“ওরা বলে এ জায়গাটা নোংরা, দুর্গন্ধ, আবর্জনায় ভরা,” রাস্তার দু’ধারে সার সার মাছের বাক্স আর বিক্রেতাদের দেখিয়ে উত্তেজিত স্বরে বলছেন এন. গীতা। “এই আবর্জনা আমাদের সম্পদ; এই দুর্গন্ধ আমাদের রুটিরুজি। এসব ছেড়ে কোথায় যাব?” প্রশ্ন তোলেন ৪২ বছরের গীতা।
মেরিনা সৈকত বরাবর ২.৫ কিলোমিটার ধরে চলা লুপ রোডের উপর গড়ে ওঠা অস্থায়ী নচিক্কুপ্পম মাছের বাজারে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। ‘ওরা’ মানে শহরের অভিজাত প্রশাসক আর পৌর কর্তৃপক্ষ, যারা শহরের সৌন্দর্যায়নের নামে তুলে দিতে চায় এই মাছের বাজার। কিন্তু গীতার মতো মৎস্যজীবীদের কাছে নচিক্কুপ্পম তাঁদের উরু (গ্রাম)। যুগ যুগ ধরে এখানে আছেন তাঁরা, শত ঘূর্ণিঝড় আর সুনামি সহ্য করে।
বাজার জমে ওঠার আগেভাগে সকাল সকাল নিজের দোকানটুকু সাজিয়ে ফেলছেন গীতা, উলটে রাখা কিছু ক্রেট আর তার উপরে প্লাস্টিকের একটা বোর্ড দিয়ে তৈরি জোড়াতাপ্পি টেবিলখানায় জল ছেটাচ্ছেন। দুপুর ২টো পর্যন্ত এটাই তাঁর ঠিকানা। বিয়ের পর থেকে এখানে মাছ বেচেন তিনি, সে দুই দশকের ওপর হয়ে গেল।
কিন্তু বছরখানেক আগে, ১১ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে গীতা-সহ লুপ রোডের প্রায় তিনশো মাছ বিক্রেতার কাছে গ্রেটার চেন্নাই কর্পোরেশন (জিসিসি) থেকে বহিষ্কারের নোটিস আসে। মাদ্রাস হাইকোর্টের একটি রায়ের ভিত্তিতে জিসিসি-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এক সপ্তাহের মধ্যে রাস্তা সাফ করার।
“লুপ রোডের উপর জবরদখল করা সবকিছু [মাছওয়ালা, দোকান, পার্ক করা গাড়ি] আইনের প্রক্রিয়া মেনে সরিয়ে দেবে গ্রেটার চেন্নাই কর্পোরেশন। গোটা রাস্তা আর ফুটপাথ জবরদখল-মুক্ত তথা গাড়ি ও পথচারীদের অবাধ যাতায়াতের উপযুক্ত করে তুলতে পুরসভাকে সাহায্য করবে পুলিশ,” বলা হয়েছিল সেই রায়ে।
কিন্তু মৎস্যজীবীদের মতে তাঁরা এখানকার পূর্বাকুডি, অর্থাৎ মূলনিবাসী। এই শহরই তাঁদের ঐতিহাসিক জন্মভূমির উপর ক্রমাগত জবরদখল চালিয়ে যাচ্ছে।
চেন্নাই (মাদ্রাজ) শহর পত্তনের বহু বহু আগে এই সৈকত বরাবর ভেসে বেড়াত অজস্র কাট্টুমারম (ক্যাটামারান)। আলো-আঁধারির মধ্যে স্থির বসে হাওয়ার গতি পরখ করতেন মাছশিকারী, গন্ধে বুঝে নিতেন সন্ধান, চোখ রাখতেন স্রোতের আনাগোনায়, কখন শুরু হবে ভান্দা-থান্নি – কাবেরী আর কোল্লিদাম নদী থেকে নির্দিষ্ট মরসুমে বয়ে আসা পলিবোঝাই স্রোত, যার সঙ্গে এককালে আসত বিপুল মাছের সম্ভার। আজ সে সম্ভারের আকার অনেক ক্ষুদ্র, কিন্তু চেন্নাইয়ের জেলেরা এখনও সৈকতে বসে মাছ বেচেন।
“জেলেরা আজও ভান্দা-থান্নির অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু এই শহরের ধুলো-বালি-কংক্রিট মানুষকে ভুলিয়ে দিয়েছে যে চেন্নাই এককালে কয়েকটা জেলে কুপ্পম-এর [পেশাভিত্তিক বসতি] সমষ্টিই ছিল,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন এস. পালয়ম, নচিক্কুপ্পম বাজারের উল্টোদিকে নদীর ওপারের গ্রাম উরু ওলকট কুপ্পমের এক মৎস্যজীবী। “কারও কি আজ সেকথা মনে আছে?”
এই সৈকতবর্তী বাজার জেলেদের জিয়নকাঠি। জিসিসি-র পরিকল্পনামতো একটা মাছের বাজারকে এখান থেকে ওখানে সরানো হলে সেটা শহরের বাকি বাসিন্দাদের কাছে তেমন অসুবিধার কিছু হবে না, কিন্তু নচিকুপ্পম বাজারে মাছ বেচেন যাঁরা তাঁদের কাছে এটা জীবন-জীবিকা তথা আত্মসত্তার প্রশ্ন।
*****
মেরিনা সৈকত নিয়ে এই লড়াই দীর্ঘদিনের।
সেই ব্রিটিশ রাজ থেকে শুরু করে পর পর আসা প্রতিটি সরকার মেরিনা সৈকতের সৌন্দর্যায়নে নিজেদের অবদান রেখে গেছে। দীর্ঘ বুলেভার্ড, পাশের সবুজ লন, মাপে মাপ গাছের সারি, পরিষ্কার হাঁটার রাস্তা, স্মার্ট কিয়স্ক, ঢালু র্যাম্প এবং আরও কত কী।
এইবারের বার আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সুয়ো মোতো পিটিশনে মৎস্যজীবীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, লুপ রোডের ভয়াবহ যানজট সমস্যার কারণে। মাদ্রাস হাইকোর্টের বিচারকরা নিজেরাই নিয়মিত এই রাস্তা যাতায়াতের পথে ব্যবহার করেন। রাস্তার ধারের মাছের দোকানগুলো দিনের ব্যস্ততম সময়গুলোতে যানজট সমস্যা বাড়ায় বলে দাবি, তাই সেগুলোকে হটানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
১২ এপ্রিল তারিখে জিসিসি আর পুলিশ লুপ রোডের পশ্চিম দিকের মাছের দোকানগুলো ভাঙতে শুরু করে, আর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে এলাকার জেলে জনগোষ্ঠী। পরপর বিক্ষোভ কর্মসূচির ধাক্কায় জিসিসি আদালতকে জানায় যতদিন না আধুনিক একটা মাছের বাজার তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে ততদিন লুপ রোডে জেলেদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে রাখবে তারা – তারপর বন্ধ হয় বিক্ষোভ। এলাকা জুড়ে এখন পুলিশের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
“চেন্নাই পুরসভা হোক আর জজসাহেব, সবাই তো সরকারেরই অঙ্গ, তাই না? তো সরকার এমনটা করছে কেন? একদিকে আমাদের সমুদ্রসৈকতের প্রতীক বানাচ্ছে, আর অন্যদিকে আমাদের রুজিরুটি কেড়ে নিচ্ছে,” বলছেন সৈকতের মাছ বিক্রেতা ৫২ বছর বয়সি এস. সরোজা।
সরোজার ইঙ্গিত হল জেলেদের জন্য সৈকতবর্তী রাস্তার ওপারে সরকারের বানিয়ে দেওয়া [২০০৯-২০১৫ সালের মধ্যে] নচিকুপ্পম আবাসনের দেওয়ালগুলি নিয়ে সাম্প্রতিক মুরাল-সৌন্দর্যায়ন প্রকল্পের দিকে। ২০২৩ সালের মার্চে তামিলনাড়ু নাগরিক আবাস উন্নয়ন বোর্ড, এসটি+আর্ট নামের একটি এনজিও এবং এশিয়ান পেইন্টস সংস্থার যৌথ উদ্যোগে জেলে জনগোষ্ঠীর বাসস্থানগুলির ‘কায়াবদল’ করে তোলার এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। নেপাল, ওড়িশা, কেরালা, রাশিয়া এবং মেক্সিকো থেকে শিল্পীদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল নচিকুপ্পমের ২৪টি বস্তির দেওয়ালে মুরাল আঁকার জন্য।
“আমাদের জীবন নিয়ে দেওয়াল আঁকল, তারপর আমাদেরই এলাকা থেকে তুলে দিচ্ছে,” বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলেন গীতা। ওই ‘নিখরচার আবাস’ মোটেই নিখরচায় হাতে আসেনি তাঁর। “এক ফড়ে আমার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা চেয়েছিল একটা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য,” জানালেন ৪৭ বছরের পি. কান্নদাসন, নচিকুপ্পমের অভিজ্ঞ মৎস্যজীবী। “আমরা টাকা না দিলে ওই বাড়ি অন্য কাউকে দিয়ে দিত,” যোগ করলেন তাঁর ৪৭ বছর বয়সি আরাসু।
চেন্নাইয়ের নগরায়ন যত বেড়েছে – জেলেবসতি আর সৈকতের মাঝ ফুঁড়ে লুপ রোডের নির্মাণ যার অন্যতম অঙ্গ – তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পুরসভার সঙ্গে জেলেদের মতবিরোধ।
মৎস্যজীবীরা এখানে নিজেদের কুপ্পমের অংশ হিসেবে দেখেন। “ছেলেরা সাগরে আর সৈকতে কাজ করবে, কিন্তু মেয়েদের কাজ করতে হবে বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে, তাহলে আর কুপ্পমের অর্থ কী রইল?” প্রশ্ন তুলছেন ৬০ বছরের পালয়ম। “পরস্পরের সঙ্গে, সমুদ্রের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ আমরা হারিয়ে ফেলব।” অনেক পরিবারের ক্ষেত্রেই সারাদিনের ব্যস্ততার মধ্যে পরস্পরের সঙ্গে দেখা-কথা হওয়ার একমাত্র সুযোগ হল পুরুষদের নৌকা থেকে মেয়েদের দোকানে মাছ সরবরাহ করার সময়টুকু। তার কারণ ছেলেরা সারারাত মাছ ধরেন আর সারাদিন ঘুমান, আর মেয়েরা দিনের বেলাই মাছ বিক্রি করতে বেরোন।
যাঁরা নিয়মিত এখানে হাঁটতে বা শরীরচর্চা করতে আসেন, তাঁরাও এই এলাকাটিকে জেলেদের জায়গা বলেই মানেন। “সকালবেলা এখানে অনেক মানুষ আসেন,” জানালেন ৫২ বছরের চিট্টিবাবু, মেরিনা সৈকতে নিয়মিত হাঁটতে আসেন তিনি। “শুধু মাছ কিনতেই আসেন অনেকে… এটা ওঁদের [জেলেদের] বংশগত পেশা আর [ওঁরা] এখানে বহুদিন ধরে আছেন। ওঁদের এখান থেকে সরে যেতে বলার কোনও মানে হয় না,” বলছেন তিনি।
সায় দিচ্ছেন নচিকুপ্পমের ২৯ বছর বয়সি মৎস্যজীবী রঞ্জিত কুমার। “একই জায়গায় নানাধরনের মানুষ আসতে পারেন। যেমন ধরুন, মানুষ এখানে হাঁটতে আসেন মোটামুটি সকাল ৬-৮টার মধ্যে। এই সময়টা আমরা সমুদ্রে থাকি। যতক্ষণে আমরা ফিরে আসি আর মেয়েরা দোকান সাজিয়ে বসে, হাঁটার লোকেরা সবাই চলে যান। ওঁদের আর আমাদের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। সমস্যা শুধু প্রশাসন তৈরি করছে,” বলছেন তিনি।
*****
বাজারে মেলে নানা প্রজাতির মাছ। ছোটো, অগভীর জলের মাছ, যেমন বরগুনি [টেরাপন জার্বুয়া] বা ভোঁতানাক টাক চান্দা [ডেভেক্সিমেন্টাম ইনসিডিয়াটর] নচিকুপ্পম বাজারে ২০০-৩০০ টাকা কিলোদরে মেলে। এগুলো স্থানীয়ভাবে ধরা হয়, গ্রামের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে, বাজারের একটা নির্দিষ্ট দিকে বিক্রি হয়। বড়ো, দামি মাছ বিক্রি হয় বাজারের অন্য প্রান্তে, যেমন সির মাছ বা চম্পা মাছ [স্কম্বেরোমোরাস কমার্সন] বিকোয় ৯০০-১০০০ টাকা কিলোয়, আর বড়ো ত্রেভালি মাছ [সিউডোক্যারাংক্স ডেন্টেক্স] পাওয়া যায় ৫০০-৭০০ টাকা কিলোদরে। এখানকার মৎস্যজীবীরা যেসব প্রজাতির মাছ বেচেন, তাদের তাঁরা স্থানীয় নামেই ডাকেন — কীচন, কারাপোডি, ভঞ্জরম, পারই।
বাজার বসার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু সূর্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। মাছ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে বিক্রি করে ফেলতে হবে; অভিজ্ঞ খরিদ্দারেরা তাজা আর বাসি মাছের তফাৎ বুঝে যান সহজেই।
“ঠিকমতো মাছ বিক্রি করতে না পারলে ছেলেমেয়েদের স্কুলের মাইনে কে দেবে?” প্রশ্ন করেন গীতা। তাঁর দুই সন্তান, একজন স্কুলে যায় অন্যজন কলেজে। “স্বামী রোজ রোজ মাছ ধরতে যাবে ভেবে বসে থাকলে তো চলবে না। রোজ রাত ২টোয় উঠে কাসিমেডু [নচিকুপ্পমের ১০ কিলোমিটার উত্তরে] যাই মাছ কিনতে, বাজার খোলার মুখে মুখে ফিরে আসি। এটা না থাকলে বেতন তো ছাড়ুন, খেতেও পাব না,” বলছেন তিনি।
তামিলনাড়ুতে সামুদ্রিক মৎস্যজীবিকায় যুক্ত ৬০৮টি গ্রামের মোট ১০.৪৮ লক্ষ মৎস্যজীবীর প্রায় অর্ধেকই নারী। আর এই বসতিগুলির মহিলারাই মূলত মাছের বাজারগুলি চালান। যথাযথ আয়ের হিসাব করা কঠিন, তবে নচিকুপ্পমের মেয়েরা বলছেন এখানে যাঁরা মাছ বিক্রি করেন তাঁদের আয় দূরের সরকার-অনুমোদিত কাসিমেডু বন্দর বা অন্যান্য ঘেরা বাজারের বিক্রেতাদের তুলনায় বেশি।
“আমার সবচেয়ে ব্যস্ত যায় শনি-রবি,” জানালেন গীতা। “প্রতিটি খরিদ্দারিতে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা মতো আসে। আর খোলার সময় (সকাল ৮:৩০-৯টা) থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত প্রায় একনাগাড়ে বিক্রি করে যাই। কিন্তু ঠিক কতটা আয় হয় ওভাবে হিসেব করে বলা তো মুশকিল, কারণ আমার তো সকালে অতদূর গিয়ে মাছ কিনে আনতেও খরচা হয়। আর কতটা খরচা হবে সেটা নির্ভর করে প্রতিদিন কোন কোন জাতের মাছ পাচ্ছি, আর তার কত দর পাচ্ছি, এসবের উপর।”
প্রস্তাবিত ঘেরা বাজারে সরে যেতে হলে আয় পড়ে যাওয়ার ভয় তাঁদের সবার মাথায় খাঁড়া হয়ে ঝুলছে। “এখানে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাতে, বাচ্চাদের মানুষ করতে পারি,” জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলেনি। “আমার ছেলে তো কলেজে পড়ছে! কিন্তু এখন ঘেরা বাজারে উঠে গেলে যদি কেউ মাছ কিনতে না আসে তবে ওর আর আমাদের অন্য সন্তানদের কলেজের খরচ কী করে জোগাব? সরকার কি সেটারও দায়িত্ব নেবে?” সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুললে বিপদ হতে পারে, সেই ভয়ও পাচ্ছেন তিনি।
বেসান্ত নগর বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটি ঘেরা বাজারে উঠে যেতে বাধ্য করা হয়েছে যে মেছুনিদের তাঁদের একজন ৪৫ বছরের আর. উমা। বলছেন, “একটা গোটা পায়রাতালি মাছ [স্ক্যাটোফ্যাগাস আর্গাস] নচিকুপ্পমে ৩০০ টাকায় বিকোয়, এই বেসান্ত নগর বাজারে সেটার ১৫০ টাকার বেশি দাম রাখাই যায় না। দাম বাড়ালে কেউ মাছ কিনবে না আমাদের থেকে। দেখুন না, কেমন ঘুপচি মতো বাজার, সব মাছ বাসি। সৈকতে তাজা মাছ বিক্রি করতেই তো চাই আমরা, কিন্তু প্রশাসন আমাদের করতে দেবে না। আমাদের এই ঘেরা বাজারে এনে বসিয়ে দিয়েছে। তাই আমাদের দাম কমাতে হয়, বাসি মাছ বেচতে হয়, আর নামমাত্র আয়ে সংসার চালাতে হয়। নচিকুপ্পমের মেয়েরা কেন সৈকতে মাছ বেচার দাবিতে লড়াই করছেন আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি; আমাদেরও সেটাই করা উচিত ছিল।”
সৈকতের নিয়মিত মাছের খদ্দেরদের মধ্যে চিট্টিবাবুও আছেন। বলছেন, “আমি জানি যে নচিকুপ্পম বাজারে তাজা মাছের দাম অনেক বেশি, কিন্তু গুণমানের নিশ্চয়তা থাকলে সেই বেশি দামটা দিতে আমি রাজি।” নচিকুপ্পমে দুর্গন্ধময় আবর্জনার কমতি একেবারেই নেই, কিন্তু তাঁর কথায়, “কোয়াম্বেডু বাজার (একটি ফলফুল-সবজির বাজার) বুঝি সারাক্ষণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে? সব বাজারই নোংরা হয়, খোলা বাজারগুলো তো তাও ভালো।”
“সৈকতের বাজারে গন্ধ থাকতেই পারে,” যোগ করছেন সরোজা, “কিন্তু খোলা রোদে সবকিছু শুকিয়ে যেতে থাকে, আর পরে ঝাঁট মেরে সরিয়ে দেওয়া যায়। নোংরা সাফ করে দেয় সূর্যই।”
“জঞ্জালের গাড়ি এসে আবাসনগুলো থেকে বাড়ির আবর্জনা নিয়ে যায়, কিন্তু বাজারের আবর্জনা নেয় না,” জানাচ্ছেন নচিকুপ্পমের ৭৫ বছর বয়সি জেলে আর. কৃষ্ণরাজ। “ওদের [সরকার] তো এ জায়গাটাও [লুপ রোড বাজার] সাফ রাখা উচিত।”
“সরকার তো কত কত নাগরিক পরিষেবা দেয়, তো এই [লুপ রোড] এলাকাটায় ঝাঁট দেওয়া যাবে না কেন? ওরা [সরকার] কি বলতে চায় যে এই জায়গাটা আমাদের পরিষ্কার রাখতে হবে, কিন্তু আর কোনও কাজে আমরা এটা ব্যবহার করতে পারব না?” প্রশ্ন তুলছেন পালয়ম।
কান্নদাসনের কথায়, “সরকার শুধু ধনীদের সুবিধা করতে চায়, হাঁটার জন্য পথ, রোপ কার এইসব প্রকল্প করছে সেই কারণেই। ওরা হয়তো সরকারকে টাকা দেয় এসব যাতে হয়ে যায় বলে, আর সরকার দালালদের টাকা দেয় এখানে কাজ করার জন্য।
“জেলের জীবন বাঁচে জলের কাছে থাকলে। তাকে ডাঙার ভিতরে ঠেলে দিলে সে কেমন করে প্রাণধারণ করবে? কিন্তু জেলেরা প্রতিবাদ করলেই তাদের গারদে পুরে দেওয়া হবে। মধ্যবিত্ত মানুষ প্রতিবাদ করলে তাও সরকার মাঝে মাঝে শোনে। আমরা জেলে চলে গেলে আমাদের পরিবারকে কে দেখবে?” বলছেন কান্নদাসন। “কিন্তু এগুলো তো জেলেদের ব্যাপার, আমাদের তো নাগরিক বলে মনেই করা হয় না,” যোগ করেন তিনি।
“ওদের যদি এখানে গন্ধ লাগে, তো ওরা চলে যাক,” বলছেন গীতা। “আমাদের কারও সাহায্য, কারও অনুগ্রহ দরকার নেই। আমরা শুধু চাই আমাদের সমস্যায় ফেলা, অত্যাচার করা বন্ধ হোক। আমরা টাকা, মাছের ক্রেট, ঋণ, এসব কিচ্ছু চাই না। আমাদের শুধু আমাদের জায়গাটায় বাঁচতে দেওয়া হোক, তাতেই হবে,” বলে ওঠেন তিনি।
“নচিকুপ্পমে যে মাছ বিকোয় তার বেশিরভাগই এখানকার, তবে আমরা মাঝে মাঝে কাসিমেডু থেকেও মাছ নিয়ে আসি,” জানালেন গীতা। “মাছ কোথা থেকে আসছে সেটা প্রশ্ন নয়,” মন্তব্য করেন আরাসু, “আমরা সবাই এখানে মাছ বেচি। আমরা সবাই একজোট। বাইরে থেকে দেখলে হয়তো মনে হবে আমরা সারাক্ষণ চিৎকার-চেঁচামেচি, ঝগড়া করছি, কিন্তু ওগুলো তো ছোটোখাটো ব্যাপার। আসল সমস্যায় আমরা সবসময় একজোট হয়ে প্রতিবাদে নামি। কাজকর্ম সব ছেড়ে আমরা শুধু নিজেদের সমস্যা নিয়ে প্রতিবাদ করি না, অন্য জেলে গ্রামের সমস্যাতেও ঝাঁপিয়ে পড়ি।”
লুপ রোড বরাবর তিনটি জেলে কুপ্পমের বাসিন্দাদের মনে ছায়া ফেলছে নতুন বাজারে দোকান না পাওয়ার আশঙ্কাও। “নতুন যে বাজার হচ্ছে সেখানে ৩৫২টা দোকান থাকবে,” বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের অবগত করলেন নচিকুপ্পম জেলে সমাজের প্রধান রঞ্জিত। “শুধু যদি নচিকুপ্পমের বিক্রেতাদের দোকান দেওয়া হয় তবে পর্যাপ্তের বেশিই দোকান থাকছে। কিন্তু ওই বাজারে নচিকুপ্পম থেকে পাট্টিনাপক্কম পর্যন্ত গোটা লুপ রোড বরাবর তিনটে জেলে কুপ্পমের বিক্রেতাদের রাখার কথা বলা হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০ বিক্রেতা। ওই ৩৫২টা দোকান অ্যালট হয়ে গেলে বাকিদের কী হবে? কাকে দোকান দেওয়া হবে, বাকিরা কোথায় যাবে, এসব নিয়ে কোনও স্বচ্ছতা নেই,” বলছেন তিনি।
“আমি গিয়ে ফোর্ট সেন্ট জর্জের [বিধানসভা যেখানে অবস্থিত] সামনে মাছ বেচব। গোটা বস্তি যাবে আমার সঙ্গে, আমরা গিয়ে বিক্ষোভ করব,” বলছেন আরাসু।
এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত মেয়েদের নাম তাঁদের অনুরোধে পরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী