উড়িষ্যার গঞ্জাম জেলার প্রমোদ বিসোয়ীর বয়স ৪৫ বছর। সুরাটের একটি তাঁত ইউনিটের সর্দার (মাস্টার) তিনি। “গত এক বছরে আমি ২৭টা শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেছি। শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যদের অনেক ক্ষেত্রেই শ্রাদ্ধে যোগ দেওয়ার [গুজরাটে এসে] টাকা থাকে না।”
অবশ্য বিকাশ গৌড়ার মৃত্যুর সময় তাঁর বাবা এবং ভাই ওর পাশেই ছিলেন। ষোল বছরের বিকাশের তাঁতের হাড়ভাঙা কাজে যোগ দেওয়ার ২৪ ঘন্টাও হয়নি। গঞ্জামের লান্ডাজুয়ালি গ্রাম থেকে ১৬০০ কিমি পথ অতিক্রম করে সুরাটের বেদ রোডের তাঁত কারখানাতে যোগ দিয়েছিল এই কিশোর। এই বছর, এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখ, সে একটি মেশিন চালু করার সঙ্গে সঙ্গে হাই ভোলটেজ বিদ্যুৎ তার শরীরে প্রবেশ করে। তৎক্ষণাৎ তার মৃত্যু হয়। তার বাবা আর ভাই কাছাকাছিই অন্য তাঁতে কাজ করছিলেন।
“সবাই জানত যে মেশিনে গণ্ডগোল ছিল। আমরা সবাই আগে ছোটখাটো ঝটকা খেয়েছি...কিন্তু আমরা ভাবিনি যে আমার ছেলে মারা যেতে পারে,” বলছেন বিকাশের বাবা চরণ গৌড়া, যিনি প্রায় তিন দশক ধরে সুরাটে কাজ করছেন। “আমাদের বাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ। আমি ভেবেছিলাম, সব থেকে ছোটো ছেলেটাকেও এনে কাজে ঢোকালে বাড়ির জন্য কিছু টাকা বাঁচাতে পারব।”
এই ঘটনার দুই সপ্তাহ পরে, মে মাসের দশ তারিখে, গুজরাট শিল্প উন্নয়ন নিগমের অন্তর্গত শচীন অঞ্চলে (সুরাট মহানগর এলাকায়) একটি তাঁত কারখানায় রাজেশ অগরওয়াল নামে জনৈক শ্রমিক একটি মেশিনে আটকে যান। মহারাষ্ট্র থেকে আগত এই তরুণ শ্রমিক ঘটনাস্থলেই মারা যায়। “মেশিনটা পুরনো ছিল। বিদ্যুৎ না গেলে মেশিনটা থামত না,” ঘটনার পরে সহকর্মীদের মধ্যে যারা বাইরে জড়ো হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন জানালো। “ও হয়তো সুতোটা ঠিক করবে বলে ভেতরে হাত ঢুকিয়েছিল, আর মেশিনটা টেনে নিয়েছে।” এই ঘটনার পর থেকে কারখানাটি বন্ধ রয়েছে।
বিদ্যৎস্পৃষ্ট হওয়া, পুড়ে যাওয়া, শ্বাসরোধ হওয়া, পতন, আঙুল বাদ যাওয়া, হাড়গোড় ও শরীরের অংশ বিশেষ থেঁতলে যাওয়া এবং মৃত্যু – শ্রমিক এবং মালিক – দু’জনেরই মতে – সুরাটের বিদ্যুৎচালিত তাঁত শিল্পে এসব “প্রায় রোজই ঘটে” কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নথিবদ্ধ হয় না এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না।
পলিয়েস্টার সুতোয় ঝুলে থাকা প্রাণ
উত্তর সুরাটের মিনা নগর অঞ্চলে প্রায় ১০০০ বর্গফুট জুড়ে যে তাঁত ইউনিটটি রয়েছে সেখানে ১০০টিরও বেশি তাঁত মেশিন পাশাপাশি চলে। কোনও রাস্তা নেই। প্রতি দফায় [শিফটে] যে ৮০ থেকে ১০০ জন শ্রমিক কাজ করেন তাঁরা সকাল ৭টা থেকে সন্ধে ৭টা অথবা সন্ধে ৭টা থেকে সকাল ৭টার ১২ ঘন্টার শিফটে কাজ করতে করতে একটু হাতপা ছড়ানোর জায়গাও পান না। একাধিক সিসিটিভি সর্বক্ষণ তাঁদের ওপর নজরদারি করে। সবথেকে নিকটবর্তী সাধারণ শৌচালয়টিতে কয়েকটি পাড়া পেরিয়ে পৌঁছোতে হয়। মে মাসে বাইরে তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু পানীয় জলের কোনও ব্যবস্থা নেই। কাছাকাছি চায়ের দোকান থেকে শ্রমিকরা জল নিয়ে আসেন। কোনও জানালা নেই।
শ্রমিকরা অবিরাম অত্যন্ত দ্রুত বেগে হাত আর পা চালাতে থাকেন যাতে সুতোটা তাড়াতাড়ি বোনা হয়। তাঁত ইউনিটের সর্দার বিসোয়ী বলছেন, “প্রত্যেক মিনিটের দাম আছে এখানে... আসলে প্রত্যেক সেকেন্ডেরও।” শ্রমিকরা প্রতি মিটার পিছু ১ টাকা ১০ পয়সা থেকে ১ টাকা ৫০ পয়সা পান। তাই, বিসোয়ীর সংযোজন, ওরা “সময় নষ্ট করতে বা জিরিয়ে নিতে পারে না।” যেদিন “বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে”, সেই দিন খালি ছুটি। মাসে প্রায় ৩৬০ ঘন্টা কাজ করার পর একজন শ্রমিক উপার্জন করেন ৭,০০০ থেকে ১২,০০০ টাকা। এর মধ্যে অন্তত ৩৫০০ টাকা ঘর ভাড়া আর খাওয়া বাবদ খরচ হয়।
বদোদরায় কেন্দ্রিক বেসরকারি সংস্থা পিপ্লস ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার (পিটিআরসি) থেকে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত সুরাট টেক্সটাইল শিল্পে শ্রমিকদের অবস্থা নামক রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মাসে ৩৬০ ঘন্টা কাজ করে সুরাটের তাঁত শ্রমিকরা ভারতে ব্যবহৃত পলিয়েস্টারের প্রায় ৯০% উৎপাদন করেন। প্রতিদিন প্রায় ৩০ মিলিয়ন মিটার কাঁচা (র) কাপড় এবং ২৫ মিলিয়ন মিটার প্রক্রিয়াজাত (প্রসেস্ড) কাপড় উৎপাদন হয়।
সুরাট আর তার আশেপাশের অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই তাঁত কারখানাগুলো। পান্ডসেরা, উধ্না, লিম্বায়াত, ভেস্তান, শচীন, কাটারগ্রাম, বেদ রোড, অঞ্জনি – এইসব অঞ্চলে রয়েছে ছোটো ছোটো কারখানা। গুজরাট, রাজস্থান আর মহারাষ্ট্রের অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কর্মরত সংগঠন অজীবিকা ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, শহরে প্রায় পনেরো লক্ষ তাঁত মেশিন রয়েছে।
ছোটো, বড়ো, মারাত্মক – শ্রমিকদের সব ধরনেরই আঘাতের সাক্ষী এই তাঁতগুলো। বেশিরভাগ শ্রমিক উড়িষ্যার গঞ্জাম জেলার মানুষ। পিটিআরসি-র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সুরাটের শুধুমাত্রে নথিভুক্ত বস্ত্র প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলিতেই ৮৪টি মারাত্মক ঘটনায় মোট ১১৪ জন মারা গেছেন। এই একই সময়কালে, ৩৭৫ জন শ্রমিক গুরুতর আহত হয়েছেন। গুজরাটের শিল্প নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তথ্যের অধিকার আইনে দায়ের করা আবেদনপত্রের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। শহরে অসংখ্য বৈদ্যুতিক তাঁত কর্মশালা আছে যেগুলো নিবদ্ধিত নয়। ফলে মৃত্যু এবং দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান যা পাওয়া যাচ্ছে তা প্রকৃত ঘটনার তুলনায় কম।
এই বিষয়ে কোনও সুস্পষ্ট সরকারি তথ্য নেই।
পিটিআরসি-র অধিকর্তা জগদীশ প্যাটেল জানাচ্ছেন যে বেশিরভাগ তাঁত ইউনিট দোকান এবং প্রতিষ্ঠান আইনের আওতায় পড়ে, কারখানা আইনের আওতায় নয়। দ্বিতীয় আইন অনুসারে অন্তত কোনও শ্রমিক দুর্ঘটনাগ্রস্ত হলে বা মৃত্যু হলে শ্রমিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
শ্রমিকদের কোনও চুক্তি নেই, চাকরিতে বহাল করা হয় মুখের কথায়। “যখন কোনও পরব বা বিয়ের মরশুমে তারা বাড়ি যায়, জানে না যে ফিরে এসে চাকরিটা থাকবে কি না। সহজেই ওদের জায়গায় অন্য লোক নেওয়া যায়,” জানাচ্ছেন প্রহ্লাদ সোয়াইন। প্রহ্লাদ সোয়াইন প্রবাসী শ্রমিক সুরক্ষা মঞ্চের (পিএসএসএম) সদস্য। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি সুরাট ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের তাঁত এবং কাপড়কল শ্রমিকের নিয়ে গঠিত। ৩৬ বছর বয়সী সীমাঞ্চলা সাহু গঞ্জামের বড়াখান্ডি গ্রাম থেকে আগত শ্রমিক। তাঁর সংযোজন, “ফিরে এসে যে দেখব চাকরি আছে – এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। যে কয়দিন শ্রমিকরা কাজে আসে না, সেইদিনগুলোর মজুরিও পাওয়া যায় না।”
বোঝাপড়া করার কোনও ক্ষমতা না থাকার ফলে অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্ঘটনা বা মৃত্যুর মামলা খুব ধীর গতিতে এগোয় বলে জানাচ্ছেন জে কে গামিত, সুরাট পৌর সংস্থার স্বাস্থ্যবিধান ব্যবস্থার সহকারী পরিদর্শক। “শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা অনেক দূরে, আর বন্ধুরা তো আসলে সহকর্মী। তারা এতই ব্যস্ত থাকে যে বারবার থানায় আসতে পারে না বা মামলা কতদূর এগোল সেই বিষয়েও খবর নেওয়ার সময় থাকে না তাদের,” বলছেন গামিত। “আঘাত বা মৃত্যুর যথাযথ সংখ্যার কোনও নথিপত্র নেই। এই ধরনের মামলাগুলিও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ধামাচাপা পড়ে যায়।
সাধারণত, তাঁত ইউনিটে মৃত্যু ঘটলে, পুলিশে মামলা রুজু হয়। কিন্তু এটা নিছক আইন এবং স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত নিয়মরক্ষার জন্য করা। গ্রেপ্তারের ঘটনা খুবই বিরল। ক্ষতিপূরণ দাবি করতে গেলে শ্রম দপ্তরের কাছে মৃতের পরিবারকে আর্জি জানাতে হয়। যদি আঘাতের জন্য ক্ষতিপূরণ হয়, তাহলে অনেক সময় শ্রমিকের চাকরি চলে যাওয়ার ভয় থাকে, কারণ ক্ষতিপূরণ দাবি করলে মালিক রেগে যেতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আদালতের বাইরে সমঝোতা করে নেওয়া হয়।
বিকাশ গৌড়া মারা যাওয়ার চার দিন পর, ২৯শে এপ্রিল, তাঁত মালিক তার পরিবারকে ২ লক্ষ ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিয়ে সোজাসুজি জানিয়ে দেন যে আর কোনও ক্ষতিপূরণ দাবি করা যাবে না। সাধারণত, মালিকরা ৫০,০০০ টাকা দেন, তাও যাতে মামলাটা বন্ধ করা যায় – আর এই প্রক্রিয়াও খুব দীর্ঘ। এই ক্ষেত্রে, পিএসএসএম এবং আজীবিকা ব্যুরো হস্তক্ষেপ করার ফলে ক্ষতিপূরণের পরিমাণও বেড়ে যায় এবং খুব তাড়তাড়ি সেটা দিয়েও দেওয়া হয়।
তিনখানা চাকরির প্রশ্ন, অগত্যা, পরিবারও মেনে নিতে বাধ্য হল।
গঞ্জম থেকে গুজরাট
সুরাট ওড়িয়া কল্যাণ সমিতির সদস্য রাজেশ কুমার পাধির মতে সুরাটে গঞ্জাম থেকে আগত শ্রমিকের সংখ্যা অন্তত ৮০০,০০০। এর মধ্যে ৭০% শহরের বৈদ্যুতিক তাঁত শিল্প ক্ষেত্রে কর্মরত। তিনি আরও জানাচ্ছেন, “উড়িষ্যা থেকে সুরাটে অভিবাসনের এই পথ খুলে গেছিল ৪০ বছর আগে।” পিআরটিসি-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, “যদিও উড়িষ্যায় গঞ্জাম একটি উন্নত জেলা হিসেবেই পরিচিত, কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ ও চাষের জমি কমে আসা এবং নিয়মিত বন্যা এবং খরার কারণে অনেকে কাজের সন্ধানে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে।”
গঞ্জাম থেকে আগত শ্রমিকরা কিন্তু কেউই সুরাটের অন্য আরেকটি বড়ো শিল্প – হীরে- তার সঙ্গে যুক্ত নন, বললেন জগদীশ প্যাটেল। “এই কাজগুলো সাধারণত স্থানীয় গুজরাটি শ্রমিকদের জন্যই সংরক্ষিত থাকে কারণ মালিকরা ‘তাঁদের বিশ্বাসভাজনদের’ই নিয়োগ করেন। গঞ্জামের শ্রমিকরা তাঁত শিল্পের তলার দিকে কাজ করেন – বছরের পর বছর ধরে একইভাবে একই মেশিন চালিয়ে যাওয়ার একঘেয়ে কাজ।”
তাও, বলছেন শ্রমিকরা, গঞ্জামে গ্রামের অবস্থার থেকে এই অবস্থা ভালো। সীমাঞ্চলা সাহু, যিনি নিজে পিএসএসএম-এর সদস্য, জানাচ্ছেন যে, “গঞ্জামে পরিস্থিতি খুবই কঠিন। প্রথম দিকে হয়তো কয়েকজন শ্রমিক এসেছিল, কিন্তু এখন বড়ো বড়ো দল বেঁধে আসে, অনেকে পরিবারের সদস্য আর পড়শিদের সঙ্গে নিয়ে আসে।”
অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে বেশিরভাগই পুরুষ। গঞ্জাম থেকে খুব কম সংখ্যক মহিলাই সুরাটে এসেছেন। যারা এসেছেন, তাঁরা সেলাই বা কাপড়-কাটার কাজ করেন – হয় কারখানাতে গিয়ে অথবা বাড়িতে বসে। প্রতি টুকরো পিছু পিস-রেট পদ্ধতিতে মজুরি পাওয়া যায়। অনেকে এসেছেন স্বামীরা এখানে মোটামুটি একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত করতে পারার পর। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকরা পরিবারকে ছেড়ে থাকেন। বছরে বা দুবছরে একবার, কয়েক সপ্তাহের জন্য বাড়িত ফেরেন। (এই বিষয়টি পরের লেখাতে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে)।
শ্রমিকদের মধ্যে একটি বড় অংশ দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত কেওয়াত জাতের মানুষ। গ্রামে মৎসজীবী বা মাঝির কাজ করতেন। সাহু পদবি যাঁদের তাঁদের কেউ কেউ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত। বেশিরভাগেরই নিজস্ব কোনও জমি নেই। “আয়ের প্রধান উৎস কৃষি। সেটা তো আবহাওয়া আর বন্যার পরিস্থিতির ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। আর কোনও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সুবিধে নেই,” জানাচ্ছেন সোয়াইন। “এর ফলে বহু মানুষ সুরাটে চলে এসেছেন। অন্তত টাকা রোজগার করে বাড়িতে তো পাঠাতে পারে, যদিও তাদের স্বাস্থ্য এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
এই অসহায়তার সুযোগেই কারখানাগুলিতে ভয়ঙ্কর শোষণ স্বাভাবিক নিয়মে দাঁড়িয়েছে। ৩৮ বছর বয়সী তাঁত শ্রমিক হৃষীকেশ রাউত গঞ্জামের ব্রহ্মপুরের মানুষ। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি বিদ্যুতের পোলের সঙ্গে দুর্ঘটনায় তাঁর তিনটি আঙুল কাটা পড়ে। তিনি বলছেন, “একজন শ্রমিক যদি দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয় বা সে মারা যায়, তার জায়গা নেওয়ার জন্য অনেক অনেক অল্পবয়সী, বিপন্ন শ্রমিক রোজ শহরে আসছে। মালিকরা খুব ভাল করে জানে যে কোনও দুর্ঘটনা বা আঘাতই বাড়ির পরিস্থিতির থেকে ভয়ানক হতে পারে না।” রাউত এখন সুরাটে নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করেন। ক্ষতিপূরণের আশা তিনি প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন, কারণ তাঁর ক্ষেত্রে দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল সুরাটের পান্ডেসারা শিল্পাঞ্চলে তাঁর এক-কামরার ঘরে।
দৈনিক সংগ্রাম, চিরস্থায়ী পরিণাম
হাড়ভাঙা খাটুনি আর যৎসামান্য মজুরির পাশাপাশি, অনেক তাঁত শ্রমিকের মধ্যেই বধিরতার সমস্যা দেখা দিতে শুরু করেছে। কারখানাগুলিতে অবিরাম উচ্চগ্রামে আওয়াজের ফলে অনেক শ্রমিক বধির হয়ে যাচ্ছেন। আজীবিকা ব্যুরোর কেন্দ্রীয় কো-অর্ডিনেটর সঞ্জয় প্যাটেল জানাচ্ছেন, “কারখানার ভেতরে শব্দের মাত্রা থাকে ১১০ ডেসিবেলের বেশি।” এই বছরের জানুয়ারি মাসে এই সংস্থা বিভিন্ন তাঁত কেন্দ্রে নিযুক্ত ৬৫ জন শ্রমিকের অডিওমেট্রি পরীক্ষা করে। ভেলোরের খ্রিস্টিয়ান মেডিকাল কলেজ এবং হাসপাতালের দ্বারা স্বীকৃত এই পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় যে ৯৫ শতাংশ শ্রমিক বিভিন্ন পর্যায়ের বধিরতায় আক্রান্ত। প্যাটেল বলছেন, “যদিও শ্রমিকদের মধ্যে বধিরতার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেহেতু এটা তাদের কায়িক শ্রমকে কোনোভাবে প্রভাবিত করে না, তাই মালিকরা এই সমস্যাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না। কোনোরকম সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা হয় না...আর বলাই বাহুল্য, শ্রমিকরা প্রশ্ন করতেও পারে না।”
ইউনিটের মধ্যে যন্ত্রের ‘পদমর্যাদাক্রম’ শ্রমিকদের অসহায়তাকে বাড়িয়ে দেয়। অঞ্জনি শিল্পাঞ্চলের একটি তাঁত কেন্দ্রের মালিক, যাঁর তাঁতে প্রায় ৮০ জন শ্রমিক কাজ করেন, আমাকে জানালেন যে “গঞ্জামের লোকেদের” চিন, জার্মানি, বা কোরিয়া থেকে আমদানি করা উচ্চমানের যন্ত্র চালাতে দেওয়া হয় না। “এইসব শ্রমিকদের শুধু এই অঞ্চলে বানানো নিম্ন মানের যন্ত্রই চালাতে দেওয়া হয়। এগুলোতে কাজ করা কঠিন আর বেশি আওয়াজ করে।” খট্খট্ আওয়াজ করে বলে এই যন্ত্রগুলির নাম দেওয়া হয়েছে খট্খট্ মেশিন। উচ্চমানের যন্ত্র আর এই যন্ত্রের কাজ একই। কিন্তু এগুলোতে উৎপাদিত কাপড় নিম্ন মানের। সেটা সুরাটের বাজারে বিক্রি হয়। উচ্চমানের যন্ত্রে উৎপাদিত উচ্চমানের কাপড় বাইরে পাঠানো হয়।
নিতিন ভায়ানি অঞ্জনি শিল্পাঞ্চলের বি-৪ সেক্টরের তাঁতকর্মী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। তিনি জানাচ্ছেন, “মালিকরা যন্ত্রে সেন্সর লাগানোর মত নিরাপত্তা ব্যবস্থার পেছনে টাকা খরচ করতে চায় না। এর অনেক দাম, আর এই শিল্পে গত কয়েক বছর মন্দা চলছে।”
অবশ্য ভায়ানি মনে করেন যে দুর্ঘটনা বা আঘাতের ঘটনাগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা নিজেরাই দায়ী। “ওরা মদ খেয়ে থাকে, নিজেদের কাজে মন দেয় না,” জানাচ্ছেন ভায়ানি। “রাত্রিবেলা মালিকরা তাঁত কেন্দ্রে থাকে না, তাই ওদের ওপর নজরদারি করার কেউ থাকে না। তখনই বেশিরভাগ দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়।”
যাঁরা ক্ষত-আঘাত নিয়ে বেঁচে যান – তাঁরা সেই একই যন্ত্রে আবার কাজ করেন – অনেকে প্রায় তিরিশ বছর কাজ করছেন। নতুন কাজ শেখার, দক্ষতা বৃদ্ধির বা পদোন্নতির কোনও সম্ভাবনা থাকে না। ফুলওয়াড়িতে তাঁতকর্মীদের মেস চালান গঞ্জামের পোলাসারা শহর থেকে আগত ৪০ বছরের শম্ভুনাথ সাহু। তিনি বলছেন, “এখানে পদোন্নতির কোনও আশাই নেই। ৬৫ বছর বয়সী শ্রমিকও সেই একই যন্ত্রে একই কাজ করে। আর এইসব শ্রমিকরা খুব চট করে বুড়িয়ে যায়...”
বাংলা অনুবাদ : সর্বজয়া ভট্টাচার্য