক ঘাঁটিগুলিতে,” জানাচ্ছেন তিনি।
চলতি বছরের জুলাই মাসে রাজ্যের সিধি জেলার একটি চরম অস্বস্তিজনক ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়: প্রবেশ শুক্লা নামের এক মদ্যপ ব্যক্তি এক আদিবাসী পুরুষের গায়ে প্রস্রাব করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার অব্যবহিত পরে স্থানীয় বিজেপি নেতা শুক্লাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
যেসব ঘটনার এমন গণরোষ উদ্রেককারী ভাইরাল ভিডিও নেই, সেখানে কিন্তু আইনের হাত এত দ্রুত নড়ে না। “আদিবাসী গোষ্ঠীগুলি প্রায়শই বাস্তুচ্যুত হতে থাকে, অথবা নিজেরা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে চলে যায়,” জানালেন তিনি। “এই বিষয়টা তাঁদের সহজ নিশানা করে তোলে। তারপর আইনের ফাঁক গলে শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলি তাঁদের উপর সহজেই দমন-পীড়ন চালাতে পারে।”
নেমাওয়ারে ভারতীর পরিবারের হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ভারতীর বোন রুপালির সঙ্গে হত্যাকারী সুরেন্দ্রর প্রেমজ সম্পর্ক।
তাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্কে আচমকাই ছেদ পড়ে যখন সুরেন্দ্র ঘোষণা করে যে সে অন্য একজন মহিলাকে বিয়ে করতে চলেছে। রুপালি হতভম্ব হয়ে গেছিল। “ও রুপালিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে রুপালির বয়স ১৮ পেরোলেই ওরা বিয়ে করবে,” জানাচ্ছেন ভারতী। “কিন্তু আসলে ও শুধু শারীরিক সম্পর্ক করতে চেয়েছিল। ও রুপালিকে ব্যবহার করে, তারপর অন্য কাউকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়।”
ক্ষুব্ধ, আহত রুপালি হুমকি দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায় সুরেন্দ্রর কীর্তিকলাপ ফাঁস করে দেবে সে। এক সন্ধ্যায় সুরেন্দ্র রুপালিকে ওর খেতে আসতে বলে, কথাবার্তা বলে বিষয়টা মিটিয়ে নিতে চায় এই বলে। পবন রুপালির সঙ্গে যায়, কিন্তু সুরেন্দ্রর এক বন্ধু ওকে কিছুটা দূরে থামিয়ে দেয়। জমির ভিতরে একটা শুনশান জায়গায় সুরেন্দ্র লোহার রড নিয়ে অপেক্ষা করছিল। রুপালি যেই সেখানে পৌঁছায়, রড দিয়ে মাথায় আঘাত করে তাকে হত্যা করে সুরেন্দ্র।
এরপর সুরেন্দ্র পবনকে মেসেজ করে যে রুপালি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে এবং ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। পবনকে বাড়ি থেকে রুপালির মা ও দিদিকেও নিয়ে আসতে নির্দেশ দেয়। সুরেন্দ্রর আসল পরিকল্পনা ছিল রুপালিকে সে ডেকেছে এই কথাটা যে যে জানে তাদের সবাইকে হত্যা করার। একে একে সুরেন্দ্র সবাইকে খুন করে ওই খেতজমিতে পুঁতে দেয়। “এটা কোনও কারণ হতে পারে একটা গোটা পরিবারকে খুন করার?” প্রশ্ন ভারতীর।
শবগুলি যখন খুঁড়ে তোলা হয়, রুপালি ও পূজার দেহে কাপড় ছিল না। “আমাদের সন্দেহ, খুন করার আগে ওদের ধর্ষণ করা হয়েছিল,” জানালেন ভারতী। “আমাদের জীবন তছনছ হয়ে গেছে।”
সাম্প্রতিকতম এনসিআরবি তথ্য জানাচ্ছে, ২০২১ সালে মধ্যপ্রদেশে ৩৭৬টি ধর্ষণের ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে – দিনে একটিরও বেশি – আর তার মধ্যে ১৫৪ জন নাবালিকা।
“আমাদের ধনদৌলতের জীবন ছিল না বটে, কিন্তু পরস্পরের সঙ্গটুকু অন্তত ছিল,” বলে ওঠেন ভারতী। “পরস্পরের জন্য আমরা জান লড়িয়ে দিতাম।”
*****
উঁচু জাতের হাতে আদিবাসীদের দমন-পীড়ন নানা কারণে সংঘটিত হয়। আদিবাসীদের আক্রমণ করার একটা সাধারণ অজুহাত হল জমি নিয়ে টানাটানি। সরকার থেকে যখন আদিবাসীদের জমি দেওয়া হয় তাঁরা আর জীবনধারণের জন্য জমিমালিকদের উপর নির্ভরশীল থাকেন না, আর সেটা গ্রামসমাজে উঁচু জাতের চিরাচরিত ক্ষমতার অবস্থানে চিড় ধরায়।
২০০২ সালে দিগ্বিজয় সিং মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন প্রায় ৩.৫ লক্ষ ভূমিহীন দলিত ও আদিবাসীকে জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তাঁদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে। পরবর্তী বছরগুলিতে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ জমির পাট্টা এবং অন্যান্য কাগজপত্রও হাতে পেয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমির বাস্তব মালিকানা রয়ে গেছে উঁচু জাতের জমিমালিকদের হাতেই।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলি থেকে যখনই কেউ নিজেদের অধিকার জানাতে গেছে, মাশুল গুণতে হয়েছে প্রাণের বিনিময়ে।
২০২২ সালের জুন মাসের শেষ দিকে গুনা জেলার ধানোরিয়া গ্রামে রামপেয়ারি সেহরিয়ার জমি জরিপ করতে পৌঁছায় প্রশাসন। প্রায় দুই দশকের লড়াই শেষে যখন আধিকারিকরা তাঁর জমির সীমানা নির্ধারণ করে দেন, রামপেয়ারির স্বপ্ন সত্যি হল বলে হয়ে হয়েছিল।
সমস্যা হল, ওই জমির মালিকানা ছিল গ্রামের দুই উঁচু জাত ধাকড় এবং ব্রাহ্মণ জাতের দুই পরিবারের হাতে।
২ জুলাই ২০২২ তারিখে তিন একরের জমিটা দেখতে যাওয়ার পথে উত্তেজনায় ফুটছিলেন রামপেয়ারি; অবশেষে নিজেকে জমি মালিক বলতে পারেন তিনি! কিন্তু জমিতে পৌঁছে তিনি দেখেন, ওই দুই উঁচু জাতের পরিবারের লোকজন সেখানে ট্র্যাক্টর চালাচ্ছে। রামপেয়ারি তাঁদের জমি খালি করতে বলেন, বচসা শুরু হয়ে যায়। বচসার শেষ হয় আযখন রামপেয়ারিকে বেধড়ক পিটিয়ে তাঁর গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয় তারা।
“আমরা যখন ঘটনা জানতে পারি, ওর স্বামী অর্জুন তড়িঘড়ি ছুটে গিয়ে দেখে স্ত্রী দগ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে,” জানালেন অর্জুনের কাকা ৭০ বছর বয়সি যমনলাল। “সঙ্গে সঙ্গে ওকে গুনার জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাই আমরা, সেখান থেকে ওকে ভোপালে রেফার করা হয় কারণ ওর অবস্থা সঙ্কটজনক ছিল।”
ছয় দিন পর মারা যান রামপেয়ারি। মাত্র ৪৬ বছর বয়স ছিল তাঁর। স্বামী ও চার সন্তান আছেন বাড়িতে, সবাই বিবাহিত।
সেহরিয়া আদিবাসী গোষ্ঠীর পরিবারটির মূল জীবিকা ছিল দিনমজুরি। “আমাদের উপার্জনের আর কোনও রাস্তা ছিল না,” ধানোরিয়ার এক জমিতে সোয়াবিন কাটাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে জানালেন যমনলাল। “জমিটা যখন শেষ অবধি হাতে এল, ভেবেছিলাম অন্তত নিজেদের খাবারটুকু ওখানে চাষ করে নিতে পারব।”
ঘটনার পর রামপেয়ারির পরিবার ধানোরিয়া ছেড়ে চলে গেছে। যমনলাল এখনও গ্রামে আছেন, কিন্তু অন্যদের ঠিকানা দিতে তিনি অপারগ। “আমরা সবাই এই গ্রামে জন্মেছি, কিন্তু একা আমিই এখানে মরব। আমার মনে হয় না অর্জুন আর ওর বাবা আর কোনওদিন ফিরবে।”
রামপেয়ারির হত্যায় পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে। পুলিশ এক্ষেত্রে তৎপর হয়েই পদক্ষেপ করেছিল।
*****
কেউ অত্যাচার করলে, আক্রান্তরা প্রশাসনের কাছে যান ন্যায়ের আশায়। কিন্তু চৈন সিংকে মেরেছিল রাজ্য প্রশাসনই।
২০২২ সালের অগস্টের একদিন মধ্যপ্রদেশের বিদিশা জেলার রায়পুরা গ্রামের কাছে একটি জঙ্গল থেকে বাইকে করে বাড়ি ফিরছিলেন চৈন সিং ও তাঁর ভাই মহেন্দ্র সিং। “বাড়ির কাজের জন্য কিছু কাঠ দরকার ছিল,” জানালেন ২০ বছরের মহেন্দ্র। “দাদা বাইক চালাচ্ছিল, আমি কাঠগুলো নিয়ে পিছনে বসেছিলাম।”
বিদিশার ঘন জঙ্গলাকীর্ণ এলাকার উপকণ্ঠে অবস্থিত রায়পুরা, সূর্যাস্তের পর রাস্তা পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যায়। রাস্তার কোনও আলো নেই। উঁচুনিচু রাস্তায় চলতে বাইকের হেডলাইটই ভরসা।
জঙ্গল এলাকার ভিতরের এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা কোনওমতে পেরিয়ে অবশেষে বড়ো রাস্তায় উঠে দম নিয়েছিলেন ভীল জনজাতির চৈন সিং ও মহেন্দ্র। পরমুহূর্তেই দেখতে পান সামনে দুটো জিপ ভর্তি ফরেস্ট গার্ড দাঁড়িয়ে। বাইকের হেডলাইট সটান জিপের উপর গিয়ে পড়ে।
“দাদা সঙ্গে সঙ্গে বাইক থামিয়ে দিয়েছিল,” জানালেন মহেন্দ্র। “কিন্তু একজন ফরেস্ট গার্ড আমাদের দিকে গুলি চালায়। আমাদের তরফে কোনও আক্রমণ করা হয়নি। আমরা শুধু কাঠ নিয়ে যাচ্ছিলাম।”
৩০ বছর বয়সি চৈন সিং তৎক্ষণাৎ মারা যান। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাইক উলটে পড়ে যায়। পিছনে বসা মহেন্দ্রের গায়েও গুলি লাগে। সংগ্রহ করা কাঠ এবং তিনি একইসঙ্গে বাইক থেকে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান। “মনে হচ্ছিল আমিও মরে যাব,” বলছেন মহেন্দ্র। “মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গে ভেসে বেড়াচ্ছি।” এর পরে মহেন্দ্রর জ্ঞান ফেরে সোজা হাসপাতালে।
বিদিশার জেলা বন আধিকারিক ওঙ্কার মাসকোলে জানালেন এই ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত চলছে। “অভিযুক্তকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল তবে সে এখন কাজে ফেরত এসেছে। বিচারবিভাগীয় তদন্তের রিপোর্ট জমা পড়লে আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব,” জানালেন তিনি।
দাদাকে গুলি করেছিল যে ফরেস্ট রেঞ্জার, তার আদৌ সাজা হবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে মহেন্দ্রর। “আশা করব যে ওর কাজের কিছু একটা সাজা ও পাবে,” বলছেন তিনি। “নাহলে কী ধরনের বার্তা দেওয়া হবে? এটাই তো, যে আদিবাসী মানুষকে খুন করাটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার? আমাদের জীবন কি এতটাই ফেলনা?”
এই ঘটনায় বিপর্যয় নেমে এসেছে চৈন সিং-এর পরিবারে; পরিবারের মাত্র দু’জন উপার্জনক্ষম সদস্যের একজন ছিলেন তিনি। অন্যজন মহেন্দ্র নিজে, যিনি এক বছর পরেও খুঁড়িয়ে হাঁটেন। “দাদা নেই, আর আমি আঘাতের কারণে খুব বেশি মজুরির কাজ করতে পারি না,” জানালেন তিনি। “ওর চারটে ছোটো ছোটো বাচ্চা আছে, কে দেখবে তাদের? আমাদের এক একর জমি আছে, ওখানে নিজেদের জন্য চানা ফলাই। কিন্তু গত এক বছরে বাড়িতে কোনও টাকাই আসেনি বলতে গেলে।”
*****
ঘটনার পর থেকে রোজগার করতে পারেননি ভারতীও।
নেমাওয়ার গ্রামে তাঁর পরিবারের হত্যালীলার পর বাবা মোহনলাল আর দাদা সন্তোষকে নিয়ে গ্রাম ছেড়েছেন তিনি। “ওখানে আমাদের কোনও জমি নেই,” জানালেন ভারতী। “শুধু পরিবারই ছিল। এখন পরিবার নেই, আর ওখানে থেকে কী করব? খারাপ স্মৃতি আছে শুধু, তাছাড়া নিরাপদও বোধ করি না।”
এরপর থেকে ভারতীর সঙ্গে মোহনলাল ও সন্তোষের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তাঁরা আর একসঙ্গে থাকেন না। “আমি ইন্দোরে আত্মীয়দের সঙ্গে থাকি, ওরা পিতমপুরে থাকেন,” জানালেন ভারতী। “আমার বাবা ও দাদা মামলা তুলে নিয়ে নতুন করে শুরু করতে চেয়েছিলেন। ওঁরা ভয় পাচ্ছেন হয়তো। কিন্তু আমি চাই যারা আমার পরিবারকে মেরেছে তাদের সাজা হোক। বিচার না পেলে নতুন করে শুরু করব কী করে?”
রুপালি ডাক্তার হতে চেয়েছিল। পবনের স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। ভারতী এককালে রাস্তায় ভিক্ষে পর্যন্ত করেছেন যাতে ভাইবোনের পেটের খাবারটুকু জোটে, আজ তাই ন্যায়বিচার ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে নেমাওয়ার থেকে ভোপাল পায়ে হেঁটে ‘ন্যায় যাত্রা’ করেছেন তিনি। ১৫০ কিলোমিটারের পথ হাঁটতে এক সপ্তাহ লেগেছিল, রাজ্যের বিরোধী দল কংগ্রেস সহায়তা দেয় তাঁকে। মোহনলাল ও সন্তোষ যাত্রায় যোগ দেননি। “ওরা আমার সঙ্গে বিশেষ কথা বলে না,” দুঃখ করছেন ভারতী। “কেমন আছি সেটাও জানতে চায় না।”
মধ্যপ্রদেশ সরকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভারতীর পরিবারকে ৪১ লক্ষ টাকা দিয়েছিল। এটা তিনভাগে ভাগ হয়, ভারতী, মোহনলাল ও সন্তোষ, এবং ভারতীর কাকার পরিবারের মধ্যে। ভারতী এখন সেই টাকাতেই জীবনধারণ করছেন। কাজে মন দিতে পারছিলেন না, তাই চাকরিটা চলে গেছে। পরিবারের দেখাশোনা করতে গিয়ে মাঝপথে স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলেন, এখন সেই শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে চান তিনি। তবে সবই হবে মামলা শেষের পর।
ভারতীর আশঙ্কা, সুরেন্দ্রর রাজনৈতিক পরিচিতির সুবাদে হয়তো মামলা হালকা করে দেওয়ার চেষ্টা হবে। তাই তিনি আপাতত এমন কিছু ন্যায়পরায়ণ এবং কম খরচের আইনজীবীর সন্ধানে আছেন যাঁরা সেটা আটকাতে পারবেন। গত দুই বছরে ভারতীর জীবন আগাগোড়া পালটে গেছে, শুধু একটা বিষয় ছাড়া: আজও নিজের পরিবারের কথাই ভেবে চলেছেন তিনি।
অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী