"মেয়েটা ঘন্টার পর ঘন্টা কেঁদেই যায় আর বলতে থাকে ওর মাকে যেন আমি এনে দিই," নিজের সাত বছরের কন্যা নব্যার কথা বলতে গিয়ে জানালেন শিশুপাল নিষাদ। "আমি কোথা থেকে ফিরিয়ে আনব ওকে? আমার তো নিজেরই মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আমরা কেউই হপ্তার পর হপ্তা দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি," বলছিলেন উত্তরপ্রদেশের সিংতৌলি গ্রামের ৩৪ বছরের এই শ্রমিক।

শিশুপালের স্ত্রী – ছোট্টো নব্যার মা – মঞ্জু ছিলেন জালৌন জেলার কুথৌণ্ড ব্লকের সিংতৌলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন “শিক্ষা মিত্র”, অর্থাৎ পার্শ্ব-শিক্ষক বা প্যারা টিচার। ইউপিতে পঞ্চায়েত নির্বাচনের বাধ্যতামূলক দায়িত্বভার পালন করতে গিয়ে যে ১,৬২১ জন শিক্ষক কোভিড-১৯ সংক্রমণ জনিত কারণে প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মঞ্জুদেবীর নাম ১,২৮২ নম্বরে রয়েছে। তবে যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন, পাঁচজনের সংসারে মঞ্জু নিষাদ একটা নিষ্প্রাণ সংখ্যামাত্র ছিলেন না, ছিলেন অনেক কিছু।

মঞ্জু ছিলেন তিন সন্তানের মা এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী সদস্য। সারামাসের রোজগার ছিল মোটে ১০,০০০ টাকা। হ্যাঁ, উত্তরপ্রদেশে শিক্ষা মিত্রদের মাইনে এতটাই নগন্য আর তার উপর তাঁদের চাকরি চুক্তিভিত্তিক, ফলত স্থায়ী মেয়াদ বা ওই ধরনের কোনও নিরাপত্তাটুকুও নেই। মঞ্জু এভাবে ১৯টা বছর কাজ করেছিলেন, এবং পুরোদমে শিক্ষকতা করা সত্ত্বেও তাঁর কপালে তকমা জুটেছিল নেহাতই একজন শিক্ষা সহায়কের (অর্থাৎ শিক্ষকের কাজে সাহায্যকারী)।

শিশুপাল নিজে ছিলেন শ্রমিক, বুন্দেলখণ্ড এক্সপ্রেসওয়েতে কাজ করে তাঁর দৈনিক আয় হত ৩০০ টাকা। তবে সেটাও বন্ধ হয়ে যায় যখন “আমি এক্সপ্রেসওয়ের যে দফায় কাজ করছিলাম সেটা দু'মাস আগে শেষ হয়ে যায়। কাছাকাছি আর কোনও নির্মাণের কাজ হচ্ছিল না, তাই এই কয়মাস আমরা সবাই আমার স্ত্রীর রোজগারের উপরেই বেঁচেছিলাম।”

এপ্রিলের ১৫, ১৯, ২৬ আর ২৯ তারিখ জুড়ে উত্তরপ্রদেশে পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে যে অতিকায় কর্মকাণ্ড চলেছিল তার দায়িত্ব ছিল হাজার হাজার শিক্ষকের উপর। প্রথমে তাঁরা প্রত্যেকে একদিন করে প্রশিক্ষণ নিতে যান, তারপর আরও দুদিন তাঁদের যেতে হয় নির্বাচনের কাজে – প্রথমদিন তদারকি এবং তার পরদিন ভোটগ্রহণের জন্য। এরপর দোসরা মে ভোট গণনার কাজে আবার হাজার হাজার শিক্ষককে ফিরে আসতে হয়। এসকল দায়িত্ব ছিল বাধ্যতামূলক এবং শিক্ষকদের ইউনিয়নগুলি নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার জন্য বারংবার আবেদন করা সত্ত্বেও তা গ্রাহ্য করা হয়নি।

১,৬২১ জন মৃত শিক্ষকের যে তালিকাটি ইউপির শিক্ষক মহাসংঘ (শিক্ষক ফেডারেশন্) বানিয়েছে সেখানে ১৯৩ জন শিক্ষা মিত্রের নাম আছে। তাঁদের মধ্যে মঞ্জু নিষাদকে নিয়ে মোট ৭২ জন মহিলা। অথচ ১৮ই মে নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী ইউপির প্রাথমিক শিক্ষা পরিষদ সংবাদ মাধ্যমকে যে বিবৃতিটি দেয় সেখানে বলা ছিল যে শুধুমাত্র যাঁরা কর্মরত অবস্থায় মারা গেছেন তাঁদেরকেই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। অর্থাৎ শিক্ষকদের মধ্যে একমাত্র যাঁরা ভোটকেন্দ্রে বা বাড়ি ফেরার সময় প্রাণ হারিয়েছেন তাঁরাই পেতে পারেন এ ক্ষতিপূরণ। “রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের অর্থ একমাত্র তাঁদেরকেই প্রদান করা হবে যাঁরা কোনও না কোন কারণে উক্ত সময়সীমার মধ্যে মারা গেছেন।”

Shishupal Nishad with Navya, Muskan, Prem and Manju: a last photo together of the family
PHOTO • Courtesy: Shishupal Nishad

শিশুপাল নিষাদ, সঙ্গে নব্যা, মুস্কান, প্রেম ও মঞ্জু: পুরো পরিবারটির একসঙ্গে তোলা শেষ আলোকচিত্র

এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতে বিবৃতিটিতে একথাও বলা ছিল যে, "জেলাস্তরের প্রশাসন ৩ জন শিক্ষকের মৃত্যু সম্বন্ধে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে [এসইসি] জানিয়েছে।" তার মানে ১,৬১৮ জন শিক্ষক যাঁরা হয় প্রশিক্ষণ নয় ভোটগ্রহণ কিংবা গণনার দিনে সংক্রমিত হন এবং তারপর বাড়ি ফিরে এসে মারা যান তাঁরা বেমালুম বাদ পড়ে গেলেন। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের রীতি, কীভাবে সে মৃত্যু ঘটায়, কিংবা আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীর কতদিন সময় লাগে মারা যেতে – এসকল বিষয় ইচ্ছে করেই ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়নি।

অত্যন্ত অসন্তোষের সঙ্গে শিক্ষক মহাসংঘ বলছে যে প্রশাসনের উচিত পুরো তালিকাটা খুঁটিয়ে দেখা “যাতে সরকার ওই ১,৬১৮ জনের নাম মিলিয়ে দেখতে পারে যাঁদের নাম বাদ পড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ হল সরকার ব্যস্ত ছিল মোটে তিনজনের নাম নিশ্চিত করতে।” পারিকে এমনটাই জানালেন মহাসংঘের সভাপতি দীনেশ শর্মা।

২৬শে এপ্রিল ভোটগ্রহণের আগের দিন জালৌন জেলার কাদাওরা ব্লকের নির্বাচনী কেন্দ্রের দ্বায়িত্ব সামলাতে আসেন মঞ্জু নিষাদ। তার একদিন আগেই তাঁকে প্রশিক্ষণের জন্য একটি শিবিরে যেতে হয়েছিল। ওই ২৫ তারিখের রাতেই তিনি গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

“সরকারের অসতর্কতার জন্যই এমনটা হয়েছিল। আমার স্ত্রী কয়েকজন উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিল। সে বারবার ছুটির জন্য আবেদন করে কারণ একথা সে বুঝতে পেরেছিল যে তাকে বাড়ি ফিরে আসতেই হবে। সেই অফিসার তাকে বলে: 'ছুটি চাইলে চাকরিটাও ছেড়ে দিতে হবে' – অগত্যা মঞ্জু কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য হয়,” বললেন শিশুপাল।

যাবতীয় নির্বাচনী দ্বায়িত্ব সামলে এপ্রিলের ২৬ তারিখ গভীর রাতে মঞ্জু একটি গাড়ি ভাড়া করে বাড়ি ফিরে আসেন। "ও বলছিল যে ওর জ্বর এসেছে আর শরীরটা প্রচণ্ড আনচান করছে," জানালেন শিশুপাল। তার পরদিন পরীক্ষা করা হয় এবং দেখা যায় যে মঞ্জু কোভিড পজিটিভ। তখন শিশুপাল তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে তারা জানায় যে তাঁকে এক সপ্তাহ ভর্তি রাখতে হবে আর দৈনিক ১০,০০০ টাকা লাগবে। সোজা ভাষায় বলতে গেলে মঞ্জু সারা মাসে যা রোজগার করেন সেটা একদিনেই খরচ হয়ে যাবে। "তখন আমি ওকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই," শিশুপাল জানালেন।

শিশুপাল বলছিলেন যে মঞ্জু তাঁদের সন্তানদের চিন্তায় কাতর ছিলেন, তিনি ভাবতেই পারছিলেন না যে তাঁকে ছাড়া ছেলেমেয়েরা বাড়িতে কী করবে, কী খাবে। দোসরা মে, অর্থাৎ হাসপাতালে তাঁর পঞ্চম দিনে এবং যেদিন তাঁর ভোটগণনার কাজে যাওয়ার কথা ছিল সেদিনই মঞ্জু মারা যান।

Manju's duty letter. Thousands of teachers were assigned election duty in UP’s mammoth four-phase panchayat elections in April. On May 2, her fifth day in the hospital – and what would have been her counting duty day – Manju (right, with her children) died
PHOTO • Courtesy: Shishupal Nishad
Manju's duty letter. Thousands of teachers were assigned election duty in UP’s mammoth four-phase panchayat elections in April. On May 2, her fifth day in the hospital – and what would have been her counting duty day – Manju (right, with her children) died
PHOTO • Courtesy: Shishupal Nishad

নির্বাচনী দ্বায়িত্ব প্রদান করে মঞ্জুকে পাঠানো চিঠি। এপ্রিল মাসে পাঁচটি দফায় ইউপিতে যে পঞ্চায়েত নির্বাচন নামের মহাযজ্ঞ চলছিল তার দ্বায়িত্ব পড়েছিল হাজার হাজার শিক্ষকের উপর। দোসরা মে, অর্থাৎ হাসপাতালে তাঁর পঞ্চম দিনে এবং যেদিন তাঁর ভোটগণনার কাজে যাওয়ার কথা ছিল সেদিনই মঞ্জু (ডানদিকে, নিজের ছেলেমেয়ের সঙ্গে) মারা যান

“তিনদিন বাদে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে আমার মা মারা যান। তিনি বারংবার বলছিলেন, ‘বেঁচে থেকে আর কীই বা হবে যখন আমার বৌমাই আমায় ছেড়ে চলে গেল',” বললেন শিশুপাল।

শিশুপাল ভেবে কূল পাচ্ছেন না যে কীভাবে তিনি তাঁর সন্তানদের অন্নবস্ত্র জোগাড় করবেন এরপর। নব্যার দুই ভাইবোন – দিদি মুস্কানের বয়েস ১৩ এবং দাদা প্রেমের বয়েস ৯। যে বাড়িটায় থাকেন তিনি সেটার ভাড়া ১,৫০০ টাকা। কীভাবে সংসার চালাবেন সেটা তাঁর বোধগম্য হচ্ছে না: "কিচ্ছু মাথায় আসছে না। পাগল হওয়ার জোগাড় হয়েছে আমার – মনে হচ্ছে কয়েক মাসের মধ্যে আমিও মারা যাব," বলছিলেন অসহায় শিশুপাল।

*****

অতিমারির এই ভয়াবহতা ছাড়াও আমাদের নজর দেওয়া উচিত শিক্ষা মিত্র নামক অব্যবস্থার দিকে। তিনটি রাজ্য জুড়ে সংগঠিত এই যোজনাটি উত্তরপ্রদেশে শুরু করা হয় ২০০০-০১ সালে। অনগ্রসর শ্রেণির শিশুরা, যারা সরকারি ইস্কুলে পড়াশোনা করে তাদের খাতে শিক্ষার বাজেটে খরচা কমাতেই সরকার এই যোজনাটি শুরু করে চুক্তির মাধ্যমে সহায়ক শিক্ষক নিয়োগের দ্বারা। কর্মসংস্থানের হাল হকিকত এমনিতেই শোচনীয় আমাদের দেশে, তার উপর এই যোজনার ফলে উচ্চমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মানুষকে মাসিক ১০,০০০ টাকার বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে – অর্থাৎ স্থায়ী শিক্ষকেরা যা পান তার একটি ভগ্নাংশ মাত্র।

নিয়ম অনুযায়ী একজন শিক্ষা মিত্রের যোগ্যতা হওয়া উচিত উচ্চমাধ্যমিক কিংবা তার সমতুল স্তরের । এই হাস্যকর বৈতনিক কাঠামো ন্যায়সঙ্গত হিসেবে ঘোষিত হয় এটা বলে যে শিক্ষকতার নিরিখে ন্যূনতম যোগ্যতার মাপকাঠি ছেঁটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু মঞ্জু নিষাদ স্নাতকোত্তর স্তর পাশ করেছিলেন। তাঁর মতো আরও হাজার হাজার শিক্ষা মিত্র শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে ন্যূনতম স্তরের চেয়ে অনেকখানি উপরে রয়েছেন, তবে কর্মক্ষেত্রের সার্বিক ডামাডোলে তাঁরা নিরুপায়। “তাঁরা যে ভয়াবহ মাত্রায় শোষিত এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। নয়তো বিএড, এমএ, এমনকি পিএইচডি থাকা সত্ত্বেও মানুষ কেন ১০,০০০ টাকা মাইনের বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন?” জিজ্ঞেস করলেন দীনেশ শর্মা।

নির্বাচনের দায়িত্ব সামলে করোনায় মৃত শিক্ষক ও অন্যান্য সরকারি কর্মীদের তালিকায় ৭৫০ নম্বরে থাকা ৩৮ বছরের জ্যোতি যাদব প্রয়াগরাজ জেলার সোরাঁও (বিকল্প উচ্চারণ 'সোরাভ') ব্লকের থারওয়াই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াতেন শিক্ষা মিত্র হিসেবে। তাঁর বিএড ডিগ্রি ছিল, এছাড়াও এই বছর জানুয়ারি মাসে তিনি সেন্ট্রাল টিচার এলিজিবিলিটি টেস্ট (সিটিইটি) পাশ করেছিলেন। তবুও মঞ্জু নিষাদের মতো তিনিও ১০,০০০ টাকা বেতনেই আটকে ছিলেন। আর এই অমানবিক চাকরিটি তিনি করছিলেন বিগত ১৫ বছর ধরে।

Sanjeev, Yatharth and Jyoti at home: 'I took her there [for poll training] and found huge numbers of people in one hall bumping into each other. No sanitisers, no masks, no safety measures'
PHOTO • Courtesy: Sanjeev Kumar Yadav

নিজেদের বাড়িতে সঞ্জীব, যথার্থ এবং জ্যোতি: ‘ওকে আমি (নির্বাচনী প্রশিক্ষণের জন্য) নিয়ে গিয়ে দেখলাম যে একটা হলঘরে অসংখ্য লোক একে অপরের সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করছে। কোথাও কোনও স্যানিটাইজার নেই, কারও মুখে মাস্ক নেই, সুরক্ষার একটাও বিধি পালিত হচ্ছে না’

“আমার স্ত্রীর নির্বচনী প্রশিক্ষণ ছিল এপ্রিলের ১২ তারিখে প্রয়াগরাজের মোতিলাল নেহরু ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে,” জানালেন তাঁর বছর ৪২-এর স্বামী সঞ্জীব কুমার যাদব। “ওকে আমি নিয়ে গিয়ে দেখলাম যে একটা হলঘরে অসংখ্য লোক একে অপরের সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করছে। কোথাও কোনও স্যানিটাইজার নেই, কারও মুখে মাস্ক নেই, সুরক্ষার একটাও বিধি পালিত হচ্ছে না।”

“ফিরে আসার পরদিন থেকেই ওর শরীরের অবনতি হতে থাকে। যেহেতু নির্বাচনের কাজের জন্য ১৪ তারিখ ওর বেরোনোর কথা ছিল (প্রয়াগরাজে ভোটগ্রহণের নির্ধারিত দিন ছিল ১৫ই এপ্রিল) আমি ইস্কুলের প্রিন্সিপালকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি যে এরকম অবস্থায় ও কেমন করে যাবে। তিনি জবাব দেন “কিচ্ছু করার নেই, দ্বায়িত্ব পালন করতেই হবে।” তাই আমি মোটরসাইকেলে করে জ্যোতিকে নিয়ে যাই ওখানে। আমি নিজেও থেকে যাই ওর সঙ্গে ১৪ তারিখ রাতে, তারপর ভোটের কাজ শেষ হলে ১৫ তারিখ ওকে ফিরিয়ে আনি। আমাদের বাড়ি যে শহরতলিতে, তার থেকে ওর নির্বাচনী কেন্দ্র ছিল ১৫ কিমি দূরে।”

তার পরপরই মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে জ্যোতির অবস্থা সংকটজনক হয়ে দাঁড়ায়। “আমি একের পর এক হাসপাতালে ওকে নিয়ে যাই কিন্তু কেউই ভর্তি করতে চায় না। ২রা মে রাত্রিবেলায় ওর ভীষণ রকমের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তার পরদিন আমি আবার ওকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যাই, কিন্তু যাওয়ার পথেই সে মারা যায়।”

কোভিড-১৯ জ্যোতিকে কেড়ে নেওয়ার ফলে তাঁর পরিবার আজ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। সঞ্জীব কুমার বাণিজ্যবিদ্যায় স্নাতক, যোগব্যায়ামে স্নাতকোত্তর এবং বেরোজগার। তিনি একটা টেলিকম সংস্থায় কাজ করতেন, কিন্তু সেটা ২০১৭ সালে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে স্থায়ী কোনও ঠিকঠাক চাকরি জোগাড় করতে না পারায় সংসারে তাঁর আর্থিক অবদান খুবই অল্প। তিনি বলছিলেন তাঁদের সংসারের হাল জ্যোতির হাতেই ছিল।

সদ্য ক্লাস ২ পাশ করা ন'বছরের সন্তান যথার্থ এবং নিজের বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে দিনরাত দুশ্চিন্তায় ভুগছেন সঞ্জীব। "সরকারের সাহায্য ছাড়া আমি কিছুই করতে পারব না," কাঁদতে কাঁদতে জানালেন তিনি।

Sanjeev worries about how he will now look after nine-year-old Yatharth
PHOTO • Courtesy: Sanjeev Kumar Yadav

ন'বছরের সন্তান যথার্থর দেখভাল কীভাবে করবেন সেই দুশ্চিন্তায় ভুগছেন সঞ্জীব

"এ রাজ্যের ১.৫ লাখ শিক্ষা মিত্র এক দশকেরও বেশি সময় জুড়ে বেতন কাঠামোর উথালপাথাল সহ্য করেছেন," বলছেন দীনেশ শর্মা, "তাঁদের সামগ্রিক এই যাত্রা অত্যন্ত দুঃখজনক। মায়াবতীর আমলে তাঁরা প্রথম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মোটামুটি ২,২৫০ টাকার মাইনের বিনিময়ে কাজ শুরু করেন। তারপর অখিলেশ যাদবের সরকারের সময় তাঁদের সবাইকে স্থায়ী কর্মী হিসেবে নিযুক্ত করে মাইনেটা ৩৫,০০০ টাকা করে দেওয়া হয় (যেটা পরে বেড়ে ৪০,০০০ টাকা হয়)। কিন্তু তখন শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কিছু মতান্তর দেখা দেওয়ার ফলে যেসব শিক্ষকদের বিএড ডিগ্রি ছিল তাঁরা এটার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট মামলা দায়ের করেন।"

"কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেই নিয়ম বদলে এমন করে দিতে পারত যাতে দশকের পর দশকের ধরে কর্মরত শিক্ষকদের জন্য টেট (টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট) পাশ করাটা আবশ্যিক না হয়। কিন্তু সরকার সেটা করেনি। ফলত ওই শিক্ষকদের মাইনে রাতারাতি আবার ৩,০০০ টাকা করে দেওয়া হয়, আর এই ধাক্কা সহ্য না করতে পেরে অনেকেই আত্মহত্যা করেন। শেষমেশ বর্তমান সরকার এই মাইনে খানিক বাড়িয়ে মাসিক ১০,০০০ টাকা করেছে।"

ইতিমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা পরিষদের এই যে বিবৃতি, যেখানে বলা হচ্ছে যে সরকার দ্বারা প্রদত্ত ক্ষতিপূরণের আওতায় মোটে তিনজন শিক্ষকের মৃত্যুকে ধরা যেতে পারে, এটা রাজ্য সরকারকে বাধ্য করেছে জবাবদিহির সামনে দাঁড়াতে।

এলাহাবাদের উচ্চ আদালত আদেশ দেয় যে নির্বাচনের দ্বায়িত্বে কর্মরত অবস্থায় যে সকল নির্বাচনী আধিকারিক (শিক্ষক এবং অন্যান্য সরকারি কর্মচারী) কোভিড-১৯ সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকের পরিবারকে ন্যূনতম ১ কোটি টাকার মরণোত্তর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। ১৮ই মে পারি'র প্রতিবেদনে এই তথ্যটি প্রকাশিত হয়েছিল।

মে মাসের ২০ তারিখে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তাঁর প্রশাসনকে নির্দেশ দে ন যেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে "বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়।" তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী: "কোভিড-১৯ অতিমারির যে প্রকোপ, তা আপাতত আমাদের নিয়মাবলির আওতায় পড়ে না... তাই এই নিয়মাবলিকে অবিলম্বে সহানুভূতির আলোয় রেখে বদলাতে হবে।" তিনি একথাও বলেন যে রাজ্য সরকার " তার অধীনে থাকা সকল কর্মচারীদের জন্য সব রকমের আবশ্যিক ব্যবস্থাপনা প্রদান করার জন্য প্রস্তুত আছে, বিশেষত এরকম একটা সময়ে যখন তাঁদেরকে নির্বাচন তথা অন্যান্য কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল।"

কিন্তু "আমাদের লেখা চিঠিগুলির প্রত্যুত্তরে রাজ্য সরকার বা রাজ্য নির্বাচন কমিশন এখনও অবধি কিচ্ছু জানায়নি। ওরা ক্ষতিপূরণের আওতায় শেষমেশ কতজন শিক্ষককে রাখবে বা নিয়মাবলিতে কী কী বদল আনতে চলেছে সে বিষয়ে কারও কাছে কোনও খবর নেই," জানালেন শিক্ষক মহাসংঘের দীনেশ শর্মা।

এপ্রিল মাসে পঞ্চায়েত নির্বাচন আয়োজন করার পর থেকে সরকার এই যে নিজেকে নির্দোষ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে এইটা শিক্ষকেরা মেনে নিতে পারছেন না। "এখন মুখ্যমন্ত্রী বলছেন যে উনি নাকি উচ্চ আদালতের নির্দেশ মেনেই যথা সময়ে নির্বাচনের আয়োজন করেছেন। অথচ উচ্চ আদালত যখন রাজ্যে লকডাউন বলবত করার জন্য আদেশ দেয় তখন সরকার তার বিরোধিতায় সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়। এছাড়াও উচ্চ আদালত যখন নির্বাচনী প্রক্রিয়া তাড়াহুড়ো করে সমাপ্ত করার নির্দেশ দেয় তখন কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ সদ্য সদ্য আছড়ে পড়ার আগে ফুঁসছিল। সরকার চাইলেই জনস্বার্থে এই নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করার জন্য আবেদন জানাতে পারত, কিন্তু সেটা তারা ইচ্ছে করেই করেনি।"

"সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে জিজ্ঞেস করে যে ভোটের গণনা ২রা মে করার বদলে ১৫টা দিন পিছিয়ে দেওয়া যাবে কিনা। কিন্তু রাজ্য সরকার আর রাজ্য নির্বাচন কমিশন তাতে রাজি হয়নি। এরা এখন উচ্চ আদালতের নির্দেশ নিয়ে ভাষণ দিচ্ছে – অথচ ভোটগণনাকে মুলতুবি করার জন্য সর্বোচ্চ আদালত যে প্রস্তাব দিয়েছিল সেটাকে এরাই নাকচ করেছিল ।"

*****

প্রয়াগরাজ (এলাহাবাদের নতুন নাম) থেকে মোহাম্মদ সুহেল পারি'কে ফোন করে জানাল, "আমি চেয়েছিলাম যে মা-কে এপ্রিলের ১৪ তারিখ রাতে বাড়িতে নিয়ে আসব আর তারপর আবার ১৫ তারিখ, মানে যেদিন আমাদের জেলায় ভোটগ্রহণ ছিল সেদিন ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে দেব, এটা আমি অনুরোধ হিসেবে মায়ের কেন্দ্রে জানাই সেখানকার প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে।”

A favourite family photo: Alveda Bano, a primary school teacher in Prayagraj district died due to Covid-19 after compulsory duty in the panchayat polls
PHOTO • Courtesy: Mohammad Suhail

মন জুড়ে থাকা একটি পারিবারিক চিত্র: পঞ্চায়েত নির্বাচনের বাধ্যতামূলক দ্বায়িত্ব পালন করার পর প্রয়াগরাজ জেলার প্রাথমিক ইস্কুল শিক্ষক আলভেদা বানো কোভিড-১৯ সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে মারা যান

সুহেলের মা আলভেদা বানো (৪৪ বছর বয়েস) প্রয়াগরাজ জেলার চাকা ব্লকের বঙ্গি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্মরত একজন শিক্ষক ছিলেন। তাঁর ভোটকেন্দ্রটিও ছিল ওই একই ব্লকে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের বাধ্যতামূলক দ্বায়িত্ব সামলাতে গিয়ে কোভিড-১৯এ মৃত শিক্ষকদের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে ৭১৩ নম্বরে।

"সেই প্রিসাইডিং অফিসার আমার আবেদন খারিজ করে দিয়ে বলেন যে মা-কে সারারাত ওখানেই থাকতে হবে, এর অন্যথা করা চলবে না। তাই ১৫ই এপ্রিল রাতে আমার বাবা গিয়ে মা-কে নিয়ে আসে আর তার তিনদিন পর থেকেই মায়ের শরীর ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করে," সুহেল বলছিল। তিন দিন পরে আলভেদা একটি হাসপাতালে মারা যান।

মোহম্মদ সুহেলের এক দিদি আছেন, তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে, তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে থাকেন। এছাড়াও সুহেলের এক ছোট ভাই আছে, ১৩ বছরের মোহাম্মদ তুফেল, সে ক্লাস নাইনে পড়ে। সুহেল নিজে দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করে এখন কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

তার বাবা সর্ফুদ্দিনের বয়স ৫২ বছর। সর্ফুদ্দিন জানান "গতবছর একটা ছোট্ট ওষুধের দোকান খুলেছিলাম লকডাউনের ঠিক আগেই," খুবই অল্প সংখ্যক ক্রেতার আনাগোনা আজ সেখানে। "মেরেকেটে দৈনিক ১০০ টাকা রোজগার হয় আমার। আলভেদার ১০,০০০ বেতনটাই ছিল আমাদের একমাত্র সম্বল।"

"শিক্ষা মিত্রদের পদোন্নতি ও বেতন বেড়ে ৩৫,০০০ টাকা হওয়ার পর তাঁদের [ওই স্তরের মাইনের নিরিখে] অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়। এখন তো শিক্ষা মিত্ররা ওই একই ইস্কুলগুলোয় ১০,০০০ টাকার বিনিময়ে পড়াচ্ছেন এবং তাঁদের অনেকেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা খুবই উচ্চমানের – তাহলে আজ কেন কেউ তাঁদের নায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে না বা আলোচনা করতে চাইছে না?" জিজ্ঞেস করলেন দীনেশ শর্মা।

ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন থেকে প্রাপ্ত একটি স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা অনুদানের সাহায্যে জিজ্ঞাসা মিশ্র জনস্বাস্থ্য এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে লেখালিখি করেন। এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুর ওপর ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন কোনওরকম সম্পাদকীয় হস্তক্ষেপ করেনি

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Reporting and Cover Illustration : Jigyasa Mishra

ਜਗਿਆਸਾ ਮਿਸ਼ਰਾ ਉੱਤਰ ਪ੍ਰਦੇਸ਼ ਦੇ ਚਿਤਰਾਕੂਟ ਅਧਾਰਤ ਸੁਤੰਤਰ ਪੱਤਰਕਾਰ ਹਨ।

Other stories by Jigyasa Mishra
Translator : Joshua Bodhinetra

ਜੋਸ਼ੁਆ ਬੋਧੀਨੇਤਰਾ, ਪੀਪਲਜ਼ ਆਰਕਾਈਵ ਆਫ਼ ਰੂਰਲ ਇੰਡੀਆ (ਪਾਰੀ) ਵਿੱਚ ਭਾਰਤੀ ਭਾਸ਼ਾਵਾਂ ਦੇ ਪ੍ਰੋਗਰਾਮ ਪਾਰੀਭਾਸ਼ਾ ਦੇ ਸਮੱਗਰੀ ਮੈਨੇਜਰ ਹਨ। ਉਨ੍ਹਾਂ ਨੇ ਜਾਦਵਪੁਰ ਯੂਨੀਵਰਸਿਟੀ, ਕੋਲਕਾਤਾ ਤੋਂ ਤੁਲਨਾਤਮਕ ਸਾਹਿਤ ਵਿੱਚ ਐੱਮਫਿਲ ਕੀਤੀ ਹੈ। ਉਹ ਬਹੁਭਾਸ਼ਾਈ ਕਵੀ, ਅਨੁਵਾਦਕ, ਕਲਾ ਆਲੋਚਕ ਹੋਣ ਦੇ ਨਾਲ਼-ਨਾਲ਼ ਸਮਾਜਿਕ ਕਾਰਕੁਨ ਵੀ ਹਨ।

Other stories by Joshua Bodhinetra