“আমাদের খাবারের প্যাকেট দিতে হবে না, রেশনের দোকান থেকে চাল কেনার ক্ষমতা আছে আমাদের। বরং এই জল জমার সমস্যার কিছু সমাধান করুন দেখি!” সেম্মনজেরিতে জড়ো হওয়া মহিলারা বললেন।
চেন্নাই থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে, কাঞ্চিপুরম জেলার অন্তর্গত ওল্ড মহাবলীপুরম রোডের পাশে অবস্থিত এই এলাকা, ২০২০ সালের ২৫শে নভেম্বর ভয়াবহ রকম জলমগ্ন হয়েছিল।
এই নিচু অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে জল জমার ঘটনা আদৌ নতুন কিছু নয়। ২০১৫ সালে চেন্নাইয়ের ভযংকর বন্যা ও পরবর্তী অব্যবস্থার জেরে সেম্মনজেরিও প্রভাবিত হয়েছিল। পরবর্তী বছরগুলিতে কিছু কিছু এলাকার রাস্তা ও নিকাশি ব্যবস্থায় খানিকটা উন্নতি হয়েছে।
সেম্মনজেরি ( সেম্মনচেরি নামেও পরিচিত) আবাসন পর্ষদের এলাকাগুলির অবশ্য এই তালিকায় নাম নেই - বিভিন্ন সময়ে নগর ও পরিকাঠামো ‘উন্নয়নের’ খাতিরে স্থানান্তরিত মানুষদের মাথা গোঁজার ঠাঁই এই জায়গা এমনিতেই উপেক্ষিত। এখানকার বাসিন্দারা চেন্নাই শহরে গৃহকর্মী, সাফাইকর্মী, অটোরিকশাচালক হিসাবে, অথবা অসংগঠিত ক্ষেত্রে বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
ঘুর্ণিঝড় নিভার করাল চেহারা নিয়ে তামিলনাড়ুর উপর নেমে এলে তার জেরে কুড্ডালোরে ২৫০ মিমি ও চেন্নাইয়ে ১০০ মিমি বৃষ্টি হল, এর ফলে সেম্মনজেরির বাড়িগুলিতেও হুহু করে জল ঢুকে গেল। ঘরের মধ্যে এক ফুট, ও রাস্তায় প্রায় দুই ফুট জল দাঁড়িয়ে গেল।
পারি’র প্রতিনিধিরা নভেম্বরের ২৭ তারিখে সেম্মনজেরিতে যান। একদিন আগেই চেন্নাইয়ের দক্ষিণ উপকুল ধরে পুদুচেরির কাছ দিয়ে ঘুর্ণিঝড় বয়ে যায় (২৫শে নভেম্বর রাত ১১:১৫ মিনিটে)। এর জেরে ৩-জনের মৃত্যু হয় , ১লাখ ৩৮ হাজার মানুষ গৃহহীন হন , ১৬,৫০০ হেক্টর জুড়ে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয় (বিভিন্ন খবরের কাগজের সুত্র অনুযায়ী), ও উপকূলবর্তী শহরগুলিতে বন্যা দেখা দেয়।
সেম্মনজেরির প্রায় ৩০,০০০ বাসিন্দার জন্য এই পরিস্থিতি আদতেই নতুন কিছু নয় – তাঁদের বাড়িতে জল ঢুকে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র তছনছ হয়ে যায়, দিনের পর দিন বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ থাকে ও উপরতলার পড়শিদের আশ্রয়ে দিন কাটাতে হয়। শৌচাগার ও নর্দমা থেকে জল উপচে পড়ে, ঘরের মধ্যে সাপ ও বিছের অবাধ বিচরণ চলে, ঘরের দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ে।
কিন্তু এই অবস্থাটা হয় কেন? শুধুমাত্র নিম্নবর্তী এলাকা বলেই নয়, আশেপাশে গজিয়ে ওঠা বহুতল বাড়িগুলির জন্য জল নিকাশির অল্পবিস্তর যা পথ ছিল তাও বন্ধ হয়ে গেছে। এলাকার জলাশয় থেকে জল উপচে পড়ে, তার সঙ্গে আবার রাজ্যের জলাধারগুলি থেকে অতিরিক্ত জল ছেড়ে দেওয়ার ফলে এই বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। উপরন্তু এলাকার চারপাশে ঘিরে থাকা প্রায় ১০ ফুট উঁচু দেওয়াল, যেটি সম্ভবত এখানে বসবাসকারী দরিদ্র পরিবারগুলির দুর্দশা আড়াল করার জন্য নির্মিত, তা জমা জল আরও বেশিক্ষণ ধরে রাখে।
মুষলধারে বৃষ্টি হলেই এখানকার রাস্তা রীতিমতো নদীর চেহারা নেয়, গাড়িগুলো নৌকার মতো ভাসতে থাকে। রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে বাচ্চারা কাপড়ের জাল নিয়ে মাছ ধরে, আর তাদের মায়েরা সারাদিন ধরে পাঁচ-লিটারের একটা বালতি করে ঘরের জমা জল বের করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যান।
মহিলারা জানালেন, “আমাদের এখানে তো ফি বছরই সুনামি আসে, কিন্তু ভোট ছাড়া অন্য সময়ে কেউ দেখতেও আসে না। ২০০৫ সালে আমরা ফোরশোর এস্টেট, উরুর কাপ্পাম, ও চেন্নাইয়ের অন্যান্য এলাকা থেকে এখানে উঠে এসেছি। আমাদের যারা তাড়িয়েছিল, সেই আধিকারিক ও নেতাগুলো দিব্যি সুখে তাদের মালিগাইয়ে [অট্টালিকা] রয়েছে। আর আমাদের অবস্থাটা দেখুন!”
যাতে জল নিকাশির ব্যবস্থাটা অন্তত হয়, সেই আশায় মহিলারা হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন, তাঁদের সঙ্গে বাচ্চারাও অপেক্ষা করে।
অনুবাদ: রুণা ভট্টাচার্য