পটলপুর গ্রামের সবেধন নীলমণি অন্তিম কৃষক উজ্জ্বল দাসের পিঠ ঠেকেছে দেওয়ালে। আক্ষরিক অর্থেই।
২০২২ সালের অক্টোবর মাসে উজ্জ্বল দাসের বাড়ির দেওয়াল ভেঙে দেয় হাতির দল। বিগত দশ বছরে এই নিয়ে আটবার ক্ষুধার্ত হাতির দল পটলপুর গ্রামে তাঁর ভিটেবাড়ির মাটির দেওয়াল গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।
সেটা ফসল তোলার সময় – আষাঢ় এবং শ্রাবণ মাস। পাহাড় ঘেরা এই গ্রামে পৌঁছতে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে, পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে হাজির হয়েছিল হাতির দল। ময়ূরাক্ষীর শাখা নদী সিদ্ধেশ্বরী নদীর তীরে প্রথমে খানিক জিরিয়ে নিয়ে ক্ষুধার্ত হাতির দল পৌঁছায় ফসলের খেতে। এখান থেকে গ্রাম মাত্র এক কিলোমিটার দূরে। অতটা পথ পেরিয়ে স্বভাবতই তাদের পেটে তখন খিদে, সোজা হানা দিয়েছিল তারা ফসল ভরা জমিতে।
“অনেকবার এইরকম হয়েছে যে হাতি এসে জমিতে [পাকা] ধান নষ্ট করছে। সেই সময় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমরা মশাল হাতে নিয়ে ধান খেতে হাতি তাড়াতে গিয়েছি,” বললেন চন্দনা এবং উজ্জ্বল দাসের ছোটো ছেলে প্রসেনজিৎ। “হাতিতে যদি ফসল খেয়ে নেয়, তাহলে আমরা কী খাব?”
চিন্তা শুধু ধান নিয়েই নয়। ১৪ বিঘা (আন্দাজ ৮.৬ একর) জমিতে প্রসেনজিৎদের পরিবার চাষ করেছে আলু, কুমড়ো, টমেটো, লাউ, কলা আর পেঁপে।
মোটেই সাদামাটা কৃষক নন উজ্জ্বল দাস। কুমড়ো চাষ করে তিনি রাজ্য সরকারের থেকে ‘কৃষক রত্ন’ পুরস্কার পেয়েছেন। রাজ্যের প্রতিটা ব্লক থেকে সেরা কৃষককে প্রতি বছর এই সম্মান জানানো হয়। ২০১৬ এবং ২০২২ সালে রাজনগর ব্লক থেকে পুরস্কার পেয়েছেন উজ্জ্বল দাস – একটি স্মারকপত্র এবং ১০,০০০ টাকা।
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে একটি ছোট্ট গ্রাম পটলপুরে তাঁদের বাড়ি। ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ঝাড়খণ্ডের সীমানা। প্রত্যেক বছর এই গ্রামে খাদ্যের সন্ধানে নেমে আসে হাতির দল। প্রথমে নিকটবর্তী পাহাড়ের জঙ্গলে অপেক্ষা করে থাকে। তারপর পাহাড়ের সব থেকে কাছের খেতে হানা দেয়।
তাদের রাস্তার প্রথমদিকেই পড়ে পটলপুর। হাতিদের আগমনের চিহ্ন গ্রামের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে – পরিত্যক্ত ভাঙা বাড়ি, ভাঙা তুলসিমঞ্চ, শূন্য উঠোন।
বারো-তেরো বছর আগে হাতিরা যখন প্রথম আসতে শুরু করে, সেই সময়ে এই গ্রামের মোট জনসংখ্যা ছিল ৩৩৭ (২০১১ সালের আদমসুমারি)। তারপরের দশকে সংখ্যাটা শুধুই কমেছে। এখন রাজনগর ব্লকের অন্তর্গত এই গ্রামে ভিটে আঁকড়ে পড়ে আছেন শুধু একটি পরিবারের সদস্যরা। হাতিদের তাণ্ডবে বিপর্যস্ত এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গ্রামের মানুষ নিরাপত্তার জন্য বাধ্য হয়েছেন আশেপাশের গ্রাম বা শহরে চলে যেতে। পটলপুরের প্রতিবেশী গঞ্জ ও শহরের মধ্যে রয়েছে সিউড়ি, রাজনগর এবং জয়পুর।
“যাদের সামর্থ্য আছে, তারা অন্য গ্রামে চলে গেছে,” তাঁদের একতলা মাটির বাড়ির উঠোনে বসে বলছিলেন উজ্জ্বল দাস। “আমার বড়ো সংসার। এই সংসার নিয়ে বাইরে কোথাও যাওয়ার মতো জায়গা আমার নেই। বাইরে গিয়ে কী খাব?” প্রশ্ন ৫৭ বছর বয়সি উজ্জ্বল দাসের। গ্রামের অন্যান্য বাসিন্দাদের বেশিরভাগের মতো উজ্জ্বল দাসের পরিবারের সদস্যরা ওবিসি তালিকাভুক্ত বৈরাগী সম্প্রদায়ের মানুষ।
চন্দনা দাস, ৫৩, জানালেন, হাতির গর্জন শুনতে পেলেই তাড়াতাড়ি রান্না সেরে পাশের গ্রাম, পাঁচ কিলোমিটার দূরে জয়পুরে চলে যান তাঁরা। আর যদি সেটা না পারেন তাহলে, বলছেন চন্দনা দাস, “সবাই একসঙ্গে বাড়ির মধ্যে ঢুকে থাকি।”
পটলপুরে পড়ে থাকা একমাত্র পরিবারের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন যে অন্য সমস্যাও রয়েছে। গাংমুড়ি-জয়পুর পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এই গ্রামে পৌঁছনোর রাস্তা জঙ্গলের কাছাকাছি হওয়ায় বেশ দুর্গম। তার ওপরে হাতির উৎপাত শুরু হওয়ার পর থেকে এখানে আর কেউ জমি কিনতে চায় না। “তাই সব বিক্রি করে দিয়ে চলে যাওয়াও খুব সহজ নয়,” বললেন উজ্জ্বল দাস।
এই পরিবারের অন্য সদস্যরা হলেন উজ্জ্বল দাসের স্ত্রী চন্দনা দাস এবং তাঁদের দুই ছেলে – চিরঞ্জিৎ আর প্রসেনজিৎ। এক মেয়ে বৈশাখীর বিয়ে হয়ে গেছে দশ বছর আগে। তিনি এখন সাইঁথিয়ায় থাকেন, পটলপুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে।
সাতাশ বছর বয়সি প্রসেনজিৎ দাসের নিজস্ব একটি মারুতি গাড়ি রয়েছে। আশেপাশের গ্রামের মানুষকে গাড়িটি ভাড়া দিয়ে মাসে আন্দাজ ১০,০০০ টাকা রোজগার হয় বলে জানালেন তিনি। পরিবারের অন্যদের মতো এর পাশাপাশি নিজেদের জমিতে চাষের কাজও করেন প্রসেনজিৎ। চাষের জন্য বৃষ্টির ওপরেই নির্ভরশীল তাঁরা। ফসলের কিছুটা নিজেদের জন্য রেখে বাকিটা বিক্রি করেন উজ্জ্বল দাস। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতি আর রবিবার করে রাজনগরের হাটে যান তিনি। বাকি দিনগুলো বড়ো ছেলে চিরঞ্জিতের মোটর সাইকেলে বা নিজের সাইকেলে সবজি ফেরি করেন গ্রাম থেকে গ্রামে। তাছাড়া ধান চাষ করে যে চাল পাওয়া যায় তার থেকে নিজেদের খোরাকির মতো ধান সরিয়ে বাকিটা বিক্রি করেন।
“হাতির আক্রমণ সহ্য করতে হলে তাই সই, এই ফসলের মায়া ছেড়ে আমি যেতে পারব না,” বললেন উজ্জ্বল দাস। গ্রাম যেতে একটুও ইচ্ছে করে না তাঁর।
রাজনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ইতিহাস শিক্ষক সন্তোষ কর্মকার বলছেন যে এই কৃষিপ্রধান অঞ্চলে হাতি আসে পুরুলিয়ার দলমা পাহাড় থেকে ঝাড়খণ্ড হয়ে খাদ্যের সন্ধানে। আগে এই পাহাড়ে গাছপালার ঘন আচ্ছাদন ছিল। ফলত হাতিদের খাদ্যের কোনও অভাব হত না।
সন্তোষ কর্মকার বলছেন, “হাতিরা আজ বিপন্ন। খাদ্যের জন্য, নির্জনতার জন্য তারা পাহাড় থেকে নেমে আসছে।” তাঁর মতে গত ২০-২৫ বছরে বিলাসবহুল রিসোর্ট বানানোর উদ্দেশ্যে ক্রমাগত কেটে সাফ করা হয়েছে জঙ্গল। এতে একদিকে যেমন তাদের খাবার কমে গেছে, অন্যদিকে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় হাতিদের বাসস্থান ঘিরে একধরনের নিরাপত্তাহীনতাও তৈরি হয়েছে।
প্রসেনজিৎ জানাচ্ছেন এই বছর (২০২৩) এখনও হাতিদের এই গ্রামে দেখা যায়নি। কিন্তু চিন্তা থেকেই যায়। তাঁর কথায়, “এখন যদি হাতি আসে তাহলে সমস্ত কলাবাগান শেষ করে দেবে।” প্রায় ১০ কাঠা জমির ওপর কলাবাগান আছে প্রসেনজিৎদের।
পশ্চিমবঙ্গের বন দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী বন্য প্রাণীর আক্রমণে ফসল নষ্ট হলে রাজ্য সরকারের থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। উজ্জ্বল দাসের নিজের নামে ৪ বিঘা জমি আছে। কিন্তু বাকি ১০ বিঘা জমির কোনও দলিল নেই। কাজেই সেই জমির ফসল হাতিরা খেয়ে নিলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় না। উজ্বল দাস বললেন, “হাতিতে যদি কুড়ি হাজার বা তিরিশ হাজার টাকার ফসল নষ্ট করে, তাহলে সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাওয়া যায় ৫০০ থেকে ৫০০০-এর মধ্যে একটা অংকের টাকা।”
২০১৫ সালে ক্ষতিপূরণের আবেদন জানিয়ে রাজনগরের ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকের থেকে ৫০০০ টাকা পেয়েছিলেন পটলপুরের এই কৃষক। তার তিনবছর পর, ২০১৮ সালে এক স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা তাঁকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০০ টাকা দেন।
গ্রামবাসীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গে রাজনগরের স্থানীয় বনবিভাগের ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জার কুদরতে খোদা বলছেন যে তাঁরা সবরকম সতর্কতা অবলম্বন করেন। তাঁর কথায়, “আমাদের ‘ঐরাবত’ নামে একটা আধুনিক গাড়ি রয়েছে। সেই গাড়িতে সাইরেন বাজিয়ে আমরা হাতি তাড়াই। হাতির শরীরে কোনওরকম আঘাত না করে শুধুমাত্র সাইরেন বাজিয়েই আমরা হাতি তাড়িয়ে থাকি।”
এছাড়াও আছে গজমিত্ররা। পটলপুর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরের গ্রাম বাগানপাড়া। সেখানকার পাঁচজন গ্রামবাসী বন বিভাগের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে হাতি তাড়ানোর কাজ করে থাকেন। হাতি এলে বন বিভাগকে খবরও তাঁরাই পাঠান।
কিন্তু পটলপুরের অন্তিম বাসিন্দারা মোটেই এই কথার সঙ্গে একমত নন। চন্দনা দাস বলছেন, “বন বিভাগ থেকে কোনও সাহায্যই আমরা পাই না।” আজ যে পটলপুরে পরিত্যক্ত ঘর-বাড়ি, শূন্য উঠোন পড়ে আছে, তার জন্য তাঁরা বন বিভাগকেই দুষছেন।