"সেই ছোট্টবেলা থেকেই আমি অবাধ্য। অন্যায় দেখলেই রুখে দাঁড়াই," জানালেন দলিত কবি, গায়ক তথা সমাজকর্মী রাজকিশোর সুনানি। কালাহান্ডি জেলার যেখানে বেদান্তের আল্যুমিনা পরিশোধনাগারটি রয়েছে, সেখান থেকে আনুমানিক ১০০ কিমি দূরে কারলাগাঁও গ্রামে থাকেন তিনি। "২০০৩ সালে এই আন্দোলনে [নিয়মগিরি পাহাড়ে বক্সাইট খননের বিরুদ্ধে] যোগ দিই আমি। গান বেঁধে মানুষকে সচেতন করি, এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম ঘুরে ঘুরে পৌঁছে দিই আন্দোলনের বার্তা," জানালেন তিনি।
"আমি আর আমার স্ত্রী লীলাবতী তখন এই গ্রামগুলোতেই থাকতাম, গানটান গাইতাম, আজ এখানে তো কাল সেখানে" স্মৃতিচারণ করছিলেন রাজকিশোর। নিজেদের গ্রামে সুনানিরা ছিলেন ক্ষুদ্র চাষি, আর যাযাবর এই জীবনযাত্রায় আদিবাসী মানুষজনের আতিথেয়তা ছাড়া রুজিরুটির আর কোনও উপায় ছিল না তাঁদের। "বেদান্তের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় বর-বৌ দুজনকেই ধরে জেলে পুরে দিল। তিন-তিনটে মাস জেলে ছিলাম আমি, লীলাবতী ছিল মাসখানেক। আজও সরকার বাহাদুর এই [খননকারী] কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে মানুষের আন্দোলনকে মেরে থেঁৎলে পিষে দিতে চায়," তিনি বলছিলেন।
দক্ষিণ-পশ্চিম ওড়িশার কালাহান্ডি জেলা থেকে রায়গড় জেলা অবধি ছড়িয়ে আছে নিয়মগিরি পাহাড়মালা। মূলত ডোঙ্গরিয়া কোন্ধ জনজাতির (তাঁরা অবশ্য নিজেদের ঝর্ণিয়া কোন্ধ বলেন) বাস এখানে, সংখ্যায় মাত্র ৮,০০০ এই জনজাতিটি বিশেষরকম দুর্বল আদিবাসী জনগোষ্ঠী (পিভিটিজি) হিসেবে চিহ্নিত। তবে এখানকার ১০০টির মতো গ্রামে ডোঙ্গরিয়া কোন্ধ বাদেও অন্যান্য বেশ কিছু জনজাতির মানুষ রয়েছেন।
ব্রিটিশ স্টারলাইট ইন্ডাস্ট্রিজের (অধুনা বেদান্ত) সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজ্য সরকারের ওড়িশা মাইনিং কর্পোরেশন ঠিক করেছে যে আদিবাসীদের পবিত্র পাহাড় কেটে বক্সাইট (যার থেকে অ্যালুমিনিয়াম পাওয়া যায়) বার করে লাঞ্জিগড় তহসিলে বেদান্তের একটি পরিশোধনাগারে (রিফাইনারি) নিয়ে যাবে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন ডোঙ্গরিয়া সমাজের মানুষজন।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের তত্ত্বাবধানে নিয়মগিরির ১২টি গ্রামে একটি গণভোট করা হয় ২০১৩ সালে, সেখানে দেখা যায় যে আদিবাসী মানুষজন উপরোক্ত ওই খনি প্রকল্পটিকে একজোট হয়ে খারিজ করেছেন। রাজকিশোরের মতো কর্মীদের পাশাপাশি এই আন্দোলনের কর্ণধার ছিল নিয়মগিরি সুরক্ষা সমিতি নামক আদিবাসীদের একটি সংঘ।
ওই গণভোটের ফলাফলকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা ওড়িশা সরকার সেদিন থেকে আজ অবধি একাধিকবার করেছে। অন্যান্য জায়গা থেকে খনন করা বক্সাইটের দয়ায় ওই পরিশোধনাগারটি অবশ্য দিব্যি চলছে। তাই আদিবাসীদের এই যে জন্মজন্মান্তরের জল-জঙ্গল-জমিন, এর উপর থেকে বিপদের কালো মেঘ কিন্তু আজও কাটেনি।
'সারা বিশ্বের পরিবেশ নির্ভর এই যে জীবজগৎ, এটা খানিকটা হলেও আমাদের মতো আন্দোলনের ভরসায় টিকে আছে। নয়তো এতদিনে সব চুকে যেত,' ঢাপের তালে পাহাড়িয়া সৌন্দর্যের কথা গাইতে গাইতে জানালেন সুনানি
খেতের ফসল কাটার পর উৎসবে মেতে ওঠে নিয়মগিরি মালভূমি, এইবছর সেই উপলক্ষ্যেই আনলাভাতা গ্রামের কাছে দেখা করেছিলাম রাজকিশোরের সঙ্গে। ছয় কিমি পাহাড়ি পথ ভেঙে তিনি পৌঁছেছিলেন এখানে। নিয়ম রাজার (তর্জমা করলে দাঁড়ায় 'অনুশাসন প্রদান করে যে রাজা') প্রতি অর্পিত এই পরবটি প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির ২৩-২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবের দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় আর শেষের দিন সকালবেলা গণ আন্দোলনের একান্ত কিছু কথা তুলে ধরেন রাজনৈতিক কর্মীরা, তার সঙ্গে সঙ্গে গাইতে থাকেন রাজকিশোর। সেই গানে আকৃষ্ট হয়ে ভিড় জমতে থাকে তাঁকে ঘিরে।
হৃদয় দিয়ে বাঁধা সে গান ছলকে পড়ে ঢাপের (ডুবকি বা ডাফলির অনুরূপ একটি বাদ্যযন্ত্র) ছন্দে, ভিড় বাড়তেই থাকে ক্রমশ। নিয়মগিরির এই গণআন্দোলন ছাড়াও তাঁর গানে ফুটে ওঠে বারগড় জেলার গন্ধমর্দন পাহাড়ের কথা, অর্থাৎ খননকারী ভারত অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানির (বিএএলসিও) হঠকারিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কাহিনি।
৫৫ বছরের রাজকিশোর আজ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে লড়াই জারি রেখেছেন নিজের গানের মাধ্যমে। তিনি সমাজবাদী জন পরিষদের (সমাজতান্ত্রিক নেতা কিষেণ পট্টনায়কের প্রতিষ্ঠিত) একজন সদস্যও বটে, নিয়মগিরি তথা ওড়িশার অন্যান্য গ্রামের মানুষদের বিদ্রোহের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এই দল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম: "এই যে আন্দোলনটির মধ্যে আপনি রয়েছেন, এটাকে নিয়ে আপনার কী মত?" তিনি জানালেন: "'সারা বিশ্বের পরিবেশ নির্ভর এই যে জীবজগৎ, এটা খানিকটা হলেও আমাদের মতো আন্দোলনের ভরসায় টিকে আছে। নয়তো এতদিনে সব চুকে যেত।" প্রকৃতির এ মহাপ্রাণ যাতে সত্যি সত্যিই না শেষ হয়ে যায়, তাই ঢাপের তালে তালে পাহাড়িয়া সৌন্দর্যের কথা গাইতে থাকেন সুনানি। এখানে প্রকাশিত ভিডিওটিতে তাঁকে গাইতে দেখতে পাবেন (ভিডিওর তলায় গানের কথাগুলি রয়েছে):
নিয়মগিরির গান
কখনও যাবো না মোরা
জল-জঙ্গল,
পাহাড়, দুয়ার, মাটি
ছাড়িয়া কোথাও...
এ লড়াই থামবে না,
যায় যদি যাক চলে জান,
শোনো শোনো বন্ধু, এ
লড়াই-ই আমাদের প্রাণ।
পাথুরে কেঁদুয়া শাল,
ঝরঝর ঝোরাই যে ঈশ্বর।
কুবেরের ঘড়া সে যে
দেশভাঙা মাঁডরি পাহাড়।
শোনো শোনো সাথী, এই
টিলা, মাটি,
ঝর্ণা ঝরং সে যে
অনাথের নাথ।
আকাশ, বাতাস, জল,
কাঁকুরে আঙার, দেওতা দেওতা সে তো হয়েছে আমার।
এ নাথ কেমন নাথ? দেয়,
শুধু দেয়... দেওতা সে জীবনের ধীর,
শোনো শোনো সাথী মোর,
এই টিলা, মাটি,
ঝর্ণা ঝরৎ ঝরে অনাথের
নাথ,
ভ-য়ে ভগবান হবে,
গ-য়ে সে গগন রবে, ব-য়ে বায়ু, ন-য়ে সুখী নীর।
ঝলমলে বুড়োশাল,
শিকড়ের ফল, সবুজে সাকিন রাঙা জমিনের দান।
গগন দিয়েছে হাওয়া,
মাঝনদী জল,
মায়ের বুকের দুধে
হয়েছে সে অতল।
দেশমাটি বুড়িমাই,
বুকপোড়া দুধ,
বন্ধু গো জেনো জেনো
থাকিবে বাঁচিয়া,
যায় যদি ছেড়ে দিয়া
দেওতা তোমার।
ভিন্ন মোদের কথা, মুহূর্তে মরে যাবো
যায় যদি ছেড়ে যায়
দেওতা আমার।
সত্যি না মিথ্যা কে
করিবে যাচাই?
ঝোরামাটি বন কেটে
বেঁচে থাকা যায়?
হায় রে পাগল শোন্,
সত্যি সে আমরণ,
দূর দূর ছুঁড়ে ফেল্
মিছেকথা তোর,
পাহাড়, বনানী, জল,
ভাঙামাটি টলমল, এ ছাড়া কে-ই বা আছে ঈশ্বরী মোর?
টিলা, ডাঙা, জানোয়ার,
শিকড়ের ফুল,
হেঁদু না কেরেস্তানি,
মুসলিমও নই,
আদিবাসী বীরহোড়,
প্রকৃতি পূজারী,
বেটাবিটি সবে তাই
হয়েছি সমান।
আজাদি আজাদি মোর আনন্দ
গান।
সরকার বাহাদুর,
কোম্পানি ওই,
একসাথে মিলে দেখি আগুন
লাগায়...
শোনো শোনো সাথী, এই
টিলা, মাটি,
ঝর্ণা ঝরং সে যে
অনাথের নাথ।
ঝোপঝাড়, জানোয়ার,
দেওতা পাহাড়
একসাথে মিলে চলো জমিন
বাঁচাই।
শুখা হলে মাঝনদী, ভুখা
হলে মাটি,
সব ছেড়ে চলে যাবো,
ফিরিবো না আর।
আমাদের মাড়ভাত লুটে
খায় যারা, একসাথে জ্বলে উঠে করি দেশছাড়া,
উলগুলানের কথা
রাখিয়াছি মনে...
ভাগচাষি, মজদুর, অসুর, চামার।
শোনো শোনো সাথী, এই
টিলা, মাটি,
ঝর্ণা ঝরৎ ঝরে অনাথের
নাথ।
শোন্ শোন্ সরকার, রাখ
ব্যাটা শুনে,
লাঠি তোর, কাঠি তোর,
রাখিয়াছি গুনে,
যায় যদি যাক চলে
প্রাণ, ঝর্ণা ঝরং সে যে অনাথ অনাথ।
আদিবাসী বীরহোড়,
পাহাড়িয়া খনি তোর,
জলরঙা জমিনেই তোর
অধিকার।
সরকার কোম্পানি রাখ
শুনে রাখ, ভূমির সুপুত মোরা শিকড়ে আঙার...
এ লড়াই ছাড়বো না,
তোর কথা মানবো না,
কাঁড়বাঁশে শোধ করি
বুলেটের ধার।
শান্তি শান্তি বঁধু, আজাদি
নাচাই,
অধিকার বুঝে নেওয়া
পাথুরে লড়াই।
বাবুবিবি সরকার, হোক
পুড়ে ছারখার
কানাকড়ি কোম্পানি
আধপেটা ভাত...
শোনো শোনো সাথী, এই
টিলা, মাটি,
হুলকি মারাংবুরু
অনাথের নাথ।
অনুবাদ:
জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)