এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে, ৩৯ বছর বয়সী সুনীতা রানী, ৩০ জন মহিলার একটি দলকে নিজেদের অধিকার রক্ষার্থে অনির্দিষ্টকালীন ধর্মঘটে সামিল হওয়ার ব্যাপারে বোঝাচ্ছিলেন। “অনিশ্চিত বেতনে কাজ করানো” আওয়াজ তুলছেন সুনীতা। “চলবে না চলবে না”, বলছেন বাকি মহিলারা একযোগে।
দিল্লি-হরিয়ানা হাইওয়ে থেকে খানিক দূরে সোনিপত শহরের সরকারি হাসপাতালের বাইরে একখণ্ড ঘাস জমির উপর, লাল জামা পরে — হরিয়ানায় এটাই তাঁদের ইউনিফর্ম — শতরঞ্চিতে বসে মহিলারা শুনছিলেন সুনীতার মুখে নিজেদের অতিপরিচিত দুঃখের বারোমাস্যা।
মহিলারা সবাই জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের পদাতিক সেনা, দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ স্থাপনকারী, স্বীকৃত সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী - আশা। ১০ লক্ষের বেশি আশা-কর্মী সারাদেশ জুড়ে কাজ করেন এবং অধিকাংশ সময়েই স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রয়োজন তথা সংকটে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে তাঁরাই প্রথম সহায়।
শুনে চমকে উঠতে হয় যে তাঁদের উপর ন্যস্ত আছে ১২ টি প্রাথমিক কর্তব্য ছাড়াও ৬০টি সহ-কর্তব্য যার মধ্যে পড়ে পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ক তথ্য প্রচার, যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসা সম্বন্ধে নিয়মিত খোঁজ রাখা এবং স্বাস্থ্য-সূচক নিয়মিত নথিভুক্ত করা।
এগুলি তো তাঁরা করেনই, তার বাইরেও আরও নানান কাজও করেন। সুনীতা জানালেন, “অথচ মা ও সদ্যজাত শিশুর স্বাস্থ্যের উন্নতি বিধানের জন্য যে প্রশিক্ষণ আমাদের দেওয়া হয়েছে, সেইকাজই কেবল করা হয়ে ওঠে না!” সোনেপত জেলার, নাথুপুর গ্রামের ২,৯৫৩ জনের দেখাশোনা করেন যে তিনজন আশা-কর্মী সুনীতা তাঁদের অন্যতম।
শিশুর জন্মের আগে ও পরে, মা এবং শিশুর যত্ন নেওয়া, সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী হিসাবে সরকারের পরিবার পরিকল্পনা নীতি, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, এবং দুই শিশুর জন্মের মধ্যে ব্যবধান রাখার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করাও আশা-কর্মীদের কাজ। আশা প্রকল্প চালু হওয়ার সময়ে ২০০৬ সালে শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতি ১,০০০ জাতকের মধ্যে ৫৭ জন , সেটাই ২০১৭ সালে কমে ৩৩ হয়েছে - এর কৃতিত্ব আআশা-কর্মীদের। ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৫-১৬ মধ্যে শিশুদের জন্মের পর খোঁজ নেওয়ার জন্য বাড়ি বাড়ি যাওয়ার হার ৩৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫১ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে প্রসব করার হার বেড়ে হয়েছে ৩৯ শতাংশ থেকে ৭৯ শতাংশ।
“সে যত ভালো কাজই আমরা করে থাকি আর এখনও করে যাই না কেন, শেষ অবধি আমাদের কেবল গাদা গাদা সমীক্ষাপত্রই পূরণ করতে হয়,” বললেন সুনীতা।
“প্রত্যেকদিন আমাদের নতুন রিপোর্ট জমা দিতে হয়,” বললেন জখৌলি গ্রামের ৪২ বছর বয়সী আশা-কর্মী, নীতু (নাম পরিবর্তিত)। “কোনওদিন সহকারী নার্স ও ধাত্রীরা (অক্সিলিয়ারি নার্স মিডওয়াইফ অর্থাৎ এএনএম - যাঁদের কাছে আশা-কর্মীরা সরাসরি দায়বদ্ধ) যতজন মহিলার প্রসব পরবর্তী যত্ন প্রয়োজন তার হিসাব চাইলে পরেরদিন আমরা গুনতে বসি প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব কতজনের হয়েছে আর তারও পরেরদিন আবার সবার রক্তচাপ নথিভুক্ত করি (কর্কট রোগ, মধুমেহ ও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে)। তার পরদিন বলা হয় নির্বাচন কমিশনের জন্য বুথ স্তরের আধিকারিক হিসাবে সমীক্ষা করতে। এর আর কোনও শেষ নেই।”
নীতু হিসাব করে দেখালেন যে ২০০৬-এ আশা-কর্মী হওয়ার পর থেকে অসুস্থতা আর উৎসব বাবদ ছুটি ছাড়া ৭০০ সপ্তাহ এই কাজে ব্যয় করেছেন। ৮,২৫৯ জনের গ্রামে নয় জন আশা-কর্মী থাকা সত্ত্বেও তিনি দৃশ্যতই ক্লান্ত। রক্তাল্পতা সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির একটি কাজ সেরে তিনি ধর্মঘটের জন্য চলা অবস্থানে পৌঁছালেন এক ঘন্টা দেরিতে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে যে সব কাজ আশা-কর্মীদের করতে বলা হয় তার মধ্যে আছে গ্রামের পাকা বাড়ি গোনা থেকে শুরু করে গরু মোষের গণনাও।
২০১৭-তে আশা-কর্মী হিসাবে যোগ দেওয়ার পর থেকে তিন বছরে আমার কাজ তিন গুণ হয়েছে — এবং তার বেশিরভাগই কাগজ-কলমের কাজ,” সরকারি হাসপাতাল থেকে আট কিলোমিটার দূরে তাঁর গ্রাম বহলগড় থেকে আসা ৩৯ বছর বয়সী আশা-কর্মী ছবি কশ্যপ জানালেন। “সকারের চাপিয়ে দেওয়া যাবতীয় সমীক্ষার কাজ সারার পর শুরু হয় আমাদের আসল কাজ।”
বিয়ের পর ১৫ বছর অবধি ছবি একা বাড়ি থেকে বেরোতেন না, এমনকি একা হাসপাতালেও যেতেন না। ২০১৬ সালে একজন আশা সহায়ক গ্রামে একটি কর্মশালায় আশা-কর্মীদের কাজ সম্বন্ধে বুঝিয়ে বলার পর, ছবি এই কাজে যোগ দিতে চাইলেন। এই কর্মশালাগুলির পর, অন্তত অষ্টম শ্রেণি অবধি পড়েছেন, গ্রামের এমন ১৮ থেকে ৪৫ বছর অবধি বয়সের তিনজন বিবাহিত মহিলা, যাঁরা সামাজিক স্বাস্থ্য স্বেচ্ছাকর্মী হিসাবে কাজ করতে উৎসাহী, তাঁদের নাম, সহায়করা তালিকাভুক্ত করেন।
ছবি আগ্রহী ছিলেন এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতাও তাঁর ছিল কিন্তু স্বামী রাজি ছিলেন না। ছবির স্বামী, বহলগড়ের ইন্দিরা কলোনির একটি বেসরকারি হাসপাতালের সেবাকর্মী এবং সপ্তাহে দুইদিন তাঁর রাতের ডিউটি থাকে। “আমাদের দুই ছেলে। আমার স্বামী ভাবলেন আমরা দুজনকেই যদি বাইরে বেরোই তবে ওদের দেখাশুনা করবে কে,” ছবি বললেন। কয়েকমাস পর, যখন অর্থের টানাটানি দেখা দিল তখন তিনি ছবিকে নাম লেখাতে বললেন। পরেরবারের নাম তালিকাভুক্তির সময়ে ছবি আবেদন করেন এবং গ্রাম সভা, ৪,১৯৬ জনসংখ্যার গ্রাম, বহলগড়ের পাঁচজন আশা-কর্মীর অন্যতম হিসাবে তাঁর নাম দ্রুত গ্রহণ করে নেয়।
“স্বামী-স্ত্রী হিসাবে আমরা একটা নিয়মই মেনে চলি। যদি ওর রাতের ডিউটি থাকে আর কোনও মহিলাকে প্রসবের জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমার ডাক আসে তাহলে বাচ্চাদের ছেড়ে আমি বেরোই না। আমি হয় অ্যাম্বুলেন্স ডেকে দেই অথবা অন্য কোনও আশা-কর্মীকে আমার বদলি হিসেবে কাজ করে দিতে বলি,” ছবি জানালেন।
প্রতি সপ্তাহেই গর্ভবতী মহিলাদের প্রসব করাতে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় আশা-কর্মীদের। “গত সপ্তাহেই এক আসন্নপ্রসবা ফোনে জানাল যে তার ব্যথা উঠেছে আর সে চায় আমিই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু আমি বেরোতে পারলাম না,” সোনেপতের রাই তেহশিলের বধ খালসা গ্রামের আশা-কর্মী শীতল (নাম পরিবর্তিত) বললেন। আয়ুষ্মান ভারত প্রধান মন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনার প্রতি ইঙ্গিত করে ৩২ বছর বয়সী শীতল আরও বললেন, “একই সপ্তাহে আমাকে একটি আয়ুষ্মান শিবিরও চালাতে বলা হয়েছিল।” তিনি জানালেন, গ্রামে যাঁরা ওই সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার যোগ্য তাঁদের সবার নথিপত্র বোঝাই ব্যাগ নিয়ে শিবিরে আটকে পড়া অবস্থায় তিনি এএনএম-এর কাছ থেকে নির্দেশ পেলেন যে অন্য সব কাজ ফেলে এখন আয়ুষ্মান যোজনার কাজকেই অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
“ওই মহিলা (উপরে যাঁর কথা বলা হয়েছে), বিয়ে হয়ে দুইবছর আগে এই গ্রামে আসার পর থেকে অনেক পরিশ্রম করে আমি তার আস্থা অর্জন করেছিলাম। আমি বরাবর তার সঙ্গে ছিলাম — ওর শাশুড়িকে রাজি করিয়েছিলাম যাতে আমি ওকে পরিবার পরিকল্পনা সম্বন্ধে বুঝিয়ে বলার সুযোগ পাই, ওকে আর ওর স্বামীকে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলাম যাতে বিয়ের পর বাচ্চা হওয়ার আগে ওরা অন্তত দুবছর অপেক্ষা করে আর তারপর ওর গর্ভাবস্থায় পুরো সময়টাই আমি সঙ্গে ছিলাম। সেদিন আমার থাকা উচিত ছিল,” বললেন শীতল।
এমতাবস্থায় তিনি এই উৎকন্ঠাগ্রস্ত পরিবারকে — যার সদস্যরা তাঁকে ছাড়া চিকিৎসকের কাছে যেতেই রাজি ছিলেন না — তাঁদের আধঘন্টা ধরে ফোনে আস্বস্ত করতে সময় ব্যয় করলেন। অবশেষে তাঁর ঠিক করে দেওয়া অ্যাম্বুলেন্সে করেই তাঁরা গেলেন। “আমরা যে আস্থা গড়ে তুলি তা এভাবে ধাক্কা খায়,” সুনীতা রানী বললেন।
অবশেষে যখন আশা-কর্মীরা কাজ শুরু করেন তখনও তাঁদের একরকম হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কাজ করতে হয়। তাঁদের কাছে ওষুধের কিট থাকে না, এমনকি প্যারাসিটামল, গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ক্যালসিয়াম ও আয়রন বড়ি, ওআরএস, কন্ডোম, জন্মনিয়ন্ত্রক বড়ি ও গর্ভধারণ নিশ্চিত করার পরীক্ষা-কিটের মতো আবশ্যিক জিনিসও থাকে না। “আমাদের কিছুই দেওয়া হয় না, মাথা ধরার ওষুধটুকুও না। আমরা প্রত্যেক পরিবারে কে কী ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রক ব্যবহার করেন সেসব তথ্যসহ অন্য ওষুধের প্রয়োজন থাকলে লিখে নিয়ে এএনএম-কে অনুরোধ করে তা আনানোর বন্দোবস্ত করি,” বললেন সুনীতা। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত সরকারি নথি তাঁদের এই কথার সত্যতা প্রমাণ করে — ১,০৪৫ জন আশা-কর্মীকে মাত্র ৪৮৫-টি ওষুধের কিট দেওয়া হয়েছিল সোনিপত জেলায়।
অনেকসময়েই আশা-কর্মীরা খালি হাতে তাঁদের পাড়ার মানুষের কাছে যেতে বাধ্য হন। “কখনও ওরা আমাদের ক্যালসিয়াম বড়ি দেয় তো আয়রন বড়ি দেয় না, অথচ গর্ভবতী মহিলাদের এই দুই ধরনের বড়ি একসাথে খাওয়া উচিত। কখনও গর্ভবতী মহিলা পিছু মাত্র ১০-টি বড়ি দেয় যা ১০ দিনেই শেষ হয়ে যায়। কোনও মহিলা তখন আমাদের কাছে এলে আমাদের হাতে দেওয়ার কিছু থাকে না,” ছবি আমাদের বুঝিয়ে বললেন।
কখনও আবার তাঁদের দেওয়া হয় নিম্নমানের জিনিস। “কয়েকমাস কোনও জোগান না থাকার পর আসে দ্রুত বিলি করার নির্দেশ সহ মেয়াদ ফুরানোর তারিখের একমাস আগের মালা-এন (হরমোন যুক্ত জন্মনিয়ন্ত্রক বড়ি),” বললেন সুনীতা। মালা-এন ব্যবহারকারী মহিলাদের প্রতিক্রিয়া আশা-কর্মীরা সযত্নে নথিভুক্ত করেন, তাঁদের এই কাজ সাধারণত বিবেচনার মধ্যেই আনা হয় না।
ধর্মঘটের দিন দুপুরবেলার মধ্যে ৫০ জন আশা-কর্মী প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন। হাসপাতালের বহির্বিভাগের পাশে একটি চায়ের দোকানে চা দিতে বলা হয়েছিল। একজন যখন জানতে চাইলেন চায়ের দাম কে মেটাবে, নীতু ঠাট্টা করে জবাব দিলেন তিনি নিশ্চয় দেবেন না, কারণ তিনি তো ছয়মাস বেতনই পাননি। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের খাতায় আশা-কর্মীরা ‘স্বেচ্ছাসেবিকা’ হিসাবে চিহ্নিত। যে অজস্র কাজ তাঁরা করেন তার মধ্যে মাত্র পাঁচটিকে ‘নিয়মিত ও পৌনঃপুনিক’ বলা হয়েছে। এইগুলির জন্য ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে কেন্দ্রীয় সরকার ২,০০০ টাকা দিতে রাজি হলেও কখনই তা ঠিক সময়ে দেওয়া হয় না।
এছাড়া আশা-কর্মীরা প্রতি কাজ পিছুও অর্থ পান। ওষুধ কাজ করছে না (ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট) এমন যক্ষ্মা রোগীকে ছয় থেকে নয় মাস ওষুধ প্রয়োগ করা বাবাদ তাঁরা সর্বোচ্চ ৫,০০০ টাকা পেতে পারেন, আবার মাত্র ১ টাকা পান ওআরএস বিলি করার জন্য। পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মহিলাদের ঝোঁক থাকে সাধারণত বন্ধ্যাত্বকরণের দিকেই, দুই সন্তানের মাঝে ব্যবধান রাখার প্রতি নয়। একটি টিউবেকটমি (মহিলাদের জন্মনিয়িন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি) বা ভ্যাসেকটমি (পুরুষদের জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি) করাতে পারলে আশা-কর্মীরা পান ২০০-৩০০ টাকা অথচ এক প্যাকেট কন্ডোম বা জন্মনিয়ত্রক বড়ি অথবা আপতকালীন অবস্থার জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রক বড়ি বিলির জন্য তাঁদের প্রাপ্য মাত্র ১ টাকা করে। আশা-কর্মীদের কাজের মধ্যে সর্বাধিক পরিশ্রমসাধ্য, সময়সাপেক্ষ কাজটি হল পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে বুঝিয়ে বলা ও পরামর্শ দেওয়া — অথচ এর জন্য তাঁরা আলাদা করে কোনও অর্থই পান না।
জাতীয় ও আঞ্চলিক স্তরে একাধিক ধর্মঘটের পর রাজ্যগুলি আশা-কর্মীদের একটি নির্দিষ্ট মাসিক ভাতা দিতে শুরু করেছে। দেশের সর্বত্র অবশ্য এই অর্থের পরিমাণ এক নয় — কর্ণাটকে দেওয়া হয় ৪,০০০ টাকা, কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশে দেওয়া হয় ১০,০০০; জানুয়ারি ২০১৮ থেকে হরিয়ানার আশা-কর্মীরা রাজ্য সরকারের কাছ থেকে পান ৪,০০০ টাকা করে।
“জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের নিয়ম অনুসারে আশা-কর্মীদের দৈনিক তিন-চার ঘন্টার হিসেবে সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন কাজ করার কথা। কিন্তু শেষ কবে এখানে কেউ ছুটি নিতে পেরেছিলেন, তা কারও মনে পড়ে না। আর আমরা আর্থিক সহায়তা বলতে কী পাই?” জোরের সঙ্গে এই কথা বলে সুনীতা উপস্থিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে আলোচনা শুরু করলেন। বহু মহিলাই কথা বললেন। তাঁরা কেউ বা ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে রাজ্য সরকারের প্রদেয় ভাতা পাননি আবার কেউ আবার টানা আটমাস পাননি তাঁদের কাজভিত্তিক উৎসাহ ভাতা।
বেশিরভাগ আশা-কর্মী ভুলেই গেছেন তাঁদের কতটা টাকা বকেয়া আছে। “রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার – এই দুই সূত্র থেকে অর্থ আসে পৃথক পৃথক সময়ে আলাদা আলাদা থোকে। কোন পাওনাটা বাকি তা লোকে ভুলেই যায়,” নীতু বললেন। এসবের সমস্যাও কম না, এতটা দীর্ঘসময় কাজ করে সমতুল বেতন না পাওয়ার জন্য অনেকেই বাড়িতে বিদ্রুপের সম্মুখীন হন; বাড়ির চাপে অনেকে কাজ ছেড়েও দিয়েছেন।
তার উপর এক উপকেন্দ্র থেকে আর এক উপকেন্দ্রে তথ্য সংগ্রহ করতে যাওয়ার জন্য অথবা রোগী নিয়ে হাসপাতালে যেতে আশা-কর্মীদের বহু সময়ে নিজেদের খরচ থেকে ১০০-২৫০ টাকা খরচ করতেও হতে পারে। “গরমের মধ্যে তেতেপুড়ে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে সভা করতে গ্রামে গেলে যোগ দিতে আসা মহিলারা আশা করে আমরা তাদের জন্য ঠাণ্ডা পানীয় আর কিছু খাবারের ব্যবস্থা করব। তাই আমরা নিজেরাই চাঁদা তুলে জলখাবারের বন্দোবস্ত করি। না করলে ওরা কেউ আসবেই না,” বললেন শীতল।
ধর্মঘটের আড়াই ঘন্টার মধ্যেই তাঁদের দাবিগুলি স্পষ্ট হয়ে গেল — এমন স্বাস্থ্য কার্ড যা দেখিয়ে আশা-কর্মী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা সরকারের কাছে নথিভুক্ত বেসরকারি হাসপাতালে পরিষেবা পেতে পারেন; তাঁদের অবসরকালীন ভাতার নিশ্চয়তা; ছোটো ছোটো কলামে ঘেঁষাঘেঁষি করে লেখা দুটি পাতার বদলে পরিষ্কার করে লেখা তাঁদের কাজকর্মের তালিকা এবং প্রতিটি স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রে একটি আলমারি, যাতে কন্ডোম আর স্যানিটারি ন্যাপকিন নিজেদের বাড়িতে রাখার দরকার না হয়। হোলি উৎসবের তিনদিন আগে নীতুর ছেলে বাড়ির আলমারিতে রাখা কন্ডোমগুলি দেখে এই বেলুনগুলির কথা জানতে চেয়েছিল।
তারচেয়েও বড়ো কথা, আশা-কর্মীরা চান যে তাঁদের কাজকে যথাযথ মর্যাদা আর স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
“জেলার অনেক হাসপাতালের প্রসব কক্ষের বাইরে দেখবেন লেখা থাকে ‘আশা-কর্মীদের প্রবেশ নিষেধ’,” বললেন ছবি। তিনি আরও বললেন, “মাঝরাতে আমরা মহিলাদের প্রসব করাতে নিয়ে গেলে ওরা আমাদের থাকতে বলে কারণ তারা সাহস পায় না আর আমাদের উপর ওদের আস্থাও আছে। কিন্তু আমাদের ভিতরে যাওয়ার অনুমতি থাকে না। হাসপাতাল কর্মীরা আমাদের বলে, ‘যাও, যাও এখন এখান থেকে’। হাসপাতাল কর্মচারীরা আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করে যেন আমরা ওদের চেয়ে নীচু স্তরের কেউ।” প্রায়ই আশা-কর্মীরা মহিলাটির পরিবারের সঙ্গে থেকে যান যদিও বেশিরভাগ প্রাথমিক বা সামাজিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রেই কোনও বিশ্রামাগার নেই।
বেলা ৩টে নাগাদ প্রতিবাদ স্থলে মহিলারা অস্থির উঠলেন। তাঁদের কাজে ফিরতে হবে এবার। সুনীতা তাড়াতাড়ি ছুটলেন এই পর্ব গুটিয়ে ফেলতে - “সরকারের উচিত স্বেচ্ছাকর্মীর বদলে আমাদের রীতিমতো কর্মচারী হিসাবে বিবেচনা করা। সমীক্ষা করার ভার আমাদের উপর থেকে তুলে নিতে হবে যাতে আমরা আমাদের কাজ করতে পারি। আমাদের প্রাপ্য বকেয়া টাকা আমাদের দিয়ে দিতে হবে।”
ইতিমধ্যে বহু আশা-কর্মী গোছগাছ করতে শুরু করে দিলেন। শেষবারের মতো সুনীতা আওয়াজ তুললেন, “কাজ পাকা, চাকরি কাঁচা”, প্রথমবারের চেয়েও জোর সাড়া এলো, “চলবে না, চলবে না!” নিজেদের অধিকারের জন্য ধর্মঘটে বসারও আমাদের অবসর নেই; সমীক্ষা আর শিবিরের সময় বাঁচিয়ে আমাদের ধর্মঘটের সময় বার করে নিতে হয়!” প্রতিদিনের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার কাজ শুরু করতে বেরোবার প্রস্তুতি হিসাবে মাথায় দোপাট্টা তুলতে তুলতে হেসে বললেন শীতল।
প্রচ্ছদ চিত্র: নিউ - মিডিয়া শিল্পী প্রিয়াঙ্কা বোরার নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে ভাব এবং অভিব্যক্তিকে নতুন রূপে আবিষ্কার করার কাজে নিয়োজিত আছেন । তিনি শেখা তথা খেলার জন্য নতুন নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি করছেন ; ইন্টারেক্টিভ মিডিয়ায় তাঁর সমান বিচরণ এবং সেই সঙ্গে কলম আর কাগজের চিরাচরিত মাধ্যমেও তিনি একই রকম দক্ষ ।
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
বাংলা অনুবাদ : চিলকা