"মোটেও আমরা এই ৫৮টা উটকে গ্রেফতার করিনি!" দাবি করলেন অমরাবতী জেলার তালেগাঁও দশহর পুলিশ থানার চিফ ইন্সপেক্টর অজয় আকারে, "মহারাষ্ট্রে এই জাতীয় পশুদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনও নির্দিষ্ট কোনও আইনই নেই, তাই গ্রেফতার করাটা আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে।"
"উটগুলোকে কেবল পাকড়াও করেছি আমরা," জানালেন তিনি।
উট প্রতিপালকদের সঙ্গেও হয়তো একই ঘটনা ঘটত, কিন্তু বাধ সাধলেন অমরাবতীর এক স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট। পাঁচজন আধা-ভবঘুরে গুজরাতের কচ্ছ অঞ্চলের পশুপালক, তাঁদের মধ্যে চারজন রাবারি সম্প্রদায়ের এবং একজন ফকিরানি জাট গোষ্ঠীর। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, শতাব্দীর পর শতাব্দী তাঁরা উট চরিয়ে এসেছেন। স্বঘোষিত কিছু 'প্রাণী অধিকার কর্মী' নালিশ ঠোকায় পুলিশ তাঁদের গ্রেফতারও করেছিল বটে, কিন্তু বিনা শর্তে চটজলদি তাঁদের জামিনের ব্যবস্থা করে দেন স্থানীয় সেই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব।
"উটগুলো যে ওদেরই, এই সংক্রান্ত কোনও কাগজপত্রই ছিল না ওই পাঁচজনের কাছে। না ছিল উট-ফুট কেনার কোনও রসিদ, এমনকি সাকিন-মুলুকের কোনও দলিলটুকুও ছিল না," আকারে জানালেন। এরপর শুরু হয় বিচিত্র এক তামাশা, পরম্পরাগতভাবে এই পেশায় নিযুক্ত ওই পাঁচ পশুপালক ভরা আদালতে উটের সচিত্র প্রমাণপত্র এবং মালিকানার নথি দাখিল করতে বাধ্য হন। তাঁদের আত্মীয়স্বজন এবং আধা-ভবঘুরে ওই দুই পশুপালক সমাজের অন্যান্য সদস্যরা না থাকলে এসব দলিলপত্র আদৌ জোগাড় করা যেত কিনা সন্দেহ, আপাতত সেসব পাঠাবার তোড়জোড়েই লেগে আছেন তাঁরা।
রাখালিয়াদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ওই ৫৮টি উট আটকে আছে একটি গোরক্ষা কেন্দ্রে, যেটি কিনা আদতে গরুদের জন্য বানানো। তাদের দেখভাল তথা চারা-পানির দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা উটের ব্যাপারে ততটাই ওয়াকিবহাল যতটা কিনা জাহাজের ব্যাপারে জানেন আদার ব্যাপারী। অবশ্য গরু এবং উট দুটি প্রাণীই জাবর কাটে বটে, কিন্তু তাদের জাব বা চারায় বিস্তর ফারাক। মামলাটা বেশি দিন গড়ালে গোরক্ষার এই কারাগারে উটেদের হাল যে দিনে দিনে বেহাল হবে, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
*****
'উট হল গিয়ে রাজস্থানের রাজ্য-প্রাণী, অন্যান্য রাজ্যে তার পক্ষে মানিয়ে নেওয়াটা মুশকিল'
যশরাজ শ্রীশ্রীমল, ভারতীয় প্রাণী মিত্র সংঘ, হায়দরাবাদ
খিটকেলে এক গভীর সন্দেহ থেকেই এ ঘটনার সূত্রপাত।
৭ই জানুয়ারি, ২০২২। হায়দরাবাদ নিবাসী পশুকল্যাণ কর্মী, ৭১ বছর বয়সী যশরাজ শ্রীশ্রীমল তালেগাঁও দশহর থানায় নালিশ ঠোকেন যে পাঁচজন চোরাকারবারী নাকি কয়েকটা উট নিয়ে যাচ্ছে হায়দরাবাদের খোঁয়াড়ে দেবে বলে। অমনি তড়িঘড়ি উট-সমেত সেই 'চোরাকারবারীদের' আটক করে পুলিশ। তবে দ্রষ্টব্য বিষয় এটাই যে পশুপালকদের সঙ্গে শ্রীশ্রীমলের মোলাকাত হায়দরাবাদে মোটেও হয়নি, বরং হয়েছিল মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলে।
শ্রীশ্রীমলের অভিযোগে লেখা ছিল: "একজন সহকর্মীর সঙ্গে বেরিয়েছিলাম অমরাবতী ছেড়ে, নিমগাভন গ্রামে [চান্দুর রেলওয়ে তেহসিল] গিয়ে দেখি যে উট-সমেত চার-পাঁচজন লোক একটা মাঠের ভিতর ঘাঁটি গেঁড়েছে। গুনে দেখলাম যে ৫৮টা উট রয়েছে - দড়িদড়া দিয়ে গলা, ঠ্যাং, সবকিছু এমনভাবে বাঁধা যে বেচারিরা চলতে ফিরতেও পারছে না, অর্থাৎ কিনা নির্যাতন হচ্ছিল তাদের উপর। কয়েকটার গায়ে তো রীতিমতো ক্ষতের চিহ্ন, দেখলাম যে বানজারা লোকগুলো ওষুধ-টষুধ কিছুই লাগায়নি। উট হল গিয়ে রাজস্থানের রাজ্য-প্রাণী, অন্যান্য রাজ্যে মানিয়ে নিয়ে তার পক্ষে টিকে থাকাটা মুশকিল। লোকগুলোর কাছে না ছিল ঠিকঠাক কোনও কাগজপত্র, না ঠিক করে বলতে পারল যে উটগুলোকে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।"
বাস্তবে ভারতবর্ষে উটের দেখা মেলে রাজস্থান, গুজরাত, হরিয়ানা ইত্যাদি নানান জায়গাতেই। অবশ্য উট প্রতিপালনের কাজটা রাজস্থান ও গুজরাতের মধ্যেই সীমিত। ২০১৯ সালের ২০তম গবাদি পশুগণনা অনুযায়ী এ দেশে উটের সংখ্যা ২৫০,০০০। অর্থাৎ ২০১২ সালের পশুগণনায় যেটা পাওয়া গিয়েছিল তার থেকে ৩৭ শতাংশ কম।
ওই পাঁচ অভিজ্ঞ পশুপালক পশুদের নিয়ে যাত্রায় সিদ্ধহস্ত, বিশেষ করে এইরকম বড়োসড়ো প্রাণীদের নিয়ে গমনাগমনে দক্ষ তাঁরা। প্রত্যেকেই গুজরাতের কচ্ছ অঞ্চলের অধিবাসী। ইহজন্মে তাঁদের কেউই হায়দরাবাদে পা রাখেননি।
"লোকগুলোর কাছ থেকে সোজাসাপ্টা কোনও জবাব না পাওয়াতে সন্দেহটা দানা বাঁধলো," হায়দরাবাদ থেকে শ্রীশ্রীমল এটাই বলেছিলেন ফোন করে, "বেআইনি ভাবে উট জবাই করার ঘটনা বেড়েই চলেছে ভারত জুড়ে।" তাঁর দাবি, তিনি যে সংগঠনটির সদস্য, সেই 'ভারতীয় প্রাণী মিত্র সংঘ' নাকি গত পাঁচ বছরে ৬০০-এর বেশি উট উদ্ধার করেছে সারা দেশ জুড়ে।
গুলবর্গা, বেঙ্গালুরু, আকোলা, হায়দরাবাদ ইত্যাদি হাজারো জায়গা নাকি এই 'উদ্ধারকর্মের' সাক্ষী। উপরন্তু সেই 'উদ্ধার' হওয়া উটগুলিকে তাঁদের সংগঠন থেকে নাকি রাজস্থান অবধি 'পৌঁছে' দেওয়া হয়েছে। শ্রীশ্রীমলের দৃঢ় বিশ্বাস, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মতো হায়দরাবাদেও নাকি উটের মাংস খাওয়ার খুব চল হয়েছে আজকাল। তবে গবেষক ও ব্যবসায়ীর দল উভয়েই হলফ করে বলছেন যে একমাত্র পুরুষ উটের মাংসই খাওয়া হয়, এবং সেটাও তারা বুড়ো হয়ে গেলেই।
ভারতীয় জনতা পার্টির সাংসদ, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা পিপলস্ ফর অ্যানিমল সংগঠনের নেত্রী মানেকা গান্ধীর সঙ্গে শ্রীশ্রীমলের যথেষ্ট সুসম্পর্ক। টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত মানেকা গান্ধীর সেই কুখ্যাত উক্তিটির কথা মনে করা যাক: "উত্তরপ্রদেশের বাঘপতকে কেন্দ্র করে একটি বিশাল বড়ো চক্র তথা চোরাকারবারের আঁতাত রয়েছে। উটগুলোকে বাংলাদেশেও পাচার করা হয়। এতগুলো উটের একত্রে থাকার অন্য কোনও কারণ হতে পারে না।”
প্রাথমিক পর্যায়ের তদন্তের পর ৮ই জানুয়ারি পুলিশ একটি এফআইআর দায়ের করে। মহারাষ্ট্রে যেহেতু আলাদা করে উটেদের রক্ষার্থে কোনও আইন নেই, তাই পশু অত্যাচার নিরোধ আইন ১৯৬০-এর অধীনে ১১ (১)(ডি)-এর আওতায় মামলা রুজু করা হয়।
অপরাধীর তকমা পান চল্লিশোর্ধ্ব প্রভু রাণা, জগ হীরা, মুসাভাই হামিদ জাট, বছর পঞ্চাশোর্ধ্ব ভিসাভাই সারাভু ও ৭০ পেরোনো ভেরসিভাই রাণা রাবারি।
তবে ইন্সপেক্টর আকারের মতে মুশকিলটা ছিল সেই ৫৮টি উটের দেখভাল নিয়ে। প্রথম দুটো রাত্তির স্থানীয় একটি ছোটখাটো গোরক্ষা কেন্দ্রের সাহায্য নেয় পুলিশ, একই সঙ্গে তারা কথাবার্তা চালাতে থাকে অমরাবতী অঞ্চলের বৃহৎ গোরক্ষা কেন্দ্রগুলির সঙ্গে। শেষমেশ অমরাবতীর দস্তুর নগরের কেন্দ্রটি এগিয়ে আসে এবং তড়িঘড়ি উটগুলিকে সেখানেই পাঠানো হয়, কারণ এতগুলো পশুকে রাখার মতো পর্যাপ্ত জায়গা কেবল ওখানেই ছিল।
মজার ব্যাপার হল, উটগুলোকে স্থানান্তরিত করার দায়িত্বটা কিন্তু গিয়ে পড়েছিল আটক হওয়া পাঁচজন যাযাবর পশুপালকের আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবের উপর। তাঁরা ৫৫ কিমি রাস্তা টানা দুদিন ধরে পায়ে হেঁটে তালেগাঁও দশহর থেকে অমরাবতী পৌঁছান।
এই পশুপালকদের প্রতি সহানুভূতি উপচে পড়ছে চারিদিক থেকে। কচ্ছের অন্তত তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে অমরাবতীর পুলিশ ও জেলা প্রশাসনকে চিঠি পাঠিয়ে অনুরোধ করা হয়েছে যাতে উটগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়, উন্মুক্ত স্থানে চরতে না পারলে বেচারিরা না খেয়ে মরবে। নাগপুর জেলার মকরধোকাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত, যেখানে রাবারিদের একটা মস্ত ডেরা (বসতি) রয়েছে, তারা হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে যে এই পাঁচজন অবশ্যই পরম্পরাগত পশুপালক এবং উটগুলো মোটেও তাঁরা হায়দরাবাদের কোনও খোঁয়াড়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন না। উটেদের মালিকানা নির্ধারণের ভার এসে পড়েছে একটি নিম্নবর্তী আদালতের উপর: যে পাঁচজন অভিযুক্ত তাদের নিয়ে এসেছেন, উটগুলো কি তাঁদেরকেই ফিরিয়ে দেওয়া উচিত, নাকি কচ্ছেই পাঠানো হবে?
মোদ্দা কথা হল, এঁরা যে পরম্পরাগত পশুপালক - এই কথাটা মহামান্য আদালত আদৌ মানবে কিনা, সেটার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে সবকিছু।
*****
"আমাদের অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয় সন্দেহ, কারণ পরম্পরাগতভাবে পশু চরিয়ে আসা এই মানুষগুলো না আমাদের মতো দেখতে, না আমাদের মতো করে কথা বলে।"
সজল কুলকর্ণি, যাযাবর রাখালিয়া সম্প্রদায়ের উপর গবেষণারত, নাগপুর
পাঁচজন মেষপালকের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ভেরসিভাই রাণা রাবারি সারাটা জীবন ধরে পায়ে হেঁটে দেশের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে উট এবং ভেড়ার পাল চরিয়ে এসেছেন, তবে পশুদের উপর অত্যাচারের এমনতর উটকো অপবাদ এর আগে কখনোই সইতে হয়নি তাঁকে।
কচ্ছি ভাষায় বৃদ্ধ জানালেন: "এমনটা প্রথমবার হল।" থানার মাঝে একটা গাছতলায় জবুথবু হয়ে বসেছিলেন, বয়সের ভারে কোঁচকানো তাঁর মুখটি লজ্জা ও দুশ্চিন্তায় ভরা।
পাঁচ 'অভিযুক্তের' মধ্যে আরেকজন, প্রভু রাণা রাবারি, ১৩ই জানুয়ারি তালেগাঁও থানায় আমাদের জানিয়েছিলেন: "কচ্ছ থেকে এনেছি উটগুলো, মহারাষ্ট্র আর ছত্তিশগড়ে আমাদের বেরাদরির কয়েকজন থাকে, ওদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল।" ঠিক তার পরদিনই, ১৪ই জানুয়ারি সরকারিভাবে গ্রেফতার করা হয় তাঁদের, অবশ্য জামিনও পেয়ে যান তৎক্ষণাৎ।
ভুজ থেকে অমরাবতীর রাস্তায় কেউই আটকায়নি তাঁদের। একটা ফোঁটাও সন্দেহ জাগেনি কারও মনে। দেশান্তরের সে যাত্রা যে এমন উটকো ঝামেলায় পড়ে থমকে যাবে, এমনটা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেননি তাঁরা।
মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা, নাগপুর এবং ভান্ডারা ছাড়াও ছত্তিশগড়ের রাবারি বসতিতে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল উটগুলিকে।
রাবারিরা আধা-ভবঘুরে পশুপালক সম্প্রদায়, কচ্ছ ও রাজস্থানের সমগোত্রীয় দু-তিনটি সম্প্রদায়ের মতো ভেড়া আর ছাগল চরিয়ে পেট চালান তাঁরা, আর রয়েছে খেতিবাড়ির কাজ তথা মালপত্র বওয়ার জন্য উট। এবং এটা তাঁরা কচ্ছ উট-পালক সংগঠনের দ্বারা নির্ধারিত 'জৈব-সাংস্কৃতিক কৌম নিয়মাবলী '-র ঘেরাটোপের মধ্যে থেকেই করেন।
এই সম্প্রদায়ের একাংশের নাম ধেবাড়িয়া রাবারি। দূর-দূরান্তের যেসব জায়গায় পর্যাপ্ত পরিমাণে জল ও খাদ্য মেলে, বছরের সিংহভাগ সময় তাঁরা সেসব জায়গায় পরিযান করেন। তবে সাম্প্রতিককালে দেখা গেছে যে বহু পরিবার বেশিরভাগ সময়ই মধ্য ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ডেরা বেঁধে থাকছে। দীপাবলি তিথি পেরোলে মরসুমি পরিযানে বেরোন তাঁরা, কচ্ছ থেকে পদব্রজে পৌঁছে যান সুদূর তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, এমনকি মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলেও।
রাখালিয়া গোষ্ঠী তথা প্রথাগতভাবে গবাদি পশু পালন করেন যাঁরা, সেইসব গোষ্ঠীর উপর কর্মরত গবেষক তথা রিভাইটালাইজিং রেইনফেড এগ্রিকালচারাল নেটওয়ার্কের (আরআরএএন) একজন বিশিষ্ট ফেলো নাগপুর নিবাসী সজল কুলকর্ণির মতে মধ্য ভারত জুড়ে ধেবাড়িয়া রাবারিদের অন্তত ৩,০০০টি বসতি রয়েছে, এবং একেকটি ডেরায় পাঁচ-দশটি পরিবার জটলা বেঁধে থাকেন। উট ছাড়াও মাংসের জন্য ভেড়া ও ছাগলের পাল পোষেন রাবারিরা।
বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাবারিদের মতো যাযাবর রাখালিয়া সম্প্রদায়ের পশুপালন নিয়ে গবেষণা করছেন কুলকর্ণি। "এই ঘটনাটা থেকে একটা জিনিস কিন্তু জলবৎ তরলং হয়ে গেল, মেষপালন করা মানুষদের ব্যাপারে কত কম জানি আমরা। এই অজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয় সন্দেহ, কারণ পরম্পরাগতভাবে পশু চরিয়ে আসা এই মানুষগুলো না আমাদের মতো দেখতে, না আমাদের মতো করে কথা বলায় অভ্যস্ত," গ্রেফতার হওয়া সেই পাঁচজন এবং 'আটক' হওয়া সেই উটগুলোর প্রসঙ্গে এই কথাগুলি বলছিলেন তিনি।
তবে কুলকর্ণির মতে ভবঘুরে জীবন ছেড়ে থিতু হয়ে যাচ্ছে, রাবারিদের মধ্যে এমন দলের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। গুজরাতে তাঁরা তাঁদের পরম্পরাগত জীবনযাত্রা থেকে সরে এসে কেতাবি শিক্ষা ও চাকরি-বাকরির দিকে ঝুঁকছেন ক্রমশই। এমন বেশ কয়েকটি পরিবারও রয়েছে যেগুলি মহারাষ্ট্রে জমি কিনে চাষবাসে ব্যস্ত, স্থানীয় চাষিদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করেন তাঁরা।
"তাঁদের সঙ্গে কৃষকদের পারস্পরিক আদানপ্রদানের ভিত্তিতে একপ্রকার মিথোস্ক্রিয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে ওঠে," বললেন কুলকর্ণি। এই যেমন 'পেন্নিং' বা 'খেত-চরানির' কথাই ধরুন – চাষের মরসুম পেরোলে ভেড়া আর ছাগলগুলোকে খেত-খামারে চরে খেতে দেন রাবারিরা। এই পশুদের লাদি থেকে মাটি ফিরে পায় তার হারানো উর্বরতা। এ যেন বিনামূল্যে পাওয়া জৈব-সার। "এ কথাটা যেসব চাষিরা জানেন, তাঁদের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ রয়েছে রাবারিদের," বোঝাচ্ছিলেন কুলকর্ণি।
যে রাবারিদের জন্য সেই ৫৮টি উট নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তাঁরা সকলেই মহারাষ্ট্র কিংবা ছত্তিশগড়ের বাসিন্দা। আজীবন এই রাজ্যগুলিতে তাঁরা ডেরা বেঁধে থাকলেও কচ্ছ-নিবাসী বেরাদরির সঙ্গে সম্পর্কটা কিন্তু ছিন্ন হয়নি তাঁদের। ওদিকে ফকিরানি জাটেরা যদিও অমন দূর-দূরান্তে পাড়ি দেওয়ার বান্দা নন, তবে পশুপালনে কিন্তু সিদ্ধহস্ত তাঁরাও। রাবারিদের সঙ্গে গভীর একটা সাংস্কৃতিক সংযোগ রয়েছে তাঁদের।
বেসরকারি সংস্থা সহজীবন ভুজে একটা পশুপালন বিষয়ক সংগঠন চালায়। তাদের মতে রাবারি, সামা এবং জাটেদের মত মেষপালনে ওস্তাদ সম্প্রদায়গুলি মিলিয়ে মোট ৫০০ জন উটপালক আছেন।
"আমরা যাচাই করে দেখেছি যে সত্যি সত্যিই কচ্ছের উট উচ্ছেরক মালধারি (উট লালন-পালনকারী) সংগঠনের ১১ জন পালক-সদস্যের থেকেই এই ৫৮টা জোয়ান উট কিনে আনা হয়েছিল – এবং এই পাঁচজনের যে আত্মীয়রা মধ্য ভারতে বসবাস করেন, উটগুলো তাঁদের জন্যেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল," ভুজ থেকে পারিকে ফোন করে জানিয়েছিলেন সহজীবনের কার্য পরিচালক রমেশ ভাট্টি।
সেই পাঁচজন আবার ওস্তাদ উট-প্রশিক্ষকও বটে, ভাট্টি বলেছিলেন যে বিপদসংকুল সেই অনন্ত যাত্রাপথে ঠিক এই কারণেই উটের ভার এসে পড়েছিল তাঁদের উপর। কচ্ছ-নিবাসী ওস্তাদ প্রশিক্ষক ও উট-চরানিদের মধ্যে ভেরসিভাইয়ের মতন অমন সুগভীর অভিজ্ঞতা মনে তো হয় না আর কারও আছে বলে।
*****
"
আমরা
যাযাবর সমাজের মানুষ
;
বেশিরভাগ
সময়ই কোনও কাগজপত্তর থাকে না আমাদের কাছে..."
মাশ্রুভাই
রাবারি, ওয়ার্ধা
অঞ্চলের রাবারি সম্প্রদায়ের নেতা
ঠিক কবে যে তাঁরা কচ্ছ থেকে রওনা দিয়েছিলেন, সেটা তাঁরা বলতে পারলেন না।
"উট পালন করে এমন লোকের থেকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে প্রাণীগুলো জোগাড় করেছিলাম নবম মাসে [সেপ্টেম্বর ২০২১], তারপর দিওয়ালির ঠিক পরেই [নভেম্বরের গোড়ার দিকে] ভাচাউ [কচ্ছের একটি তেহসিল] থেকে পায়ে হেঁটে রওনা দিই," জানালেন শত হেনস্থায় আলুথালু প্রভু রাণা রাবারি। "এবছর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে শেষাশেষি নাগাদ আমাদের গন্তব্য, ছত্তিশগড়ের বিলাসপুরে পৌঁছনোর কথা ছিল।"
কচ্ছে তাঁদের গাঁ থেকে প্রায় ১,২০০ কিমি রাস্তা পাড়ি দেওয়ার পর গ্রেফতার হন ওই পাঁচজন। ভাচাউ থেকে আহমেদাবাদ হয়ে নন্দুরবার, ভুসাওয়াল, আকোলা, করঞ্জা পেরিয়ে তালেগাঁও দশহরে এসে উঠেছিলেন – শেষোক্ত সবকটি জায়গাই মহারাষ্ট্রে। কথা ছিল এরপর ওয়ার্ধা, নাগপুর, ভান্ডারা (এগুলিও মহারাষ্ট্রে) পেরিয়ে দুর্গ ও রায়পুর হয়ে বিলাসপুরে (তিনটে জায়গাই ছত্তিশগড়ে পড়ছে) গিয়ে উঠবেন। ওয়াশিম জেলার করঞ্জা শহর ছুঁয়ে নবনির্মিত সমৃদ্ধি সড়কের উপর দিয়েও কিছুটা পথ হেঁটেছিলেন তাঁরা।
"দিন গেলে কমবয়সী একটা উট হেসেখেলে ২০ কিমি হাঁটতে পারলেও আমরা দিনে ১২-১৫ কিমি পাড়ি দিতাম," বুঝিয়ে বলছিলেন মুসাভাই হামিদ জাট, পাঁচজনের মধ্যে তাঁর বয়সটাই বোধহয় সবচেয়ে কম। "রাত হলে বিশ্রাম নিতাম, তারপর সক্কাল সক্কাল কাজে লেগে পড়তাম সবাই।" রান্নাবান্না নিজেরাই করতেন, দুপুরের ভাতঘুমের সঙ্গে সঙ্গে উটগুলোও খানিক জিরিয়ে নিত, তারপর আবার শুরু হত হাঁটা।
উট চরানোর মতো সাদামাটা কাজ করতে গিয়েও যে কেউ গ্রেফতার হতে পারে, এটা তাঁরা ঠিক হজম করে উঠতে পারছেন না।
"মরে গেলেও মাদি উট বেচি না আমরা, এঁড়ে উটগুলো কাজে লাগে মালপত্তর বইতে," ওয়ার্ধা জেলার রাবারি সম্প্রদায়ের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা মাশ্রুভাই রাবারি বোঝাচ্ছিলেন আমাদের, "উটগুলোই তো আমাদের পা।" 'আটক' হওয়া ৫৮টি উটের প্রত্যেকটিই পুরুষ।
সবাই তাঁকে আদর করে 'মাশ্রু মামা' বলে ডাকে। যেদিন ওই পাঁচজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ, সেদিন থেকে তাঁদের সঙ্গ ছাড়েননি তিনি। বাড়ির লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা থেকে, অমরাবতী অঞ্চলে উকিলের ব্যবস্থা, 'অভিযুক্তদের' বয়ান অনুবাদ ও রেকর্ড করতে পুলিশদের সাহায্য করা, সবকিছুই একা হাতে সামলাচ্ছেন তিনি। মারাঠি ও কচ্ছি দুটো ভাষাতেই সাবলীল এই মানুষটা এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাবারি বসতিগুলির মধ্যে যোগসূত্র।
"বিদর্ভ, তেলেঙ্গানা আর ছত্তিশগড়ের বিভিন্ন ডেরায় আমাদের বেরাদরির ১৫-১৬ জনের কাছে এই উটগুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্যই নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল," বলছিলেন মাশ্রুভাই, "একেকজনের ভাগে ৩-৪টে করে উট পড়ার কথা।" যাত্রাকালে উটের পিঠে পুরো সংসারটাই বেঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন রাবারিরা – বাচ্চাকাচ্চা থেকে ভেড়ার ছানা, সবকিছুই। মহারাষ্ট্রে ধাঙড় নামে একটি পশুপালক সম্প্রদায় রয়েছে, বলদ-টানা গাড়ি ব্যবহার করে থাকেন এই মানুষেরা, কিন্তু রাবারিদের মধ্যে সে চল নেই।
মাশ্রুভাইয়ের কথায়: "নিজেদের দেশে আমাদেরই বেরাদরির কয়েকজন উটগুলোকে বড়ো করে, ওদের থেকেই কিনে আনি। পশুগুলো বুড়ো হয়ে গেলে ১০-১৫ জন মিলে যখন ঠিক করে যে জোয়ান উট কিনতে হবে, তখন কচ্ছে থাকা আত্মীয়দের কাছে খবর পাঠিয়ে দিই। একসাথে অনেকগুলো উট পাঠিয়ে দেয় ওরা, সঙ্গে থাকে ওস্তাদ কিছু লোক। উটগুলো নিয়ে আসার জন্য সেই ওস্তাদদের হাতে মজুরি বাবদ খানিকটা করে টাকা দিতে হয় - লম্বা পথ চলতে হলে খরচা বাবদ মাসে ৬-৭ হাজার টাকা লাগে।" একেকটা জোয়ান উটের দাম ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা, জানালেন মাশ্রুভাই। ৩ বছর বয়স হলেই কাজে জুটে যায় তারা, আয়ু ওই মেরেকেটে বছর ২০-২২। "একটা ছেলে উট মোটামুটি ১৫ বছর খাটতে পারে," বললেন তিনি।
"সত্যি সত্যিই তাদের কাছে কোনও কাগজপত্তর ছিল না," স্বীকার করলেন মাশ্রুভাই, "এর আগে তো কখনও দরকার পড়েনি এসবের। তবে হ্যাঁ, যা বুঝছি এবার থেকে সাবধান হতে হবে। দিনকাল বদলে যাচ্ছে কেমন যেন।"
উটসহ ওই পাঁচজনকে অকারণে একগাদা ঝক্কি সইতে হল বেআক্কেলে সেই নালিশটির কারণে, গজগজ করতে করতে মারাঠিতে বলে উঠলেন মাশ্রুভাই: "আমি ঘুমান্তু সমাজ আহে , আমচ্যা বারিয়াচ লোকাই কাড় কঢ়ি কঢ়ি কাগড় পত্র নাস্তে।" অর্থাৎ “আমরা হলাম গিয়ে যাযাবর সম্প্রদায়, বেশিরভাগ সময়ই কোনও কাগজপত্তর থাকে না আমাদের সঙ্গে [ঠিক যেমনটা হয়েছিল এক্ষেত্রে।]”
*****
"
অভিযোগ
করা হয়েছে আমরা নাকি পশুগুলোর উপর অত্যাচার করেছি। কিন্তু খোলামেলা জায়গায় না
ছেড়ে এভাবে ওদের আটকে রাখার চেয়ে নিষ্ঠুর অত্যাচার আর কিছু হয় না।"
পর্বত
রাবারি, নাগপুরের
রাবারি গোষ্ঠীর এক প্রবীণ উট-পালক
আটক হওয়া প্রত্যেকটি উটই জোয়ান পুরুষ, ২ থেকে ৫ বছরের মধ্যে বয়স তাদের। এই জাতীয় কচ্ছি প্রজাতির উট সাধারণত কচ্ছের স্থলজ বাস্তুতন্ত্রেই পাওয়া যায়। কচ্ছে এরকম উট আনুমানিক ৮,০০০টির বেশি অবশিষ্ট নেই বর্তমানে।
এই প্রজাতির পুরুষ উটের ওজন গড়ে ৪০০-৬০০ কিলো ও স্ত্রী উটের ওজন ৩০০ থেকে ৫৪০ কিলোর মধ্যে হয়। ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস অনুযায়ী সরু বুক, একটিমাত্র কুঁজ, বাঁকা লম্বা ঘাড় এবং কুঁজ, কাঁধ ও গলায় লম্বা লম্বা লোম এই প্রজাতির বৈশিষ্ট্য। চামড়ার রঙ বাদামী, কালো, এমনকি সাদাটেও হয়।
বাদামী রঙের এই উটগুলি খোলা জায়গায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা ও পাতা খেতে ভালোবাসে। সে জঙ্গল হোক, কিংবা মাঠ, অথবা আবাদ শেষে খেতে, হরেক জায়গা থেকে ডালপাতা খুঁটে খেতে ওস্তাদ এরা।
উট-পালনের কাজ দিনকে দিন কঠিন হয়ে উঠেছে রাজস্থান ও গুজরাতে। এই দুটি রাজ্যে আর আগের মতো অবাধে জলা-জঙ্গল বা বাদাবনে ঢোকা যায় না, একাধিক বিধিনিষেধ আছে এই গতিবিধিতে। তাছাড়া এই অঞ্চলগুলিতে উন্নয়নের দাপটেও উট ও উট-পালকের দল আজ প্রতিকূলতার সম্মুখীন। এককালে যেখানে ভরপুর বিনেপয়সার চারা-পানি পাওয়া যেত, আজ সেখানে খাবার খুঁজতে কাহিল হয়ে পড়ে উটের দল।
অমরাবতীর গোরক্ষা কেন্দ্রের কাঁটাতারে ঘেরা একটা খোলা মাঠে আটক সেই উটের দলের কাছেই যে শিবিরে তাঁদের বেরাদরির লোকজন জড়ো হয়েছেন, সেখানেই জামিন পেতে না পেতেই ওই পাঁচজন এসে উঠেছেন। প্রাণীগুলির শরীরস্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই রাবারিদের, দরকার মতো যে আর খাবার জুটছে না তাদের।
কচ্ছ (বা রাজস্থান) ছাড়া অন্য কোনও জায়গায় মানিয়ে নেওয়া যে উটেদের পক্ষে অসম্ভব, এক কথায় এটা উড়িয়েই দিলেন রাবারিরা। "যুগের পর যুগ ধরে এরা আমাদের সঙ্গে গোটা দেশ জুড়ে ঘুরেছে," জানালেন আসাভাই জেসা, অভিজ্ঞ এই রাবারি উট-পালক থাকেন ভান্ডারা জেলার পৌনি ব্লকের আসগাঁওয়ে।
পর্বত রাবারির কথায়: "ব্যাপারটা নিতান্তই হাস্যকর।" আপাতত নাগপুরের উম্রেদ শহরের কাছেই একটা গ্রামে ডেরা বেঁধেছেন অভিজ্ঞ এই পরিযায়ী পশুপালক। "অভিযোগ করা হয়েছে আমরা নাকি পশুগুলোর উপর অত্যাচার করেছি। কিন্তু খোলামেলা জায়গায় না ছেড়ে এভাবে ওদের আটকে রাখার চেয়ে নিষ্ঠুর অত্যাচার আর কিছু হয় না।"
"গরুছাগল যা খায়, সেসব কি আর উটের মুখে রোচে?" বলে উঠলেন জাকারা রাবারি। নাগপুর জেলার উম্রেদ তালুকে স্থিত সির্সি গ্রামে থাকেন তিনি, এই ৫৮টি উটের মধ্যে থেকে খান তিনেক পাওয়ার কথা ছিল তাঁর।
নিম, বাবলা, অশ্বত্থ ছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের গাছের ডালপাতা খুঁটে খেতে ভালোবাসে কচ্ছি উটের দল। কচ্ছ জেলার অপেক্ষাকৃত রুখাশুখা পাহাড়ি অঞ্চলে চরে চরে ঘাস-পাতা খায় বলেই এদের দুধে এমন চমৎকার পৌষ্টিক মূল্য। একটি কচ্ছি বকনা উট গড় হিসেবে প্রতিদিন ৩-৪ লিটার দুধ দেয়। কচ্ছি মেষপালকেরা একদিন অন্তর জল খাওয়াতে নিয়ে আসেন তাঁদের উটগুলিকে। তেষ্টা পেলে সাধারণত ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে ৭০-৮০ লিটার জল সাবাড় করে দিতে পারে এই প্রাণীগুলি। তবে তেমন পরিস্থিতিতে একফোঁটা জল ছাড়াই তারা কাটিয়ে দিতে পারে দিনের পর দিন।
এই যে ৫৮টি উট গোরক্ষা কেন্দ্রে আটকে রয়েছে, এরা কিন্তু এমনভাবে ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে চারা-পানি খেতে অভ্যস্ত নয় মোটেও। হ্যাঁ, চিনা-বাদামের যে খোসা-টোসা এখানে দেওয়া হচ্ছে, সেসব খাওয়ার অভ্যেস বুড়ো উটদের থাকলেও জোয়ান প্রাণীদের তা নেই, জানালেন পর্বত রাবারি। অমরাবতী আসতে আসতে তারা হয় রাস্তার দুধারের গাছপালা কিংবা খেত-খামার থেকে ডালপালা খেয়েছে।
পর্বত রাবারি এই কথাও জানালেন যে একটা জোয়ান এঁড়ে উট দিন গেলে ৩০ কিলো অবধি চারা সাবড়ে দিতে পারে অনায়াসে।
এখানকার গোরক্ষা কেন্দ্রগুলিতে সবুজ ঘাস ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ছাঁট ফসল খেতে দেওয়া হয় গরুছাগলদের – যেমন সোয়াবিন, গম, জোয়ার, ভুট্টা, ছোট-বড়ো বিভিন্ন শ্যামাধানের (মিলেট) দানা ইত্যাদি। পাকড়াও করা উটগুলোর কপালে এসবই জুটছে আপাতত।
পর্বত ও জাকারার মতো আরও ডজনখানেক রাবারি জনজাতির মানুষেরা রয়েছেন যাঁরা বিগত বহু দশক ধরে মহারাষ্ট্র ও ছত্তিশগড়ে বসবাস করছেন, তাঁদের বেরাদরির কয়েকজনকে যে উট-সমেত এমন করে পাকড়াও করা হয়েছে, এটা শুনে অমরাবতীতে ছুটে এসেছেন। আপাতত উটগুলোকে চোখে চোখে রাখতেই ব্যস্ত তাঁরা।
"সবকটা উট মোটেও বেঁধে রাখা ছিল না; তবে কয়েকটাকে না বেঁধে উপায় ছিল না মোটেই, নয়তো একে অপরকে কামড়া কামড়ি করে তো মরতোই, উপরন্তু পথচলতি মানুষদের উত্যক্ত করে মারত," জানালেন জাকারা রাবারি। যতক্ষণ না তাদের মালিকানার ব্যাপারে কোনও ফয়সালা নিচ্ছে আদালত, ততদিন অবধি সেই গোরক্ষা কেন্দ্রে ঘাঁটি গেঁড়েছেন তিনি। তাঁর কথায়: "জোয়ান উটগুলো বড্ডো একরোখা হয়।"
রাবারিরা বারবার আর্জি জানাচ্ছেন উটগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হোক যাতে তারা বাইরে চরে খেতে পারে। পুলিশ এসে আটক করার পর এমন ঘেরাটোপের মধ্যে থাকতে থাকতে উট মারা গেছে, এমন ঘটনা বেশ কয়েকবার হয়েছে এর আগে।
উটগুলোকে যাতে যথা শীঘ্র রাবারিদের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়, এ ব্যাপারে নিম্ন আদালতে আপিল জানিয়েছেন তাঁদের স্থানীয় উকিল মনোজ কাল্লা। কচ্ছ থেকে আগত রাবারিদের আত্মীয়রা, এ এলাকায় বসবাস করা রাবারিরা, এমনকি বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা খদ্দেরদের দল – সবাই মিলে একজোট হয়ে পুঁজি ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন যাতে মামলার খরচা, উকিলের পারিশ্রমিক, নিজেদের থাকাখাওয়ার খরচের পাশাপাশি অসহায় প্রাণীগুলোর জন্য ঠিকঠাক চারা-পানির ব্যবস্থা করা যায়।
ওদিকে সেই ৫৮টির উটের দায়-দায়িত্ব সবই আপাতত সেই গোরক্ষা কেন্দ্রের ঘাড়ে এসে পড়েছে।
এই কেন্দ্রটি যারা চালায়, সেই গৌরক্ষণ সমিতির সহকারী দীপক মন্ত্রী জানালেন যে, "প্রথম প্রথম ওদের খাওয়াতে বেশ অসুবিধা হত, কিন্তু এখন বুঝে গেছি যে ঠিক কোন খাবার কতটা করে খাওয়াতে হবে ওদের – এ ব্যাপারে রাবারিরা বিশাল সাহায্য করেছেন। কাছেই ৩০০ একরের খামার আছে আমাদের, সেখান থেকে সবুজ আর শুকনো, দুই ধরনেরই চারা আসছে উটগুলোর জন্য। ওদের জন্য কোনও কিছুরই কমতি নেই এখানে।" যে কটি উটের গায়ে কাটাছেঁড়া ছিল, তাদের চিকিৎসার জন্য নিজস্ব পশুচিকিৎসকও আছে তাঁদের। "ওদের দেখভালে কোনও ত্রুটি রাখিনি আমরা, কোত্থাও কোনও অসুবিধা নেই আর," তাঁর দাবি।
পর্বত রাবারি আশা রাখেন যে খুব শীঘ্রই আদালতের আদেশে প্রাণীগুলোর বন্দিত্ব ঘুচবে, অবিলম্বে তারা ফিরে যেতে পারবে মালিকের কাছে, "উটগুলো একদম খাচ্ছে না ঠিকঠাক, এটা তো ওদের জন্য জেলখানারই সামিল।"
জামিন পাওয়ার পর থেকে ভেরসিভাই তথা অন্য চারজন বাড়ি ফেরার জন্য মুখিয়ে থাকলেও উটগুলোকে ছাড়া তাঁরা ফিরে যেতে নারাজ। "শুক্রবার, ২১শে জানুয়ারি, ধামানগাঁওয়ের (নিম্ন আদালত) হাকিম সাহেব (জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট) হুকুম জারি করেছেন, ওই পাঁচজন মেষপালক যেন ৫৮টি উটের মালিকানার নথিপত্র দায়ের করেন অবিলম্বে," রাবারিদের উকিল মনোজ কাল্লা জানিয়েছিলেন পারিকে। "উটগুলো যাঁদের জন্য তাঁরা নিয়ে আসছিলেন, তাঁদের থেকে পাওয়া কোনও রশিদ হলেও চলবে।"
ওদিকে সেই উটের হবু খদ্দের এবং নিজেদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে অবলা প্রাণীগুলির ছাড়া পাওয়ার আশায় গোরক্ষা কেন্দ্রেই হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন রাবারিরা। ধামানগাঁওয়ের আদালতের পানে অশেষ ভরসায় তাঁরা চেয়ে আছেন।
এদিকে সেই বেকুব উটের দল 'গ্রেফতার' না হয়েও বন্দি হয়ে পড়ে আছে গোরক্ষার খাঁচায়।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)