কানহাইয়ালাল রেলগাড়ির ইঞ্জিন চালকের গুমটি থেকে লাল সবুজ রঙের এক জোড়া নিশান হাতে লাফ দিয়ে, মন্থর গতি ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। এইজন্যই আমরা এতক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। যদিও, এইটা আশা করিনি যে তিনি আগামী ২০০ মিটার পথ পোড় খাওয়া দৌড়বিদের মতো ছুটে পার করবেন। বন্ধুর পথে হোঁচট খেতে খেতে আমরাও তাঁর পিছনে দৌড়তে থাকি। লাল নিশান ওড়াতে ওড়াতে কানহাইয়ালাল ছুটে গেলেন রক্ষীবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ের দিকে, তারপর দ্রুত গেট বন্ধ করে আটকে দিলেন। এইবার তিনি রেলগাড়ির দিকে ঘুরলেন এবং সবুজ নিশান ওড়ালেন। ট্রেন এগিয়ে চলল, বন্ধ রেলগেট অতিক্রম করে আবার দাঁড়িয়ে গেল। কানহাইয়ালাল এবার গেট খুলে দিলেন এবং তারপর ইঞ্জিনচালকের গুমটির দিকে দৌড় দিলেন, আমরাও ততক্ষণে ছুটে তাঁর কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছি।

PHOTO • P. Sainath

এক-দিকের ৬৮ কিলোমিটার রেলপথে তিনি ১৬ বার এই কাজটি করেন। তাঁর কথায়, “এইটাই তো আমার কাজ। আমি হলাম চলমান দ্বাররক্ষক, মোবাইল গেটকিপার।” তাঁর কথায় ‘মোবাইল’ শব্দটি তার আদি দ্যোতনা নিয়ে ফিরে আসে। ছত্তিশগড় রাজ্যের দক্ষিণ পূর্ব সেন্ট্রাল রেলওয়ের অধীন ২৩২ ডাউন ধামতারি প্যাসেঞ্জারে – ‘লেবার ট্রেন’ বা ‘মজদুর ট্রেন’ নামেই যা অধিক পরিচিত। এই ট্রেন শ’য়ে শ’য়ে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে গ্রাম ছেড়ে রায়পুরগামী মরিয়া দেশান্তরি শ্রমিকদের বাহন। ধামতারি থেকে রায়পুরের তেলিবান্ধা পর্যন্ত পুরো পথ যেতে সময় লাগে তিন ঘন্টা পাঁচ মিনিট, মাঝে নয়খানি স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ায়। সব মিলিয়ে ১৯টি রেলগেট বা লেভেল ক্রসিং পড়ে এই যাত্রাপথে, যার মধ্যে মাত্র দুটি অথবা তিনটিতে রক্ষী নিযুক্ত আছেন।

কানহাইয়ালাল গুপ্তার কথায়, “আমার কাজ রেলগেট খোলা এবং বন্ধ করা। আগে এই লেভেল ক্রসিংগুলিতে রক্ষী বহাল ছিল, কিন্তু এখন আমাকে চলমান দ্বাররক্ষী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। পূর্বে আমি গ্যাংম্যান হিসেবে কাজ করতাম, তারপর পদোন্নতি হয়ে আমি এই নতুন কাজে বহাল হই, এই কাজে আমার দুবছর হয়ে গেল। কাজটা করতে আমার বেশ ভালো লাগে।” অবশ্যই নিজের কাজে তিনি নিবেদিতপ্রাণ এবং কঠোর পরিশ্রমী (সম্ভবত, মাসিক ২০,০০০ টাকার কমই আয় করেন তিনি)।

PHOTO • P. Sainath

এই যাত্রাপথে প্রথমদিকের স্টেশনগুলোতে ‘চলমান দ্বাররক্ষক বা মোবাইল গেটকিপার’, একবার ট্রেন লেভেল ক্রসিংয়ের গেট পেরিয়ে গেলে একেবারে পেছনদিকের কামরায় উঠে পড়েন। যেহেতু ট্রেন এখনও সম্পূর্ণ ভর্তি হয়নি, অতএব তিনি বেশ আরামে বসার জায়গা পেয়ে যান। কিন্তু, রায়পুরের কাছাকাছি পৌঁছলেট্রেনে আর তিলধারণের জায়গা থাকে না। ফলে দৌড়ে কানহাইয়ালাল ইঞ্জিন ড্রাইভারের গুমটিতে উঠে পড়েন এবং পরের লেভেল ক্রসিংয়ের গেট অবধি পৌঁছনোর আগে দাঁড়িয়েই থাকেন।

এক সময়ে রেল দপ্তর থেকে এখানে অনেক কর্মী নিয়োগ করা হত। বর্তমানে শূন্যপদের সংখ্যা প্রচুর। তাই কানহাইয়ালালের কাজটিকে সদর্থক পদক্ষেপ মনে করার কারণ নেই। এটা কর্মী সংখ্যা সংকোচনের ফিকির ছাড়া আর কিছুই নয়। নিরাপত্তার নিরিখে দেখতে গেলে উল্লিখিত ১৬টি লেভেল ক্রসিংয়ের সবগুলোতেই দ্বারকক্ষক থাকা আবশ্যিক। রেল দপ্তরের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় সারা দেশে ৩৩,০০০-এর অধিক লেভেল ক্রসিং আছে, যার মধ্যে ১১,৫০০টি রক্ষীবিহীন।

সমস্ত রেল দুর্ঘটনার ৪০ শতাংশ, এবং রেললাইনের উপর দুই তৃতীয়াংশ অঘটনের জন্য লেভেল ক্রসিংয়ের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা দায়ী। রক্ষী বহাল আছেন যে সকল লেভেল ক্রসিংয়ে, সেখানে কদাচিৎ অঘটন ঘটে। রক্ষীবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা এড়াতে রেলমন্ত্রক দ্বাররক্ষীদের নিয়োগ না করে এই লেভেল ক্রসিংগুলিকেই বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষপাতী। অথবা কানহাইয়ালালের মত ‘চলমান দ্বাররক্ষী’ নিয়োগ করে অনেকের কাজ একজনকে দিয়ে করিয়ে নেওয়ার পন্থায় বিশ্বাসী।

২৩২ ডাউন ধামতারি প্যাসেঞ্জারে অবশ্য অঘটনের সম্ভাবনা কম। প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে বসা, হাতে গোনা কয়েকটি ন্যারো গেজ ট্রেনের এটি অন্যতম। এই ট্রেনের গতি খুব মন্থর, আর সেটা এইরকম মানুষের গাদাগাদি ভিড়ে ঠাসা ট্রেনের জন্যভালো। এসব সত্ত্বেও কানহাইয়ালালের নিয়োগের একমাত্র কারণ হল রেলে কর্মীর সংখ্যা হ্রাস করা।

PHOTO • P. Sainath

ন্যাশনাল রেলওয়ে মজদুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ভেনু পি. নায়ার জানাচ্ছেন, “ভারতীয় রেলের মোট অনুমোদিত কর্মীসংখ্যা ১৩.৪ লক্ষ হলেও বর্তমানে প্রায় ২ লক্ষ শূন্যপদ রয়েছে। এই সংখ্যা প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা এখন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। ’৭০-এর দশকে ভারতীয় রেলে ১৭ লক্ষ নিয়মিত কর্মী এবং ৫ লক্ষ অনিয়মিত শ্রমিক নিযুক্ত ছিলেন। অথচ আজকের দিনে কর্মী সংখ্যার এই হাল – যদিও তখনকার তুলনায় রেলযাত্রীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে স্টেশন, রেললাইন এবং বুকিং কাউন্টারের সংখ্যাও। কিন্তু স্পষ্টতই গত ২০ বছরে রেলে কর্মসংস্থান উল্লেখ যোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে। এটা একটা ভুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ।” ভারতীয় রেল প্রতিদিন ১২,০০০ ট্রেন চালায়, তাতে ২.৩ কোটি যাত্রী নিত্য সফর করেন।

সাতটি কোচ বিশিষ্ট ধামতারির ‘লেবার ট্রেনের’ যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৪০০-এর কম। অথচ এর প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যার মানুষ ট্রেনের ভেতরে, রেলগাড়ির দুইদিকে এবং পেছনে, এমনকি দুটি কোচের মাঝখানেও চড়ে যাতায়াত করেন। জনৈক কর্মী আমাদের জানান, “ট্রেন যখন রায়পুরে ঢোকে তখন আপনাদের একবার ট্রেনের হাল দেখা উচিত। রেলগাড়ির ছাদটা পর্যন্ত ভর্তি হয়ে যায়।”

ভিডিও ক্যামেরা এবং অন্যান্য লটবহর নিয়ে আমরা প্রতিটি রক্ষীবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে কানহাইয়ালালের সঙ্গে কথাবার্তা বলছি দেখে যাত্রীরা বেশ আমোদ অনুভব করছিলেন। দুই কামরার মাঝখানে চিঁড়েচ্যাপ্টা একজন যাত্রীর ঘোষণা, “সিনেমার সুটিং হচ্ছে নির্ঘাত! এরা বলিউডের না হয়ে যায় না!” অমনি তাঁর সঙ্গী সজোরে বলেন, “তাহলে হিরো কোথায়?” তৃতীয় আরেক যাত্রীর বক্তব্য, “হিরোর কথা বাদ দাও! হিরোইনটিকে দেখাও দেখি।”

স্টেশনগুলিতে তাঁরা আমাদের সঙ্গে ধৈর্য্য ধরে কথা বলেন। সকলেই গ্রাম থেকে শহরে যাচ্ছেন কাজের খোঁজে। নিকটবর্তী অঞ্চল যেখানে কৃষিব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে বিপন্ন এই যাত্রীরা সেইসব গ্রামের মানুষ। আমরা জানতে চাই, ট্রেন কেন, এই ভিড়ের মধ্যে যাত্রা করে রায়পুর পৌঁছতে পৌঁছতে শরীর যে ক্লান্ত হয়ে পড়বে।“ধামতারি থেকে রায়পুর অবধি যেতে ট্রেনের টিকিট বাবদ ভাড়া মাত্র ২০ টাকা। একই পথ বাসে গেলে ৬০-৭০ টাকা ভাড়া পড়ে যাবে, অর্থাৎ ট্রেন টিকিটের প্রায় তিন গুণ। বাসে যাতায়াত করলে দুই দিক মিলিয়ে ভাড়া বাবদ যা খরচ হবে তাতে আমাদের সারাদিনের আয় ২০০-২৫০ টাকার প্রায় অর্ধেকটাই বেরিয়ে যাবে।”

PHOTO • P. Sainath

২৩২ ডাউন ধামতারি প্যাসেঞ্জারের পেছনদিকের যাত্রীরা

ইঞ্জিন চালক ভেনুগোপাল আমাদের বোঝান, “সকালের ট্রেনে বেশিরভাগ যাত্রীই পেশায় শ্রমিক। আশপাশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলি থেকে মানুষ এই ট্রেনে চেপে দিনমজুরি করতে রায়পুর যান। প্রতিদিন আবার সন্ধ্যের ট্রেন ধরে গ্রামে ফিরে আসেন।”

“খুব কঠিন কাজ,” কেন্দ্রী স্টেশনে রোহিত নাওরাঙ্গের সঙ্গে কথা হয়। পেশায় শ্রমিক, কেন্দ্রীতে তাঁর নিজের একটি সাইকেল সারাইয়ের ছোট্ট দোকান থাকা সত্ত্বেও, প্রায়শই এই পথে যাত্রা করতে তিনি বাধ্য হন। তাঁর কথায়, “এখানে শুধু এই কাজ করে পেট চালানো সম্ভব নয়।”

ইতিমধ্যে, আমরা আবার ট্রেনে উঠে পড়েছি, কানহাইয়ালাল নিজের কাজে সম্পূর্ণরূপে মনোনিবেশ করেন, পরের গেটটির জন্য তিনি প্রস্তুত। “গেট খোলো আর বন্ধ করো” হাসি মুখে তিনি বলে ওঠেন।

২০১৪ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর এইপ্রতিবেদনের একটি সংস্করণ ইংরেজি এবং হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত হয় বিবিসি নিউজ অনলাইনে:

( http://www.bbc.com/news/world-asia-india-29057792 )

অনুবাদ: স্মিতা খাটোর

ਪੀ ਸਾਈਨਾਥ People’s Archive of Rural India ਦੇ ਮੋਢੀ-ਸੰਪਾਦਕ ਹਨ। ਉਹ ਕਈ ਦਹਾਕਿਆਂ ਤੋਂ ਦਿਹਾਤੀ ਭਾਰਤ ਨੂੰ ਪਾਠਕਾਂ ਦੇ ਰੂ-ਬ-ਰੂ ਕਰਵਾ ਰਹੇ ਹਨ। Everybody Loves a Good Drought ਉਨ੍ਹਾਂ ਦੀ ਪ੍ਰਸਿੱਧ ਕਿਤਾਬ ਹੈ। ਅਮਰਤਿਆ ਸੇਨ ਨੇ ਉਨ੍ਹਾਂ ਨੂੰ ਕਾਲ (famine) ਅਤੇ ਭੁੱਖਮਰੀ (hunger) ਬਾਰੇ ਸੰਸਾਰ ਦੇ ਮਹਾਂ ਮਾਹਿਰਾਂ ਵਿਚ ਸ਼ੁਮਾਰ ਕੀਤਾ ਹੈ।

Other stories by P. Sainath
Translator : Smita Khator

ਸਮਿਤਾ ਖਟੋਰ ਪੀਪਲਜ਼ ਆਰਕਾਈਵ ਆਫ ਰੂਰਲ ਇੰਡੀਆ (ਪਾਰੀ) ਦੇ ਭਾਰਤੀ ਭਾਸ਼ਾਵਾਂ ਦੇ ਪ੍ਰੋਗਰਾਮ ਪਾਰੀਭਾਸ਼ਾ ਭਾਸ਼ਾ ਦੀ ਮੁੱਖ ਅਨੁਵਾਦ ਸੰਪਾਦਕ ਹਨ। ਅਨੁਵਾਦ, ਭਾਸ਼ਾ ਅਤੇ ਪੁਰਾਲੇਖ ਉਨ੍ਹਾਂ ਦਾ ਕਾਰਜ ਖੇਤਰ ਰਹੇ ਹਨ। ਉਹ ਔਰਤਾਂ ਦੇ ਮੁੱਦਿਆਂ ਅਤੇ ਮਜ਼ਦੂਰੀ 'ਤੇ ਲਿਖਦੀ ਹਨ।

Other stories by Smita Khator