ছাদের ঠিক নিচে ঝুলছে একটা হাঁড়ি।
নির্ঘাত ওতে ঔষধি গুণসম্পন্ন জড়িবুটি, পুজোর ফুল-পাতা জাতীয় জিনিসপত্র অথবা চাল ভরা আছে। রাজম গিরি, যিনি এই মুহূর্তে খোলা উঠোনে দোসা বানাতে ব্যস্ত, আশা রাখি কাজ থেকে ফুরসৎ পেলে এই হাঁড়ির রহস্য উদ্ঘাটন করবেন আমার কাছে। শ্বশুরমশাই জি. সিদ্ধাইয়ার সামনে আপাতত তিনি সসম্ভ্রম নীরবতা পালন করছেন।
রাজমের ঠিকানা তামিলনাড়ুর অনিন্দ্য সুন্দর বারগুর পাহাড়ের কোলে ইরোড জেলার উসিমালাই গ্রাম। তাঁদের পরিবারিক জীবিকা পশুপালন। তামিলনাড়ুর পাঁচটি দেশজ প্রজাতির অন্যতম লালচে-সাদা রং বিশিষ্ট, তথা আঞ্চলিক পাহাড়ের নামে পরিচিত বারগুর প্রজাতির গরু পালন করে তাঁরা। সূর্য উঠলেই পুরুষরা বাড়ির গবাদিপশুদের চরাতে নিয়ে যান বনে। আমি বারগুরে এসেছি এই বিশেষ প্রজাতিকে চর্মচক্ষে দেখব বলে, দেশজ গোসম্পদ বিষয়ক এক প্রতিবেদনের কাজে। রাজমের সঙ্গে মোলাকাত হল যখন, তখন বাড়ির সদস্যদের মধ্যে কেবল মেয়ে, বাচ্চা আর বুড়োবুড়িরাই ঘরে ছিলেন।
আর ছিল ছাদের গা ছুঁয়ে ঝুলতে থাকা সেই মাটির হাঁড়ি।
সিদ্ধাইয়া এবং সি. কেঞ্জেন বসে রয়েছেন পাটের দড়িওয়ালা খাটিয়ার ওপর। সিদ্ধাইয়া জানালেন তাঁর বয়স ৫০। তৎক্ষণাৎ তাঁর বন্ধু কেঞ্জেন বাগড়া দিলেন এই বলে, “তোমার বয়স মোটেই ৫০ নয়, ৬০।” যদিও রীতিমাফিক বয়সের হিসাব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামান না এই দুই পশুপালক। দেখে মনে হয় উভয়েরই বয়স ৬০ এর কোঠায়। দুজনেরই গলায় ঝুলছে রূপোর লিঙ্গম, যা নিছক অলংকারমাত্র নয়, তাঁরা লিঙ্গায়েত সমাজের সদস্য, এটি তারও পরিচায়ক বটে। বারগুরের এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা গবাদি পশু পালন করলেও দুধ খান না, উপরন্তু তাঁরা নিরামিষভোজী। “কেবল বাচ্চা আর বুড়োদের জন্যে দুধের আয়োজন থাকে আমাদের হেঁসেলে,” জানালেন বারগুর হিল ক্যাটল ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ই. এন. শিবাসেনাপতি, যিনি আমাকে উসিমালাই অবধি নিয়ে গেছিলেন।
নিজ সম্প্রদায়ের আচারবিচারের ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে রাজমের শ্বশুরমশাই। তিনি কিছুটা ক্ষমা চাওয়ার সুরেই আমাকে জানালেন তাঁদের বাসায় বাইরে থেকে আগত যে কেউ, এমনকি অতিথিকেও সোমবার খাবার দেওয়া নিষেধ। তাঁদের ঘরের অন্দরমহলে আমার প্রবেশাধিকার নেই। সেখানে আমার যাওয়াটাকে অশুদ্ধ বলেই ধরে নেওয়া হবে বলে মনে করেন তাঁরা।
তবে কি না, বুঝিয়ে বললেন সিদ্ধাইয়া, আমি নেহাতই ভাগ্যবান যে কাঠের উনুন বাড়ির উঠোনেই রাখা, অতএব আমার কপালে এক কাপ চা নিশ্চয়ই জুটবে। উনুনের গড়ন ছিমছাম, সাদামাটা। তিনকোনা করে সাজানো পাথর, তার নিচেই কাঠের আগুন জ্বাল দেওয়ার জায়গা, আর তার ঠিক উপরে পাথরে পাত্র বসানোর বন্দোবস্ত। রাজম লোহার পাইপ দিয়ে আগুনের আঁচ কিছুটা উসকে দিলেন। কাঠে ঝলক খেলে যায়, আগুন জ্বলে ওঠে। অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে জল ফুটে উঠলে তাতে চাপাতা আর চিনি মিশিয়ে আমার সামনে হাজির করলেন ভারাতু বা লাল চা।
রাজমের বাড়ির সবেতেই পুরোনো দিনের ছোঁয়া। কাদামাটির দেয়ালের রং ফিকে হয়ে আসা নীল আর লাল। বাড়ির বাছুরগুলোর জন্য বরাদ্দ আছে একটা ঘর। উঠানে, উনুনের চারপাশে, দোসা তৈরির জন্য পেষাইয়ের ভারি পাথর আর সরু কিন্তু পেল্লায় একখানা হামানদিস্তা। আর আছে ফালা ফালা করে রাখা বেত - ঝুড়ি বোনার উপকরণ।
আর আছে ছাদের গা ছুঁয়ে ঝুলে থাকা সেই মাটির হাঁড়িখানা।
রাজমকে হাঁড়ির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে একগাল হাসেন তিনি। তারপর ঘরে ঢুকেই একটা মিউজিক সিস্টেম চালু করে বেরিয়ে এলেন।
“হাঁড়ির মধ্যে স্পিকার যন্তরটি আছে তো, তাতেই তো গান শোনা যায়,” বলে ওঠেন তিনি।
কোনও এক তামিল ছায়াছবির গান বেজে ওঠে, মাটির হাঁড়ির গায়ে ধাক্কা খেয়ে জোরে ভেসে আসে সেই গানের সুর।
কচিকাচারা এসে ভিড় জমায়, বকবক করতে থাকে। আমার কিছু প্রশ্নের উত্তরও দেয় তারা। তাদের মধ্যে একজন রাজমের ভাইঝি। সে জানায়, মাটির হাঁড়িতে যন্ত্রটা রাখার বুদ্ধি তার চিত্তাপ্পা (তামিল ভাষায় কাকা) অর্থাৎ রাজমের দেওরের।
“তুমি নাচ করতে ভালোবাসো বুঝি?” রাজমের ভাইঝিকে জিজ্ঞেস করি আমি। লাজুক কন্যে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেও তার নাম আর প্রিয় তামিল ছায়াছবির গান আমার অজানাই রয়ে যায়।
রাজমকে হাঁড়ির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে একগাল হাসেন তিনি। তারপর ঘরে ঢুকেই একটা মিউজিক সিস্টেম চালু করে বেরিয়ে এলেন
রাজম ঘরের কাজে ফেরেন। বাড়ির পিছনের জঙ্গল থেকে উনুনের জ্বালানি সংগ্রহ করতে যান তিনি। তাঁর পিছু নিই আমিও। একা থাকলে অনেক কথা বলেন রাজম। আমার সামনে নিজের রোজনামচা হাজির করেন তিনি – হাড়ভাঙা পরিশ্রম সেই ভোর পাঁচটা থেকে রাত্তির নটা, জ্বালানি সংগ্রহ থেকে দোসার গোলা বানানো, একটি বাচ্চাকে বাড়িতে জন্ম দেওয়া থেকে অন্যটিকে হাসপাতালে প্রসব করার কিসসা শোনান তিনি। রাজমের দুই কন্যাসন্তান – ললিতা আর জ্যোতিকা।
এবারে রাজমের প্রশ্নবান ছোঁড়ার পালা। “তোমার কটা বাচ্চা? তুমি কোথায় থাক?” তারপর খুনসুটির ছলে বলে ওঠেন, “তোমার থালি [সোনার মঙ্গলসূত্র] কই?” তাঁকে বলি আমি সোনা পরি না। “আমারটা দেখ,” বলে নিজের বাঁহাতের বুড়ো আঙুলে গলার হারখানি টেনে এনে দেখান তিনি। ছোটো ছোটো কালো আর সোনালি পুঁতি দিয়ে গাঁথা তাঁর হার যেটায় আছে লাল, কালো, সোনালি লকেট আর চারটে সেফটিপিন। ক্যামেরায় তাঁর ছবি তোলার করার সময় তিনি জানতে চান, “তোমার কাছে সোনা আছে, তাও তুমি পর না যে বড়ো?” অপরূপ বারগুর পাহাড়ের কোলে নিজের বসতবাড়ির পেছনে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠেন রাজম…
সেই হাসির সুরেলা ঝংকার ছাদ থেকে ঝুলতে থাকা হাঁড়ির গা বেয়ে আসা শব্দকেও ছাপিয়ে যায়।
অনুবাদ: আহেলি মৈত্র
অনুবাদ সম্পাদনা: স্মিতা খাটোর