কোল্লিদাম নদীর তীর, বালিয়াড়ির বুকে ঘন হয়ে আসতে থাকা আঁধারে পর পর গল্প শুনিয়ে যাচ্ছিলেন কৃষক ভাডিভেলান । মিনিট দশেক দূরেই শ্রীরঙ্গমে তাঁর তিলখেত। কতশত গল্প – ১৯৭৮ সালে তাঁর জন্মের ১২ দিন পর কেমন দুকূল ভাসিয়েছিল এই স্রোতস্বিনী, বা তাঁর গাঁয়ের কথা, যেখানে সব্বাই এল্লু (তিল) ফলায়। সুগন্ধী মধুরঙা তেল বেরোয় এই বীজ পিষলে। কিংবা ‘পানিতে ভাসমান খানদুই কলাপাতা আঁকড়ে ধরে’ সাঁতার শেখার কাহিনি, প্রিয়ার প্রেমে পড়ার স্মৃতি। তিনি থাকতেন কাবেরী নদীর পাড়ে, কোল্লিদাম যার কাছে নস্যি। হবু শ্বশুরের হাজার ওজর-আপত্তি সত্ত্বেও প্রিয়ার সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধেন ভাডিভেলান। আর তাঁদের দেড় একর জমিনে ধান, আখ, মাসকালাই ও তিল ফলানোর গল্প তো আছেই...
প্রথম তিনটে ফসল খানিকটা হলেও ঘরে টাকা আনে। “ধান বেচে যেটুকু রোজগার করি, সেটা দিয়ে আখ চাষ করি, লাঙল দিয়ে চষে পয়সাকড়ি সব মাটিতেই ফিরে যায়,” ভাডিভেলান বুঝিয়ে বললেন। কাঠের ঘানিতে পেষার পর প্রকাণ্ড একখানি ঘড়ায় ভরে রাখা হয় নাল্লেনাই (জিঞ্জেল্লি বা তিলের তেল)। “আমরা রান্নায় ব্যবহার করি, আচার বানাই,” বললেন প্রিয়া, “ও, আর উনি রোজরোজ কুলকুচি করেন এটা দিয়ে।” পাশ থেকে একগাল হেসে ভাডিভেলান যোগ করলেন, “আর তেল মেখে চান, ওটা যে আমার বড্ড প্রিয়!”
ভাডিভেলান অনেক কিছুই ভালোবাসেন, তবে প্রত্যেকটাই বেশ সহজ-সরল সাদামাটা। বাল্যকালে নদীতে মাছ ধরা, টাটকা ধরা মাছ বন্ধুদের সঙ্গে ঝলসে খাওয়া, পঞ্চায়েত প্রধানের ঘরে টিভি দেখা — সে যুগে টিভি বলতে গাঁয়ে শুধু ওইটিই ছিল। “আরে টিভি দেখতে এত ভাল্লাগত যে যন্তরটা কাজ না করলে যে ‘উঁইইই’ শব্দ করত, সেটাও মন দিয়ে শুনতাম!”
কিন্তু, দেখতে দেখতে স্মৃতিচারণের সোনালি রোদ্দুটাও কেমন গোধূলির সঙ্গে ফিকে হয়ে এল... “শুধু খেতিবাড়ির ভরসায় আর বাঁচা যায় না,” বুঝিয়ে বললেন আমায়, “আমি ট্যাক্সিও চালাই, তাই টিকে আছি।” শ্রীরঙ্গম তালুকের তিরুভালারসোলাইয়ে তাঁর বাড়ি থেকে ভাডিভেলান টয়োটা এটিওসে চেপেই তো নদীর পাড়ে এসেছি। বেসরকারি এক মহাজনের থেকে ৮ শতাংশ সুদে টাকা ধার করে গাড়িটা কিনেছিলেন, মাসে মাসে কড়কড়ে ২৫,০০০ টাকা গুনতে হয়। জীবন তাঁদের অভাব-অনটনে ভরা, দম্পতিটি জানাচ্ছেন। অভাব তুঙ্গে উঠলে সোনাদানা বন্ধক রেখে পেট চালান। “দেখুন, আমাদের, মতো ইনসান যদি বাড়ি বানাতে ব্যাংকের থেকে কর্জ নেয়, এমন ছোটাছুটি করাবে যে দশজোড়া চপ্পল খয়ে যাবে,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ভাডিভেলান।
আকাশটা ততক্ষণে তেলরঙা ছবি হয়ে উঠেছে: গোলাপি, নীল, কালো। না জানি কোত্থেকে একটা ময়ূর ডেকে উঠল। “এ নদীতে উদবেড়াল আছে,” জানালেন ভাডিভেলান। কাছেই নদীতে লাফ কেটে সাঁতরে বেড়াচ্ছিল কয়েকটি বাচ্চাছেলে, ভোঁদড়ের চেয়ে কোনও অংশে কম নয় তারা। “আমিও তো এমনটাই করতাম, বড়ো হওয়ার সময় এখানে আমোদ-আহ্লাদের আর কোনও উপায় ছিল না।”
ভাডিভেলান অবশ্য নদ-নদীর উপাসনাও করেন। “প্রতিবছর আদি পেরুক্কু পরবের দিন — তামিল মাস আদির ১৮তম দিবস — আমরা সব্বাই মিলে কাবেরীর তীরে যাই। নারকেল ভেঙে, কর্পূর জ্বালিয়ে, ফুল চড়িয়ে প্রার্থনা করি।” বোধহয় তার প্রতিদান রূপেই কাবেরী ও কোল্লিদামের (কোলেরূন) বরকতে শস্য-শ্যামলা হয়ে ওঠে তাঁদের চাষজমি। এই কিসসা আজ ২,০০০ বছর ধরে বহমান।
*****
চড়ায়ে তিলের নাড়ু, সিজা-ভিজা ডাল,
তারই পাশে মাংস মেশানো কতি চাল,
ধূপ, ধুনো, ফুল-মালা, টাটকা সে ভাতে —
জোড়হাতে মাইয়ারা নাচে একসাথে,
সুন্দরী বুড়ি তার আশীষের শেষে
রেখে গেল কথা কিছু ইতি ভালোবেসে:
“আমাদের মহারাজা, বরকতে তার
থাকিবে না খিদে, রোগ, বৈরিতা আর;
মোদের মুলুকে যেন বাদলাধারায়
সোনাদানা ফলে শুধু, এটুকুই চাই।”
দ্বিতীয় শতকে লেখা তামিল মহাকাব্য সিলাপ্পাথিকারমের এই ইবাদতের আচারটি “আজও প্রায় একই ভাবে পালিত হয় তামিলনাড়ুতে,” তাঁর ওল্ড তামিল পোয়েট্রি ব্লগে এমনটাই লিখছেন চেন্থিল নাথন [কবিতা: ইন্দিরা ভিরাভু, পংক্তি ৬৮-৭৫]।
এল্লু (তিল) একাধারে প্রাচীন ও মামুলি। নানান কাজে আসে এ ফসল। দক্ষিণ ভারতের রান্নাবান্নায় নাল্লেনাই, অর্থাৎ তিলের তেল বহুল প্রচলিত। দেশি ও বিদেশী — অনেক ধরনেরই রান্নায় ব্যবহৃত হয় তিল। খুদে খুদে সাদা-কালো এই বীজের কৃপায় স্বাদু হয়ে ওঠে মশলাদার খাদ্য। তাছাড়া বিভিন্ন আচার-উপাচার, বিশেষত যেখানে পূর্বজদের স্মরণ করা বা পুজো করা হয়, তার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই বীজ।
তিলে ৫০ শতাংশ তেল, ২৫ শতাংশ প্রোটিন ও ১৫ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট থাকে। তিল ও রামতিল (নাইজের) নিয়ে ভারতীয় কৃষি-গবেষণা সমিতির (আইসিএআর বা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ) একটি প্রকল্প মোতাবেক এটি, ‘শক্তির ভাণ্ডার ও ই, এ, বি কমপ্লেক্স ভিটামিন তথা ক্যালশিয়াম, ফসফোরাস, লোহা, তামা, ম্যাগনেশিয়াম, দস্তা ও পটাশিয়ামে সমৃদ্ধ।’ সুতরাং এ শস্য পেষাই করে তেল বার করে নেওয়ার পর যেটা পড়ে থাকে, সেই এল্লু পুনাকু বা খইল যে উৎকৃষ্ট পশুখাদ্য, সেটা বোধহয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
‘দেশজ তৈলশস্যের মধ্যে সবচাইতে প্রাচীন তিল (সিসামাম ইন্ডিকাম এল.), ভারতে তিলচাষের ইতিহাস দীর্ঘতম।’ আইসিএআর প্রকাশিত এগ্রিকালচারাল হ্যান্ডবুক বলছে যে তিল উৎপাদনে ভারতই এক নম্বর, সারা বিশ্বে যেখানে যেখানে তিলচাষ হয়, তার ২৪ শতাংশ জমিই এ দেশে। তাছাড়া দুনিয়াভর তৈলবীজ চাষক্ষেত্রের ১২-১৫ শতাংশ, উৎপাদনের ৭-৮ শতাংশ ও ব্যবহারের ৯-১০ শতাংশ রয়েছে ভারতের ভাগে।
তবে এসব কিন্তু মোটেও হালে হালে ঘটেনি। ইন্ডিয়ান ফুড, আ হিস্টোরিকাল কম্পানিয়নের রচয়িতা কে.টি. আচায়া জানাচ্ছেন, তিল রপ্তানির যথেষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে।
সাধারণ অব্দের প্রথম শতাব্দী থেকেই দক্ষিণ ভারতের বন্দরে বন্দরে তিল লেনদেনের ঐতিহাসিক বর্ণনা মেলে। গ্রিক ভাষাভাষী এক নাম না জানা মিশরীয় নাবিক তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞাতার পরিপ্রক্ষিতে দ্য পেরিপ্লাস মারিস এরিথ্রেএয়ি (এরিথ্রেয়ান সাগর পরিক্রমা) গ্রন্থে সে ব্যবসার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণী তুলে দিয়েছেন আমাদের হাতে। অজ্ঞাতনামা এই লেখকের জবানে, সে যুগে কোঙ্গুনাড়ু (অধুনা তামিলনাড়ুর পশ্চিম ভাগ) থেকে বেশ কিছু বহুমূল্যবান সামগ্রী পাঠানো হত দেশ-দেশান্তরে — যেমন হাতির দাঁত, মসলিন, তিলের তেল ও সোনা। এর থেকেই বোঝা যায় এই তেলের মর্যাদা ঠিক কতখানি ছিল।
আচায়া লিখছেন, স্থানীয় ব্যবসায় বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছিল। মাঙ্কুড়ি মরুতানরের লেখা মাতুরাইক্কাঞ্চিতে উঠে এসেছে মাদুরাইয়ের সরগরম এক বাজারের চিত্র: ‘বস্তা বস্তা গোলমরিচ আর ধান, শামাধান (মিলেট), ছোলা, মটর ও তিলের মতো ১৬ রকমের শস্যদানার ঢিপি সাজানো আছে আনাজ বেনিয়ার গলিতে।’
তিলের তেল পৃষ্ঠপোষক হত রাজারাজড়ার দল। আচায়ার বইয়ে উল্লেখ রয়েছে দোমিঙ্গো পেজের, এই পর্তুগীজ বেনিয়াটি ১৫২০ সাল নাগাদ বেশ কয়েকবছর বিজয়নগরে বাস করেছিলেন। রাজা কৃষ্ণদেবরায়াকে নিয়ে পেজ লিখেছিলেন:
“রাজামশাইয়ের অভ্যেস, ভোরের আলো ফুটিবার অগ্রে এক পাঁইটের তিন-চতুর্থাংশ জিঞ্জেল্লি (তিল) তৈল পান করা, উক্ত তেল দিয়া তিনি অবগাহনও করিয়া থাকেন; ক্ষুদ্র একখানি কৌপিনে লজ্জা নিবারণ করিয়া দুই হস্তে বিশালবপু ওজন তুলিয়া লহেন, তাহার পরে স্বীয় তরবারি লইয়া ব্যায়াম করিতে থাকেন, যতক্ষণ না ঘর্ম দ্বারা উক্ত তৈল সম্পূর্ণরূপে না নির্গত হইতেছে।”
ভাডিভেলানের বাবা পালানিভেল বেঁচে থাকলে অবশ্য এককথায় সে রাজার কীর্তিকলাপ মেনে নিতেন। ছেলের মুখে বাবার বর্ণনা শুনে টের পেলাম, তিনি খেলাধূলার বিশেষভাবে অনুরাগী ছিলেন। “উনি খুবই সতর্ক ভাবে শরীরের কাঠামোটা বজায় রাখতেন। পাথর [ওজন] তুলতেন, নারকেল বাগানে কুস্তি শেখাতেন। সিলাম্বামেও [সঙ্গম সাহিত্যে উল্লিখিত তামিলনাড়ুর সুপ্রাচীন সামরিক শিল্পক্রীড়া] ওস্তাদ ছিলেন তিনি।”
কালেভদ্রে নারকেল তেল ছাড়া ভোজ্য তেল বলতে মূলত খেতের তিলই ইস্তেমাল করত ভাডিভেলানের পরিবার। দুটোই বড়োসড়ো পাত্রে মজুত করা থাকত। “খুব ভালো করে মনে আছে, বাবা একটা র্যালে কোম্পানির সাইকেল চালাতেন। ওটায় মাসকালাইয়ের বস্তা বেঁধে সিধে পৌঁছে যেতেন ত্রিচির গান্ধীবাজারে। ফিরে আসতেন লংকা, সর্ষে, গোলমরিচ আর তেঁতুল নিয়ে। কিছুটা পণ্যবিনিময়ের মতো। বছরভর ভাঁড়ার কখনও ফাঁকা থাকত না!”
*****
২০০৫ সালে, ত্রিচির কাছে ভায়ালুর মন্দিরে বিয়ে করেন ভাডিভেলান ও প্রিয়া। “বাবা আসেননি, বিয়েতে তাঁর মত ছিল না। ওদিকে আমার ইয়ার-দোস্তরা আরেক কাণ্ড করে বসেছিল! গাঁয়ে আত্মীস্বজনদের নিতে এসে ব্যাটারা সিধে আমার বাবাকে গিয়ে বিয়েতে যাবেন কিনা জিজ্ঞেস করে বসে। তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন তিনি,” বলতে গিয়ে অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন ভাডিভেলান।
ওঁদের বাড়ির হলঘরে বসেছিলাম আমরা, পাশেই একটি তাকে সাজানো দেবদেবীর ছবি। দেওয়ালে টাঙানো পারিবারিক তসবির, আর একটি টিভি। সময় পেলেই এই যন্তরটির সাহায্যে দুঃখকষ্ট থেকে ছুটি নেন প্রিয়া। আপাতত ওঁদের সন্তান দুটি এখানে নেই, স্কুলে গিয়েছে। পোষা কুকুরটা দেখলাম ল্যাজ নেড়ে আলাপ জমাতে এসেছে। ভাডিভেলান বললেন, “ওর নাম জুলি।” আমি “আহা, মেয়েটা বড্ড মিষ্টি দেখতে,” বলতেই দেখলাম অসন্তুষ্ট হয়ে জুলি পালিয়ে গেল। তখন পাশ থেকে মুচকি হেসে ভাডিভেলান জানান দিলেন, “ও ছেলে কুকুর!”
আমাদের খেতে ডাকলেন প্রিয়া, গিয়ে দেখি বড়াই ও পায়সম সহকারে রীতিমতো মহাভোজের আয়োজন করে ফেলেছেন। কাঁচকলার পাতায় খাবার পরিবেশন করলেন। আহা, বড়োই স্বাদু, পেট আইঢাই হওয়ার জোগাড়!
পাছে চোখ জুড়িয়ে আসে, তাই চটপট কাজের কথায় চলে এলাম। তিল চাষ করার অভিজ্ঞতা কেমন? “মাথা খারাপ হয়ে যায়,” উত্তর দিলেন ভাডিভেলান। কৃষি জিনিসটাই ওরকম, তাঁর মতে। “মুনাফা বলে কিছু নেই বললেই চলে। ইউরিয়ার আকাশ ছোঁয়া দাম, বাদবাকি সারগুলোও দামি। তারপর মাঠে লাঙল চালাও রে, তিলের বীজ ছড়াও রে। এবার উঁচু করে হলরেখা টানতে হবে, যাতে রেখা বরাবর জল গড়াতে পারে। আর কেবল সূর্য ডোবার পরেই আমরা মাঠে জল দিই।”
বীজরোপনের তিন সপ্তাহ পর ঠিকমতন সেচ শুরু হয়, জানালেন প্রিয়া। ততদিনে দিব্যি লকলকে লম্বা হয়ে যায় গাছগুলো, হাতদুটো মাটি থেকে ৯-১০ ইঞ্চি উপরে ধরে রাখলেন তিনি। “তারপর হুহু করে বাড়তে থাকে। পাঁচ হপ্তা পর আগাছা নিড়িয়ে ইউরিয়া দিই, তারপর দিন দশক বাদে বাদে পানি দেওয়া হয়। জম্পেশ রোদ আলো পেলে ফসলটাও ভালো হয়।”
স্বামী কাজে বেরোলে মাঠের ওপর নজর রাখেন তিনি। দেড় একর জমি, হরবখত দুইখান করে ফসল ফলান এই দম্পতি। ঘরকন্নার কাজ সেরে, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে, নিজের জন্য খাবারদাবার বেঁধে সাইকেল চালিয়ে খেতে পৌঁছে যোগ দেন খেতমজুরদের সঙ্গে। “সকাল ১০টায় সক্কলের জন্য চা কিনে দিই। আর দুপুরের খাওয়াদাওয়া হলে পালা আসে চা আর পালাকরমের [জলখাবার]। সাধারণত সুইয়াম [মিষ্টি] আর উরুলাই বোন্দা [মুখোরোচক] খাই আমরা।” ঘর থেকে খেত অবধি বারবার যাতায়াত করেন প্রিয়া, সারাটাক্ষণ চলতে থাকে জিনিসপত্র আনা, বওয়া, নুয়ে পড়া, তোলাপাড়া, রান্নাবান্না আর ঝাড়পোঁছ... “ফলের রস খান একটু,” খেত পরিদর্শনে বেরোনোর আগে আমাদের অনুরোধ করলেন তিনি।
*****
এল্লু ভায়াল [তিল-খেত] দেখলে সত্যি চোখ জুড়িয়ে যায়। ছোট্ট ছোট্ট ফুল, পলকা, যেন বসুধার গয়না, বাহারি রং, গোলাপি থেকে সাদা, শিফন শাড়ি আর ফরাসি ম্যানিকিওরের কথা মনে করিয়ে দেয়। দক্ষিণ ভারতের হেঁশেলে হেঁশেলে বর্তমান গুরুপাক তেলটা যে এই পুষ্পরাজিরই দান, তা বোঝা দায়।
তিলগাছ যেমন লম্বা তেমন ক্ষীণকায়, গাঢ় সবুজ পাতা। কাণ্ড জুড়ে সারি সারি শুঁটি। একেকটা কাঠবাদামের মতো বড়ো, এলাচের মতো আকার। একটা শুঁটি ফাটিয়ে আমাদের দেখালেন প্রিয়া। ভিতরে বেশ কয়েকটা ফ্যাকাশে সাদা তিলের বীজ। আস্ত এক চামচ তেল পেতে গেলে এরকম ক’টা বীজ পিষতে হবে, সেটা ভাবলেও মাথা ঘোরে। আরে বাবা, একখান ইডলি খেতে গেলেও তো দু’চামচ ইডলি পোডিতে (একধরনের শুকনো চাটনি) কুলোয় না!
তবে এপ্রিলের গনগনে রোদে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাবনাচিন্তা করাটা অসম্ভব ব্যাপার। কাছেই খানকতক গাছের জটলা রয়েছে দেখে ছায়ার খোঁজে পা বাড়ালাম। মহিলা খেতমজুররাও এখানে জিরোতে আসেন বলে জানালেন ভাডিভেলান। আপাতত ওঁদের অনেকেই পড়শি চাষি গোপালের মাসকালাইয়ের খেতে কর্মরত। আগুনঝরা সূর্যের থেকে বাঁচতে প্রত্যেকের মাথায় সুতির তোয়ালে জড়ানো। একদণ্ডও না থেমে ঘাম ঝরিয়ে চলেছেন তাঁরা, মাঝে কেবল মধ্যাহ্নভোজ ও চা-নাস্তার বিরতি।
তাঁদের প্রত্যেকেই বয়োজ্যেষ্ঠ। সবচাইতে বয়স্ক বোধহয় ভি. মারিয়ায়ি, সত্তরের কোঠায় পা রেখেছেন। আগাছা নিড়ানো, চারা প্রতিস্থাপন আর ফসল কাটার থেকে রেহাই মিললে শ্রীরঙ্গমের মন্দিরে গিয়ে তুলসীমালা বেচেন। মানুষটা যতখানি মৃদুভাষী, মাথার উপয সূর্য ঠিক ততটাই প্রকট। খেমজুরদের মতো এ তাপদাহেরও কোনও বিরতি নেই...
তবে তিলগাছের সঙ্গে রোদ্দুরের কোনও শত্রুতা নেই। এমন অনেক কিছুরই তোয়াক্কা করে না এ উদ্ভিদ, ভাডিভেলানের পড়শি, এস. গোপাল, ৬৫, জানালেন। এ বিষয়ে প্রিয়া ও ভাডিভেলানও একমত। এই তিনজন কৃষকের জবানে কীটনাশক বা স্প্রের কথা তেমন শোনা গেল না। যা বুঝলাম, এঁরা সেচ নিয়েও তেমন একটা চিন্তিত নন। যেদিক থেকেই দেখি না কেন, তিল আর শামাধানের বিস্তর মিল — চাষে তেমন ঝুটঝামেলা নেই, হরবখত চোখে চোখে রাখতে হয় না। তবে হ্যাঁ, দুশমন একটা আছে বটে — বেমরসুমি বৃষ্টি।
আর ২০২২ সালে ঠিক সেটাই হয়েছে। ভাডিভেলানের কথায়: “যখন জল পড়ার কথা নয়, তখন বৃষ্টি হল — জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিতে, গাছগুলো যখন ছোটো, ফলে বৃদ্ধিটা আটকে গেল।” ফসল কাটার সময় হয়ে এসেছে, ফলন যৎসামান্য বই হবে না বলেই আশা করছেন। “গতবছর যে ৩০ ছটাকে (একরের এক-তৃতীয়াংশ) বীজ ছড়িয়েছিলাম, অন্যান্য বছর সেখানে ১৫০ কেজি ফলে। তবে এবছর ৪০ কেজিও ছাড়াবে কিনা সন্দেহ আছে।”
দম্পতিটি আশঙ্কা করছেন, এটুকু তিল পিষে সারা বছরের ভোজ্য তেলের চাহিদা না-ও মিটতে পারে। “দফায় দফায় তিল পেষাই করি, একেকবারে ১৫-১৮ কেজি। ৭-৮ লিটার তেল মেলে প্রতিবার। সাল কাটাতে দু-দফা পেষাই তো করতেই হয়,” প্রিয়া বুঝিয়ে বললেন। পরদিন আমাদের তেলকলে নিয়ে যাবেন বলে কথা দিলেন ভাডিভেলান। কিন্তু বীজগুলো? ওগুলো সংগ্রহ করা হয় কেমন করে?
আমন্ত্রণ এল গোপাল আন্নার তরফ থেকে। তাঁর তিলখেতটা খানিক দূরেই, পাশে একটা ইটভাটা যেখানে অসংখ্য অভিবাসী মজুর পরিবার ঘাম ঝরায়, ওটা তাদের বাসাও বটে — ইট-পিছু এক টাকা বই জোটে না। তাঁদের বাচ্চাকাচ্চাও বড়ো হয় এখানে, ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালনে সময় কাটে যাদের। সন্ধ্যাবেলার সময় বলে ইটভাটাটা নিশ্চুপ। আমাদের মদত করতে এগিয়ে এলেন ইটভাটার এক মজুর এম. সীনিআম্মল।
কেটে রাখা তিলগাছের উপর ত্রিপল চাপা ছিল, শুরুতেই সেটা হটিয়ে নিলেন গোপাল আন্না। দিনকতক এভাবেই ডাঁই করে পড়ে আছে গাছগুলো, যাতে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বেড়ে আপনা-আপনি শুঁটি ফেটে বীজগুলো বেরিয়ে আসে। দক্ষতার সঙ্গে একগাছি লাঠি দিয়ে গাছগুলো উল্টে দিলেন সীনিআম্মল। শুঁটিগুলো পেকে গেছে, চোখের সামনেই সেগুলো ফুটুস করে ফেটে তিল বেরিয়ে এল। হাতে করে জড়ো করে ছোটো ছোটো ঢিবি সাজিয়ে রাখলেন তিনি। এরপর, গাছগুলো নিঃশেষ হওয়া অবধি শুঁটি ফাটানোর প্রক্রিয়াটা জারি থাকল।
প্রিয়া, গোপাল আন্না ও তাঁর মেয়ে মিলে গাছগুলো একত্রিত করে আঁটি বেঁধে ফেললেন। আজ আর এসব জ্বালানির কাজে আসে না। “আমার মনে আছে, এককালে এই দিয়েই ধান সেদ্ধ করা হত। তবে আজকাল তো চালকলেই ওসব হয়ে যায়। বীজ বার করা হয়ে গেলে তিলগাছ পুড়িয়ে শেষ দিই আমরা,” ভাডিভেলান বুঝিয়ে বললেন আমাদের।
পুরোনো এমন অনেক প্রথাই আজ বিলুপ্ত, জানালেন গোপাল আন্না। তবে উয়ির ভেলির (জীবন্ত বেড়া) প্রথা নিশ্চিহ্ন হওয়ায় বিশেষ ভাবে উদ্বিগ্ন হতে দেখলাম তাঁকে। “ওগুলো যখন ছিল, বেড়ার ধার বরাবর শেয়াল গর্ত খুঁড়ে বাস করত। যার ফলে আমাদের ফসল সাবড়াতে উটকো পশুপাখি হানা দিত না। আজ আর শেয়াল দেখাই যায় না!” দুঃখ করছিলেন তিনি।
“খাঁটি সত্যি কথা,” ভাডিভেলান সহমত, “আগে চারিদিকে শেয়াল দেখা যেত। বিয়েথা করার আগে, লোমশ কুকুর ভেবে নদীর পাড় থেকে একটা পুঁচকে শেয়ালছানা কুড়িয়ে এনেছিলাম। বাবা তো দেখামাত্র বলে দিলেন কেমন যেন গড়বড় ঠেকছে। সেদিন রাতে ভিটের পিছনে একপাল শেয়াল এসে বিকট হুক্কাহুয়া জুড়ে দিল। অগত্যা যেখান থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম, ওখানেই গিয়ে ছানাটাকে রেখে এলাম!”
আমাদের আড্ডার মাঝেই সীনিআম্মল আম্মা খড় ও শুকনো পাতা মেশানো তিল চালান করে ফেলেছিলেন একটা কুলোয়। এবার মাথার উপর তুলে পাক্কা ওস্তাদের মতো কুলোটা নাড়তে লাগলেন। একাধারে সবল ও অপূর্ব তাঁর কুলো-ঝাড়ার ছন্দ, দক্ষ তো বটেই। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হয়ে সরগমের তালে তালে ঝরতে লাগল রাশি রাশি তিল।
*****
শ্রীরঙ্গমের শ্রী রঙ্গ মারাচেক্কু (কাঠের ঘানিওয়ালা) তেলকল, রেডিওতে একখান পুরোনো তামিল গান বাজছে। ক্যাশ রেজিস্টারের পিছনে গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন মালিক আর. রাজু। তিল পিষতে পিষতে কেমন যেন গোঙাচ্ছিল ঘানিটা। ইস্পাতের দৈত্যাকার পাত্রের কানায় কানায় ছলকে উঠছে তিলের তেল। পিছনের উঠোনে পড়ে পড়ে শুকোচ্ছে আরও অসংখ্য তিল।
“১৮ কিলো তিল পিষতে দেড় ঘণ্টা লাগে। ওতে দেড় কিলো তালগুড় ঢালি আমরা। আনুমানিক ৮ লিটার তেল বেরোয়। স্টিল-মিলে যতটা বেরোয়, তার চেয়ে একটুখানি কম,” বুঝিয়ে বললেন তিনি। এক কেজি বীজ পিষতে খদ্দেরদের থেকে ৩০ টাকা করে নেন, আর তাপ বর্জিত পদ্ধতিতে পেষাই করা তিলের তেল লিটার-পিছু ৪২০ টাকায় বিকোয়। “কেবল ফার্স্ট কোয়ালিটির (সবচাইতে উচ্চমানের) তিল ইস্তেমাল করি — হয় সরাসরি চাষিদের থেকে কিনি, কিংবা গান্ধীবাজার থেকে ১৩০ টাকা কিলোয় — তেলের স্বাদগন্ধ বাড়াতে ভালো মানের তালগুড় লাগে, তার দর ৩০০ টাকা কিলো।”
সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা অবধি সারাদিনে চারবার ঘোরে এই যন্ত্রটি। টাটকা পেষাই হওয়া তেলের রং স্বচ্ছ না হওয়া পর্যন্ত রোদ খাওয়ানো হয়। তেল নিংড়ে নেওয়ার পরেও খইল (এল্লু পুনাকু) কিছুটা তৈলাক্ত রয়ে যায়, তাই কেজি-পিছু ৩৫ টাকা দিয়ে সেগুলো পশুখাদ্য রূপে কেনেন চাষিরা।
রাজুর আন্দাজ, এক একর জমির তিল চাষ করে, কেটে, বস্তায় পুরতে হাজার কুড়ি টাকার খানিক বেশিই লাগে। ফলন ৩০০ কিলোর একটু বেশি। তাঁর হিসেবমতো ত্রৈমাসিক এই ফসল থেকে প্রতি-একর ১৫-১৭ হাজার টাকা লাভ হয়।
গণ্ডগোলটা ঠিক ওইখানেই, জানালেন ভাডিভেলান, তাঁর কথায়, “আমার মেহনতের মুনাফা কে লোটে বলুন তো? বেনিয়ারা। ব্যাটাদের থেকে আমরা যা পাই, ফসল হাত-বদলে ওরা তার দুগুণ মুনাফা লুটে নেয়,” নালিশ ঠুকে মাথা নেড়ে জানালেন, “ওরা থোড়াই না মূল্য সংযোজন করে? এই জন্যই তো তিল বেচি না। বাড়ির জন্য চাষ করি, নিজেদের খোরাকি মেটাতে। যথেষ্ট...”
ব্যস্ততায় মোড়া ত্রিচির গান্ধীবাজারে তিলের দোকানগুলোয় নরক গুলজার। বাইরে মাসকালাই, খোসা-সহ মুগ ও তিলের বস্তার উপর বসে রয়েছেন চাষিরা। আর বেনিয়ারা বসে আছেন তাঁদের ঠাকুর্দার বানানো পেল্লায় দোকানের ভিতর। যেদিন গিয়েছিলাম, সেদিন মাসকালাই-ই বেশি ছিল বলে জানিয়েছিলেন বছর ৪৫-এর পি. সরভানন। মহিলা ও মরদ মজুরের দল চালুনিতে চেলে, ওজন করে বস্তায় ডাল পুরছেন। “স্থানীয় তিল উৎপাদন এই সবে আরম্ভ হয়েছে,” বলে উঠলেন তিনি, “বস্তা বস্তা তিল এই এলো বলে।”
তবে ফলন তুঙ্গে থাকলেও ৫৫ বছর বয়সি এস. চন্দ্রশেখরন তাঁর বাপ-দাদার আমলে যা দেখেছেন, আজ আন্দাজমতন তার এক-চতুর্থাংশয় গিয়ে ঠেকেছে। “এককালে জুন মাসে গান্ধীবাজারে রোজ রোজ প্রায় ২,০০০ এল্লু মুটাই [তিলের বস্তা] আসত। কিন্তু গত কয়েকবছর পাঁচশোর বেশি আসছে না। চাষিরা হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। এই ফসলটা [তিল] অত্যন্ত শ্রমসাধ্য। দরটা বাড়ছেই না — ১০০ থেকে ১৩০ টাকা কিলোর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। তাই ওঁরা তিল ছেড়ে মাসকালাইয়ের দিকে ঝুঁকছেন, কারণ ওটা একদিনের মধ্যে মেশিন দিয়ে কেটে বস্তাবন্ধ করা যায়।”
কিন্তু তেলের দাম ও আকাশছোঁয়া, উপরন্তু বাড়ছে বই কমছে না, তাহলে চাষিরা ভালো দর পাচ্ছেন না কেন? আমি সওয়াল করাতে তড়িঘড়ি জবাব এল, “পুরোটাই তো বাজারের, চাহিদা আর জোগান, বাইরের রাজ্যে কতটা উৎপাদন হচ্ছে, তাবড় তাবড় তেলকলের মালিকরা কতটা মজুত করছে, এসবের উপর নির্ভরশীল।”
যেখানাই যাই না কেন, ফসল বা পণ্য সে যা-ই হোক না কেন, গপ্পোটা একই। ‘বাজার’ নামের বস্তুটি কারও জন্য পৌষমাস, কারও জন্য সর্বনাশ। তবে পৌষমাসটা যে কাদের চলছে, সেটা তো বলাই বাহুল্য...
*****
একধারে সুদীর্ঘ ও জটিল ভোজ্য তেল শিল্পের ইতিহাস, আমদানি ও উৎখাতে ভরা, ফসল ও সাংস্কৃতিক অভ্যেসের দাস্তান। দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির সমাজবিজ্ঞান ও নীতিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. রিচা কুমার ‘স্বয়ংসম্পূর্ণতা থেকে বেড়ে চলা সংকটের পথে ’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্রে লিখছেন, “১৯৭৬ অবধি চিত্রটা এরকম — ভারতে ভোজ্য তেলের যা চাহিদা, তার প্রায় ৩০ শতাংশই আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করে মেটাই...দুধের উৎপাদন বাড়াতে দুগ্ধ সমবায়গুলি সফল হলে সরকার সেটা নকল করতে চেয়েছিল।”
কিন্তু, “হলুদ বিপ্লব সত্ত্বেও ১৯৯০-এর মাঝখান থেকে ভারতে ভোজ্য তেলের ঘাটতি মাথা চাড়া দেয়, কারণ তৈলবীজ-শস্যদানা-ডালের মিশ্রচাষের বদলে গম, চাল ও আখ-চাষ বাড়তে থাকে যেহেতু সরকার উক্ত চাষের উপর বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ও ক্রয়-নিশ্চয়তা চাপিয়ে দিয়েছিল। উপরন্তু ভোজ্য তেল আমদানিতে উদারীকরণ হওয়ায় ইন্দোনেশিয়া থেকে সস্তার পাম-তেল ও আর্জেন্টিনা থেকে সোয়াবিনের তেল এসে বাজার ভরিয়ে দেয়।
“সস্তা হওয়ায় অন্যান্য ভোজ্য তেলের জায়গা দখল করে পাম-তেল ও সোয়াবিনের তেল। ঠিক যেমন অপেক্ষাকৃত মূল্যবান দেশি ঘিয়ের বাজার বেদখল করে জনপ্রিয় বনস্পতি শিল্প (পরিশুদ্ধ, হাইড্রোজেনেটেড ভেজিটেবল শর্টেনিং)। এই জাতীয় পণ্যগুলি ভারতের খামার ও হেঁশেল থেকে সর্ষে, তিল, তিসি, নারকেল ও চিনেবাদামের মতো অসংখ্য প্রথাগত ও স্থানীয় তৈলবীজ উৎখাত করে দেয়, কারণ কৃষকের পক্ষে এসব অলাভজনক হয়ে উঠেছিল,” লিখছেন ড. কুমার।
আজ এমন আকাল পড়েছে যে পেট্রোলিয়াম ও সোনার পর ভোজ্য তেলই আমাদের আমদানি তালিকার শীর্ষে। ২০২৩ সালের জুন মাসে প্রকাশিত পুশিং ফর সেল্ফ-সাফিশিয়েন্সি ইন এডিবল্ অয়েলস্ নিবন্ধ মোতাবেক: মূল্যের নিরিখে কৃষি আমদানির খাতে ৪০ শতাংশ ও মোট আমদানির খাতে ৩ শতাংশ ভোজ্য তেলের কুক্ষিগত। দেশভর ভোজ্য তেলের যতটা চাহিদা রয়েছে তার প্রায় ৬০ শতাংশ আমদানির দ্বারা মেটে।
*****
ভাডিভেলান ট্যাক্সি চালিয়ে সাংসারিক খাইখরচার ৬০ শতাংশ মেটান। তাঁর গাঁ পেরিয়েই কাবেরী যেমন দু’ভাগে বিভক্ত হয়, ঠিক তেমনই চাষ ও গাড়ি-চালানোর মাঝে দ্বিখণ্ডিত ভাডিভেলানের সময় ও জিন্দেগি। কৃষিকাজ অত্যন্ত কঠিন বলে জানাচ্ছেন তিনি, “যতটা খামখেয়ালি, ততটাই কষ্টকর।”
স্বামী সারাটাদিন ট্যাক্সি চালিয়ে ফেরে, তাই খেতিবাড়ির কাজে হাত লাগাতে বাধ্য হয়েছেন প্রিয়া। ঘরকন্না হাজারও কামকাজ তো আছেই, সিংহভাগটাই তিনি একা সামলান। তবে সুযোগ পেলেই ভাডিভেলান হাত বাড়িয়ে দেন। কখনও রাত্তিরে খেতে পানি দেওয়া, কখনও বা ফসল-কাটা যন্ত্র ভাড়া করতে দিনের পর দিন ছোটাছুটি করা — খেতে-খেতে ফসল পাকলে এ যন্তরের চাহিদা রাতারাতি তুঙ্গে ওঠে। আগে আগে মাঠেঘাটে অনেক ঘাম ঝরিয়েছেন। “কিন্তু আজকাল বেলচা চালালে পিঠে খ্যাঁচ ধরে, গাড়ি চালাতে পারি না!”
দম্পতিটি তাই খেতমজুর বহাল করেন, মানে জোগাড় করতে পারলে আর কি। অধিকাংশ সময়ই আগাছা নিড়ানো, চারা স্থানান্তর ও তিল ঝাড়ার কাজে বয়স্ক মহিলাদের ডেকে আনেন তাঁরা।
মাসকালাই চাষও ঠিক ততটাই কঠিন। “ফসল কাটার আগে আর পরে বৃষ্টি পড়ল, শুখা রাখতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে গেছিলাম।” তাঁর কষ্টের দাস্তান শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল তিনি যেন সত্যি সত্যিই কোনও মহাকাব্যের মহারথী। যে উলুন্দুর যাদুবলে আমার ইডলি আর দোসা স্বাদু হয়ে ওঠে, তার প্রতি সম্ভ্রমটা আরও এককাঠি বেড়ে গেল।
“বছর কুড়ি বয়সে লরি চালাতাম। ওটার ১৪ খানা চাকা ছিল। দু’জন চালক ছিলাম, পালা করে চালাতাম, দেশময় ঘুরে বেড়িয়েছি। উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, কাশ্মীর, রাজস্থান, গুজরাত...” কী কী খেতেন (উটের দুধের চা, ডাল-রুটি, ডিম-ভুজিয়া), কোথায় কোথায় স্নান করতেন (নদীর পানিতে, কিংবা খুব ঠান্ডা থাকলে করতেনই না, যেমন শ্রীনগরে), গাড়ি চালাতে চালাতে কী কী শুনতেন (“অবশ্যই ইলিয়ারাজার গান আর কুতু পাটু, নইলে ঘুমিয়ে পড়ব যে!”), এমন নানান কথা বললেন আমায়। কথায় কথায় উঠে দোস্তি, আড্ডা আর ভূতের গপ্পো। “একদিন রাত্রে, প্রকৃতির ডাক আসায় লরি থেকে নেমেছি। মাথায় কম্বল মুড়ি দিয়েছিলাম। পরদিন অন্যরা বলাবলি করছিল, তারা নাকি ঘোমটা পরা ভূত দেখেছে!” বলেই হেসে উঠলেন ভাডিভেলান।
দেশের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত লরি চালাতে গিয়ে হপ্তার পর হপ্তা ঘরে থাকা হত না, তাই শেষমেশ এই কাজে ইতি টানেন তিনি। বিয়েশাদির পর স্থানীয় অঞ্চলেই চালান ভাডিভেলান, আর চাষবাস করেন। এই দম্পতির দুই সন্তান — মেয়ে ক্লাস টেনে পড়ে আর ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে। “ওদের সবকিছু দিতে চাই আমরা, কিন্তু তাও যেন মনে হয় ছেলেবেলায় আমি আরও খুশি ছিলাম,” ভাবনার সাগরে ডুব দিয়ে জানালেন তিনি।
তাঁর বাল্যকালের কাহিনিগুলো অবশ্য অতটাও সহজ-সরল নয়। “তখনকার দিনে কেউ আমাদের বড়ো করেনি, জানেন তো,” আমার দিকে ঘুরে আলতো হেসে বললেন ভাডিভেলান, “আমরা আপনা-আপনিই বড়ো হয়েছি।” নবম শ্রেণিতে উঠে তবেই জীবনে প্রথমবার চটিজুতো পরার সুযোগ হয়েছিল, তার আগে অবধি খালিপায়েই হেঁটে বেড়িয়েছেন। ঠাকুমার সংগ্রহ করা চাষের শাক-সবজি ফেরি করতেন, একেক বান্ডিল ৫০ পয়সায়। “তা সত্ত্বেও লোকে দরাদরি করত,” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন। এদিক সেদিক সাইকেল চালিয়ে ফিরতেন তিনি, গায়ে থাকত স্কুল থেকে দেওয়া গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট। “ওগুলো মাস তিনেক চলত। বাড়ির লোকে বছরে একবার বই জামাকাপড় কিনে দিত না।”
দৃঢ় পায়ে জীবনের কঠিনতম দিনগুলো পেরিয়ে এসেছেন ভাডিভেলান। খেলাপাগল মানুষ ছিলেন, দৌড়বাজ, রেসে পুরস্কারও পেয়েছেন। কাবাডি খেলতেন, নদীতে সাঁতার কাটতেন, সঙ্গে ছিল বন্ধুদের সঙ্গে বাড়িতে আড্ডা বা টোটো করে ঘুরে বেড়ানো, ফি রাত্তিরে আপ্পায়ির (ঠাম্মা) মুখে গল্প শোনা। “আধা শুনেই ঘুমে ঢলে পড়তাম, পরদিন রাতে গপ্পোটা ওইখান থেকে শুরু করত ঠাম্মা। কত্ত কত্ত গল্প জানত ঠাম্মা তার ইয়ত্তা নেই, রাজারানির কাহিনি, ঠাকুর-দেবতার গাথা...”
তবে খেলাধূলার সাজ-সরঞ্জাম ও খোরাকির খরচ মেটানো তাঁর পরিবারের পক্ষে মুমকিন ছিল না, তাই যুবা বয়সে ভাডিভেলান কোনদিনও জেলাস্তরে খেলার সুযোগ পাননি। জাউ, ভাত, ঝোল আর কালেভদ্রে মাংস বই ঘরে আর কিছুই জুটত না। স্কুলে গেলে দুপুরবেলা উপমা খেতে পেতেন, আর বিকেলের ‘জলখাবার’ বলতে ভাত-ধোওয়া আমানি আর নুন। ‘জলখাবার’ শব্দটা ইচ্ছে করেই ব্যবহার করেন ভাডিভেলান। নিজের বাচ্চা দুটোর জন্য আজ প্যাকেট প্যাকেট মুখোরোচক খাবার কিনে আনেন তিনি।
নিজের ছোটোবেলার দুঃখ-দারিদ্র্য থেকে সন্তানদের আড়াল করে রেখেছেন মানুষটি। দ্বিতীয়বার শ্রীরঙ্গমে যেতেই কন্যা-সহ প্রিয়াকে কোল্লিদামের পাড়ে বালি খুঁড়তে দেখলাম। গর্তটা ছ’ইঞ্চি হতে না হতেই চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল বেরোনো শুরু হল। “নদীর পানি বড়োই শুদ্ধ,” বলে উঠলেন প্রিয়া। তারপর একখান বালির স্তূপ বানিয়ে তাতে চুলের কাঁটা লুকিয়ে রাখলেন মা, আর মেয়ে সেটা খেলাচ্ছলে খুঁজতে লাগল। ওদিকে ছেলের সঙ্গে অগভীর জলে চটপট স্নান সেরে নিলেন বাবা। যতদূর চোখ যায়, এখানে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। বালিয়াড়ি জুড়ে গোঠে ফেরা গরুর খুরের ছাপ স্পষ্ট। খসখসিয়ে উঠল নদীর তৃণদল। আর পাঁচটা দিগন্তবিস্তৃত ফাঁকা পরিসরের মতো এই জায়গাটাও অপরূপ। ঘরে ফেরার পথে সব্বার আগে আগে যেতে যেতে ভাডিভেলান বললেন, “আপনাদের শহরে তো আর এমনটা পাবেন না, বলুন!”
*****
পরের বার কাবেরীর সঙ্গে যখন মোলাকাত হয়, শহর বলে ভ্রম হয়েছিল। লোকে লোকারণ্য! সময়টা অগস্ট ২০২৩, ভাডিভেলানের সঙ্গে প্রথমবার দেখা করার পর গোটা একটা বছর কেটে গিয়েছে। আদি পেরুক্কু পরব উপলক্ষ্যে এসেছিলাম। কাবেরীর দুই তীরে পালিত এই পরবে একদেহে হয় লীন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আচার।
শ্রীরঙ্গমের একটা শান্ত গলিতে নিজের গাড়িটা রাখতে রাখতে ভাডিভেলান বলে উঠলেন, “মারাত্মক ভিড় হবে কিন্তু।” হাঁটতে হাঁটতে কাবেরীর আম্মা মণ্ডপম্ ঘাটে গিয়ে উঠলাম, তীর্থযাত্রীরা এখানেই এসে জড়ো হন সব্বাই। সবে সকাল ৮.৩০, আর এর মধ্যেই তিলধারণের জায়গা নেই। সিঁড়ির ধাপে ধাপে ঠাসাঠাসি করছে মানুষ আর কাঁচকলার পাতায় সাজানো নদীর নৈবেদ্য — নারকেল, ধূপকাঠি গোঁজা কলা, সিঁদুর-নির্মিত খুদে-খুদে গণেশমূর্তি, ফুল, ফল ও কর্পূর। আবহাওয়াটা বিয়েবাড়ির মতোই, তবে আরও পরিব্যাপ্ত।
সপরিবারে পুরুতদের ঘিরে ধরেছেন সদ্য বিবাহিত দম্পতিরা। থালায় রাখা নব-অলঙ্কার নতুন সুতোয় গাঁথতে [মঙ্গলসূত্র] সাহায্য করছেন বামুনেরা। এরপর স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রার্থনা করবেন, তারপর নদীর জলে ভাসিয়ে দেবেন এযাবৎ সাবধানে তুলে রাখা বিয়ের মালা। একে অপরের গলায় হলুদে-ছোপানো সুতো বাঁধছেন মেয়ে-বধূরা, আত্মীস্বজন ও বন্ধুবান্ধবের হাতে তুলে দিচ্ছেন সিঁদুর ও মিঠাই। সকালের টাটকা রোদে কাবেরীর ওপার থেকে ঝলমলিয়ে উঠছে ত্রিচির বিখ্যাত গণেশ মন্দির — উচি পিল্লাইয়ার কোইল।
আর এসবের মাঝে ক্ষিপ্রবেগে বয়ে চলেছে নদী — ঢেউয়ে ঢেউয়ে ধরা আছে ইবাদত ও মানতের ডালা, ছলকে ওঠা পানির নেশায় পূর্ণ হচ্ছে মাটি ও মানুষের খোয়াব — ঠিক যেমনটা চলে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে...
ফ্রম সেল্ফ-রিলায়েন্স টু ডিপেনিং ডিস্ট্রেস্: দি অ্যাম্বিভ্যালেন্স অফ দ্য ইয়েলো রেভোল্যুশন ইন ইন্ডিয়া নিবন্ধটি আমাদের ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য ড. রিচা কুমারের প্রতি লেখকের অশেষ কৃতজ্ঞতা।
২০২০ সালের রিসার্চ ফান্ডিং প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে গবেষণামূলক এই প্রতিবেদনটি রূপায়িত করতে আর্থিক অনুদান জুগিয়েছে বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র