“ব্যাংক থেকে টাকা আদায় করার লোক আমার কাছে আসা বন্ধ করে দিয়েছে,” এমনটাই আমাদের জানালেন ইয়াভতমলের বাসিন্দা সরস্বতী আম্বেরওয়ার। ১৫ জুন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম যেখানে সফরে আসছেন, সেখান থেকে সরস্বতীর বাড়ি বেশি দূরে নয়। ১৯৯৮ সালে বিদর্ভে প্রথম দফার কৃষি সংকটের দরুণ আত্মহননের পথ বেছে নেন তাঁর স্বামী রামদাস, ঘটনাটি তৎকালীন সংবাদ মাধ্যমে চাউর হয়েছিল। তখন থেকেই পাওনাদারদের টাকা মেটানোর জন্য সরস্বতীকে বছরের পর বছর ধরে বহু চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। তাই, ব্যাংকের টাকা আদায়কারী দলের হঠাৎ আসা বন্ধ করে দেওয়াটা বেশ চমকপ্রদ বিষয়।
“কিশোর ভাউ আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। শেষবার যখন লোকগুলো এসেছিল, আমি ওদের দেখিয়েছিলাম সেটা,” জানান সরস্বতী। “তারপর থেকেই ওরা আসা বন্ধ করে দিল।” এমনকি কোনও অচেনা লোকও এই পথ মাড়ান না। কিশোর তিওয়ারি বিদর্ভ জন আন্দোলন সমিতির (ভিজেএএস) সভাপতি এবং অঞ্চলের চাষবাস সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হওয়া অন্ততম প্রধান ব্যক্তিত্ব। অতএব তাঁর সঙ্গে ব্যাংকের সম্পর্ক একেবারেই বন্ধুত্বপূর্ণ নয় সেটা বলাই বাহুল্য। কৃষিঋণ সংক্রান্ত বিষয়ে বহুবার তিনি ব্যাংকের লোকজনকে ঘেরাও করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছেন। তা কী বলা ছিল সেই চিঠিখানায়?
মোটামুটি তরজমা করলে বয়ানটা দাঁড়ায় এই রকম: “প্রিয় রিকভারি অফিসার, রামদাস স্বর্গ থেকে একাধিকবার আমার সামনে প্রকট হয়েছেন। উনি জানিয়েছেন: ‘আমার কাছে ঋণের টাকাটা আছে এবং আমি শোধ করার অপেক্ষায় আছি’। দয়া করে আপনার দলবলকে তাড়াতাড়ি স্বর্গে পাঠান। আপনাদেরই একান্ত অনুগত, কিশোর তিওয়ারি।” সরস্বতী জানালেন, এরপর আর কোনওদিন ওদের টিকিটিও দেখা যায়নি।
এই সপ্তাহে তিওয়ারি রাষ্ট্রপতি কালামকে যে খোলা চিঠি লিখেছেন, তা অবশ্য আরেকটু মার্জিত। এই চিঠিতে তিনি আবেদন জানিয়েছেন, “রাষ্ট্রপতি যেন একটু সময় বার করে ইয়াভতমল অথবা ওয়ার্ধার মতো জায়গায় গিয়ে হতভাগ্য কৃষি-বিধবাদের সঙ্গে দেখা করেন।”
একদিনের সফরে এই কয়েকটা জায়গা-সহ নাগপুরেই মূলত রাষ্ট্রপতির ঘুরে যাওয়ার কথা। ইয়াভতমলের আমোলাকচন্দ কলেজের একটি অনুষ্ঠানেও তিনি উপস্থিত থাকবেন। এছাড়াও যাবেন ওয়ার্ধার মহাত্মা গান্ধী হিন্দি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখনও অবধি কোনও কৃষি-সমস্যা সংক্রান্ত অধিবেশন তাঁর এই সফরে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
তুলোর দর সংক্রান্ত সমস্যা
যে জায়গা ঘিরে রাষ্ট্রপতির মূল কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে সেই ইয়াভতমল আদতে কৃষি সমস্যায় জর্জরিত বিদর্ভের সবথেকে দুর্দশাগ্রস্ত অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি। “কেবল এ বছরেই বিদর্ভে ৪২৮ জন কৃষকের আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে,” জানান তিওয়ারি। “এখনই যদি তুলোর দাম, ঋণ এবং কর্জ করতে পারার ব্যাপারে তড়িঘড়ি কোনও পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে এটা আমাদের জন্য সব থেকে খারাপ বছর হতে চলেছে।” আর সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি খুব জটিল হবে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ১২৯৬ জন কৃষক “কৃষি-সংকটের” দরুণ আত্মহননের পথ নিয়েছিলেন। এছাড়া সেই একই ছয় জেলাতে আরও ১৩৪৮ জন কৃষকের আত্মহননের কথা সরকারি তথ্যে বলা হলেও, সেগুলি যে আসলে কৃষি-সমস্যার জেরে হয়েছে, সরকার তা মানতে নারাজ।
ইয়াভতমল এই অঞ্চলের সেই ছয়টি জেলার অন্যতম, যেখানে ২০০১ সাল থেকে সর্বমোট ৬,০০০-এরও বেশি কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। সরস্বতী (প্রচ্ছদ চিত্রে যাঁকে তাঁর দুই মেয়ের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে) এ দেশের সেই ১ লাখেরও বেশি মহিলাদের মধ্যে পড়েন, যাঁরা ১৯৯০-এর মাঝামাঝি সময় থেকে কৃষি-সংকটের দরুণ ঘটা আত্মহত্যায় স্বামীকে হারিয়েছেন। এই ইয়াভতমলেই ওঁর মতো আরও কয়েকশ মহিলা আছেন। অবশ্য এই কয়েক বছরে বহু গণ্যমান্য মানুষের আনাগোনার সাক্ষী থেকেছে তাঁর একচিলতে ভিটেখানা। যেমন মহারাষ্ট্রের শিবসেনা সরকারের রাজস্ব মন্ত্রী থাকাকালীন নারায়ণ রাণেও এসেছিলেন এ বাড়ি। যে ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ সরস্বতী পেয়েছিলেন, তা অবশ্য বহুকাল আগেই ঋণ শোধ করতে গিয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে।
“আমার মেয়ে মীনাক্ষীর অসুখের পিছনেই আমাদের ৩০,০০০ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে এখন,” সরস্বতী জানান। (আরেক মেয়ের মৃত্যু হয়েছে ২০০৪ সালে)। “এই ক’বছরে পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে কয়েক একর জমি আর কিছু গবাদি পশুও বেচে দিয়েছি আমরা। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে চাষবাসের খরচ বাড়ছে, হয়রানিও হচ্ছে বেশি।” তবে এখনও সরস্বতী তেমন কোনও উপায়ান্তর না পেয়ে চাষের কাজই করে যাচ্ছেন এই আশায় যে, একদিন ঠিক ভাগ্যের চাকা ঘুরবে।
এই একই জেলার পিসগাঁও গ্রামের বর্ষা রাস্সে যে কাজ হাতে পান তাতেই লেগে পড়েন, সে যত কম মজুরিই দেওয়া হোক না কেন। বর্ষার স্বামী মারুতি তাঁদের আট একর জমি দুই মরসুমের জন্য ইজারা দিয়েছিলেন –এই চুক্তির অংশ হিসেবে নিজের শ্রম দিতেও কসুর করেননি। “বোনেদের বিয়ে ওকেই দিতে হত কিনা," মারুতির প্রতিবেশীরা বলছিলেন আমাদের, "চাষবাসের হালও খারাপ হচ্ছিল দিনকে দিন।” পরবর্তীকালে প্রবল বৃষ্টিতে মারুতির নিজের ফলনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শেষমেশ ২০০৪ সালে উনি আত্মহত্যা করেন। তাঁর নেওয়া ঋণের ভারে আজও নাজেহাল হচ্ছেন বর্ষা। তাঁদের দুই ছেলে-মেয়েরই বয়স এখন পাঁচ বছরের কম।
“এঁরা দিনের পর দিন যেভাবে কঠিন পরিশ্রম করেন, তাতে হয়তো আরও বেশি উৎপাদন করতে পারতেন, কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি কেবল খারাপই হয়েছে,” বলছেন বিজয় জাওয়ান্দিয়া, যিনি কৃষিকাজ বিষয়ে এই অঞ্চলের অন্যতম পণ্ডিত। “এই সমস্ত কৃষকেরা অসম্ভব সব বাধার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। মৌলিক সমস্যাগুলো নিয়ে এখনও অবধি কোনও আলোচনাই হয়নি। আদতে ঋণের বোঝাই এঁদের বিধবা করেছে। থাকা-খাওয়ার খরচ দিনে দিনে বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে চাষবাসের খরচাপাতি। কমছে কেবল এঁদের উপার্জন।”
“প্রধানমন্ত্রীর প্যাকেজ এঁদের কিছু নতুন লোন নিতে সাহায্য করেছে বটে, কিন্তু পুরোনো লোনের ব্যাপারে কোনও সহায়তা এঁরা পাননি। তাই এঁদের ঋণের বোঝা এখন দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসবের মধ্যে ফসলের দরের সমস্যা যে প্রধান, তা নিয়ে সরকার কোনওদিনই রা কাড়েনি। এমনকি পশ্চিমের তুলা উৎপাদনকারীদের উপর যে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির চাপ, সে বিষয়েও তারা নীরব। ফলে দাম পড়ে যাওয়ায় এই কৃষকেরা উৎপাদন খরচটাও তুলতে পারেন না। নতুন ঋণের বোঝার জেরে পুনরায় কর্জগ্রহণের যোগ্যতাটুকুও হারাচ্ছেন তাঁরা। ফলত, এই মরসুমে ব্যাংকগুলো এঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। অগত্যা ফের মহাজনদের কাছেই হাত পাততে হবে এঁদের সকলকে।”
অন্নপূর্ণা সুরোশে, বিজয় জাওয়ান্দিয়ার সঙ্গে সহমত হলেন। নাগেশওয়াডি গ্রামের এই বাসিন্দা জানাচ্ছেন, “ক্ষতিপূরণের পুরো টাকা দিয়েই আমরা কর্জ মিটিয়েছি কিন্তু এর যেন কোনও শেষই নেই।” অন্নপূর্ণার আদতেই এখনও ঋণ পরিশোধ হয়নি, দুই ছেলে ও এক মেয়ের স্কুলের মাইনেটাও যোগাতে হয় কিনা! গত বছর আত্মঘাতী হওয়ার আগে তাঁর স্বামী রামেশ্বর নিজেদের যে চার একর জমি ইজারায় দিয়ে গিয়েছিলেন, তার মেয়াদ শেষ হলে অন্নপূর্ণা নিজেই এবার সেই জমিতে চাষবাস করতে চান। “খাটতে হলে নিজেদের জমির জন্যই না হয় দেব খাটনিটা।”
আপাতত, অন্নপূর্ণা সারাদিনের কাজের বিনিময়ে যে ২৫ টাকা পান, তা দিয়েই যাবতীয় খরচ চালানোর চেষ্টা করছেন।
রামপুরের মঙ্গলাবাই মোখাড়কর চাষবাসের সঙ্গে জড়িত সেই একমাত্র ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্য, যে ঘরে এমন আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘদিন এই পরিস্থিতির সঙ্গে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছেন তিনি। স্বামী প্রভাকররাও আত্মহত্যা করেছেন ন’বছর হল, এরই মাঝে মঙ্গলাবাই নিজের আট মেয়ের মধ্যে তিনজনের বিয়ে দিয়েছেন। প্রভাকররাওয়ের মৃত্যুর আগে কয়েকজনের বিয়ে হয়ে গেছে। “পণ-টনের কোনও বালাই ছিল না,” আমাদের জানাতে ভোলেন না মঙ্গলাবাই। যদিও প্রতিবার এসব বিয়ে-শাদির জন্য হাজার চল্লিশেক টাকা গচ্চা গেছে, তবু তিনি একটা পয়সাও নিজের জামাইয়ের থেকে নেননি। “ওঁরা কোনও দহেজ নেয়নি, তা আমি কোন প্রাণে নিই বলুন তো?” মঙ্গলাবাই কোনওমতে নিজের মেয়েদের পড়াশোনাও করিয়েছেন। “এরা প্রত্যেকে ম্যাট্রিক পাশ কিংবা ফেল," বলে চলেন তিনি, "ওদের বাবা মারা যাওয়ার পর তিন মেয়ে স্কুলের লেখাপড়া শেষ করেছে।”
তিনি জানান, এতগুলো বছর ধরে নিজেদের জমি ইজারা দেওয়ার পর, “এ বছর আমরা আমাদের সাত একর জমি নিজেরাই আবাদ করব।” কিন্তু মঙ্গলাবাই এসবের ঝুটঝামেলাগুলো সম্বন্ধেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। “আমাদের গ্রামের অবস্থাটাই দেখুন একবার। সব পরিবারের একই হাল। যদি চাষবাসে কোনও বদল না আসে, আমরা সবাই ডুবব।”
তিওয়ারি জানান, “এই হল ইয়াভতমল এবং অন্যান্য জেলার অবস্থা। এই বিধবারা প্রত্যেকেই কৃষক, এঁদের হালতই এখানকার আসল ছবিটা স্পষ্ট করে তোলে।”
রাষ্ট্রপতি কালামকে লেখা তিওয়ারির চিঠিতে আরও বলা হয়, “আমাদের দৃঢ় অভিমত এই যে, বিদর্ভের পরিস্থিতি ভালো নয়, এবং সে জন্য কোনও উদ্বোধনী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা নৃত্যানুষ্ঠান করার আদর্শ সময় নয় এটা…আপনি যদি খানিকটা সময় বার করে হতভাগ্য বিধবাদের সঙ্গে দেখা করেন, তাহলে আমরা একান্তভাবে বাধিত থাকব।”
এই প্রতিবেদন প্রথম ২০০৭ সালের ১৩ জুন দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
আপনি যদি আত্মহত্যা-প্রবণ হন , কিংবা এমন কাউকে চেনেন যিনি মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন , তাহলে জাতীয় হেল্পলাইন কিরণ - এ সত্বর ফোন করুন এই নম্বরে - ১৮০০-৫৯৯-০০১৯ ( ২৪ ঘণ্টা , টোল-ফ্রি) , অথবা আপনার এলাকার অনুরূপ কোনও হেল্পলাইনে । মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তথা পরিষেবা-মূলক তথ্যাদির জন্য দয়া করে এসপিআইএফের মানসিক স্বাস্থ্য নির্দেশিকাটি দেখুন ।
অনুবাদ: অভিলাষ বিশ্বাস
অনুবাদ সম্পাদনা: রম্যাণি ব্যানার্জী