গাড়িটা যখন থামল, জুয়ারারাম ভাট তখন আধা-প্রস্তুত ঘোড়াটাকে বালিশের মতো মাথায় দিয়ে রাস্তার ধারে ঘুমাচ্ছিলেন। গাড়ির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল তাঁর। ৬০ বছর বয়সি কারিগর ছুটে গেলেন গাড়িতে বসা মানুষটির দিকে। খেলনা ঘোড়াটির উপর বসে দেখালেন কতটা শক্তপোক্ত ওটা। ৩০০ টাকা তো দর হবেই? ক্রেতা অবশ্য কমিয়ে কমিয়ে নিয়ে গেলেন ২০০ টাকায়। অতএব বিকেল চারটে নাগাদ জুয়ারারামের সেদিনকার মতো প্রথম, এবং সম্ভবত শেষ বিক্রিটা সাঙ্গ হল।

যেখানে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন জুয়ারারাম, তার কাছেই তাঁর বাঁশের পোলে তেরপল আর প্লাস্টিকে মোড়া ডেরা। এখানে স্ত্রী বুগলিবাই, দুই ছেলে, তাঁদের স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে থাকেন তিনি। পশ্চিম জয়পুরের আম্বাবারি দরগা এলাকায় আমানিশাহ নালার ব্রিজের কাছে ৪০-৫০টি কুঁড়েঘর আছে, সেগুলিরই একটা তাঁদের এই ডেরা। এখানে বসবাসকারী ভাট (রাজস্থানে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসি হিসেবে চিহ্নিত সম্প্রদায়) পরিবারগুলি শুকনো ঘাস বা খড় দিয়ে হাতি, ঘোড়া, উট ইত্যাদি নানা ঘর সাজানোর জিনিস বানায়।

“সালটা মনে নেই, তবে আমার বাবা-ই জয়পুর থেকে নাগৌর জেলার দিদওয়ানা শহরে আসেন,” জুয়ারারাম বলেন। খেলনা বানানোর প্রক্রিয়ায় তাঁর কাজ খড়ের কাঠামোগুলো বানানো। বারবার সরু বাঁশের কাঠি ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে তিনি গঠনটা শক্তপোক্ত করে তোলেন, দড়ি আর তার দিয়ে খড়গুলো বেঁধে আকৃতি আনেন। এতদূর করে তিনি কাঠামোটা দেন বুগলিবাইকে। তিনি লাল মখমলের কাপড় দিয়ে মুড়ে দেন, তারপর সোনালি জরি বসিয়ে সাজিয়ে তোলেন কাঠামোটি। একটা জিনিস বানানো শেষ করতে তাঁদের লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা।

যে কুঁড়েঘরে বসে তাঁরা কাজ করছেন সেটিই তাঁদের বাড়ি, কারখানা, এবং ‘গুদাম’। এই অস্থায়ী বাড়িটি চারবারেরও বেশি পালটেছেন তাঁরা, প্রতিবারই পুলিশ এবং জয়পুর শহর কর্তৃপক্ষ অবৈধ বলে ভেঙ্গে দিয়েছে তাঁদের বসতি। এখন যেখানে থাকছেন, সেখানে জল মেলে ট্যাংকার এবং কাছেপিঠের দোকান থেকে, সুলভ শৌচাগার বা আমানিশাহ নালার কাছাকাছির জায়গা ব্যবহার করেন শৌচের জন্য, আর বিদ্যুতের জন্য বেশিরভাগ পরিবারের সম্বল ব্যাটারি-চালিত এলইডি লাইট।

ব্রিজের কাছের এই বসতির অন্যান্য সদস্যদের মতো জুয়ারারামের পরিবারেরও হাতেও কখনও জমির মালিকানা ছিল না – তাঁরা প্রায় সবাই রাজস্থানের যোধপুর আর নাগৌর জেলার গ্রাম থেকে এসেছেন। কাঠের পুতুল বানানো এবং পুতুল-নাচের আয়োজন করা তাঁদের চিরাচরিত পেশা ছিল বলে জানালেন জুয়ারারাম, কিন্তু এখন তাঁরা প্রধানত খড় আর জরি দিয়ে ঘর-সাজানোর জিনিসই বানান।

Pooja Bhat has been making dry grass elephants, horses and camels since childhood. 'The lockdown forced us to even beg', she says
PHOTO • Madhav Sharma
Pooja Bhat has been making dry grass elephants, horses and camels since childhood. 'The lockdown forced us to even beg', she says
PHOTO • Madhav Sharma

পূজা ভাট ছোটো থেকে খড়ের হাতি, ঘোড়া আর উট বানিয়ে আসছেন। ‘লকডাউন আমাদের ভিক্ষা পর্যন্ত করতে বাধ্য করেছিল,’ তিনি বলেন

“টিভি আর মোবাইল ফোন দেখেই এখন লোকের সময় কেটে যায়, আমাদের পুতুল-নাচ আর দেখতে চায় না কেউ,” জুয়ারারাম বলেন। ছোটোবেলায় বাবা আর ঠাকুরদার কাছে কাঠের পুতুল বানানো শিখেছেন তিনি। সাধারণত তিনজনের একটি দল একটি পুতুলনাচে অংশ নিত, তাতে রোজগার হত “১০-২০ টাকা আর মাঝেমধ্যে সঙ্গে একটু আটা।” কিন্তু গত দুই দশক ধরে স্থানীয় দর্শকদের মধ্যে এই অনুষ্ঠানগুলি দেখার উৎসাহে ক্রমশ ভাঁটা পড়ছে।

অনেক দিন ধরেই এর দর্শক ছিলেন মূলত জয়পুর আর তার আশেপাশের নামীদামী হোটেলের বিদেশি পর্যটকরা। এদের জন্য তিনজনের একটি দল এক ঘণ্টার একটি শো করত — একজন পুতুলগুলির দায়িত্বে থাকতেন, আর অন্য দু’জন হারমোনিয়াম আর ঢোলক বাজাতেন। এই পুতুলনাচ সাধারণত লোকগীতি আর লোকগাথাকে ঘিরে হয়। সম্প্রদায়ের এক বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য, ৭৩ বছর বয়সি যোধপুরের প্রেমরাম ভাট বলেন, জনপ্রিয় গল্পগুলির মধ্যে একটি ছিল সতেরশো শতাব্দীতে বাদশাহ শাহজাহানের রাজত্বকালে মাড়ওয়ার রাজবংশের অমর সিং রাঠোরের গল্প — আর নাগৌরের রাজসিংহাসনের জন্য রাজপুতদের ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, মারামারি খুনখারাপির গল্প।

এই শোগুলি থেকে তাঁদের এক-একজনের মাসে তিন-চারবার ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হত। কিন্তু লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটনও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, এবং তারই সঙ্গে এঁদের আয়ও। “হোটেল আর পর্যটকরা যেটুকু কাজ এতদিন দিচ্ছিল আমাদের, সেটুকুও থেমে গেল করোনার জন্য হোটেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায়,” জুয়ারারাম বললেন। “কোনও পর্যটক নেই। তাই এই খড়ের খেলনাগুলোই এখন আমাদের জীবিকার একমাত্র উপায়।”

প্রেমরাম জানালেন, ভাট সম্প্রদায় পারম্পরিকভাবে কাঠের পুতুল বানানো আর পুতুলনাচ দেখানোর সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, এই খড়-ভেলভেটের জিনিসগুলো সাম্প্রতিক। সম্প্রদায়ের মানুষরা ১৯৬০-এর আশেপাশে খেলনা ঘোড়াগুলো বানাতে শুরু করে, তিনি বলেন, যখন এই হাতে-তৈরি জন্তুগুলোর চাহিদা অন্যান্য দেশে বাড়ছিল, বিশেষত পশ্চিম ইউরোপে। তাছাড়া, কাঠের জিনিস বানানো অনেক বেশি ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ, তাই ভাট কারিগররা এখন শুধু বিশেষ বায়না পেলে তবেই এগুলো বানান।

'Now, people have TVs and mobile phones for their entertainment, they do not need our puppet shows anymore', says Juara Ram (right)
PHOTO • Madhav Sharma
'Now, people have TVs and mobile phones for their entertainment, they do not need our puppet shows anymore', says Juara Ram (right)
PHOTO • Madhav Sharma

‘টিভি আর মোবাইল ফোন দেখেই এখন লোকের সময় কেটে যায়, আমাদের পুতুল-নাচ আর দেখতে চায় না কেউ,’ বললেন জুয়ারারাম ভাট (ডানদিকে)

“কাপড়ে মোড়া খড়ের ঘোড়াগুলো রাজস্থান জুড়ে ছড়ানো রামদেওরা মন্দিরগুলোয় নৈবেদ্য হিসেবে খুব জনপ্রিয়,” বললেন প্রেমরাম ভাট। কিংবদন্তি শোনান তিনি, এই আঞ্চলিক দেবতা সতেরশো শতাব্দীতে একটা কাঠের ঘোড়াকে জ্যান্ত করে নিজের বাহনে পরিণত করেন। এই জন্যই আজও হাতে তৈরি ঘোড়াগুলিকে জয়সলমীর জেলার রামদেওরা শহরে অগস্ট-সেপ্টেম্বরের আটদিন ব্যাপী বার্ষিক মেলায় নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয়।

“মা-বাবা আর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দেখে দেখে আমি এগুলো বানানো শিখেছিলাম। ছোটোবেলা থেকেই আমি খড় দিয়ে ঘোড়া, হাতি, উট বানাচ্ছি,” জুয়ারারামের কুঁড়ে ঘরের উল্টোদিকের রাস্তায় বসে ১৮ বছর বয়সি পূজা ভাট বলেন। প্রচলিত রাজস্থানি লাহেঙ্গা পরিহিত পূজা খড়ের কাঠামোর উপর লাল মখমল সেলাইয়ে ব্যস্ত।

অতিমারি তাঁর আয়ের উপরেও ছাপ ফেলেছে। “আগে এই খেলনাগুলো বিক্রি করে আমাদের দিনে দুইবেলার খাবার ব্যবস্থা হয়ে যেত,” পূজা বলেন, “কিন্তু লকডাউন আমাদের ভিক্ষা করতে বাধ্য করেছিল।” দিনে দশটার বদলে এখন কপাল ভালো থাকলে তাঁর খুবজোর একটা কি দুটো বিক্রি হয়। “আগে দিনের শেষে আমরা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পেতাম [দামের উপর লাভ], কিন্তু এখন খুব বেশি হলে ১০০-১৫০ টাকা পাই আমরা। ক্রেতারা এখন হাতে তৈরি খেলনা কিনতে চান না। আর চাইলেও এত দরাদরি করেন। আমাদের খরচগুলোও পুরো ওঠে না এমনই কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হই।”

তাঁর নিজের-সহ ব্রিজের কাছে বসবাসকারী অন্য পরিবারগুলিরও কোনও পরিচয়পত্র বা নথি নেই, আর সরকার থেকে কোনওরকম সাহায্যও পান না তাঁরা। “যখনই আমরা কোনও পরিচয়পত্র তৈরি করতে যাই, আধিকারিকরা তাড়িয়ে দেন আমাদের,” বলেন পুজার ২৫ বছর বয়সি দিদি মঞ্জু। “ভোটার আইডি বানানোর চেষ্টা করেছি আমরা অনেকবার। কোনও সরকারি প্রকল্পে আমাদের জায়গা নেই। কয়েকজন মানুষের সাহায্যে আমরা কোনওমতে ওইসময়টায় টিকে থাকতে পেরেছি, ওঁরা লকডাউনের সময়ে এখানে এসে খাবার দিয়ে যেতেন। সেই সময়ে আমরা তিনদিনের বাসি পুরিও খেয়েছি।”

রাজু ভাট পূজার বাড়ির পাশেই থাকেন, কাজ করেন। তিনিও ২০২০ সালের মার্চের পর থেকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলেছেন। পাঁচ বছর বয়স থেকে খড়ের জিনিস বানাচ্ছেন তিনি। ৩৮ বছর বয়সি রাজু বলেন, লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গেই ক্রেতারা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, অথচ খেলনাগুলি বানানোর জন্য দরকারি জিনিসের দাম বেড়েই চলেছিল ক্রমশ।

'No one in our community wants their children to continue doing this work', says Raju Bhat, with his wife Sanju and sons Rohit (left), and Deepak (right)
PHOTO • Madhav Sharma
'No one in our community wants their children to continue doing this work', says Raju Bhat, with his wife Sanju and sons Rohit (left), and Deepak (right)
PHOTO • Madhav Sharma

‘আমাদের সম্প্রদায়ের কেউ চান না যে তাঁদের সন্তানদেরও এই কাজই করে যেতে হোক,’ বলেন রাজু ভাট,সঙ্গে তাঁর স্ত্রী সঞ্জু আর দুই ছেলে রোহিত (বাঁদিকে) আর দীপক (ডানদিকে)

“আগে আমরা ফল-সবজি মোড়ার খড় পেতাম চাঁদপোল মান্ডি বা মুহানা মান্ডি থেকে ১০০-১৫০ টাকা এক কুইন্টাল দরে। তার থেকে আমরা খান পঞ্চাশেক খেলনা বানাতাম, কিন্তু এখন এক কুইন্টালের জন্য আমাদের দিতে হয় ১৫০০ টাকা। এছাড়া মখমলের দাম মিটারপিছু ৭০ টাকা, সাজানোর চুমকি ৫০০ টাকা কিলো, আর দড়ি ২০০ টাকা কিলো। এই ছোটো বাঁশ আর তারের টুকরোও কিনতে হয় খেলনাগুলোকে বেঁধে রাখার জন্য,” সবিস্তারে জানালেন রাজু।

২০২০ সালের মার্চে লকডাউন ঘোষিতে হলে পরিস্থিতি বদলের আগে অবধি ১৮ ইঞ্চির একটা খড়-মখমলের জিনিস বানাতে রাজুর লাগত ৬০-৬৫ টাকা, কিন্তু এখন লাগে ৯০ টাকারও বেশি। “এগুলোকে আমরা ১০০-১২০ টাকায় [কখনও কখনও ২০০ টাকায়] বিক্রি করি, নির্ভর করে জিনিসটার মাপের উপর।

এগুলি বেচে তাঁদের যা রোজগার হয় তাতেই ছ’জনের পরিবারটির দিন গুজরান হয় ­– রাজু, তাঁর স্ত্রী সঞ্জু, ৩২, আর তাঁদের চার সন্তান – দীপক, ১৭, অনিল, ১৫, গুড্ডি, ১২, আর রোহিত, ১০। সন্তানদের কেউই এখন আর স্কুলে যায় না। দীপক আর অনিল বছর দুই আগে স্কুল ছেড়ে খড়ের খেলনা বানানোর কাজে পরিবারকে সাহায্য করতে শুরু করেছে। গুড্ডি আর রোহিত কাছাকাছি এক সরকারি স্কুলে পড়লেও স্মার্টফোন না থাকায় এখন অনলাইন ক্লাস করতে পারে না।

“গুড্ডি আর রোহিতকে আমি আবার পড়তে পাঠাব সরকার স্কুল খোলার কথা ঘোষণা করলে,” রাজু বললেন। “আমাদের সন্তানদেরও এই কাজই করে যেতে হোক, এটা আমাদের সম্প্রদায়ের কেউই চায় না। কিন্তু আমাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ বলে আমরা একরকম বাধ্য হয়েই তাদেরও এই কাজে জড়িয়ে ফেলি। আমার সন্তানদের জন্যও আমি আর পাঁচজন বাবার মতোই স্বপ্ন দেখি। আমি চাই তারা চাকরি করুক। সারা জীবন তারা এই খড়ের খেলনা বানিয়ে যাক, এ আমি মোটেই চাই না। আমি চাই না যে যখনতখন কেউ চড়াও হয়ে তাদের ভিটেবাড়ি ভেঙ্গে চুরমার করুক।”

রাজু টের পান, ঠিক যেভাবে তাঁর সম্প্রদায়ের কাঠের পুতুল বানানোর কাজ ফুরিয়ে গেছে, একদিন সেইভাবেই তাঁদের খড়ের জিনিস বানানোর কাজও একদিন থমকে যাবে। “আমার প্রজন্ম অবধিই এই কাজ চলবে,” তিনি বলে উঠলেন।

মূল হিন্দি প্রতিবেদনটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন চিলকা।

বাংলা অনুবাদ: শ্রীপূর্ণা মজুমদার

Madhav Sharma

ਮਾਧਵ ਸ਼ਰਮਾ, ਜੈਪੁਰ ਤੋਂ ਹਨ ਤੇ ਇੱਕ ਸੁਤੰਤਰ ਪੱਤਰਕਾਰ ਹਨ। ਉਹ ਸਮਾਜਿਕ, ਵਾਤਾਵਰਣ ਸਬੰਧੀ ਤੇ ਸਿਹਤ ਸਬੰਧੀ ਮਸਲਿਆਂ ਬਾਰੇ ਲਿਖਦੇ ਹਨ।

Other stories by Madhav Sharma
Translator : Sripurna Majumder

Sripurna Majumdar is an undergraduate student of Comparative Literature at Jadavpur University, Kolkata. Reading and stargazing are some of her most favourite things to do.

Other stories by Sripurna Majumder