“ইস্কুল যাবো...ইস্কুল...বৈভব...বৈভব...ইস্কুল…”
গরহাজির কোনও এক সহপাঠীকে সম্বোধন করে প্রতীক ক্রমাগত এই কথাগুলি বলে চলেছে। একটা মাটির ঘরের চৌকাঠে বসে আছে সে, তার দৃষ্টি সামনেই হেসে খেলে বেড়ানো ক’টি বাচ্চার দিকে। ১৩ বছরের এই ছেলেটি সকাল থেকে বিকেল অবধি এখানে ঠায় বসে থাকে। কখনও বা উঠানের একটা গাছে হেলান দিয়ে ও নিজের জগতটা দেখে — বিগত ১১ মাস ধরে তার পৃথিবী অবশ্য চৌকাঠ, উঠান, গোয়াল ঘর আর গাছের বাইরে বিশেষ প্রসারিত হতে পারেনি।
রাশিন গ্রামের বাচ্চারা প্রতীকের সঙ্গে খেলে না। “এখানকার বাচ্চারা বোঝেই না ও কী বলে। ও একা-একাই থাকে,” তার মা সারদা রাউত বুঝিয়ে বললেন, সারদার বয়স ৩২। পাড়ার আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে, এমন কি তাঁর অন্যান্য সন্তানের থেকেও প্রতীক যে আলাদা তা তিনি অনেক আগেই লক্ষ্য করেছেন। ১০ বছর বয়স অবধি ও কথাবার্তা বলতে বা নিজের কাজগুলি করতে পারত না।
আহমেদনগর জেলার করজাত তালুকে, ওদের গ্রাম থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে শোলাপুরের শ্রী ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ সর্বোপচার রুগ্নালয় নামের সরকারি হাসপাতালে আট বছর বয়সে তার ডাউনস সিন্ড্রোম ধরা পড়ে। সারদার মনে পড়ে, “১০ বছর বয়স অবধি ও কথা বলতে পারত না। কিন্তু তারপর ও স্কুলে যেতে শুরু করার পর থেকে আমাকে আই (মারাঠি ভাষায় মা) বলে ডাকতে শুরু করে। এখন ও নিজে বাথরুমে যায়, নিজেই চান করে নেয়। স্কুলটা আমার ছেলের কাছে খুব জরুরি। কয়েকটা অক্ষর শিখেছে, নিয়মিত স্কুলে যেতে পারলে তার আরও উন্নতি হবে। হায় রে এই মড়ক (অতিমারি)!” উত্তেজিত কণ্ঠে তিনি বলে ওঠেন।
২০২০ সালের মার্চ মাসের গোড়ায় কোভিড-১৯ অতিমারি শুরু হতেই প্রতীকের আবাসিক স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৬ থেকে ১৮ বছরের, বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন যে ২৫ জন আবাসিক-শিক্ষার্থীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রতীক তাদের অন্যতম।
২০১৮ সালে প্রতীক স্কুলে যেতে শুরু করার পর এক আত্মীয়, শোলাপুর জেলার কারমালা তালুকের বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য জ্ঞানপ্রবোধন মতিমন্দ নিবাসী বিদ্যালয়ের কথা জানান তার মাকে। প্রতীকের গ্রাম থেকে আন্দাজ ১০ কিলোমিটার দূরে এই বিদ্যালয়টি। শ্রমিক মহিলা মণ্ডল নামে, পুণের একটি বেসরকারি সংস্থা দ্বারা পরিচালিত এই বিদ্যালয়টি অবৈতনিক হওয়ায় পরিবারটিকে কোনও ব্যয়ভার বহন করতে হয় না।
সোম থেকে শুক্র সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪.৩০ অবধি আর শনিবার কয়েক ঘন্টা চলা এই বিদ্যালয়ে চার জন শিক্ষক পড়ুয়াদের কথা বলা, ব্যায়াম করা, নিজের যত্ন নেওয়া, কাগজ দিয়ে শিল্পকর্ম তৈরি করা ইত্যাদি শেখান, সেই সঙ্গে ভাষা-শিক্ষা দেন, সংখ্যা, রং, ও এই জাতীয় অন্যান্য জিনিস ও সেগুলির কাজ চিনতে বুঝতে শেখান।
কিন্তু লকডাউন প্রতীকের বিদ্যালয়ের নিয়মানুবর্তিতা তথা নির্ঘণ্ট, শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে তার মেলামেশা, সব বানচাল করে দিয়েছে। মার্চ মাসে বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে শেখা কিছু ইংরাজি ও মারাঠি অক্ষর মাঝে মাঝে সে বাড়িতে লেখার চেষ্টা করে বটে — অ আ ই... a b c d।
সারদার মহা চিন্তা যে এই ১১ মাসের বিরতিতে যা শিখেছিল, তার সবই সে ভুলতে বসেছে। তিনি জানাচ্ছেন যে ডিসেম্বর থেকে প্রতীক বর্ণমালা লেখা বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি আরও জানালেন, “মার্চ মাসে যখন ফিরে আসে তখন ও বেশ শান্তশিষ্ট ছিল। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে ও ততই খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। আমি আদর করে কিছু বললেও রাগত গলায় উত্তর দিচ্ছে।”
বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণ ও সেখানের নিয়ম বৌদ্ধিকরূপে প্রতিবন্ধী শিশুদের পক্ষে খুবই জরুরি বলে জানালেন উত্তর-মধ্য মুম্বইয়ের সিয়ানে অবস্থিত, লোকমান্য তিলক সাধারণ হাসপাতালের বিকাশজনিত ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপিকা, শিশুস্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ডঃ মোনা গজরে। বিশেষ বিদ্যালয়ের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তিনি বললেন যে সেখানে “প্রতিটি কাজকে অনেকগুলি ক্ষুদ্রতর ভাগে ভাগ করে ধৈর্য ধরে বার বার দেখানোর ফলে মনে রাখা এবং কাজগুলি ক্রমে নিজের থেকে করতে শেখা সহজ হয়। এই প্রশিক্ষণে বিরতি ঘটলে (বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধী) বাচ্চারা নিজেদের শেখা কাজ কয়েক মাসের মধ্যেই ভুলে যেতে পারে।”
ওরা যখন বাড়ি আসে তখন ওদের সঙ্গে স্কুল থেকে পঠনপাঠনের জন্য কিছু নানান সরঞ্জাম পাঠানো হয় যাতে ওদের লেখাপড়ার সঙ্গে সংযোগ বজায় থাকে। প্রতীককে সেইগুলির প্রতি মনোযোগ দেওয়ানো সারদার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে। “তার শিক্ষকরা রং ও বর্ণমালার তালিকা দিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু ও আমাদের কথাই শোনে না আর আমাদেরও তো কাজকর্ম থাকে,” তিনি বললেন। দশম শ্রেণি অবধি পড়াশুনা করা সারদা সংসার সামলানো ছাড়াও তাঁর বছর চল্লিশের স্বামী দত্তাত্রেয় রাউতের সঙ্গে নিজেদের দুই একর চাষের জমিতে কাজও করেন।
খারিফ মরশুমে তাঁরা নিজেদের সম্বৎসরের খোরাকির জোয়ার আর বাজরা ফলান। “নভেম্বর থেকে আমরা মাসে ২০—২৫ দিন অন্যের জমিতে কাজ করি,” বললেন সারদা। তাঁদের মোট মাসিক আয় ৬,০০০ টাকার বেশি হয় না। বাবা-মা কারও পক্ষেই ছেলেকে পড়াবার জন্য বাড়ি বসে থাকা সম্ভব নয় — বাড়িতে থাকা মানেই এমনিতেই অভাবের সংসারে আবার একজনের মজুরি বাবদ আসা টাকাটাও কমে যাওয়া।
প্রতীকের দাদা, ১৮ বছরের ভিকি তালুক কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়েন, ভাইকে পড়াশুনায় সাহায্য করার মতো বাড়তি সময় তারও নেই। লকডাউনের পর থেকে সে অনলাইন ক্লাস করছে, কিন্তু বাড়িতে কারও স্মার্টফোন না থাকায় তাকে গ্রামেই এক বন্ধুর বাড়ি যেতে হয় তার ফোনে পড়াশুনা করতে।
অনলাইন মাধ্যমে লেখাপড়া করা সবার জন্যই এক কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে (অনলাইন শ্রেণিকক্ষ থেকে অফলাইন শ্রেণিবৈষম্য) । বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতা সম্পন্নদের মধ্যে যারা বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে, তাদের জন্য এ আরও বড়ো বাধা। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, ভারতে ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৪০০,০০০ বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যে (মোট বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন বাচ্চাদের সংখ্যা ভারতে ৫০০,০০০) মাত্র ১৮৫,০৮৬ জন কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায়।
এই প্রতিষ্ঠানগুলির বেশিরভাগই সরকারি নির্দেশিকা পেয়েছে লকডাউনের সময়ে। (মহারাষ্ট্র সরকারের) প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য কমিশনেরেট সামাজিক ন্যায় ও বিশেষ সহায়তা প্রদান বিভাগের কাছে অতিমারির সময়ে, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছাত্রদের জন্য অনলাইন ক্লাস করার অনুমতি চেয়েছিল। সেই পত্রে বলা হয় — “থানে জেলার খরঘরের নভি মুম্বইয়ের বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন মানুষদের ক্ষমতায়নের জন্য স্থাপিত জাতীয় প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত পাঠ্য বিষয়ের মাধ্যমে এবং প্রয়োজন মতো এই জিনিসগুলি মা-বাবাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাঁদের মধ্যমে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য শিক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।”
প্রতীকের স্কুল, জ্ঞানপ্রবোধন বিদ্যালয় থেকে অক্ষর, সংখ্যা ও বিভিন্ন বস্তুর ছবি সম্বলিত চার্ট, পাঠ্য কবিতা ও গান ভিত্তিক অনুশীলনী ও আরও কিছু লেখাপড়ার সরঞ্জাম মা-বাবাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। তাছাড়াও তাঁদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য স্কুল থেকে ফোনে কথাও বলা হয়। স্কুলের প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর, রোহিত বাগাড়ে জানালেন যে তিনি ফোন মারফত নিয়মিত বাচ্চাদের খবর রাখছেন এবং মা-বাবাদের পরামর্শ দিচ্ছেন।
অবশ্য বাগাড়ে এ কথাও জানালেন যে ২৫ জন বাবা-মায়েদের মধ্যে সবাই হয় ইটভাটা শ্রমিক অথবা খেত মজুর। “পড়াবার জন্য মা-বাবার বাচ্চাদের সঙ্গে থাকা দরকার। কিন্তু একটা বাচ্চার জন্য বাড়ি থাকলে তো তাঁদের মজুরি মার যাবে। প্রতীকের মতো বাচ্চাদের অলসভাবে দিন কাটানো ছাড়া আর উপায় থাকে না। প্রতিদিনের কাজকর্ম, খেলাধুলা একদিকে যেমন ওদের আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে, তেমনই অন্যদিকে নিজেদের মেজাজ এবং আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এইসব কাজ অনলাইন চালানো অসম্ভব, বাচ্চাদের দিকে আলাদা করে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন,” জানালেন তিনি।
বন্ধ বিদ্যালয় আরও এক বৌদ্ধিকরূপে প্রতিবন্ধকতা-সম্পন্ন ছাত্র, ১৮ বছরের সংকেত হুম্বের জীবনের উপরেও ছাপ ফেলেছে—সে থাকে ১২,৬০০ জনসংখ্যা বিশিষ্ট রাশিন গ্রামে। মার্চ মাস থেকে নিজের পাকা বাড়ির অ্যাসবেস্টসের ছাদের তলায় একটা লোহার খাটে বসে সে এখন সারাদিন গুনগুন করে চলে। (এমনিতেও এই বিদ্যালয়গুলি ১৮ বছর অবধি ছেলে-মেয়েদেরই ভর্তি নেয়। তারপর তারা সাধারণত বাড়িতেই থাকে। করজাত তালুকে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে কয়েকটি, কিন্তু এখানে যে অর্থ ব্যয় করতে হয় তা খেত মজুর মা-বাবার সামান্য আয়ে কুলায় না)।
ছয় বছর বয়সে সংকেতের ‘গভীর মানসিক প্রতিবন্ধকতা’ ধরা পড়ে, (চিকিৎসাপত্র অনুসারে) ফলে সে কথা বলতে পারে না এবং সে বারে বারে মৃগী রোগ-জনিত খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয় বলে তাকে নিয়মত ওষুধ খেতে হয়। ২০১৫ সালে গ্রামের আশা-কর্মীর (স্বীকৃত সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী) পরামর্শক্রমে সংকেতের ১৫ বছর বয়সে তার মা মনীষা (৩৯) তাকে স্কুলে দাখিল করেন।
“আগে আমাদের ওকে জামা-কাপড় পরিয়ে দিতে হত, চান করিয়ে দিতে হত, শৌচাগার ব্যবহারেও সাহায্য করতে হত। চারপাশে মানুষজন দেখলে ও অস্থির হয়ে উঠত। কিন্তু স্কুল যাওয়ার পর থেকে তার অনেকটা উন্নতি হয়েছে,” বললেন মনীষা।
১১ মাস যাবৎ বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ও শৌচাগার ব্যবহার করার প্রশিক্ষণ ভুলে গেছে। “মার্চ মাসে বাড়ি ফিরে আসার কয়েক সপ্তাহ পর থেকেই ও তার জামাকাপড় ময়লা করে ফেলত, নিজের মুখে আর দেওয়ালে মল মেখে রাখত,” বললেন মনীষা।
প্রথমদিকে কয়েক সপ্তাহ ও পরে টানা কয়েক মাস বন্ধ স্কুল থাকায় তাঁর দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। “সংকেত আক্রমণাত্মক আর জেদি হয়ে যায়, রাতে ঘুমাতে পারে না। কখনও কখনও সারা রাত না ঘুমিয়ে সে খাটে এমনি এমনি বসে বসে দুলতে থাকে,” জানালেন মনীষা।
২০১০ সালে ৩০ বছর বয়সে তাঁর কৃষিজীবী স্বামী আত্মহত্যা করার পর থেকে মনীষা ছেলে ও ১৯ বছর বয়সী মেয়ে ঋতুজাকে নিয়ে নিজের মা-বাবার কাছে থাকেন। (দূরসংযোগের মাধ্যমে স্নাতক স্তরের পড়াশোনার কারণে ঋতুজা এখন থানে জেলার বদলাপুর শহরে নিজের এক মাসির বাড়িতে থাকেন)। মনীষা সারা বছর নিজের মা-বাবার সাত একর জমিতে কাজ করেন। খেতমজুরদের সাহায্যে তাঁরা ভুট্টা ও জোয়ার চাষ করেন খরিফ এবং রবি মরসুমে।
মনীষা বলছিলেন, “আমার বাবা-মা, দু’জনের বয়সই ৮০ বছরের উপরে — তাদের পক্ষে সংকেতকে সামলানো সম্ভব না। ওরা আদর করে কিছু বললেও ওদের ধাক্কা দেয়, ওদের দিকে জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারে আর জোরে চিৎকার করে।” কিন্তু মনীষার পক্ষে বাড়িতে বসে থাকা সম্ভব না। “তাহলে কাজ কে করবে? আমরা তবে খাবই বা কী?” তাঁর প্রশ্ন।
মার্চ মাসে যখন ও স্কুল থেকে ফিরে আসে তখন এতখানি আক্রমণাত্মক ছিল না সে। মনীষা আরও জানালেন, “ও আমার সঙ্গে চাষের খেতে যেত, গরুর খাবার মাথায় করে নিয়ে পৌঁছে দিতে সাহায্য করত। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাস থেকে ও হঠাৎই আসা বন্ধ করে দেয়। মনীষা ওকে আসার জন্য বললে ও মাকে লাথি মারে বা মারধর করে। “আমি তার উপর রাগ করতে তো আর পারিনা। একজন মায়ের কাছে তার সব বাচ্চাই সমান। যেমনই হোক ও, আমার কলিজার টুকরো,” বললেন তিনি।
মনীষা দশম শ্রেণি অবধি পড়াশোনা করেছেন, স্কুল থেকে দেওয়া চার্টটির সাহায্যে তিনি ছবি দেখিয়ে বিভিন্ন জিনিস ছেলেকে চিনতে শেখাবার চেষ্টা করেন। খেত থেকে ফিরে এসে সংসারের কাজ করতে করতে এই কাজ করেন। দুঃখ করে বলছিলেন তিনি, “আমি চার্ট দেখানো মাত্র ও একেবারে আমার কাছ থেকে পালিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে বসে থাকে। আমার কথাই ও শোনে না।”
বাড়ি ফেরত আসার পর, বিদ্যালয়ের নির্ঘণ্ট, নিয়মিত কাজকর্ম, সেখানে আর সব ছাত্রদের সঙ্গে খেলাধুলা, লেখাপড়ার সরঞ্জামের সাহায্য শেখা আর নিজের যত্ন নেওয়ার শিক্ষার অভাব এই সকল গভীর ও অতিমাত্রায় মানসিক প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন শিশু-কিশোরদের আচরণের উপর ছাপ ফেলতে পারে বলে জানালেন রোহিত বাগাড়ে।
বাড়িতে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ আর নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক পরিষেবা থাকলেও প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের জন্য মুখোমুখি ক্লাস করাটা খুব জরুরি। “তাছাড়া একটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে পড়াতে অশেষ ধৈর্য দরকার হয়, যতক্ষণ না বুঝতে পারছে ততক্ষণ বারবার বলে তাকে রাজি করানোর চেষ্টা করে যাওয়া মা-বাবার পক্ষে সম্ভব হয় না,” বাগাড়ে বললেন। “অভিভাবকরা এই কাজ করতে অভ্যস্ত না হওয়ায় ধৈর্য রাখতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়ে বলেন যে বাচ্চাটি তাঁদের কথা শোনে না।”
মুম্বইয়ের লোকমান্য তিলক হাসপাতালের ডঃ গজরে জানালেন, “বৌদ্ধিকরূপে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার মূল কথা ধারাবাহিকতা।” এরই সঙ্গে তিনি বলেন যে অতিমারির কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহু প্রতিবন্ধী শিশু তাদের বিশেষ ধরনের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে পরনির্ভরশীল ও স্কুলছুট হয়ে যাচ্ছে। “অফলাইন থেরাপি ও প্রশিক্ষণের অভাব, বিশেষত বৌদ্ধিকরূপে প্রতিবন্ধী শিশুদের ক্ষেত্রে, কখনই অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে পূরণ করা যায় না। মার্চ থেকে আমরা ৩৫টি বিশেষ শিশুকে অনলাইন প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছি। অক্টোবরের মধ্যে সেই সংখ্যা ভীষণ রকম কমে গেছে [৮-১০-এ এসে ঠেকেছে],” হাসপাতালের অটিজম মোকাবিলা কেন্দ্রে ভর্তি হওয়া বাচ্চাদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ডঃ গজরে জানালেন।
যশবন্ত রাও চবন প্রতিষ্ঠানের (একটি বেসরকারি ট্রাস্ট) প্রতিবন্ধী অধিকার ফোরামের সমন্বয়কারী, বিজয় কানহেকর জানালেন যে মহারাষ্ট্রে, দৃষ্টিশক্তিহীন, শ্রবণশক্তিহীন বা বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত এবং বেসরকারি - দুই মিলিয়ে ১,১০০ বিশেষ আবাসিক বিদ্যালয় আছে। কানহেকর একথাও বললেন যে এই বিদ্যালয়গুলি আপাতত বন্ধ আছে।
কিন্তু প্রতীক এবং সংকেতের স্কুলের পক্ষে আবার তা খুলে আগের মতো ক্লাস চালু করা কঠিন। কারণ, সরকারি অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও রাজ্যের শিক্ষা ও ক্রীড়া দপ্তরের কাছে বারবার আবেদন করেও তারা কোনও অর্থসাহায্য পায়নি। মার্চ থেকে বিদ্যালয়টি কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও অর্থ সাহায্য পায়নি — ফলে বিদ্যালয় পুনরায় চালু করা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“আমরা অভিভাবকদের কাছ থেকে কোনও অর্থ গ্রহণ করি না, ফলে আর্থিক সাহায্য পাওয়াটা আমাদের পক্ষে অত্যন্তই জরুরি। এই অতিমারির সময়ে স্কুলের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুরক্ষা ব্যবস্থার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার — শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীদের জন্য পিপিই রাখা দরকার কারণ আমাদের ছাত্রদের এমনিতেই স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা আছে,” বললেন বাগাড়ে।
“মহারাষ্ট্রের সমস্ত আবাসিক বিদ্যালয় আপাতত বন্ধ থাকায় বাচ্চাদের বাড়িতে কিচ্ছুটি করার নেই,” বললেন কনহেকর। এর ফলে একদিকে বাচ্চারা আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ছে আর অন্য দিকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সামলাতে গিয়ে মা-বাবার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর চাপ পড়ছে।”
তাঁদের ফোরাম নিরাপদ বিশেষ বিদ্যালয় চালু করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে — যেটি হবে “সব নিয়ম এবং বিধিনিষেধ মান্য করে চলবে এমন একটি কোভিড-মোকাবিলা কেন্দ্রের সমতুল বিশেষ বিদ্যালয়,” বললেন কনহেকর। তাঁরা মহারাষ্ট্রের সামাজিক ন্যায় ও বিশেষ সহায়তা বিভাগের কাছে এই মর্মে লিখিত আবেদনও করেছেন। তা ছাড়াও কনহেকরের মতে প্রতিবন্ধী শিশুদের সর্বাগ্রে কোভিড-১৯ টিকা পাওয়া উচিত।
এই মুহূর্তে বিদ্যালয়ের ঝাঁপ বন্ধ, নিয়মিত কোনও রুটিন নেই, নেই বন্ধু, নতুন কিছু শেখারও নেই — ফলে প্রতীক এবং সংকেতের মতো ছেলেমেয়েরা একা একা নিজেদের উঠানে বসে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। অতিমারি সম্বন্ধে তাদের সম্যক ধারণা নেই বটে, কিন্তু টেলিভিশনে কোভিড সংক্রান্ত বিধি-নির্দেশ শুনে শুনে প্রতীক আওড়াতে থাকে, “কলোনা...কলোনা...কলোনা...”
অনুবাদ: চিলকা