এক মুহূর্তের জন্য, চেন্নাই-ত্রিচি হাইওয়ে ধরে কোলাক্কানাথ শহরে যাওয়ার পথের দুই দিককে ঠিক জুঁইফুলের বাগানের মতো দেখায়। ঠাহর করলে দেখা যাবে সবুজ পাতা কম, বড়ো বড়ো সাদা ‘ফুল’-ই বেশি। আদতে এগুলি এবার তোলার জন্য প্রস্তুত পাকা তুলোর গুটি, এবং নারী-পুরুষ, বুড়ো-জোয়ান, সবাই হাত চালিয়ে কাজে ব্যস্ত – এটি ফসল কাটার মরসুমের শেষ অধ্যায়।
দিব্যা তুলোর খেতে তাঁর শিফট শেষ করে দুচাকা চড়ে বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছান। ওড়না বাঁ কব্জির উপর গুটিয়ে নিয়ে, উৎফুল্ল এই তরুণী আমাদের দিকে চেয়ে হাসেন। “আমরা তাহলে এবার আমাদের গাঁয়ে যাই? আমার গাঁ সিরুকানপুর।” দিব্যা নিজের বাইকে চেপে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যান। যত তাঁকে অনুসরণ করি, তত বেশি বেশি সুবিশাল তুলোখেত দেখতে পাই।
বাহনটিকে দাঁড় করিয়ে রাখার সময়ে আরেক তরুণী, অম্বিকাপাথি, মাত্র সাড়ে তিন ফুট লম্বা, আমাদের অভিবাদন জানালেন। “একটি সাঁতার প্রতিযোগিতায় আমদের বন্ধুত্ব হয়েছিল,” দিব্যা বললেন। তারপর একছুটে সাঁতার ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জেতা কয়েকটি স্মারক বার করে আনলেন।
আট বছর বয়সে একটি খোলা কুয়ো থেকে জল আনার সময় দিব্যা তাঁর বাঁ হাতের একটা অংশ হারান। “আমার মা-বাবা পুথুর-কাট্টুর [হাড় বসানোর একটি চিরাচরিত প্রথা] চেষ্টা করেছিল। ওতে কোনও লাভই হয়নি, কারণ হাড়ের কিছু অংশ তো ভেঙে টুকরো হয়ে গিয়েছিল,” মনে করে বলছিলেন তিনি। পরে সেপ্টিকের ক্ষতগুলির জন্য তাঁর অগ্রবাহুর কয়েক ইঞ্চি হারান তিনি। নিজের কব্জি থেকে ওড়নাটি খুলতে খুলতে বলে উঠলেন দিব্যা।
খেলায় ফিরে গিয়ে, দিব্যা শৈশবে ঘটা এই শারীরিক ক্ষতির অধ্যায়কে পেছনে ফেলে এগিয়ে যান। তাঁদের পরিবার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জমিতে তুলো চাষ করে। তিনি নিজেও পরিবারের বাকি সদস্যদের মতই জমিতে কাজ করেন। “আমরা আমাদের জমিতে বীজ বোনাটা স্থগিত রাখি যাতে অন্যের জমিতে কাজ করে কিছু পয়সা উপার্জন করতে পারি। আমি দিনে অন্তত ৭০ কিলো তুলোর গুটি তুলি, যে কোনো স্বাভাবিক মানুষের মতোই, কখনও তো বেশিও তুলি,” নিজের হাতে ধরা ডজন দুয়েক প্রশংসাপত্রকে এদিক-ওদিক করতে করতে, অপ্রতিভ হাসি হেসে বলেন দিব্যা।
“এগুলি আমার রাজ্য এবং জাতীয় স্তরের সাঁতার ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জেতা পদক। আমি আন্তর্জাতিক স্তরে দিল্লিতে একটি প্যারালিম্পিক প্রতিযোগিতার ক্রীড়া বিভাগে নির্বাচিত হয়েছি, যেটি এইমাসের পরের দিকে অনুষ্ঠিত হবে। আমার বন্ধু অম্বিকা সাঁতার বিভাগে নির্বাচিত হয়েছে।” দিব্যা অম্বিকার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ইশারা করেন।
অম্বিকাপাথি লাজুক ও স্বল্পভাষী প্রকৃতির। কিন্তু যখন তিনি খেলাধুলার প্রতি নিজের আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন, তখন যেন বাঁধ ভেঙে কথা বেরিয়ে এল। “খুব ভালো লাগে যে আমিও আজ গর্ব করার মতো একটা কিছু করি। আগে আমি শুধু গরু-ছাগল চরাতে নিয়ে যেতাম আর তুলোর খেতে কাজ করতাম, কোনওদিন গ্রামের বাইরে পা দিইনি,” বলে উঠলেন আঠাশ বছর বয়সি পিটুইটারি ডোয়ার্ফিজমে আক্রান্ত এই মহিলা। তিনি জানেন না তাঁর পরিবারে তিনিই কেন একমাত্ৰ খর্বকায় মানুষ। তাঁর ভাইয়েরা সরকারি আপিসে কাজ করলেও, অম্বিকা কখনও স্কুলেও যাননি।
“গ্রামের প্রায় সক্কলেই তাদের বাড়ির পিছনের পুকুরে সাঁতরায়। পেরামবালুর কালেক্টারেটের আধিকারিকরা যখন ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষদের খুঁজে একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করানোর জন্য মঙ্গলমেদু গ্রামে আসেন, আমি এই সুযোগে আমার সাঁতারের দক্ষতার সদ্ব্যবহার করি। তবে যেই না সাঁতারের পোশাক দেখিয়ে আমাকে সেটি পরতে বলা হয়, আমি আমার নাম বাতিল করে পত্রপাঠ বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিলাম,” অম্বিকা লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠেন।
প্রথমে তিনি পেরামবালুরের একটি বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত সেলাইয়ের কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। “আমি সেলাই মেশিন অবধি পৌঁছাতে পারি না বলে আমাকে নিয়ে লোকে উপহাস করত, এতে আমার মনে খুব আঘাত লাগত। এখন অবশ্য আমি আমার নিজের তো বটেই, অন্যদেরও জামাকাপড় সেলাই করি।”
গ্রামে এখন অম্বিকার অনেক অনুরাগী। পদক জিতে গ্রামে ফিরলে প্রত্যেকবার তাঁর বন্ধুবান্ধব, যাঁদের মধ্যে অনেকেই পুরুষ, বিশাল কাটআউট-সহ তাঁকে স্বাগত জানাতে হাজির হন।
দুই মহিলাই পেরামবালুর জেলা তথা তামিলনাড়ু রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেন। বিশ্বব্যাংকের বদান্যতায় তামিলনাড়ু সরকারের দ্বারা বাস্তবায়িত পুধু ভাজভুর প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁদের দক্ষতা শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল।
দিব্যা নিজের এলাকায় প্রকল্পটির দলনেতার উৎসাহে, দশম শ্রেণির পড়াশোনা শেষ করেছেন। তাঁর আশা এই যোগ্যতা তথা খেলাধুলোয় নিজের অর্জিত সাফল্যের দৌলতে একটা কাজ তিনি পেয়ে যাবেন। অম্বিকাপাথির ক্ষেত্রে এটা অবশ্য একদম শূন্য থেকে শুরু। “কারকুম ভারতাম” নামে পরিচিত তামিলনাড়ুর ‘সাক্ষর ভারত’ প্রকল্পের মাধ্যমে পড়াশোনা করতে চান তিনি।
“এ কোনও ব্যাপারই না, আমি পারব,” অম্বিকা বললেন। দিব্যাও সম্মতি জানিয়ে বলেন, “এখন আমরা জেনে গেছি কেন আমাদের ভিন্নভাবে সক্ষম বলা হয়। আমরা কাজকর্ম নিজস্ব কায়দায় এবং ও নিজস্ব গতিতে করি।”
উভয় মহিলাই বিদেশে গিয়ে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে অপেক্ষা করে আছেন। সেক্ষেত্রে মে মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক কোয়ালিফাইং ইভেন্টটি জিততে হবে।
“আমরা খুব খুশি যে ইভেন্টগুলি পরের বছর তুলোর ফসল কাটা ও বীজ বোনার মরসুমের মাঝে অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের তো আর কাজ থেকে ছুটি নেবার সামর্থ্য নেই,” বললেন দিব্যা। গ্রামে তাঁদের জীবন কৃষিকাজ, ফসল বোনা আর ফসল কাটার সঙ্গে সঙ্গেই আবর্তিত হতে থাকে।
অনুবাদ: সপ্তপর্ণা সমাজদার