৯ বছরের চন্দ্রিকা বেহেরা আজ বছর দুই ইস্কুলছুট হয়ে বসে আছে। বড়াবাঁকি গাঁয়ে ওর মতো আরও ১৮জন আছে যাদের এখন ১ম থেকে ৫ম শ্রেণিতে পড়ার কথা। অথচ, ২০২০ থেকে তারা নিয়মিত ক্লাসেই যেতে পারছে না। জিজ্ঞেস করাতে জানা গেল, চন্দ্রিকার মা তাকে পাঠশালায় যেতেই দেন না।
২০০৭ থেকে বড়াবাঁকি গ্রামেই একখান ইস্কুল ছিল বটে, তবে ২০২০ সালে সেটি চিরতের বন্ধ করে দেয় ওড়িশা সরকার। ছোট্ট চন্দ্রিকার মতো বড়াবাঁকি গাঁয়ে প্রাথমিক স্তরের যেসব পড়ুয়ারা রয়েছে, তাদের অধিকাংশই সাঁওতাল কিংবা মুণ্ডা আদিবাসী জনজাতির সদস্য। ৩.৫ কিলোমিটার দূর জামুপাসি গ্রামের বিদ্যালয়ে গিয়ে দাখিল হতে বলা হয়েছিল ওদের।
“বাচ্চাদের পক্ষে প্রতিদিন এত্তটা হাঁটাহাঁটি সম্ভব নয়। অতদূর হাঁটতে গেলে ওরা খালি নিজেদের মধ্যে চুলোচুলি করবে শেষে। আমরা গরিব মজুর। পেটের ভাত জোগাব, না হররোজ বাচ্চাদের নিয়ে ইস্কুলে যাতায়াত করব? আমাদের নিজেদের যে পাঠাশালাটা আছে, বাবুরা তো ওটাকেই আবার চালু করতে পারেন,” বক্তব্য চন্দ্রিকার মা মামি বেহেরার।
অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানালেন, ততদিন অবধি তাঁর কনিষ্ঠ সন্তানের মতো ৬-১০ বছরের বাচ্চাকাচ্চারা না হয় শিক্ষাদীক্ষার হতে শতহস্ত দূরেই পড়ে থাকুক। বছর তিরিশেকের মামি আরও একটি শঙ্কার কথা বললেন, জাজপুর জেলার দানাগাডি ব্লকের এই জঙ্গলে শিশু অপহরণকারীর দলও লুকিয়ে থাকতে পারে।
জ্যেষ্ঠপুত্র জোগির জন্য অবশ্য পুরোনো একখান সাইকেল জোগাড় করেছেন তিনি। ৬ কিলোমিটার দূর অন্য একটি ইস্কুলে ৯ম শ্রেণিতে পড়ে জোগি। তবে ৭ম শ্রেণির পড়ুয়া বড়ো মেয়ে মণিকে কিন্তু হেঁটে হেঁটেই জামুপাসির সেই ইস্কুলটিতে যেতে হয়।
“আমাদের প্রজন্মটা তো শরীর ভেঙে যাওয়া পর্যন্ত হেঁটেছে, চড়েছে, খেটে মরেছে। নিদেনপক্ষে আমাদের বাচ্চাদের জন্যও কি অন্য একটা ভবিষ্যতের কথা ভাবা যাবে না?” সুস্পষ্ট সওয়াল মামির।
বড়াবাঁকির ৮৭টি গেরস্থালির সিংহভাগটাই আদিবাসী। জনাকয়েকের হাতে লাঙল চালানোর মতো একচিলতে করে জমি আছে বটে, তবে অধিকাংশই দিনমজুর। একেকজন তো ইস্পাত বা সিমেন্ট কারখানায় ঘাম ঝরাতে ৫ কিলোমিটার দূর সুকিন্দা অবধি পাড়ি দেন। এছাড়াও সুতোকাটা কল আর বিয়ারের ক্যান প্রস্তুতকারক কারখানায় কাজ করতে সুদূর তামিলনাড়ুতেও চলে গেছেন কয়েকজন পুরুষ।
হতদরিদ্র পরিবারগুলির দৈনিক খাদ্য পরিকল্পনার নিরিখে মিড-ডে মিলের প্রয়োজন অপরিসীম — বড়াবাঁকির বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে মধ্যাহ্ন ভোজন আদৌ মিলবে কি না, অনিশ্চয়তার আঁধার ঘনিয়েছে সে বিষয়েও। কিশোর বেহেরার কথায়, “নয় নয় করেও সাত-সাতটা মাস ধরে, ইস্কুলে রাঁধা গরমাগরম খাবারের বদলে যে চাল বা টাকাকড়ি দেবে বলেছিল, তার কিছুই মেলেনি।” কিছু কিছু পরিবার এমনও আছে যাঁদের অ্যাকাউন্টে মিড-ডে মিলের বদলে টাকা ঢোকে, তবে মাঝেসাঝে তাঁদের বলে দেওয়া হয় যে ৩.৫ কিলোমিটার দূর নতুন ইস্কুলের চত্বরে খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
*****
ওই একই ব্লকে পড়শি গ্রাম পুরনামানাতিরা। এপ্রিল ২০২২শের পয়লা সপ্তাহ। যে সরুমতন রাস্তাটা গাঁয়ের পিছন দিয়ে বাইরের দিকে যাচ্ছে, দুপুর দুপুর সেখানে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল একদিন। কর্মশ্রান্ত মহিলা ও পুরুষ, হঠাৎই চোখে পড়া কোনও এক ঠাম্মা, সাইকেলে চড়ে বসা দুটি উঠতি কিশোর — পথ জুড়ে ভিড় জমিয়েছে সবাই। কারও মুখে কোনও রা নেই, সব্বাই যেন শক্তি সঞ্চয়ে ব্যস্ত, মধ্যাহ্নের ওই গনগনে সূর্যের থেকে রেহাই পেতে গামছা বা আঁচলে কপাল ঢেকেছে প্রত্যেকে, ৪২ ডিগ্রি পার করেছে তাপমাত্রা।
দাবদাহের তোয়াক্কা না করেই ১.৫ কিলোমিটার পথ ঠেঙিয়ে পাঠশালা থেকে বাড়ির খুদে খুদে বাচ্চাদের আনতে যাচ্ছেন পুরনামানাতিরার মানুষজন।
সুকিন্দার একটি সিমেন্ট কারখানায় চুক্তিশ্রমিকের কাজ করেন পুরনামানাতিরার দীপক মালিক। বিস্তৃত ক্রোমাইট রিজার্ভের জন্য সুকিন্দা উপত্যকাটি বিখ্যাত। মূলত তফশিলি জাতি অধ্যুষিত এ গ্রামে দীপকের মতো অন্যরাও একটা কথা হাড়ে হাড়ে বোঝেন — সন্তানসন্ততির জীবনে ঠিকমতন পড়াশোনাটাই উন্নতির একমাত্র চাবিকাঠি। “গতর না খাটালে দিনের শেষে চাট্টি ডালভাতও জুটবে না, গাঁয়ের বেশিরভাগ লোকের ক্ষেত্রেই এটা সত্যি,” বলে উঠলেন তিনি, “ওই জন্যই তো ২০১৩-১৪ সালে যখন ইস্কুলবাড়িটা তৈরি হল, আমাদের প্রত্যেকেই বিশাল খুশি হয়েছিলাম।”
মোট ২৫টি পরিবারের বাস এ গাঁয়ে, ১ম-৫ম শ্রেণিতে পড়ার কথা এমন বাচ্চার সংখ্যা ১৪। অথচ ২০২০ সালের অতিমারির পর থেকে এ তল্লটে একখানাও প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, জানালেন পুরনামানাতিরার বাসিন্দা সুজাতা রানি সমল। তার বদলে ১.৫ কিলোমিটার পথ ভেঙে পাশের গাঁ চাকুয়ায় যেতে হয় এখানকার কচিকাঁচা পড়ুয়াদের — মাঝে একখান রেললাইনও টপকাতে হয়, ঘনঘন যেখানে ছুটে চলেছে ট্রেন।
হ্যাঁ, রেললাইন না টপকাতে চাইলে আপনি ওভারব্রিজ হয়ে পাকা সড়ক ধরে হাঁটতেই পারেন, তবে দূরত্বটা সেক্ষেত্রে ১.৫ থেকে বেড়ে ৫ কিলোমিটারে গিয়ে ঠেকবে। শর্টকাটে যেতে চাইলে পুরোনো ইস্কুল আর গোটা দুই মন্দির ছুঁয়ে গাঁয়ে ধার বরাবর এঁকেবেঁকে রেললাইনের উঁচু বাঁধটায় গিয়ে উঠবেন, সামনেই ব্রাহ্মণী স্টেশন।
দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে ছুটে গেল একটা মালগাড়ি।
ভারতীয় রেলের হাওড়া-চেন্নাই মেন-লাইন হয়ে দশ মিনিট অন্তর অন্তর ব্রাহ্মণী স্টেশন পার করে যায় মালগাড়ি আর যাত্রীবাহী ট্রেন। বড়োরা সঙ্গে না থাকলে, পুরনামানাতিরার কোনও পরিবারই তাদের বাচ্চাদের একা একা বিদ্যালয়ে যেতে দেয় না।
পরের ট্রেন আসার আগেই তড়িঘড়ি লাইন টপকায় সবাই, রেললাইন জুড়ে তখনও কম্পন বিদ্যমান। বাঁধের ধার হয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে হড়কে নামে কিছু বাচ্চা, সবচাইতে পুঁচকেদের চটজলদি হেঁচকে টেনে পার করানো হয় রেল-বাঁধ। চলতে থাকা দলছুটদের হাঁকডাক করার পালা। কাদামাখা পা, কড়া পড়ে যাওয়া পা, রোদে পোড়া পা, চটিজুতোহীন পা, হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া পা — দল বেঁধে ২৫ মিনিট কুচকাওয়াজ করে সব্বাই।
*****
বড়াবাঁকি ও পুরনামানাতিরার প্রাথমিক দুটি বিদ্যালয় সহ মোট ৯,০০০টি ইস্কুলে তালা পড়ে গেছে ওড়িশায়। পোশাকি শব্দটা অবশ্য বেশ গালভরা — ‘কন্সলিডেটেড’ কিংবা ‘মার্জড’, অর্থাৎ পাশের গ্রামের বিদ্যালয়ের সঙ্গে একত্রিত বা সংযুক্ত। এটি সম্ভবপর হয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কেন্দ্র সরকার দ্বারা গঠিত ‘সাস্টেনেবল অ্যাকশন ফর ট্রানসফর্মিং হিউমান ক্যাপিটাল (এসএটিএইচ বা সাথ)’ নামের একটি পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে।
ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও মধ্যপ্রদেশ — এই তিন রাজ্যে ইস্কুলশিক্ষা ‘সংস্কার’ করার দোহাই দিয়ে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে পথচলা শুরু করে সাথ-ই। ২০১৮ সালে প্রকাশিত প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা আছে: সাথ-ইর লক্ষ্য ছিল যাতে “সরকারি স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থাটি যাতে সম্পূর্ণভাবে সংবেদনশীল, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং রূপান্তরমূলক হয়ে ওঠে প্রতিটি শিশুর জন্য।”
তবে পাঠশালায় ঝাঁপ পড়া বড়াবাঁকির গ্রামে এই ‘রূপান্তরের’ ছবিটা একটু অন্যরকম। ডিপ্লোমা আছে এমন একজনই আছে এ গাঁয়ে, এছাড়াও ক্লাস ১২ পাশ আছে জনাকয় আর ম্যাট্রিক ফেল আছে বেশ কয়েকজন। রাতারাতি গল্প হয়ে যাওয়া ইস্কুলের পরিচালন সভিতির অধ্যক্ষ কিশোর বেহেরার কথায়, “এবার তো মনে হয় আর সেটুকুও থাকবে না আমাদের।”
এ গাঁয়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে পাশের গাঁয়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম কে ওয়াস্তে ‘সংযুক্তিকরণ’ হচ্ছে। আসলে যে যে ইস্কুলে পড়ুয়া সংখ্যা খুবই অল্প, ধরে ধরে বন্ধ করা হচ্ছে সেগুলি। নভেম্বর ২০২১-সালে সাথ-ই’র একটি রিপোর্টে নীতি আয়োগের তৎকালীন সিইও অমিতাভ কান্তে এই ‘সংযুক্তিকরণের’ বড়াই করে বলেছিলেন, এটা নাকি ‘দুঃসাহসী আর অগ্রগামী সংস্কার’-এর মধ্যে অন্যতম।
হররোজ মাইলের পর মাইল পেরিয়ে চাকুয়ায় তার নতুন ইস্কুলে গিয়ে পুরনামানাতিরার ছোট্ট সিদ্ধার্থ মালিকের পায়ে যে ব্যথাটা হয়, সেটাকে কিন্তু মোটেও ‘দুঃসাহসী’ বা ‘অগ্রগামী’ মনে হয় না তার। সিদ্ধার্থর বাবা দীপক জানালেন, এমনও বহু দিন গেছে যখন তাঁর ছেলে ইস্কুলে যেতেই পারেনি।
ভারতে প্রায় ১১ লক্ষ সরকারি বিদ্যালয় আছে, যার মধ্যে আনুমানিক ৪ লাখ ইস্কুলে পড়ুয়া-সংখ্যা ৫০-এর কম, এবং ১.১ লাখ পাঠশালায় তো জনা কুড়ি বা তারও কম শিক্ষার্থী রয়েছে। সাথ-ইর রিপোর্ট অনুযায়ী এগুলি নাকি “সাব-স্কেল স্কুল”, অর্থাৎ মাত্রাতিরিক্ত ক্ষুদ্র। এধরনের বিদ্যালয়ে কোন কোন খামতি রয়েছে, তার একখানা তালিকাও রয়েছে সেই রিপোর্টে: দুজনের বেশি শিক্ষক নেই এবং তাঁরা একাধিক শ্রেণিতে পড়ান, বিষয়-ভিত্তিক দক্ষতার অভাব, আলাদা করে কোনও প্রধানশিক্ষক নেই, এবং খেলার মাঠ, সীমানা প্রাচীর তথা গ্রন্থাগারের অভাব।
তবে পুরনামানাতিরার মা-বাবারা এ ব্যাপারে সহমত যে উপরোক্ত সুযোগ-সুবিধাগুলি অবশ্য চাইলেই তাঁদের গাঁয়ের পাঠশালায় যোগ করা যেত।
চাকুয়ার ইস্কুলে আদৌ কোনও গ্রন্থাগার আছে কিনা সেটা হলফ করে কেউই বলতে পারলেন না। তবে হ্যাঁ, বাউন্ডারি ওয়াল একখান আছে, যেটা কিনা তাঁদের পুরোনো পাঠশালায় ছিল না।
ওড়িশায় বর্তমানে সাথ-ইর তৃতীয় পর্যায় চলছে। ‘সংযুক্তিকরণের’ নিশানায় মোট ১৫,০০০টি বিদ্যালয় রয়েছে।
*****
নীলচে রঙের স্কুলের উর্দি পরে চড়াই পথে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে বড়াবাঁকির ঝিল্লি দেহুরি। গ্রামে এক মস্ত আমগাছের ছায়ায় কমলা রঙের ত্রিপল পেতে জড়ো হয়েছেন গ্রামবাসীরা, ইস্কুল সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। সবার শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছল ঝিল্লি।
বড়াবাঁকির প্রাথমিক ও উচ্চ-প্রাথমিক স্তরের পড়ুয়ারা ৩.৫ কিলোমিটার দূর জামুপাসির পাঠশালায় যেতে বাধ্য হয়। কিশোর বেহেরা জানালেন, ভরদুপুরের রোদ্দুরে হেঁটে বা সাইকেলে যেতে বড্ড কষ্ট হয় বাচ্চাগুলোর। অতিমারির পর ২০২২ সালে তাঁর ভাইয়ের মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু ইস্কুলে যেতে গেলে এমন তেপান্তর পেরোতে হয়, সেটা সে জানত না। এই তো, গত সপ্তাহেই বাড়ি ফিরতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল মেয়েটি। জামুপাসির লোকজন তখন মোটরসাইকেলে করে তাকে বাড়ি দিয়ে যায়।
কিশোরের কথায়, “আমাদের বাচ্চাকাচ্চাদের হাতে মোবাইল ফোন নেই। বিপদ-আপদের জন্য মা-বাবার ফোন নম্বর নিয়ে রাখার প্রথাটাও এখানকার ইস্কুলে নেই।”
জাজপুর জেলার সুকিন্দা ও দানাগাডি ব্লক জুড়ে, প্রত্যন্ত সব গ্রাম থেকে অসংখ্য মা-বাবারা জানালেন, সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়াটা ঠিক কতখানি বিপজ্জনক। ঘন জঙ্গল ঠেঙিয়ে, ব্যস্ত রাজপথ ধরে হেঁটে, রেললাইন টপকিয়ে, খাড়াই পাহাড় বেয়ে নেমে, মরসুমি নদীনালার জলে প্লাবিত পথ পেরিয়ে তবেই পৌঁছনো যায় বিদ্যালয়ে — মাঝে পড়ে জংলি কুকুর ভর্তি গ্রাম আর এমন সব মাঠ যেখানে অহরহ হানা দেয় হাতির পাল।
সাথ-ইর রিপোর্ট বলছে: বন্ধের জন্য তালিকাভুক্ত ইস্কুল আর সম্ভাব্য নতুন ইস্কুলের দূরত্ব বুঝতে ব্যবহৃত হয়েছে ভৌগলিক তথ্য রীতি বা জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস)। তবে খাতায়-কলমে জিআইএস-ভিত্তিক অংক আর রক্তমাংসের বাস্তব, দুইয়ের মাঝে বিস্তর ফারাক।
দূরত্ব বা রেললাইন টপকানো ছাড়াও দুশ্চিন্তার অনেক কারণ আছে মায়েদের, জানালেন গীতা মালিক। ইনি পুরনামানাতিরার পঞ্চায়েতের একজন প্রাক্তন ওয়ার্ড সদস্য। “ইদানিং আবহাওয়া বড্ড খামখেয়ালি হয়ে পড়েছে। বর্ষকালে ঝলমলে রোদ থাকে সকালবেলায়, অথচ ইস্কুল ছুটি হওয়ার সময় ঝড়ঝাপটা শুরু হয়। এমনতর অবস্থায় একটা বাচ্চাকে কেমন করে দূরগাঁয়ে পাঠাই বলুন তো?”
দুই সন্তানের মা গীতা। বড়োটির বয়স ১১, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে, ছোটোটি ৬ বছরের, সদ্য সদ্য পাঠশালার চৌকাঠ ডিঙিয়েছে। পরিবারের প্রত্যেকেই ভাগচাষি, তাই ছেলেদের জন্য সুন্দর একটি ভবিষ্যতের আশা করেন গীতা। তারা যেন নিজের রোজগারে শালিজমি কিনে উঠতে সক্ষম হয়।
আমগাছের নিচে জড়ো হওয়া মা-বাবাদের প্রত্যেকেই স্বীকার করলেন, গাঁয়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বন্ধ হওয়ার পর থেকে ওঁদের সন্তানেরা হয় ক্লাস করা ছেড়েই দিয়েছে কিংবা কস্মিনকালে ইস্কুলে যায়। একেকজন তো মাস ১৫ দিন অবধি পাঠশালার ছায়াও মাড়ায় না।
পুরনামানাতিরার বিদ্যালয়টিতে একটি অঙ্গনওয়াড়িও ছিল ৬ বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য। কিন্তু ইস্কুলটি উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটিকেও ৩ কিলোমিটার দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
*****
অনেকের কাছেই গ্রামীণ পাঠশালা প্রগতির প্রতীক; সম্ভাবনা ও বাস্তবায়িত আকাঙ্খার টোটেম।
পেশায় শ্রমিক মাধব মালিক ষষ্ঠ শ্রেণির বেশি পড়ার সুযোগ পাননি। ২০১৪ সালে পুরনামানাতিরা গাঁয়ে পাঠশালার আবির্ভাব ঘটলে তিনি ভেবেছিলেন, দুই ছেলে মনোজ ও দেবাশিসের আগামী দিনগুলো নিশ্চয় সুখকর হবে। “ইস্কুলটার খুব যত্ন নিতাম আমরা, আমাদের আশা-ভরসা সবকিছুর প্রতীক ছিল ওটা।”
ফটকে চিরতরে তালা পড়ে যাওয়া এই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির কক্ষগুলি আজও ঝাঁ চকচকে। নীল-সাদা দেওয়ালে ঝুলছে ওড়িয়া বর্ণমালা, সংখ্যা ও ছবি-আঁকা চার্ট। একটি দেওয়ালে অঙ্কিত রয়েছে ব্লাকবোর্ড। ক্লাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর, গ্রামবাসীরা ঠিক করেন যে কৌম প্রার্থনার জন্য এর চাইতে পবিত্র স্থান আর হয় না — তাই একখানি কক্ষ আজ রূপান্তরিত হয়েছে কীর্তনের জন্য, সব্বাই জড়ো হন এখানে। একদিকের দেওয়ালে সাজানো রয়েছে পিতলের পাত্র ও দেবতার ছবি।
ইস্কুলবাড়ির যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের সন্তানসন্ততি যাতে ঠিকমতন পড়াশোনা করে উঠতে পারে, সে ব্যাপারেও বদ্ধপরিকর পুরনামানাতিরার মানুষজন। গ্রামের প্রতিটি পড়ুয়ার জন্য টিউশনির ইন্তেজাম করেছেন তাঁরা — ২ কিলোমিটার দূর একটি গ্রাম থেকে সাইকেলে চেপে আসেন শিক্ষক। দীপকের কথায়, বৃষ্টিবাদলার দিনে প্রধান সড়কে জল জমলেও পড়াশোনা যাতে থমকে না দাঁড়ায়, তাই তিনি কিংবা গাঁয়ের অন্য কেউ মোটরবাইকে চেপে সেই শিক্ষককে আনতে যান। টিউশনির ক্লাস কিন্তু সেই পুরোনো পাঠশালাতেই হয়, পরিবার-পিছু ২৫০-৪০০ করে টাকা পান শিক্ষক।
“যাবতীয় লেখাপড়া সব এখানেই হয়, এই টিউশনির ক্লাসে,” জানালেন দীপক।
বাইরে, টকটকে আগুনরঙা পলাশের ক্ষীণ ছায়ায় গ্রামবাসীরা এখনও আলোচনায় মত্ত — ইস্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থটা যে কতখানি সুদূরপ্রসারী, সে ভাবনাতেই ব্যস্ত তাঁরা। বর্ষাকালে ব্রাহ্মণী নদীতে বান ডাকলে পুরনামানাতিরা থেকে যাতায়াত করাটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। দিনের পর দিন থাকে না বিজলি, অসুখ-বিসুখ হলে আসতে পারে না অ্যাম্বুল্যান্স — এ সবেরই অভিজ্ঞতা আছে তাঁদের।
“মনে হচ্ছে ইস্কুলটা উঠে যাওয়ার মানে আমরা ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছি, যেন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠবে,” বলে উঠলেন মাধব।
সাথ-ই প্রকল্পে কেন্দ্র সরকারের জুড়িদার বস্টন কন্সালটিং গ্রুপ নামের একটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা সংস্থা। তাদের মতে এটি “ মহতী একটি শিক্ষা রূপান্তর কার্যক্রম ”, যার ফলে ইতিমধ্যেই নাকি লেখাপড়ায় উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে।
অথচ জাজপুরের এই দুটি ব্লকের একের পর এক গ্রাম সহ সমগ্র ওড়িশার মা-বাবারা জোরগলায় বলছেন, এভাবে ইস্কুলে ইস্কুলে তালা পড়ার ফলে পড়াশোনা বস্তুটাই আস্তে আস্তে হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
গুন্দুচিপাসি গাঁয়ের পাঠশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। সুকিন্দা ব্লকের খরড়ী পাহাড়িয়া-বনের মাঝে অবস্থিত এই গ্রামের প্রত্যেকেই শবর (সবর বা সভর বলেও পরিচিত) জনগোষ্ঠীর মানুষ, এ রাজ্যে তাঁরা তফশিলি জনজাতির তালিকাভুক্ত। উপরোক্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে অবধি এখানকার ৩২টি বাচ্চা পড়তে যেত সেখানে।
লকডাউনের পর ইস্কুল-টিস্কুল সব খুলল বটে, কিন্তু ক্লাস করতে পাশের খরড়ী গ্রামে যেতে বাধ্য হত পড়ুয়ারা। বনজঙ্গল ঠেঙিয়ে হাঁটলে মোটে এক কিলোমিটারের রাস্তা। প্রধান সড়ক দিয়েও যাওয়া যায় বটে, কিন্তু যানবাহন চলাচলে সেটা এমনই ব্যস্ত যে কচিকাঁচাদের পক্ষে ও পথ না মাড়ানোই ভালো।
পাঠশালায় হাজিরা আজ তলানিতে ঠেকেছে, তবে এটা যে নেহাতই নিরাপত্তা ও মিড-ডে মিলের মধ্যে টানাপোড়েন — সেকথা স্বীকার করলেন গুন্দুচিপাসির বাবা-মায়েরা।
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইস্কুলের পথে হাঁটা লাগায় দ্বিতীয় শ্রেণির ওম দেহুরি আর প্রথম শ্রেণির সূর্যপ্রকাশ নাইক। খাবারদাবার বা খাবার কেনার চাট্টি পয়সা — থাকে না কিছুই, শুধু প্লাস্টিকের বোতলে ভরা থাকে পানি। ওই একই ইস্কুলে যেতে ঘণ্টাখানেক লাগিয়ে দেয় তৃতীয় শ্রেণির রানি বারিক, অবশ্য তার জন্য দায়ী গড়িমসি আর পিছনে থাকা বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা।
ছয় দশক পার করেছে যে বিদ্যালয়, তার দুয়ারে তালা মেরে বাচ্চাদের জঙ্গল পেরোতে বাধ্য করাটা যে কতটা অর্থহীন, জোরগলায় সেকথা জানালেন রানির ঠাম্মা বাকোতি বারিক: “কুকুর আর সাপখোপ তো আছেই, মাঝেসাঝে তো এক-আধটা ভালুকও দেখা দেয় — আপনিই বলুন, আপনাদের শহুরে মা-বাবারা সত্যিই বিশ্বাস করেন যে এভাবে ইস্কুলে যাওয়া নিরাপদ?”
নিতান্তই যারা পুঁচকে, তাদের নিয়ে পাঠশালায় যাতায়াত করার দ্বায়িত্বটা আপাতত ৭ম ও ৮ম শ্রেণির পড়ুয়ারাই সামলাচ্ছে। তবে দুই খুড়তুতো-বোন ভূমিকা ও ওম দেহুরিকে সামলাতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে ক্লাস সেভেনের শুভশ্রী বেহেরা। তার কথায়, “ওরা মোটেও সবসময় আমাদের কথা কানে দেয় না। হঠাৎ করে দৌড় লাগালে, একসঙ্গে দুজনের পিছু নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।”
নতুন বিদ্যালয়ে হেঁটে যায় দিনমজুর মামিনা প্রধানের দুই সন্তানও — সপ্তম শ্রেণির রাজেশ পঞ্চম শ্রেণির লিজা। নিজের বাড়িতে বসে আমাদের দিকে সওয়াল ছুঁড়ে দিলেন মামি: “এক ঘণ্টা ধরে হেঁটে মরে আমার খোকাখুকি, কিন্তু আদৌ আর কোনও উপায় আছে আমাদের?” ভিটেখানি তাঁর ইট আর খড় দিয়ে গাঁথা, ছাদ বলতে খড়ের ছাউনি। চাষের মরসুম এলে স্বামী মাহান্তোর সঙ্গে অন্যের জমিতে খাটতে যান তিনি, বাকি বছরটা চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজের খোঁজে কাটে।
গুন্দুচিপাসির পাঠশালায় শিক্ষার মান যে অনেকটাই উচ্চকোটির ছিল, এ বিষয়ে বাবা-মায়েরা একমত। গাঁয়ের মোড়ল, ৬৮ বছর বয়সি গোলকচন্দ্র প্রধানের বক্তব্য: “ওখানে আমাদের বাচ্চাকাচ্চাদের ক্লাসরুমের [নতুন ইস্কুলের] এক্কেবারে পিছনের দিকে বসতে হয়। অথচ এখানকার স্যার-ম্যাডামরা প্রত্যেকটা বাচ্চার দিকে আলাদা আলাদা করে মনোযোগ দিতেন।”
সুকিন্দা ব্লকে গুন্দুচিপাসির কাছেই সান্তারাপুর গ্রাম, ওখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ২০১৯ সালে তুলে দেওয়া হয়েছে। পড়ুয়ারা তাই বাধ্য হয়ে ১.৫ কিলোমিটার হেঁটে হেঁটে জামুপাসির ইস্কুলে যায়। জংলি কুকুরের তাড়া খেয়ে একটি দীঘির জলে পড়ে গিয়েছিল ১১ বছরের শচিন মালিক। তার বড়দা সৌরভ জানাচ্ছেন, “২০২১ সালের শেষ নাগাদ এটা ঘটেছিল। ভাইয়ের থেকে বয়সে বড়ো দুটো ছেলে মিলে ওকে বাঁচায়, নইলে ডুবেই মরত, তবে সব্বাই এমন ঘাবড়ে গেছল যে তারপর বেশ কয়েকদিন গাঁয়ের অনেকগুলো বাচ্চা আর ইস্কুলের ছায়াও মাড়ায়নি।” ২১ বছর বয়সি সৌরভ ১০ কিলোমিটার দূর ডুবুরি গাঁয়ের একটি ইস্পাত কারখানায় সহায়কের কাজ করেন।
জামুপাসির পাঠশালায়, মিড-ডে মিল রান্নায় সহকারী-পাচকের কাজ করেন লাবণ্যা মালিক। সান্তারাপুর-জামুপাসির রাস্তায় জংলি কুকুরের পাল যে প্রাপ্তবয়স্কদেরও ছেড়ে কথা কয় না, যখন তখন হামলা করে, সেটা জানা গেল এই স্বামীহারা মহিলার কাছ থেকে, “১৫-২০টা কুকুরের দঙ্গল। ওদের তাড়া খেয়ে একবার মুখ থুবড়ে পড়েছিলাম, ব্যাটারা আমার উপর দিয়ে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে চলে গেল। একটা তো আমার পায়ে কামড়েই দিল।”
৯৩টি গেরস্থালি মিলিয়ে সান্তারাপুর গ্রাম। অধিকাংশই তফশিলি জাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতিসমূহের মানুষ। এখানকার প্রাথমিক পাঠশালায় যখন তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, তখন ২৪টি বাচ্চা পড়ত সেখানে। আজ মোটে ৮-১০জন নিয়মিত হাজির হয় ক্লাসে।
এ গ্রামেরই গঙ্গা মালিক ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে জামুপাসির পাঠশালায়। বাবা সুশান্ত মালিক পেশায় দিনমজুর। জঙ্গলাকীর্ণ শুঁড়িপথের ধারে একটি মরসুমি দীঘি আছে, একদিন ইস্কুল যেতে গিয়ে সেখানে পড়ে যায় গঙ্গা। তারপর থেকে ক্লাস করাই ছেড়ে দিয়েছি মেয়েটি। সেদিনের কথা মনে করে সুশান্ত বললেন, “বেচারি দীঘির জলে মুখ ধুচ্ছিল, হঠাৎ পা হড়কে পড়ে যায়। শেষমেশ লোকজন উদ্ধার করেছিল বটে, কিন্তু আরেকটু হলেই ডুবে যেত গো আমার মেয়েটা। তারপর থেকে আকছার ইস্কুল ফাঁকি দিতে শুরু করল।”
গঙ্গা ফাইনাল পরীক্ষাটা পর্যন্ত দিতে যাওয়ার সাহস জোগাতে পারেনি বটে, কিন্তু সে বলছে, “দেখলাম যে দিব্যি আমায় পাশ করিয়ে দিয়েছে।”
সহায়তার জন্য অ্যাস্পায়ার ইন্ডিয়ার কর্মীদের ধন্যবাদ জানাচ্ছেন প্রতিবেদক।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)