সকাল ৭টা বাজে, ডাল্টনগঞ্জের সাদিক মঞ্জিল চৌক ইতিমধ্যেই পুরোদস্তুর গমগমে, শাঁশাঁ করে ছুটে চলেছে ট্রাক, একে একে শাটার তুলছেন দোকানিরা, কাছেই কোথাও একটা মন্দির থেকে ভেসে আসছে রেকর্ড করা হনুমান চালিশার সুর।
এরই মাঝে একখান দোকানের সিঁড়িতে বসে, মনের সুখে সিগারেট টানতে টানতে, চারপাশের লোকজনকে লক্ষ্য করে তারস্বরে কথা বলে চলেছেন ঋষি মিশ্র। কদিন আগেই সাধারণ নির্বাচন চুকেছে, নতুন সরকার গঠন হতে চলেছে — আজকের এই প্রভাতী আড্ডার বিষয় সেটাই। নজরুদ্দিন আহমেদ অনেকক্ষণ ধরেই খৈনি ডলতে ডলতে লোকজনের তর্কবিতর্ক শুনছিলেন, এবার আর থাকতে না পেরে বলে উঠলেন, “এত্ত তক্কো কীসের শুনি? সরকার যে-ই বানাক না কেন, আমাদের রুজিরুটির বন্দোবস্ত তো সেই নিজেদেরকেই করতে হবে।”
ঋষি বাবু ও আহমেদ সাহেবের মতো বেশ কয়েকজন দিনমজুর এখানে রোজ ভিড় জমান, তাই অনেকেই এই জায়গাটাকে ‘লেবার চক’ বলেন। পালামৌয়ের কাছেপিঠের গাঁয়ে কোনও কামকাজ নেই, জানালেন তাঁরা। এ শহরে সাদিক মঞ্জিলের মতন এমন আরও চারখানা লেবার চক আছে, প্রতিটাতেই দেখবেন ২৫-৩০ জন লেবার দিনমজদুরির বরাত পাওয়ার অপেক্ষা করছেন। কাজের খোঁজে আশপাশের গ্রাম থেকে জড়ো হন তাঁরা।
“আটটা অবধি সবুর করুন। এত্ত লোক হবে যে দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও পাবেন না,” মোবাইল ফোনে সময় দেখতে দেখতে বললেন ঋষি মিশ্র।
২০১৪ সালে আইটিআই পাশ করে বেরোনো ঋষি বাবু ড্রিলিং মেশিন চালাতে পারেন, আজ সেরকমই কোনও একটা কাজ পেলে ভালো হয়। সিঙরা কালান গাঁয়ের ২৮ বছরের এই বাসিন্দাটির কথায়: “চাকরিবাকরির আশায় এই সরকারকে ভোট দিয়েছিলাম। [নরেন্দ্র] মোদী আজ ১০ বছর হল মসনদে আছে। কটা শূন্যপদ ঘোষণা করেছে আর কটাই বা চাকরি দিয়েছে শুনি? এই সরকার আরও পাঁচটা বছর থাকলে সমস্ত আশা-ভরসা খতম হয়ে যাবে।”
নজরুদ্দিন আহমেদেরও (৪৫) ঠিক এমনটাই মনে হয়। নেওরা গ্রামের এই মানুষটির পরিবারে সদস্য সংখ্যা সাত, অথচ রোজগেরে বলতে তিনি একা। “গরিব ইনসান আর চাষিদের কথা কে-ই বা ভাবে?” নজরুদ্দিন সাহেব সওয়াল করলেন, “হররোজ পাঁচশোজন এখানে একাট্টা হয়। মোটে জনা দশেক কামকাজ পায়, বাকিরা খালিহাতেই ঘরে ফেরে।”
এক মোটরবাইক আরোহীর আবির্ভাবে ছেদ পড়ল আমাদের কথাবার্তায়। দিনমজুরির উমিদে সব্বাই মিলে ঘিরে ধরলেন তাঁকে। দরাদরি করে মজুরি স্থির হল, ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল এক তরুণের। তাঁকে বাইকের পিছনে তুলে আরোহী চটজলদি রওনা দিলেন।
অগত্যা আবারও আগের জায়গায় ফিরে এলেন ঋষি মিশ্র, সঙ্গে বাকিরাও আছেন। “নিজের চোখেই দেখুন এই তামাশাটা। একজন কেউ এলেই সবাই মিলে লাফিয়ে উঠি,” মুখে তাঁর হাসি লেগেছিল বটে, নেহাতই কষ্টের হাসি সেটা।
তারপর, বসতে বসতে বলে উঠলেন, “যে ইচ্ছে সরকার গড়ুক, যেন গরিবের কল্যাণ হয়। মেহেঙ্গাই [মূল্যবৃদ্ধি] কমা উচিত। মন্দির বানালে বুঝি গরিবদুঃখীর পেট ভরবে?”
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র