দুর্গা দুর্গা বলে আমার,
দগ্ধ হল কায়া,
একবার দে গো মা,
চরণের ছায়া।
গলা ছেড়ে দেবী দুর্গার জয়গান গাইতে গাইতে ভক্তিরসে ডুবে গেলেন পটশিল্পী বিজয় চিত্রকর। তাঁর মতন পাটকর বা পটশিল্পীরা সাধারণত আগে গান লেখেন, তারপর পট আঁকেন — লম্বায় একেকটা ১৪ হাত পর্যন্ত হয় — শেষে সংগীত ও ভাষ্য সমেত দর্শকের সামনে প্রদর্শন করেন।
বিজয় বাবুর বাড়ি ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার আমাদোবি গ্রামে। তাঁর কথায় স্থানীয় সাঁওতালি উপকথা, গ্রামীণ জীবনযাপন, কুদরত ও পৌরাণিক গল্পকথার আধারেই পটের ছবি আঁকা হয়। “আমাদের প্রধান বিষয় গ্রামীণ সংস্কৃতি; চারপাশের দুনিয়ায় যা যা দেখি, সেসবই ফুটিয়ে তুলি ছবিতে।” ১০ বছর বয়স থেকে পট এঁকে চলেছেন তিনি। “করম নাচ, বাহা নাচ, কিংবা রামায়ণ-মহাভারতের কোনও গল্প, গ্রামের কোনও দৃশ্য...” এরপর একটি সাঁওতালি পটচিত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেন বিজয় চিত্রকর: “এখানে মেয়েবৌরা ঘরকন্নার কাজ করছে, মরদরা মাঠে গেছে বলদ নিয়ে, আকাশে পাখপাখালির ঝাঁক।”
“ঠাকুর্দার কাছে এই শিল্পে তালিম নিয়েছি। বিশাল নামজাদা আঁকিয়ে ছিলেন, তখনকার দিনে ক্যালকাটা থেকে লোক আসত ওঁর সঙ্গে দেখা করতে, ওঁর গান শুনতে।” বিজয় বাবুর পরিবার বহু প্রজন্ম ধরে পটশিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, “পট যুক্ত আ-কার, মানে পৈটিকর, ইসিলিয়ে পাটকর পেইন্টিং আয়া [পট যুক্ত আ-কার, অর্থাৎ পাটকর, এটার থেকেই পটশিল্প এসেছে]।”
পটশিল্পের উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডে। শিল্পের এই আঙ্গিকে কথকতার সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায় রংবেরঙের সূক্ষ্ম ছবি। পটশিল্পে প্রাচীন যুগের রাজারাজড়াদের প্যাঁচানো পুঁথি বা পাণ্ডুলিপির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। রাঁচি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও আদিবাসী লোককাহিনি-বিশেষজ্ঞ পুরুষোত্তম সারমা জানাচ্ছেন, “এই শিল্পকলা যে ঠিক কত পুরানো সেটা সঠিক করে বলা মুশকিল, কারণ এর কোনও লিখিত প্রমাণ নেই, কেবল এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে বয়ে চলেছে।”
আমাদোবি গাঁয়ে পটশিল্পীর ছড়াছড়ি, আর ৭১ বছর বয়সি অনিল চিত্রকরই সবচেয়ে প্রবীণ। “আমার প্রতিটা ছবিতে একটা করে গান আছে। আমরা সেই গানটাই গাই,” বুঝিয়ে বললেন তিনি। সাঁওতাল জনজাতির প্রধান পরব উপলক্ষ্যে আঁকা করম নাচের একটা পট দেখিয়ে পারি’কে তিনি জানালেন, “মাথায় কোনও গপ্প এলেই সেটা এঁকে ফেলি। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গানটা লেখা, তারপর পট আঁকা, তারপর মানুষের জন্য সেটা গাওয়া।”
প্রকৃত পাটকর বা পটশিল্পী হতে গেলে গভীর সাংগীতিক জ্ঞান থাকা দরকার, আর সেটা অনিল কাকা ও বিজয় বাবু বাদে হাতেগোনা কয়েকজনেরই আছে কেবল। পটের জগতে সমস্ত আবেগ-অনুভূতির জন্য আলাদা আলাদা গান আছে বলে জানালেন অনিল চিত্রকর — আনন্দ, দুঃখ, পুলক, উত্তেজনা ইত্যাদি, “গ্রামীণ এলাকায় আমার বিভিন্ন দেবদেবী, মহাকাব্য আর উৎসব নিয়ে গান গাই — দুর্গা, কালি, দাতা কর্ণ, নৌকা বিলাস, মনসামঙ্গল ও আরও নানান কিছু।”
অনিল কাকা তাঁর বাবার থেকে এই আঙ্গিকের উত্তরাধিকার পেয়েছেন, লোকে বলে তিনি নাকি পটের গানের জীবন্ত মহাফেজখানা ছিলেন। “পালাপরবের [সাঁওতালি ও হিন্দু] সময় আমরা গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে আমাদের ছবি দেখাতাম, একতারা আর হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতাম। লোকে খানিক খানিক টাকা কিংবা আনাজের বদলে পটের ছবি কিনত,” অনিল কাকা বললেন আমাদের।
কথকতার সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায় রংবেরঙের সূক্ষ্ম ছবি। পটশিল্পে প্রাচীন যুগের রাজারাজড়াদের প্যাঁচানো পুঁথি বা পাণ্ডুলিপির প্রভাব বিদ্যমান
ইদানীং পটের ছবি আকারে হ্রাস পেয়েছে — সাঁওতাল সৃষ্টিতত্ত্ব ঘিরে আঁকা যে ছবিগুলো এককালে ১২-১৪ হাত লম্বা হত, তা আজ কমতে কমতে এ৪ কাগজের সাইজে এসে ঠেকেছে — মোটামুটি হাতখানেক বহর, ২০০ থেকে ২,০০০ টাকায় একেকটা বিক্রি হয়। “খুব বড়ো পট বেচতে পারি না, তাই ছোটো ছোটো ছবি আঁকি। কোনও খদ্দের যদি নিজেই গাঁয়ে আসেন, আমরা তাঁকে ৪০০-৫০০ টাকায় বেচে দিই,” অনিল কাকা জানাচ্ছেন।
প্রবীণ এই শিল্পী বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মেলা আর কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি বোঝালেন কেন এই শিল্প বিশ্বদরবারে পরিচিতি পেলেও রুজিরুটির সহায় হতে ব্যর্থ হয়েছে। “মোবাইল ফোন এসে সামনাসামনি লাইভ গানবাজনার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে, হাতে-হাতে এত্ত মোবাইল যে গান গাওয়া বা বাজনা বাজানোর ধারাগুলো মরেই গেছে। যুগ-যুগের এ রীতি-রেওয়াজ আজ খতম। আজকাল কীসব লারেলাপ্পা মার্কা গান হয়, ফুলকা ফুলকা চুল, উড়ি উড়ি যায়ে,” ব্যঙ্গের ছলে বহুল জনপ্রিয় একটি গানের কলি আউড়ালেন অনিল কাকা।
পটচিত্রে পটু, এককালে এমন খান চল্লিশেক পরিবার ছিল এই আমাদোবি গ্রামে, অথচ প্রবীণ পটশিল্পীর থেকে জানতে পারলাম যে আজ মোটে খানকতক ঘরেই এ শিল্পকলার রেওয়াজ টিকে আছে। “আঁকাআঁকিতে অনেকেই আমার কাছে হাতেখড়ি নিয়েছে, তবে ওসব থেকে বিশেষ আয়-ইনকাম হত না বলে সব্বাই ছেড়েছুড়ে মজুরি করে খায়। আমার ছেলেদেরও তালিম দিয়েছিলাম, কিন্তু ঠিকমতন রোজগার হত না, তাই প্রত্যেকেই পট আঁকা ছেড়ে দিল।” অনিল চিত্রকরের বড়োছেলে জামশেদপুরে রাজমিস্তিরির কাজ করেন, ছোটোছেলে দিনমজুর। সস্ত্রীক একটি ছোট্ট কুঁড়েঘরে থাকেন অনিল কাকা, খানকতক ছাগল আর মুরগি নিয়ে সংসার; ঘরের বাইরেই দেখলাম খাঁচার ভিতর একটি টিয়াপাখি বসে আছে।
২০১৩ সালে ঝাড়খণ্ড সরকার আমাদোবি গ্রামটিকে পর্যটনকেন্দ্রে রূপান্তরিত করেছিল বটে, তবে গুটিকয় পর্যটক বাদে কেউই আসে না। “কোনও টুরিস্ট বা সাহিব [সরকারি আধিকারিক] এলে আমরা ওঁদের জন্য গান করি, ওঁরা আমাদের খানিক পয়সাকড়ি দেন। গতবছর মোটে দুখানা ছবি বেচতে পেরেছিলাম,” দুঃখের কথা জানালেন অনিল কাকা।
পর্যটক আর অফিসার ছাড়াও সাঁওতালদের করম পুজো, বাঁদনা পরব, এবং হিন্দুদের উৎসব বা মেলার সময় কাছেপিঠের গ্রামে পটের ছবি বিক্রি করেন এখানকার শিল্পীরা। অনিল চিত্রকরের কথায়: “শুরুতে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরেই ছবি বেচতাম। দূর-দূরান্তে যেতাম, এমনকি বাংলা, ওড়িশা আর ছত্তিশগড়েও।”
*****
হাতেনাতে পটচিত্রের প্রক্রিয়া প্রদর্শন করে দেখালেন অনিল কাকা। প্রথমে একটি ছোট্ট শিলে আঁজলা ভরে জল ঢেলে তাতে অন্য একটি পাথর ঘষতে লাগলেন যতক্ষণ না মেটেরং বেরোচ্ছে। তারপর পুঁচকে মতন একটি তুলি দিয়ে শুরু হল পট আঁকা।
পাটকর চিত্রে সমস্ত রং হয় নদীর পাড় থেকে আনা নুড়িপাথর বা ফুল-পাতা থেকে তৈরি হয়। খুঁজেপেতে যুৎসই পাথর জোগাড় করে আনাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। “পাহাড়-টিলা কিংবা নদীর ধারে যেতে হয়; কখনও কখনও চুনাপাথর খুঁজে পেতে তিনচারদিন লেগে যায়,” বিজয় চিত্রকর বললেন।
পটচিত্রকরেরা হলুদ থেকে পীতবর্ণ, শুঁটি কিংবা কাঁচালঙ্কা থেকে সবুজ এবং পুটুসগাছের ফল থেকে বেগুনি রং নিষ্কাশন করে থাকেন। কালো আসে কেরোসিনের লম্ফ জ্বেলে ভুসোকালি সংগ্রহ করে, আর লাল, সাদা ও মরচে রং আসে বিভিন্ন ধরনের পাথর থেকে।
যদিও কাপড় ও কাগজ এ দুইয়ের উপরেই পট আঁকা যায়, তবে শিল্পীরা আজকাল কেবল ৭০ কিলোমিটার দূরে জামশেদপুর থেকে কিনে আনা কাগজই পছন্দ করেন। “একেকটা কাগজের দাম ৭০-১২০ টাকা, ও দিয়ে খুব সহজেই চারটে ছোটো-ছোটো ছবি বানিয়ে ফেলি আমরা,” বিজয় বাবু জানাচ্ছেন।
পটচিত্র যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য প্রাকৃতিক রংয়ের সঙ্গে নিম কিংবা বাবলাগাছের রজন মিশিয়ে নেন তাঁরা। “এটা করলে পোকামাকড় কাগজ কাটতে পারে না, ছবিটা যেমন কে তেমন রয়ে যায়,” বিজয় চিত্রকর এটাও জানালেন যে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করেন বলেই তাঁদের পটের এত কদর।
*****
আট বছর আগে অনিল চিত্রকরের দুটো চোখেই ছানি পড়ে যায়। দৃষ্টিশক্তি ঘোলাটে হতে শুরু করায় আঁকাআঁকি স্তব্ধ হয়ে যায়। “ঠিকমতন দেখতে পাই না। রং বাদে রেখাগুলো আঁকতে পারি, গান গেয়ে গল্পও শোনাতে পারি, তবে লাইনের ভিতর আর রং চাপাতে পারি না,” বলে নিজের একখান পট তুলে দেখালেন তিনি। দেখলাম যে দুজনের নাম লেখা আছে — প্রথম নামটা অনিল কাকার, রেখাচিত্রটা তিনিই এঁকেছেন, আর দ্বিতীয় নামটা তাঁর এক শিষ্যের, রং চড়িয়েছেন যিনি।
অঞ্জনা পাটকরও (৩৬) একজন ওস্তাদ পটচিত্রকর, অথচ “আমি এখন আর আঁকি-টাকি না। আমার বর তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে, ও বুঝতেই পারে না আমি কেন ঘরকন্নার কামকাজ সামলে এসব এঁকে-টেকে যেচে ক্লান্ত হচ্ছি। কাজটা সত্যিই খুব খাটাখাটনির, তাই কোনও মুনাফা না হলে এসব করে আর কী-ই বা হবে?” স্বহস্তে আঁকা ৫০টি পট তৈরি হয়ে পড়ে আছে অঞ্জনাদির, অথচ বেচতে পারছেন না। এই শিল্পকলা শিখতে তাঁর সন্তানরাও ইচ্ছুক নয় বলে জানালেন তিনি।
অঞ্জনা পাটকরের মতন ২৪ বছরের গণেশ গায়েনও একদা পট আঁকায় পারদর্শী ছিলেন, অথচ আজ গাঁয়ে একখান মুদির দোকান চালান আর মাঝেসাঝে দিনমজুরি করেন। তাঁর বক্তব্য: “গতবছর মোটে তিনখানা ছবি বিকতে পেরেছিলাম। শুধু এটার রোজগারে বসে থাকলে ঘর-সংসার লাটে উঠবে যে!”
“নতুন প্রজন্মের ছেলেপিলেরা গান লিখতেই জানে না। গাওয়া, গল্প-বলা, এগুলো কেউ শিখলে তবেই না পটচিত্র জিন্দা থাকবে। নইলে, এর মৃত্যু অবধারিত,” বলে শেষ করলেন অনিল কাকা।
এই প্রতিবেদন ও ভিডিওতে ব্যবহৃত পটের গানগুলি সীতারাম বাস্কে ও রনিত হেমব্রমের সহায়তায় তর্জমা করেছেন জশুয়া বোধিনেত্র ।
মৃণালিনী মুখার্জী ফাউন্ডেশন (এমএমএফ) প্রদত্ত একটি ফেলোশিপের সহায়তায় এই প্রতিবেদনটি লিখিত।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র