মেয়ের বিয়ে, তাই ন'টি ওভি গেয়ে প্রাণপ্রিয় দেবদেবীদের সাধ করে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন পুণে জেলার শিরুর-নিবাসী বিজয়া মেইদ – আমোদে আহ্লাদে পরিপূর্ণ এই দোহাগুলিতে ফুটে উঠেছে বিয়েবাড়ির কিছু খণ্ডচিত্র
বিজয়া মেইদ যখন জানতে পারলেন যে তাঁর কলেজ-পড়ুয়া ছেলে জিতেন্দ্র গ্রামে গ্রামে ঘুরে জাঁতা পেষাইয়ের গান সংগ্রহ করছেন, তখন আর থাকতে না পেরে তিনি বলেই ফেললেন একদিন, "খোকা রে, আমিও তো গুটিকয়েক গান জানি, তুই নিবি না ওগুলো?" তা এই "গুটিকয়েক"-টা শেষমেশ ১৭৩-এ গিয়ে দাঁড়ায় – জাঁতা পেষাইয়ের গানের প্রকল্পে (জিএসপি) এটা ছিল তাঁর অমূল্য অবদান।
১৯৯০-এর দশকে জিএসপির যে আদি দলটি একলাখেরও বেশি জাট্যাভার্চ্যা ওভ্যা (জাঁতা পেষাইয়ের গান) সংগ্রহ করেছিল, জিতেন্দ্র মেইদ ছিলেন সেই দলেরই অন্যতম এক সদস্য। গাইয়েরা প্রত্যেকেই মহিলা, এবং তাঁদের বেশিরভাগই মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা। তবে অল্প কয়েকজন কর্ণাটক-নিবাসীও ছিলেন। (জিএসপির দ্বায়িত্ব পারি'র হাতে আসার পর জিতেন্দ্রও যোগ দিয়েছেন এই নতুন দলে, এখানে তিনি ওভিগুলিকে মারাঠি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে আশাতাই ওগালেকে সাহায্য করেন।)
বছর তিনেক আগে যখন আমরা পুণে শহরে জিতেন্দ্রর বাড়িতে গিয়েছিলাম বিজয়াবাইয়ের (এখন তাঁর বয়স ৮০) সঙ্গে দেখা করতে, তিনি বলছিলেন, "আমি নিজে ওই ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছি বটে, তবে আমার ছেলেমেয়েরা কিন্তু সব্বাই শিক্ষিত। কয়েকজন চাকরিবাকরি করে, বাকিদের সব নিজের নিজের ব্যবসাপাতি আছে।" এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন জাঁতা পেষাইয়ের গান গাইতে, কিন্তু প্রথমটায় ওভির কথাগুলো ঠিক মনে করতে পারছিলেন না। তবে ছেলের সাহায্যে আস্তে আস্তে সবকিছু মনে পড়ে যায় তাঁর, আর আমরাও মহানন্দে রেকর্ড করে ফেলি একের পর এক দোহা।
এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে নদীর মতো বহতা সাংগীতিক সহজিয়ার এই নারী-কেন্দ্রিক ধারাটি। মা এবং মাসির কাছে জাঁতা পেষাইয়ের গানে হাতেখড়ি হয়েছিল বিজয়াবাইয়ের। আট বোন আর তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়ো। পুণের ইন্দাপুর তালুকের পলশদেও গ্রামে থাকত তাঁর পরিবার। ১৬ বছর বয়েসে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তবে সে বিয়ের আগে হোক বা পরে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়নি এমন একটিও দিন আসেনি তাঁর জীবনে – জানালেন বিজয়াবাই।
মহারাষ্ট্রের বহু নারীর মতোই বিজয়াবাইয়ের জীবনও আবর্তিত হয় পালা-পার্বণ কিংবা আচার-অনুষ্ঠানের লৌকিকতা, দেবদেবীদের উপর নিবিড় বিশ্বাসকে ঘিরেই
বিয়ের পর পুণে জেলায় শিরুর তালুক-শহরে চলে আসেন তিনি। তাঁর স্বামী কান্তিলাল মেইদ দিনেরবেলায় স্থানীয় একটি আড়তে মাপাড়ির (পাল্লাধারী) কাজ করতেন। রাতেও বিশ্রাম জুটত না তাঁর, একটি রেশনের দোকানে কাজ করতে যেতে হত তাঁকে। সপ্তাহান্তে কিলো পাঁচেক জোয়ার কিংবা বাজরা হাতে পেতেন, এটাই ছিল তাঁর পারিশ্রমিক।
বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার পর সংসারের খাইখরচা বেড়েই চলেছিল, তাই ওইটুকু আনাজ আর আড়ত থেকে পাওয়া টাকায় কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না কান্তিলাল। "মা বাধ্য হয়েছিল শিরুরে একটা তামাকের কারখানায় কাজ করতে। তামাকের ছাঁট বাড়িতে নিয়ে আসত, আমরা সেগুলো তারপর ছোট ছোট প্যাকেটে ভরে ফেলতাম," ছোটোবেলার কথা মনে করছিলেন জিতেন্দ্র। তিনি তাঁর পাঁচ ভাই আর এক বোনের সঙ্গে মায়ের সঙ্গে কাজে হাত লাগাতেন। "কেরোসিনের একটা পিদিম জ্বালিয়ে সেটার আগুনে প্যাকেটগুলো সিল করতাম আমরা।"
আশির দশকে এরকম ১,০০০ খানা ছোটো ছোটো প্যাকেট বানিয়ে দিতে পারলে বিজয়াবাইয়ের হাতে আসত বারো আনা (৭৫ পয়সা)। স্বামী-স্ত্রীর এ হেন যৌথ প্রয়াসের পরেও মাস গেলে বাড়িতে মেরেকেটে ৯০টা টাকাও আসতো কিনা সন্দেহ। তাই জিতেন্দ্র এবং তাঁর পাঁচ ভাই বাধ্য হয়ে টুকিটাকি কাজ করে সংসারের ভাঁড়ার ভরার চেষ্টায় লেগে থাকতেন। কখনও বা শাকসবজি বিক্রি করতেন, কখনও বা ইস্কুল যাওয়ার পথে খবরের কাগজ বিলি করতেন।
মহারাষ্ট্রের বহু নারীর মতোই বিজয়াবাইয়ের জীবনও আবর্তিত হয় পালা-পার্বণ কিংবা আচার-অনুষ্ঠানের লৌকিকতা , দেবদেবীদের উপর নিবিড় বিশ্বাসকে ঘিরেই। জাঁতা পেষাইয়ের গানের এই কিস্তিটিতে ন'টি ওভি গেয়ে প্রাণপ্রিয় দেবদেবীদের সাধ করে মেয়ের বিয়েতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন বিজয়াবাই। এই লোকাচারটি হিন্দুসমাজে বহুল প্রচলিত, ছেলেমেয়ের বিয়েতে আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধবদের ডাকার আগে আমন্ত্রণ পাঠানো হয় গৃহদেবতাকে। মূর্তির চরণে আমন্ত্রণ পত্রটি নিবেদন করে হবু বরবৌয়ের জন্য সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করা হয়।
জেজুরি কেল্লায় রয়েছে খান্ডোবা (খান্ডেরাও/খান্ডেরাজা) ও মহলসার মন্দির, এই ওভিগুলিতে গায়িকা তাঁর মেয়ের বিয়েতে ভারহাডির (বরযাত্রী) দলে যোগদান করতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন সেই দেবদেবীকে। কাছেই তুলজাপুরে রয়েছে অম্বাবাইয়ের (অম্বিকা) দেউল। লোকশ্রুতি অনুযায়ী অম্বামাতার রথটিকে টেনে নিয়ে যায় বাঘের দল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওভিতে এই দেবীর আগমনের কামনায় উৎসুক হয়েছেন গায়ক। বিয়ের জন্য রংবেরঙের শাড়ি কেনা হয়েছে, গায়ক প্রার্থনা করছেন যাতে গণেশ (গণপতি) এসে সেগুলিকে আশীর্বাদ করে যান। সাত নং ওভিতে তিনি বারবার বলছেন যাতে বিয়ের মণ্ডপের খুঁটিগুলো দূরে দূরে পোঁতা হয়। আসলে গদিতে মোড়া পেল্লাই এক চতুর্দোলায় চেপে গণরাজ আসবেন তো, পাছে তাঁর কোনও অসুবিধা হয় মণ্ডপে ঢুকতে।
আমোদে আহ্লাদে পরিপূর্ণ এই দোহাগুলিতে ফুটে উঠেছে বিয়েবাড়ির নানানরঙা খণ্ডচিত্র। পাছে পাড়াপড়শিরা তাঁর মেয়েকে নিয়ে গুজব রটায়, তাই পুরুত মশাইকে গায়ক কড়া ভাষায় বলছেন যাতে সে কোনও রকমের গণ্ডগোল না পাকায়। ওদিকে স্থানীয় লোকাচার অনুযায়ী মণ্ডপের ঠিক বাইরেই স্নান করছেন মেয়ের বাবা, তাই চারিদিক জল-কাদায় প্যাচপ্যাচ করছে। বিয়ের মরসুমে কাপড়জামার দাম হয়ে যায় আকাশছোঁয়া, তাই গায়ক তাঁর ভাইকে অনুরোধ করছেন তিনি যেন লৌকিকতা রক্ষার্থে কনের মা, অর্থাৎ তাঁকে একটা শাড়ি উপহার দেন। বিয়ের দিনে কনের দিদিরা তাঁদের নবজাতকদের নিয়ে এসেছেন কোলে করে – গায়ক বর্ণনা করছেন যে কীভাবে শামিয়ানার তলায় সেই শিশুদের জন্য শাড়ি দিয়ে বানানো সারি সারি দোলনা টাঙিয়ে রাখা হয়েছে।
অন্তিম ওভিটিতে গায়ক আবারও আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন গণপতিকে, অনুরোধ করছেন তিনি যেন দেবী শারদাকে নিয়ে আসেন। গণরাজ যেন আশীর্বাদ স্বরূপ নতুন নতুন শাড়ি (পৈঠানি) উপহার দেন নবদম্পতিকে, আদতে বলতে চাইছেন যে নতুন কাপড়জামা কেনা হয়েছে তা তো গণপতির আশীর্বাদেরই ফসল।
জেজুরি গড়ে এবার তরে পাঠাই বিয়ার বায়না রে,
খান্ডেরাজা আসবে জানি মালসারানির সঙ্গে সে।
হলদে বেলায় তত্ত্ব সাজাই তোমার সনেই অম্বাবাই,
আঙন ছাড়ি নতুন শাড়ি গনশা বাবার জন্যে তাই।
বায়না পাঠাই তুলজাপুরায় দেওতা কুলের শ্রেষ্ঠ হে,
রথের খাঁচে বাঘ বেঁধেছে অম্বিকামাই ধন্যি সে।
শোন্ রে বামুন, সাত খুনাখুন, করিসনে তুই নিন্দে আর,
পড়শি পাগল, বিয়ার আগল, এক বিটি মোর বারবেলার।
হায় রে কপাল, বিয়ের সকাল, উঠোন জুড়ে ডাকছে বান,
পূজার বাবা, হদ্দ হাবা, মন পিরিতেই করছে স্নান।
বিয়ার মাসে বেনিয়া হাসে, শখ শাড়ি সব আকাশ ছোঁয়,
ভাই রে আমার, ছাঁদনাতলার আঁচল পাতি তোর কুলোয়।
শোন্ শোন্ ছোকরা, রাখ্ দেখি নখরা, দূরে দূরে খুঁটি পুঁতে
শামিয়ানা ধর,
তাকিয়া তোশক বেঁধে, প্রকাণ্ড ভুঁড়ি সেধে, আসবে গণেশরাজা
স্বর্গ নাগর।
আজকে বিয়ার দিনে, ঝলমলে শামিয়ানে, দোলনা দোদুল সারি দিগন্তে
ধায়,
আহ্লাদী কনে তার বোনেদের পরিবার, বেটাবিটি ফুলেফলে ফুর্তি
রাঙায়।
সংসারে মোর, বিয়ার ঝাঁঝর, পাত পেড়ে তাই ডাকছি আজ,
শারদা পাশে গনশা আসে পৈঠানি তার অঙ্গলাজ।
পরিবেশক/গায়ক: বিজয়া মেইদ
গ্রাম: শিরুর
তালুক: শিরুর
জেলা: পুণে
জাতি: সোনার (স্বর্ণকার)
তারিখ: এখানে প্রকাশিত ভিডিও ও গানগুলি ২০১৮ সালের ৮ই অক্টোবর রেকর্ড করা হয়েছিল
পোস্টার: উর্জা
হেমা রাইরকর
ও গি পইটভাঁ'র হাতে তৈরি জাঁতা পেষাইয়ের গানের আদি প্রকল্পটির সম্বন্ধে
পড়ুন
।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)