পারাই ঢাক বেজে উঠতেই মিছিল শুরু হয়ে গেল।
জনা ষাটেকের একটা ভিড় থেকে গর্জন ওঠে: “জয় জয় জয় ভীম, জয় আম্বেদকর জয় ভীম।” মুম্বইয়ের ধারাভিতে চলছে প্রতিবছর ৬ ডিসেম্বর ড. বি আর আম্বেদকরের প্রয়াণ দিবসে অনুষ্ঠিত মহাপরিনির্বাণ মিছিল।
একে একে সবাই মোমবাতি জ্বালিয়ে ধারাভির পেরিয়ার চৌকে জড়ো হয়, আর হঠাৎই মুম্বই শহরে অবস্থিত এশিয়ার বৃহত্তম বস্তির এই ছোট্ট কোণটি উৎসবে মেতে ওঠে। এই মহাপরিনির্বাণ দিবস (আম্বেদকরের মৃত্যুদিন) অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা জয় ভীম ফাউন্ডেশন। মিছিল হবে ঘণ্টাদুয়েকের, যাবে ই ভি রামস্বামী (পেরিয়ার) চৌক থেকে গণেশন কোভিলে আম্বেদকরের মূর্তি পর্যন্ত মোটামুটি ১.৫ কিলোমিটার পথ।
“আজকের দিনটা আমাদের কাছে উৎসবের মতোই। পুরো মুম্বই শহর ১৪ এপ্রিল (আম্বেদকরের জন্মদিবস) আর ৬ ডিসেম্বর উদ্যাপন করে, আমাদের মহান নেতা এবং জাতপাত-ভিত্তিক বৈষম্যে আক্রান্ত মানুষদের জন্য তাঁর অবদান মনে রেখে,” বলছেন জয় ভীম ফাউন্ডেশনের অন্যতম সদস্য ভেন্নিলা সুরেশ কুমার। তাঁর স্বামী সুরেশ কুমার রাজু এই জয় ভীম ফাউন্ডেশনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। “আমরা গোটা পথটা নীল পতাকায় সাজাই, দরজায় দরজায় গিয়ে মানুষকে আমন্ত্রণ জানাই আমাদের সঙ্গে হাঁটার জন্য।”
ভেন্নিলা ধারাভির আম্বেদকর মূর্তিটিতে মাল্যদান করেন, তারপর তামিল গানের দলের সঙ্গে তাঁদের নেতার অবদান নিয়ে গাইতে গলা মেলালেন।
উত্তর মুম্বইয়ের একটি সংস্থায় ড্রাইভারের কাজ করেন সুরেশ। ৪৫ বছর বয়সের সুরেশ কাজ করেন ১৪ ঘণ্টার শিফটে, মাস শেষে ঘরে আনেন ২৫,০০০ টাকা। ৪১ বছরের ভেন্নিলা গৃহকর্মী, ধারাভির কাছেই একটি বহুতলে প্রতিদিন রান্না ও ঘর পরিষ্কারের কাজ করেন – দৈনিক ছয় ঘণ্টার কাজ। মাসে মাসে হাতে আসে ১৫,০০০ টাকা।
দম্পতির দুই ছেলে কার্তিক, ১৭, ও আরন, ১২ শহরের বেসরকারি স্কুলে পড়ে। “শহরের অন্যান্য জায়গার উদ্যাপনেও আমরা যোগ দিই, যেমন দাদরের চৈত্যভূমি। ধারাভিতে সাধারণত পারাইয়ার গোষ্ঠীর মানুষরাই আম্বেদকরকে মানেন এবং এই উৎসবে যোগ দেন,” জানালেন ভেন্নিলা।
ভেন্নিলা ও সুরেশ আদতে তামিলনাড়ুর বাসিন্দা এবং পারাইয়ার জনগোষ্ঠীর সদস্য, যা তাঁদের নিজেদের রাজ্যে তফসিলি জাতি হিসেবে নথিভুক্ত। “আমার বাবা ১৯৬৫ সালে তিরুনেলভেলি থেকে ধারাভিতে আসেন কাজের খোঁজে,” বলছেন তিনি। দেশে সেচের অভাব এবং অন্য নানা কারণে চাষ থেকে রোজগার কমে যাওয়ায় দেশান্তর গমনে বাধ্য হয় তাঁর পরিবার।
ধারাভিতে তাঁদের বাড়ির আশপাশের আম্বেদকরপন্থীদের সংগঠিত করতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এই দম্পতি। সুরেশ জানাচ্ছেন ২০১২ সালে, রাজা কুট্টি রাজু, নিত্যানন্দ পালানি, অনিল সান্তিনি এবং অন্যান্য সদস্যদের সহায়তায়, “আমরা ধারাভিতে ১৪ এপ্রিল আর ৬ ডিসেম্বর তারিখগুলোয় যৌথ উদ্যাপনের ধারাটা শুরু করি আম্বেদকর এবং তাঁর নানা অবদান সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে।”
গাড়ি চালানোর কাজ বাদে জয় ভীম ফাউন্ডেশনের জন্য স্বেচ্ছাশ্রম দেন সুরেশ। ২০১২ সালে ২০ জন সদস্য ছিল, আজ সেই সংখ্যাটা ১৫০, জানালেন তিনি। “এখানকার বেশিরভাগ সদস্যই আমাদের মতোই পরিযায়ী। ওরা গাড়ি চালায়, রেলে কাজ করে, কিন্তু মিছিল হলে ঠিক যোগ দেয়,” জানালেন তিনি।
নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে কাজে লাগার জন্য স্কুল ছেড়ে দেন ভেন্নিলা। জানালেন, একটি অফিসে রান্নার কাজ করতে করতে ইংরেজি শিখেছেন। ২০১৬ সালে এলাকার বেশ কয়েকজন মহিলার সঙ্গে মিলিতভাবে ভেন্নিলা একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করেন, নাম দেন মাগিঢ়চি মাগলির পেরভাই। “আমরা মেয়েরা খুব একটা অবসর কাটানোর সুযোগ পাই না এখানে, তাই এই শুধু মেয়েদের একটা দল গড়ে এর মাধ্যমে আমরা নানারকমের অনুষ্ঠান করি, একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যাই।” লকডাউনের সময় ভেন্নিলার নানা যোগাযোগ খাটিয়ে এই স্বনির্ভর গোষ্ঠী ধারাভির মানুষকে খাবার, কাঁচা বাজার, এবং ক্ষুদ্র আর্থিক সহায়তা দিয়ে সাহায্য করেছে।
তামিলে ‘মাগিঢ়চি’ মানে আনন্দ, হেসে জানালেন তিনি। “ঘরের ভিতরে মেয়েরা সবসময় শোষিত হয়, অবসাদে ভোগে। এটা এমন একটা জায়গা যেখানে আমরা সবাই সবার সঙ্গে কথা বলি, আনন্দে থাকি।”
অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী